কথায় বলে- “আজ যে রাজা, কাল সে ফকির”। বিবর্তনের ব্যাপারটাও তাই। বিবর্তন মানে শুধু উন্নত হতে উন্নততর প্রজাতিতে রূপান্তরিত হওয়া নয়। বিবর্তন মানে হলো- প্রকৃতি নামক ‘গডমাদার’ এর বন্দুকের নলের সামনে “জ্বি হুজুর! জ্বি হুজুর!”- করে মাথা নত হয়ে থাকা। বীরের মতো প্রকৃতির সাথে পাংগা নিতে না গিয়ে চতুরতার সাথে নিজের গায়ের চামড়া বাঁচিয়ে চলা।
কথা হচ্ছে- বিবর্তনের মাধ্যমে প্রকৃতি যেমন কিছু প্রজাতিকে তার অন্যান্য সন্তানদের উপরে রাজত্ব করার ক্ষমতা দিয়েছে, তেমনি কিছু প্রজাতিকে রাজ-সিংহাসন হতে টেনে নামিয়ে পথের ভিখারিও বানিয়েছে। দেখে নেয়া যাক এমন কিছু প্রজাতির দশা, যাদের হুংকারে একসময় জগত কেঁপে উঠলেও বর্তমানে তাদের রেখে যাওয়া নাতিপুতিদের হুংকারে গায়ে সুড়সুড়ি লাগে।
৫। ক্রেওডোন্টস (Creodonts)
দুর্ধর্ষ সেই প্রাগৈতিহাসিক সংস্করণ
ক্রেওডোনটসরা ছিলো ‘প্যালিওসিন‘ এবং ‘মাইওসিন‘ যুগের দুর্ধর্ষ প্রাণী। এদের মস্তিষ্ক ছিলো ছোট, কিন্তু সেটা তারা উতরে গেছিলো শক্তিশালী চোয়াল এবং পেশী দিয়ে। দুর্ধর্ষ শিকারী এই প্রাণীদের বিভিন্ন ফ্লেভারে মাইওসিন যুগে পাওয়া যেতো। কেউ ছিলো হায়েনার মতো দেখতে, কেউ ভালুকের মতো, আবার কেউ বেড়ালের মতো।
এসব গোত্রের মাঝে সবচেয়ে ভয়াবহ ছিলো ‘হায়েনোডন গিগাজ’রা। তারা ছিলো একেকটা ঘোড়ার সাইজের। তাদের চোয়াল ছিলো কুমিরের চোয়ালের মতো লম্বা এবং মোটামুটি এদের অর্ধেক সাইজের কোনো প্রাণীর শরীর সহজে টেনে-ছিঁড়ে আলাদা করে ফেলার মতো ক্ষমতাসম্পন্ন। প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীদের মধ্যে এদের মত ঘ্রাণ শক্তিসম্পন্ন প্রজাতি খুব কমই ছিলো। অত্যন্ত ক্ষীপ্র গতিসম্পন্ন এসব হায়েনোডনরা ছিলো একাই একেকটা ‘কিলিং মেশিন’। কিন্তু তারা একা ঘুরে বেড়াতো না। তারা থাকতো দলবদ্ধ হয়ে। ফলস্বরূপ, এরকম একটা দলের একটা ‘টি-রেক্স’ ডাইনোসরের মত দৈত্যাকার প্রাণীকেও বাগে আনতে বেশি বেগ পেতে হতো না।
‘জুরাসিক পার্ক’ মুভির সেই ‘ভেলোসিরেপ্টর’-দের কথা মনে আছে? তাদের মাথায় একটা স্তন্যপায়ী প্রাণীর মস্তিষ্ক, শরীরে উষ্ণ রক্ত এবং এখানে-সেখানে আরো কিছু মাংসল পেশী যোগ করার পরে যে জিনিসটা দাঁড়াবে সেটাই হচ্ছে ‘হায়েনোডন’।
তাদের করুণ দশা-সম্পন্ন বংশধরেরা
পশমি এবং আদুরে ‘রেকুন (Raccoon)’। তার পর-দাদাদের কিছু চিহ্ন এখনো চেহারায় অবশিষ্ট থাকলেও সাইজে এবং কাজে-কর্মে তাদের সেই দুর্ধর্ষতার কোনো কিছুই এখন আর অবশিষ্ট নেই।
এদের এখন দিন কাটে ডাস্টবিনের ময়লা ঘুঁটে কিংবা মানুষের বাসা-বাড়িতে ঢুকে খাবার চুরি করে। এরা এখন মানুষদের নিকট বিরক্তি উদ্রেককারী প্রাণী। প্রতি সকালে ঘুম থেকে উঠে শিকার ধরে ‘রাজকীয় একটা নাস্তা’ দেবার বদলে এখন এরা মানুষের হাত থেকে ছুঁড়ে ফেলা খাবারের প্যাকেটে মুখ গুঁজে দেখে কোনো খাবার অবশিষ্ট আছে কিনা।
কিন্তু কেন তাদের এই দুর্গতি?
