দীর্ঘদিন ধরে কোয়ারেন্টিনে ঘরে বসে থাকতে থাকতে প্রেমিক-প্রেমিকাদের কী অবস্থা? দিনের পর দিন কোনো দেখা সাক্ষাৎ নেই, কোনো ডেটিং নেই, কোনো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নেই! দম্পতিদের মধ্যে যারা দূরে দূরে আটকা পড়েছেন, তাদের কী অবস্থা? দিনের পর দিন কোনো স্পর্শের কিংবা অন্তরঙ্গতার সুযোগ নেই! সবাই যদি সঙ্গীহীনভাবে এমন দূরে দূরে থাকে আরো অনেক দিন, তাহলে মানবজাতির ভবিষ্যৎ বংশবৃদ্ধির অবস্থা কী হবে?
খেয়াল করেছেন, গাছের অবস্থা কিন্তু ঠিক এই রকমই! সে এক জায়গায় বসে থাকে চুপচাপ। মাটিতে গেঁড়ে থাকা শিকড়ের জন্য সে অন্য জায়গায় যেতে পারে না। গার্লফ্রেন্ড এর সাথে দেখা করতে পারে না, মুখোমুখি বসে কথা বলতে পারে না, চুমু খেতে পারে না, শারীরিকভাবে আরো ঘনিষ্ট হতে চাইলেও সেটা অসম্ভব গাছের পক্ষে। গাছ তাহলে কী করে?
গাছ সুন্দর করে সেজেগুজে থাকে ডেটিংয়ের জন্য। নতুন, সুন্দর পাতা দিয়ে মেকআপ করে। সুন্দর সুন্দর ফুল ফোটায় (যে ফুল মূলত হচ্ছে তার সেক্স অর্গান)। তারপরে এই ফুলের মধ্যে পরাগরেণু তৈরি করে। মানুষের ক্ষেত্রে তুলনা করুন, কোনো ছেলে তার শরীরের অভ্যন্তরের শুক্রাণু বের করে লিংগের আশেপাশে ছড়িয়ে রাখলো। এর পরে এই শুক্রাণু বা পরাগরেণু পৌছে দিতে হবে স্ত্রী ফুলের কাছে। এই কাজে ঘটকালি করে মৌমাছি, পাখি, ভ্রমর, অন্যান্য পোকা, এমনকী বাতাস! পুরুষ ফুলের পুংস্তবক থেকে পরাগরেণু নিয়ে স্ত্রী ফুলের স্ত্রী স্তবকে পৌঁছাতে পারলে তারপরে ফার্টিলাইজেশন সম্পন্ন হবে। নতুন ফুল হবে, বীজ হবে, সেই বীজ থেকে গাছ হবে, বংশবৃদ্ধি হবে। এই পদ্ধতিতেই পৃথিবীর উদ্ভিদকূল প্রেম, ডেটিং, যৌনমিলন এবং বংশবৃদ্ধি- সব করে আসছে কোটি কোটি বছর ধরে। ফসিল রেকর্ড থেকে পাওয়া যায়, অন্তত ১৩ কোটি বছর আগে সপুষ্পক উদ্ভিদ এসেছিলো পৃথিবীতে।
২০২০ সালে নিল ডিগ্রেস টাইসন নতুন সিরিজ নিয়ে এলেন- ‘Cosmos: Possible Worlds’. এখানে তিনি মূল আলোকপাত করেন মানুষের সম্ভাবনা নিয়ে। যদি আমরা পরিবেশ দূষণ না করি, এটম বোমা ফেলে নিজেরা সুইসাইড না করি, তাহলে ভবিষ্যৎ পৃথিবী কেমন হবে, প্রযুক্তিগতভাবে আরো কী কী সুবিধা পাবো আমরা- সেগুলাই বেশি দেখানো হয়েছে। এটা দেখাতে গিয়ে মানব ইতিহাসের অতীত অনেক ঘটনা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন, যে ছোট ছোট ঘটনাগুলো আমাদের ইতিহাসের একেকটা গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। দুই লিঙ্গ বিশিষ্ট সপুষ্পক উদ্ভিদের আবির্ভাব তেমনই একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস ছিলো পৃথিবীর প্রাণবৈচিত্র্যের জন্য। বর্তমান সময়ে আমরা যা কিছুই খাই, তার ৩৫% এসেছে এই পরাগায়নের ফসল হিসেবে।
