এই পর্বের নাম বিলুপ্তপ্রাণ নগরী (Lost City of Life)। ভূ-রাসায়নিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রাণের উদ্ভব এবং বিকাশ ব্যাখ্যা করা হয়েছে এই পর্বে।
পৃথিবী বা যে কোনো গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়ার সহজ উপায় কী? সবচেয়ে প্রচলিত উত্তর সম্ভবত, পানি খোঁজা, কারণ পানিতে বিভিন্ন জলজ প্রাণ থকতে পারে। কিন্তু ধরুন, পৃথিবীর সব পানি শুকিয়ে গেল। ভবিষ্যতে কেউ যদি এই গ্রহে এসে খুঁজতে চায় যে এখানে কোনোকালে প্রাণ ছিল কিনা, তাহলে তারা কী খুঁজবে?
তারা তখন খুঁজবে এই গ্রহের খনিজ পদার্থগুলো, মিনারেল গুলো। ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ বিভিন্ন খনিজের মধ্যে অনেক জৈব যৌগ, ছোট বড় বিভিন্ন পর্যায়ের উদ্ভিদ বা প্রাণী আটকা পড়ে ফসিল হয়ে যায়। এই মিনারেলস বিশ্লেষণ করে সেই সময়কার প্রাণ জগত সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
আমাদের পৃথিবীর সাগরতলের মিনারেলগুলো (বিশেষত অলিভিন, (Mg,Fe)2 SiO4) নিয়ে বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সেগুলার মধ্যে বিভিন্ন প্রজাতির আদিম অণুজীব, সায়ানোব্যাকটেরিয়া আটকা পড়ে আছে। এই সায়ানোব্যাকটেরিয়া বাতাসের কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্রহণ করে, আর অক্সিজেন ত্যাগ করে। এখান থেকে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারলেন, প্রাচীণ যুগের পৃথিবীর বাতাসে প্রচুর কার্বন ডাইঅক্সাইড ছিল, অক্সিজেন ছিলই না বলতে গেলে। আমাদের আকাশ তখন লাল রঙের ছিল।
সায়ানোব্যাকটেরিয়াগুলো বায়ুমণ্ডল থেকে CO2 কমিয়ে দিয়েছে, O2 বাড়িয়ে দিয়েছে। পৃথিবীর আকাশ তখন নীল হলো ধীরে ধীরে। কিন্তু যখনই অক্সিজেন বেড়ে গেল, সায়ানোব্যাকটেরিয়া নিজে সেই পরিবেশে টিকতে পারেনি। সে তখন পানির তলে বা মাটির তলে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছে, যেখানে অক্সিজেন তাকে স্পর্শ করতে পারবে না।
আর ভূ-পৃষ্ঠে রাজত্ব করেছে সেই সব উদ্ভিদ এবং প্রাণী, যাদের অক্সিজেনে কোনো সমস্যা নেই। পরবর্তী সময়কার খনিজ পদার্থে দেখা গেছে, প্রচুর পরিমাণ অক্সিজেনের উপস্থিতি।
খনিজ পদার্থগুলো সাধারণত সাগরের তলায় বিভিন্ন রকম বিন্যাস-সমাবেশ করে ঘরবাড়ি বানায়। বাইরের পৃথিবীর যত ঝড়-ঝঞ্ঝা, আগ্নেয়গিরি, লাভা, নোনা পানির স্রোত, গরম পানির স্রোত, বরফ –সব কিছু থেকে নিরাপদ থাকার জন্য এই খনিজ পদার্থের বাসাটা খুব ভাল একটা জায়গা। প্রাচীণ পৃথিবীর জৈব অণুগুলা সম্ভবত এইরকম বাসার মধ্যে জমেছে, অনুকূল পরিবেশ পেয়ে নিজেরা সংখ্যায় বৃদ্ধি পেয়েছে, তারপরে সম্ভবত আদিম প্রাণ গঠন করেছে। অর্থাৎ পৃথিবীর প্রথম প্রাণ সম্ভবত এইরকম খনিজ পদার্থের মধ্যেই হয়েছে, খোলা আকাশের নিচে বা খোলা পানিতে প্রাণের উদ্ভবের তুলনায় খনিজ পদার্থের মধ্যে প্রাণ সৃষ্টির সম্ভাবনা বেশি। কাজেই, পৃথিবীর বাইরে যদি আমরা প্রাণ খুঁজতে চাই, তাইলে এইসব খনিজ পদার্থ আগে খোঁজা উচিত।
অনুষ্ঠানের উপস্থাপক নেইল ডি’গ্রাস টাইসন সেই কাজই করেছেন। প্রথমে আমাদের নিয়ে গেছেন সাগরতলে। সবুজ অলিভিন এবং অন্যান্য খনিজ পদার্থ কিভাবে তৈরি হচ্ছে, সেগুলা দেখালেন। এরপর আমাদের পৃথিবীর বাইরে অন্য কয়েকটা গ্রহে নিয়ে গেলেন।
নাসা বিভিন্ন প্রকার গ্রহ/উপগ্রহকে ৫টা ক্যাটাগরিতে ভাগ করেছে। ক্যাটাগরি ১ হচ্ছে জীবনের জন্য একটুও বিপদজনক না এমন জায়গা (যেমন -চাঁদ), সেখানে মানুষ যেতে পারবে, ঘুরেফিরে বেঁচে আসতে পারবে। আর ক্যাটাগরি ৫ হচ্ছে জীবনের জন্য সবচেয়ে বেশি বিপদজনক জায়গা। এইরকম কয়েকটা জায়গা ঘুরে আসি চলুন টাইসনের সাথে।
প্রথমে আমরা গেলাম বৃহস্পতির উপগ্রহ ইউরোপাতে। বৃহস্পতির আকর্ষণের কারণে ইউরোপার মাটি এবং পাহাড় -পর্বত প্রতিদিন ভাংচুর হতে থাকে। পুরা দোজখের মত অবস্থা! আমাদের পৃথিবীতে যেমন জোয়ার-ভাটা হয় চাদের আকর্ষণে, সেইরকম এদের মাটি-পাহাড় ভেঙে যায় বৃহস্পতির আকর্ষণে। একে বলে tidal flexing.