স্তন্যপায়ীদের টিকে থাকার প্রতিযোগিতায় এদের শক্তিধর চোয়াল এবং পেশীবহুল শরীর কোনো কাজেই আসেনি। বরং ক্রেওডোন্টসদর যেসব বংশধরেরা পেশীর শক্তিমত্তা এবং আকারের দিকে নজর না দিয়ে ঘ্রাণশক্তি এবং ক্ষীপ্রতার দিকে মনোযোগ দিয়েছিলো (যাতে বিপদ টের পেলে পালাতে পারে) তারাই টিকে গেছে। বিবর্তনের এটাই মূলনীতি। ধূর্ত, কাপুরুষরাই এখানে টিকে যায়; যাতে আরো কয়টা দিন বেঁচে থেকে মানুষের বাসাবাড়িতে ঢুকে খাবার-দাবারের সাথে সাথে দরজার সামনে হতে জুতা কিংবা পা মোছার পাপোষও চুরি করতে পারে!
৪। স্যাবর-টুথেড মারসুপিয়ালস
দুর্ধর্ষ সেই প্রাগৈতিহাসিক সংস্করণ
যারা হলিউডের ‘টেন থাউজ্যান্ড বিসি’ কিংবা ‘আইস এইজ’ সিরিজের এনিমেশন মুভিগুলো দেখেছেন তারাই স্যাবর টুথেডদের সম্পর্কে জ্ঞাত। আট ইঞ্চি লম্বা ক্ষুরধার দাঁত-সম্পন্ন প্রাণীগুলো ছিলো ‘প্লাইয়োসিন’ যুগের দুর্ধর্ষ শিকারি প্রজাতি। তারা তিন-চার কিংবা পাঁচটার দলে ভাগ হয়ে ঘুরে বেড়াতো। এদের দলটাকে চোখে পড়লেই আমাদের আদিপুরুষদের পরনের নেংটি নষ্ট হয়ে যেত।
একেকটা ২৫০-৩০০ পাউন্ড ওজনবিশিষ্ট এসব দানব তাদের শিকারকে, তা যত বড়ই হোক না কেন, প্রথমে মাটিতে শুইয়ে ফেলতো। তারপর সেই আট ইঞ্চি লম্বা দাঁত বসিয়ে দিতো শিকারের গলায় কিংবা রক্তপ্রবাহী ধমনীতে। এরপর শিকার দুর্বল হওয়া পর্যন্ত সামান্য অপেক্ষা এবং অতঃপর ভূরিভোজ।
তাদের করুণ দশা-সম্পন্ন বংশধরেরা
আপনারা হয়তো এখানে নাম হিসেবে ভাবছেন বাঘদের কথা। কিন্তু তারা হচ্ছে স্যাবর টুথেডদের আরেক অংশ ‘স্মাইলোডন’-দের বংশধর। কোয়ালা, ক্যাঙ্গারু এবং অপোসামরা (Opossum) হলো স্যাবর টুথেড মারসুপিয়ালদের প্রকৃত নাতিপুতি। স্যাবর টুথেডদের এই প্রজাতিকে দেখে পূর্বে মানুষদের আত্মারাম খাঁচাছাড়া হবার যোগাড় হলেও বর্তমানে এদের বংশধর অপোসামরা মানুষদের কাছে বেশ প্রিয়। অনেকে এদের হেয়ার-স্টাইলও অনুকরণ করে থাকেন।
কিন্তু কেন তাদের এই দুর্গতি?