মানুষ গুহায় থাকত যখন, তখন শিকার করে কিংবা ফলমূল পেড়ে খেতো । অনেক পরে তারা কৃষিকাজ আবিষ্কার করে। গম চাষ করতে হলে ৬ মাস ধরে একই জায়গায় বসে থাকতে হয়। ফলে কৃষিজমির আশেপাশে গ্রাম গড়ে উঠে। সেই সাথে গড়ে উঠে কৃষিভিত্তিক সভ্যতা ।
বিশ্বের প্রাচীনতম গ্রাম কোথায়, সেটা নিয়ে বিতর্ক আছে। ইউভাল নোয়াহ হারারির মতে, প্রাচীনতম গ্রাম ইজরায়েলের জেরিকো। ডিগ্রেস টাইসন এই এপিসোডে একটা প্রাচীন গ্রাম দেখিয়েছেন, যেটা প্রাচীনতম না হলেও মানব বসবাসের একটা অনেক পুরনো উল্লেখযোগ্য বসতি। জায়গাটা হলো তুরস্কের চ্যাটালহুইক (Çatalhöyük)। অনেকগুলো চৌকোনা – ঘন সন্নিবিষ্ট ঘর। ঘরে কোনো জানালা নেই, কোন দরজা নেই। ঘরের ছাদে একটা ফুটো। সেই ফুটো দিয়ে মই বেয়ে ভিতরে আসতে হয়। গ্রামের বাড়িগুলো একেবারে গায়ে গায়ে লাগানো। কোথাও কোনো রাস্তা নেই। বাড়িগুলোর ছাদই রাস্তা হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
এই চ্যাটালহুইক ৯ হাজার বছরের পুরনো। এখানে পাওয়া উল্লেখযোগ্য জিনিসের মধ্যে আছে ওই গ্রামের ম্যাপ। বাড়িগুলোর অবস্থান চিহ্নিত করা ছিলো সেই ম্যাপে। মানুষের তৈরি প্রাচীনতম ম্যাপ সম্ভবত সেটা। ব্লমবস গুহার অর্থহীন আর্ট আস্তে আস্তে এখন অর্থপূর্ণ দরকারী আর্টে পরিণত হচ্ছে!
এরপর টাইসন রেনেসাঁ উত্তর বিজ্ঞানীদের জীবন ও কাজ নিয়ে কিছু আলোচনা করলেন। লিউয়েন হুক অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে আবিষ্কার করলেন পানির মধ্যের জীবাণু, দাঁতের ময়লার জীবাণু এবং খালি চোখে দেখা যায় না এমন সব প্রাণী। তার বন্ধু ‘ক্রিশ্চিয়ান হয়গান’ একই সময়ে দূরবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কার করে আকাশের চাঁদ, শনির বলয়, বৃহস্পতির উপগ্রহ দেখা শুরু করলেন। এটা ১৬০০ শতাব্দীর নেদারল্যান্ডের কথা। নতুন নতুন চিন্তাভাবনা, নতুন সব ধারণা, মুক্তমত প্রকাশের একটা কেন্দ্র হয়ে উঠেছিলো তখন নেদারল্যান্ড। পৃথিবীর বাইরেও শনি, মঙ্গলগ্রহে আমাদের মতোই আরো পৃথিবী আছে, ছোট পানির কণার মধ্যেও ছোট ছোট জীব ঘুরে বেড়ায়- এসব নতুন নতুন কথা নেদারল্যান্ডবাসীকে আলোড়িত করেছিলো ব্যাপকভাবে।
তৎকালীন দার্শনিকরা চিন্তা করলেন, এই জগৎগুলোর কথা আমাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলোয় উল্লেখ নেই কেন? দুনিয়ার যাবতীয় জ্ঞান তো এর মধ্যেই থাকার কথা!