তারপর টাইসন আমাদের নিয়ে গেলেন শনির উপগ্রহ, এনসেলাডাস এ। (Enceladus) আরেকটা ক্যাটাগরি ৫ বিশ্ব। পুরা উপগ্রহটা বরফে ঢাকা। জায়গায় জায়গায় বরফের আগ্নেয়গিরি, সেখান থেকে বরফ ছিটকে বেরুচ্ছে ঘণ্টায় ৮০০ মাইল বেগে। বরফগুলা পানি, এ্যামোনিয়া, আর মিথেনের। বরফের চাদরের তলায় তরল সাগর থাকার কথা। সেই সাগর পৃথিবীর চেয়েও কয়েকগুণ বেশি গভীর। কিন্তু, এই গভীর সাগরের তলাতেও টাইসনের স্পেসক্রাফট এসে পৃথিবীর খনিজ পদার্থ অলিভিন খুঁজে পেল (এই অংশটা কাল্পনিক। তবে অলিভিন থাকার সম্ভাবনা আছে। ভবিষ্যতের কোনো অভিযানে হয়তো পাওয়া যাবে)।
ভয়ংকরতম ক্যাটাগরি ৫ জগতেও যদি আদিম পৃথিবীর অলিভিন থাকতে পারে, তাহলে সেখানেও আজ হোক কাল হোক, প্রাণের বিকাশ ঘটতে পারে। অন্যান্য কম বিপজ্জনক গ্রহই বা বাদ যাবে কেন! এখন কথা হচ্ছে, এই প্রাণ সৃষ্টি হতে সময় লাগে অনেক বিলিয়ন বছর। আজ যে সব জায়গায় কোনো প্রাণ দেখা যাচ্ছে না, কয়েক বিলিয়ন বছর পরে সেগুলোই পৃথিবীর মত জনবহুল হয়ে উঠতে পারে।
—————————-
এই পর্বে উল্লেখিত কয়েকজন তুলনামূলক কম পরিচিত বিজ্ঞানীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেই —
১। ভিক্টর গোল্ডস্মিথ – নরওয়েজিয়ান মিটিওরলজিস্ট (১৮৮৮-১৯৪৭)। জিওকেমিস্ট্রির জনক। অলিভিন এর সাথে প্রাণের সম্পর্ক তিনিই আবিষ্কার করেছেন। অলিভিনের প্রতি তিনি এতই আসক্ত ছিলেন, যে তার কফিন তৈরি হয়েছিল অলিভিন দিয়ে। ব্যক্তিগত জীবনে এই বিজ্ঞানী ছিলেন ইহুদী। হিটলার এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে তার গবেষণা অনেক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল।
২। কৃশ্চিয়ান ফ্রেডরিক শুনবেইন – জার্মান রসায়নবিদ (১৭৯৯-১৮৬৮)। ওযোন গ্যাস আবিষ্কার করেছিলেন। বউয়ের নিষেধ উপেক্ষা করে নিজের রান্নাঘরে গবেষণা চালাতে গিয়ে হঠাৎ করে সেলুলোজ আবিষ্কার করেছিলেন। বউয়ের কথা না শুনলে মাঝে মাঝে ভালো, বেশির ভাগ সময়েই অবশ্য কপালে খারাপি জোটে!
৩। ক্যারোলাইন হার্শেল (১৭৫০-১৮৪৮) – জার্মান এস্ট্রনমার উইলিয়াম হার্শেলের বোন। বিজ্ঞান জগতে তিনিই প্রথম নারী, যিনি তার বৈজ্ঞানিক কাজের জন্য বেতন পেয়েছিলেন। হার্শেলের পর্যবেক্ষণকেন্দ্র তিনিই দেখাশোনা করতেন। তিনি তারাগুলোর অবস্থান লিপিবদ্ধ করেছিলেন নিউ জেনারেল ক্যাটালগ নামে একটা বইতে, যে বই আজো ব্যবহৃত হয়। শনির উপগ্রহ এনসেলাডাস সহ প্রচুর গ্রহ-উপগ্রহ-নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করেছে এই হার্শেল পরিবার।