‘হোমো স্যাপিয়েন্স’দের উদ্ভাবনী ক্ষমতা। হোমো স্যাপিয়েন্সরা এক পর্যায়ে এদের মারার এতো এতো কৌশল শিখে গেলো যে তারা আর মানুষদের সাথে কুলিয়ে উঠতে পারছিলো না। তদুপরি ভৌগলিক আবহাওয়ার নাটকীয় উত্থান-পতনও তাদের বংশবিস্তারে খুব একটা সুবিধা যোগায়নি। ফলে হোমো স্যাপিয়েন্স এবং ভৌগলিক আবহাওয়া দুয়ে মিলে জোট বেঁধে তাদের বংশ নির্বংশ করতে লাগলো, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা ‘কোয়ালা’ কিংবা ‘সজারু’র মত কিউট আকার ধারণ না করলো।
যদিও এখনো এদের একটা বংশধর তাদের আদি বীরত্বপূর্ণ ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এরা হচ্ছে- তাসমানিয়ান ডেভিল। এদের দেখলেই মানুষ সেই স্মাইলোডনদের দেখার মত করে ঘুরে দৌড় দেয়। এদের হাত থেকে মৃতরাও নিস্তার পায় না। মৃত, পঁচা-গলা শরীরও এরা চেটেপুটে একদম সাফ করে দেয়। আর যে একবার এদের রক্তহিম করা তীক্ষ্ণ চিৎকার শুনেছে, সে আর দ্বিতীয়বার এদের ছায়া মাড়ানোর সাহস করেনি।
৩। মেগাথেরিয়াম (Megatherium)
দুর্ধর্ষ সেই প্রাগৈতিহাসিক সংস্করণ
‘মেগাথেরিয়াম’-রা ছিলো আকারে বর্তমানের আফ্রিকান হাতিদের থেকে সাইজে একটু বড়। এরা খাদ্যাভ্যাসে তৃণভোজী হলেও প্রাগৈতিহাসিক যেকোনো শিকারি প্রাণীর আক্রমণ অনায়াসে ঠেকিয়ে দিতে পারতো। এমনকি সেই দুর্ধর্ষ শিকারি ‘স্মাইলোডন’-দের আক্রমণও! স্মাইলোডনদের আট ইঞ্চি ধারালো দাঁতের জবাব হিসেবে এদের ছিলো আট ইঞ্চি ধারালো নখ।
এরা পেছনের দুই পায়ের উপর ভর করে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারতো। তখন এরা আফ্রিকান হাতিদের থেকে দ্বিগুণ উচ্চতা সম্পন্ন হতো। বর্তমান গবেষণায় বলা হচ্ছে এদের কংকালগুলো বিশালাকৃতির। এই বিশাল আকৃতির সাথে আট ইঞ্চি ধারালো নখ নিয়ে তারা ‘স্মাইলোডন’দের থেকেও ভয়ংকর কিছু হয়ে উঠতে পারতো। কিন্তু এর বদলে তারা অহিংস নীতি গ্রহণ করেছিলো এবং যেসব ‘স্মাইলোডন’ বেশি সাহসী হয়ে তাদের আক্রমণ করার চেষ্টা করে, তাদের চপেটাঘাত করেই সন্তুষ্ট ছিলো। আমাদের মতে এর থেকে দুর্ধর্ষ হতে পারে কেবল একটা সুপার-পাওয়ার দেশের প্রেসিডেন্ট হয়েও নিজেদের যা আছে তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা এবং অন্যের সম্পদের দিকে হাত না বাড়ানো।