দার্শনিক বারুখ স্পিনোজা তখন একটা নতুন মতবাদ প্রচার করা শুরু করলেন। তিনি বললেন, প্রকৃতির নিয়মগুলোই হচ্ছে ধর্ম। ঈশ্বর হচ্ছে প্রকৃতির সূত্র। এই নিয়মগুলোর ব্যতিক্রম কিছু ঘটলেই সেটা হবে মিরাকল/অলৌকিক ঘটনা। বাইবেল ঈশ্বরের বাণী নয়, মানুষেই লিখেছে বাইবেল। সুতরাং বাইবেল নিয়ে গবেষণা করলে ঈশ্বরকে পাওয়া যাবে না। প্রকৃতির নিয়মগুলো নিয়ে গবেষণা করলে ঈশ্বরকে বোঝা যাবে- এটাই ছিল তার মতবাদ।
বাংলাদেশের অভিজিৎ রায়ের মত স্পিনোজার উপরেও মৌলবাদীদের চাপাতির আঘাত আসলো। তবে আক্রমণকারীর চাপাতির কোপে কেবলমাত্র তার আলখাল্লার এক অংশই ছিঁড়লো, শারীরিকভাবে তিনি অক্ষত রইলেন। বাকি জীবন তিনি সেই ছেঁড়া আলখাল্লা পরেই ঘুরে বেড়াতেন। মানুষকে দেখাতেন মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর মৌলবাদীর আক্রমণের জ্বলন্ত প্রমাণ।
পরবর্তী যুগের বিজ্ঞানীদের মধ্যে স্পিনোজার ইনফ্লুয়েন্স ছিলো অনেক। তার লেখা ‘এথিক্স’ বইটা পরবর্তী যুগের বিজ্ঞান গবেষকদের দিক নির্দেশনা দিয়েছে। ৩০০ বছর পরে আলবার্ট আইনস্টাইনও স্বীকার করেছেন তার এই গুরুর ফিলসফিকাল অবদানের কথা।
এপিসোডের শেষ দিকে টাইসন দেখিয়েছেন নতুন এক প্রযুক্তিতে কীভাবে আমাদের নিকতবর্তী তারকা, ‘প্রক্সিমা সেঞ্চুরি’-তে যাওয়া যাবে। এর আগের রকেটগুলো হতো আকারে অনেক বড়। কিন্তু এবার খুব ছোট ছোট, গাছের পাতার সাইজের অনেকগুলো রকেট/ন্যানোক্রাফট পাঠানো হবে। এদের চলার জন্য শক্তি লাগবে খুব কম। মাত্র ২০ বছরে এরা প্রক্সিমা সেঞ্চুরিতে পৌঁছে যাবে, যেখানে এর আগে মানুষের কোনো রকেট যেতে পারেনি।
নাসার ন্যানো ক্রাফট যখন পাঠানো হবে, তখন এটা মাত্র ৪ ঘন্টায় ভয়েজারকে ওভারটেক করে ফেলবে!
এটাই হচ্ছে প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান। আজ যা অসম্ভব মনে হচ্ছে, কাল তা পানির মত সহজ কাজ। আজকের ধারণা কাল ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যেতে পারে। প্রশ্ন করতে হবে সবকিছু নিয়েই। পরীক্ষা আর পর্যবেক্ষণ করতে হবে। যা যা পর্যবেক্ষণের সাথে মিলবে, সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যা যা পর্যবেক্ষণের সাথে একটা সময় পরে আর মিলবে না- সেগুলো বাদ দিতে হবে। এটাই বিজ্ঞানের মূলকথা।
যুগে যুগে বিজ্ঞানীরা তাদের আগে থেকে জেনে রাখা ধারণা ভুল প্রমাণ করে নতুন আবিষ্কার মেনে নিয়েছেন সহজভাবেই, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে। জোহান কেপলার সারা জীবন বিশ্বাস করে এসেছিলেন, পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্র। শেষ বয়সে এসে যখন প্রমাণ পেলেন যে, “না! পৃথিবী নয়, সূর্য মহাবিশ্বের কেন্দ্র”, তখন নির্দ্বিধায় তিনি আগের বিশ্বাস ত্যাগ করলেন। এভাবেই বিজ্ঞান প্রতি মুহূর্তে নিজেকে আরো উন্নত করে।
এখানেই বিজ্ঞানমনস্কতার সাথে গোঁড়া বিশ্বাসের পার্থক্য। ”সকল জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎস হচ্ছে একটাই পুস্তক, এটা বদলাবে না”- এই ধরণের বিশ্বাস সামনে এগিয়ে চলার পথে বিজ্ঞানের সাথে সাংঘর্ষিক। হতে পারে ১০০০ বা ২০০০ বছর আগে কালিজিরা বা গরুর মূত্রই ছিলো সেরা মেডিসিন। কিন্তু বর্তমানে আরো ভালো ঔষধ তৈরি হয়েছে। যে ওষুধ তৈরি হয়নি, সেগুলোও তৈরির কাজ চলছে (যেমন- করোনার ওষুধ)। এই সময়ে এসেও প্রাচীন ঔষধগুলোর উপর অন্ধভাবে নির্ভর করা বেশ বোকামির কাজ।