তাদের করুণ দশা-সম্পন্ন বংশধরেরা
শ্লথ ভল্লুক। এরা এতটাই আগ্রাসী যতটা আগ্রাসী হচ্ছে বর্তমান বিশ্বের দেশ সুইজারল্যান্ড, কানাডা কিংবা হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ। এরা পুরোপুরি তৃণভোজী এবং সুইজারল্যান্ড, কানাডা এবং হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের মানুষদের মতই রিল্যাক্স মুডে থাকতে পছন্দ করে। এরা সবচেয়ে ধীরগতির প্রাণী হিসেবে পরিচিত। যখন কোনো প্রজাতি চলাফেরায় ধীরগতির কারণে ব্যাপক পরিচিত হয়, তখন তাদের বিবর্তন প্রক্রিয়া নেমে কোথায় গিয়ে ঠেকেছে সেটা ব্যাখ্যা করার জন্যে বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন হয়না।
তাদের চলাফেরা করার দশা এতই করুণ যে ধর্মগ্রন্থে এদের নামে উৎসর্গ করে পুরো আলাদা একটা পাপের শ্রেণীই তৈরি করা হয়েছে (তবে সত্যি কথা হলো, “Sloth” শব্দটা এসেছিলো মধ্যযুগীয় ইংরেজি শব্দ “slouthe” বা “slewthe” হতে, যার মানে ছিলো “অলস”। এই অলসতার জন্যেই প্রাণীগুলোর নাম স্লথ রাখা হয়েছিলো)! এই পাপে জড়িতদের জন্যে আলাদা শাস্তির কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ ঈশ্বরের মতেও এদের অবস্থা বড়ই করুণ! এই লিংকের ভিডিওতে দেখুন একটা শ্লথের রাস্তা পার হবার দৃশ্য।
কিন্তু কেন তাদের এই দুর্গতি?
যথারীতি দায়ী ‘হোমো স্যাপিয়েন্স’। মেগাথেরিয়ামরা আমাদের দৃশ্যপটে আবির্ভূত হবার কিছু পরেই বিলুপ্ত হয়ে গেছিলো। স্মাইলোডনদের ধারালো, লম্বা দাঁত ঠেকাতে পারলেও মানুষের তীর, বর্শা আর ঠেকাতে পারেনি। ফলে মোটামুটি সন্ন্যাস ব্রত গ্রহণ করার পরেও হোমো স্যাপিয়েন্সদের সভ্যতার বিস্তারের স্বার্থে তাদেরও মঞ্চ ছেড়ে চলে যেতে হয়।
তবে এক্ষেত্রে মনে হচ্ছে শেষ হাসিটা তাদের রেখে যাওয়া বংশধরেরাই হাসছে। খালি একবার তাকিয়ে দেখুন! নিজেদের ওজনের দ্বিগুণ পরিমাণ খাবারে পেট ভর্তি লাঞ্চ সেরে আবার ১৮-২০ ঘণ্টার ঘুম। আমাদের মানবসভ্যতার এত পরিশ্রমের কারণও কি উদরপূর্তি করে একটু নিশ্চিন্তে ঘুম দেওয়া নয়?
২। এন্টেলোডন (Entelodon)
দুর্ধর্ষ সেই প্রাগৈতিহাসিক সংস্করণ
এন্টেলোডনরা ছিলো সাত ফুট লম্বা একেকটা দানব। তাদেরকে ‘অলিগোসিন (Oligocene)’ যুগের সেরা লুটেরার খেতাব দেওয়াই যায়। অন্যান্য দক্ষ শিকারি প্রাণীদের শিকার লুটপাট করে খেতে এরা বড়ই ওস্তাদ ছিলো। অন্য প্রাণীরা এদের অপরিচ্ছন্ন স্বভাবের জন্যে বিশেষ পছন্দ করতো না। এই ব্যাপারে অবশ্য একটু পরেই আসছি।
দীর্ঘকায় এসব প্রাণীর দাঁতগুলো ছিলো এত মজবুত এবং ধারালো যে এদের হাড় হতে মাংস আলাদা করে খাওয়ার দরকার পড়তো না। পুরো হাড়টাই চিবিয়ে গুঁড়ো করে ফেলতো। প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীদের মধ্যে এদের আলাদা পরিচিতিই আছে শক্তিশালী দাঁতের জন্যে।
তাহলে সমস্যা কোথায়? এরা কেন অন্যের শিকার লুট করে খেত? এর কারণ এরা শিকারে পুরো আনাড়ি ছিলো। তাই এদের একমাত্র উপায় ছিলো অন্য শিকারিদের খাবারে ভাগ বসানোর।
কিন্তু তাতেও সমস্যা থাকে। এরা যদি শিকারে আনাড়িই হয়, তাহলে অন্য শিকারি প্রাণীর খাবার এরা কিভাবে ছিনিয়ে নিতো? মূল ব্যাপারটা আসলে এখানেই। যখন ছিনিয়ে নেয়া খাবারের মালিকানা ফেরত পেতে কেউ দাঁত-মুখ খিঁচে তেড়ে যেতো, তখন এন্টেলোডনরা সেই খাবারের উপর নির্বিকার চিত্তে মলত্যাগ করে দিতো। এর ফলে ঐ খাবারের প্রকৃত মালিক কিছুক্ষণ শোকে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতো। তার মন চাইতো এন্টেলোডনটাকে কামড়ে-টেনে ছিঁড়ে ফেলতে। কিন্তু আগেই যে বলেছি এরা অপরিচ্ছন্ন স্বভাবের জন্যে কুখ্যাত ছিলো, তাই শোকে মাথা পুরো আউলে গেলেও হিংস্র সেই শিকারি প্রাণীদের এইসব খবিশ মার্কা এন্টেলোডনদের চামড়ায় দাঁত বসানোর চিন্তা করতেও গা গুলিয়ে উঠতো। ফলে আম-ছালা সব হারিয়ে বিষন্ন চিত্তে সেই শিকারের প্রকৃত মালিক ক্ষুধার্ত অবস্থায়ই তার বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিতো।
তাদের করুণ দশা-সম্পন্ন বংশধরেরা
আধুনিক যুগের শুকর। অনেকে হয়তো আগেভাগেই নামটা ধারণা করে ফেলেছিলেন। এন্টেলোডোনদের জলহস্তীর পূর্ব পুরুষ হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। ইদানীংকালের ডিএনএ গবেষণায় দেখা গেছে শুকরদের চেয়ে জলহস্তীদের সাথেই তাদের মিল বেশী। হতে পারে! কারণ শূকররা এখন অন্যের আধ-খাওয়া, এঁটো, বাসি খাবারে ভাগ বসায় না। তারা খায় অতি উন্নতমানের ভিটামিন-সমৃদ্ধ, সর্বাধিক মান নিয়ন্ত্রণে এবং কম্পিউটারাইজড পদ্ধতিতে প্রস্তুতকৃত ঘাস, লতা-পাতা, গম, ভুসি ইত্যাদি। তবে যখন তাদের জীবনযাপনের অন্যান্য অভ্যাস এবং রুচির দিকে তাকাবেন, তখন মার্ক-শিট থেকে এই পয়েন্টটুকু আবার কেটে নিতে হবে। আর স্বীকার করতে হবে এরা এন্টেলোডোনদের বংশধর। কারণ এরা তাদের সেই আদিপুরুষদের মত এখনো খবিশই রয়ে গেছে। তদুপরি যে দাঁতের কারণে তাদের আলাদা খ্যাতি ছিলো সেটারও অনেকাংশেই এখন বিলুপ্তি ঘটেছে।
কিন্তু কেন তাদের এই দুর্গতি?
তাদের থেকেও বড় বড় শিকারিরা সব শিকার ধরে খেয়ে ফেলতো। তাই তারা দলবদ্ধ হয়ে ‘লুটেরা গ্যাং’ বানিয়ে খাবার লুট করে খেয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু এভাবে আর কয়দিন টিকে থাকা যায়। ফলে মাংসাশী হতে তারা তৃণভোজীতে পরিণত হলো। যেহেতু তৃণভোজীদের শক্তিশালী দাঁতের প্রয়োজন নেই, সেহেতু তাদের সেই ক্ষমতাশালী দাঁত তারা হারিয়ে ফেললো।
১। অ্যান্ড্রুসারকাস (Andrewsarchus)
দুর্ধর্ষ সেই প্রাগৈতিহাসিক সংস্করণ
Andrewsarchus mongolianis–রা ছিলো অন্যান্য প্রাণীদের সামনে মূর্তিমান আতংক। ‘লর্ড অব দ্যা রিংস’ মুভির সেই দৃশ্যটার কথা মনে আছে যেখানে রোহানের ঘোড়সওয়াররা দানবাকৃতির নেকড়ে বাঘদের অতর্কিত আক্রমণের মুখে পড়েছিলো? সেই নেকড়ে বাঘদেরই কল্পনা করুন আরেকটু বিশদভাবে। তাদের চোয়ালের ক্ষমতাকে করে দিন দ্বিগুণ, শরীরে আরো কিছু মাংসপেশি যোগ করুন, আর তাদের হিংস্রতাকে মুভির ঐ দৃশ্যে দেখানো হিংস্রতার সাথে গুণ দিন দশ দিয়ে। ফলাফল যেটা পেলেন সেটাই হলো অ্যান্ড্রুসারকাস।
আমেরিকান গ্রিজলী ভালুকের থেকে দেড়গুণ বড় আয়তনের অ্যান্ড্রুসারকাসরা হচ্ছে আমাদের এই তালিকার সবচেয়ে সেরা খুনে প্রাণী। ‘ভেলোসিরেপ্টর’-দের রাজত্বের পরবর্তী যুগের সেরা খুনে প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী ধরা হয় এটাকে। এরা ছিলো ১৫ ফুট লম্বা এবং এই ১৫ ফুটের মধ্যে প্রথম ৩ ফুটই ছিলো তাদের চোয়াল। এরা অত্যন্ত ক্ষীপ্র গতিসম্পন্ন হওয়ার সাথে সাথে অতি ধুরন্ধর মস্তিষ্কবিশিষ্টও ছিলো। এদের মস্তিষ্ক সমসাময়িক যুগের অন্যান্য প্রাণীদের মস্তিষ্কের থেকে অনেক উন্নত ছিলো।
তাদের করুণ দশা-সম্পন্ন বংশধরেরা
Ovis aries এবং Capa aegagrus। যারা মাথা চুলকাচ্ছেন নাম দুটো নিয়ে, তাদের জন্যে লিংক দেয়া আছে। নিজেরাই জেনে আসুন তাদের পরিচয়। হ্যাঁ, প্রাগৈতিহাসিক যুগের স্কেলে সবচেয়ে বুদ্ধিমান এবং হিংস্র প্রাণীদের তালিকায় থাকা এই অ্যান্ড্রুসারকাসদের সবচেয়ে কাছাকাছি বংশধর হচ্ছে এরা! একটা কথা আগেই খেয়াল রাখুন, এরা অ্যান্ড্রুসারকাসদের সরাসরি বংশধর নয়। বরং দূরবর্তী কাজিন। অ্যান্ড্রুসারকাসদের সরাসরি কোনো বংশধরই আজ আর জীবিত নেই। অ্যান্ড্রুসারকাসরা যে গণের (Order) সদস্য, সেটার নাম ছিলো ‘Mesonychia’. এই গণের সবচেয়ে কাছাকাছি গণ হলো ‘Artiodactyla’. উপরের মহারথীরা সেই গণের সদস্য। অ্যান্ড্রুসারকাসদের মত চতুর এবং ধূর্ত প্রাণীরা বিলুপ্ত হয়ে গেলেও তাদের এই দূরবর্তী কাজিনেরা এখনো টিকে আছে। কে জানে তাদের কর্মকাণ্ড দেখে মনে হয় প্রকৃতিও আনন্দ পায়!
কিন্তু কেন তাদের এই দুর্গতি?
বরফযুগের পরপরই অ্যান্ড্রুসারকাসরা স্তন্যপায়ী জগত হতে বিলুপ্ত হয়ে যায়। তাদের সেই প্রখর বুদ্ধিমত্তা আর হিংস্রতার বিপরীতে এখন যা অবশিষ্ট আছে সেটা তার আদিপুরুষের সম্পূর্ণ বিপরীত। বলা যায়- তাদের পর-দাদারা স্তন্যপায়ীদের বুদ্ধিমত্তার যে স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করে দিয়ে গেছিলো, তাদের নাতিপুতিরা সেই স্ট্যান্ডার্ডের পুরো উলটো পাশে অবস্থান করছে। একদিক দিয়ে অবশ্য তারা, তাদের পূর্বপুরুষদের সংস্কৃতি অনুযায়ী, বুদ্ধিমত্তার নতুন স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করেছে। তবে স্কেলের উল্টোদিক থেকে, এই যা!
আরো ভালো করে বলতে গেলে বলতে হয়- প্রকৃতি-মাতা যাদেরকে এককালে বুদ্ধিমত্তার স্কেলে উঁচুতে বসিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করার ক্ষমতা দিয়েছিলো, এখন সময় এবং ক্ষমতার পালাবদলে তারাই সেই একই স্কেলের সর্বনিম্ন ধাপের সদস্য।
মাঝে মাঝে মনে হয়, আমাদের মানব সভ্যতার ক্ষেত্রেও বিবর্তনের এই উলটো রথযাত্রা ঘটছে। যেহেতু, বিবর্তন অতি ধীর একটি প্রক্রিয়া, তাই ব্যাপারটা বড় আকারে চোখে ধরা পড়ার কথা নয়। কিন্তু নিজের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে গর্বিত হতে হতে একদিন যদি হঠাৎ দেখেন ছাগল-ভেড়ারাও আপনার আই-কিউ নিয়ে হাসাহাসি করছে, তখন যেন অবাক হবেন না!
(সমাপ্ত)
তথ্যসূত্রঃ http://www.cracked.com/article_16117_6-formerly-kickass-creatures-ruined-by-evolution_p2.html
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ নির্ঝর রুথ ঘোষ (আর্টিকেলের খুঁটিনাটি দিক তুলে ধরার জন্যে)
অসাধারন! এক কথায় অসাধারন! বিশেষ করে সর্বশেষ বয়ান টা মানসম্পন্ন ও এপিক বয়ান।
Nice eloquent writing. Much enjoyed.
প্রবন্ধটা পড়ে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। কীভাবে এত শক্তিশালী প্রজাতিগুলোর বিলুপ্তি ঘটে যায়! আমরা মানুষেরাই তো টিকে থাকার জন্য কয়েকটার বিলুপ্তি ঘটিয়েছি। আবার শুধু টিকে থাকার দোহাই দিয়েও এখন পার পাওয়া যায় না। কারণ ফ্যান্সি শিকারের নেশায়ও অনেক প্রজাতি আমরা বিলুপ্ত করে দিচ্ছি। তার উপর যুদ্ধের কারণে মনুষ্যজাতির হাতে মানুষেরই বিলুপ্ত হওয়ার আশংকা আছে। যা হোক, সুন্দর লিখেছেন। তবে আমি কিছু পয়েন্ট উল্লেখ করতে চাই। যদি কোনো পয়েন্টে ভুল বলে থাকি, সেটাও সংশোধন করে দেবেন বলে আশা করি। যেমনঃ ১) প্রবন্ধটা আপনি নিচের মূল প্রবন্ধ থেকে অনুবাদ করেছেন, তাই না? সেক্ষেত্রে মূল প্রবন্ধটার নাম এবং লিঙ্ক উল্লেখ করার দরকার ছিলো,… আরো পড়ুন
ভালি লিখেছেনভাই