CRISPR-Cas9 (ক্রিসপার-ক্যাস-নাইন ) কয়েক বছর আগে আবিষ্কৃত জিনোম ইডিটিং প্রযুক্তি। যারা জিনেটিক্সের ব্যাপারে একটু হলেও খোঁজখবর রাখেন তারা ইতোমধ্যে একবার হলেও এর নাম শুনেছেন। এই তো মাস কয়েক আগে ন্যাচারে এইচআইভিতে এই প্রযুক্তি ব্যবহারের কথা এসেছে। এই CRISPR-Cas9 (ক্রিসপার-ক্যাস-নাইন) আসলে কী জিনিস? কীভাবে কাজ করে?
ব্যাক্টেরিয়া কীভাবে ভাইরাল সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে সেটা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়েই একদল বিজ্ঞানী মূলত এর সন্ধান পান। বিজ্ঞানীরা দেখেন, বেশিরভাগ ব্যাক্টেরিয়ার একধরনের অভিযোজনযোগ্য প্রতিরোধ ব্যবস্থা (adaptive immune system) আছে, যার মাধ্যমে ব্যাক্টেরিয়া ভাইরাল ডিএনএ সনাক্ত করে ধ্বংস করতে পারে। এই সিস্টেমের নামই হলো CRISPR (ক্রিসপার)।
CRISPR (ক্রিসপার) সিস্টেমের একটি অংশ হলো প্রোটিন Cas9 (ক্যাস-নাইন)। এই প্রোটিন নিজস্ব উপায়ে ভাইরাল ডিএনএ সনাক্ত এবং তা ব্যবচ্ছেদ করতে সক্ষম। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে এই Cas9 (ক্যাস-নাইন) প্রোটিন কীভাবে কাজ করে তা বুঝতে সক্ষম হয়েছেন। শুধু তাই-ই নয়, তারা উপলব্ধি করেছেন Cas9 (ক্যাস-নাইন) প্রোটিনের এই গুণ জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং টেকনোলজিতে ব্যবহার করা সম্ভব। যার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা কোষের মধ্যকার ডিএনএর কিছু অংশ মুছে ফেলতে বা কিছু বাড়তি অংশ যোগ করতে পারবেন। যা এর আগে কখনই সম্ভব হয়নি।
CRISPR (ক্রিসপার) প্রযুক্তি ইতোমধ্যেই ইঁদুর এবং বানর কোষের ডিএনএ পরিবর্তনে সফলতার সাথে ব্যবহৃত হয়েছে। চীনের বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, মানুষের ভ্রুণেও এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা সম্ভব। ফিলাডেলফিয়ার একদল বিজ্ঞানী ক্রিসপার প্রযুক্তি ব্যবহার করেছেন মানব কোষের এইচআইভি ভাইরাসের একটি অংশের ডিএনএ অপসারিত করে। বোঝাই যাচ্ছে, সদ্য আবিষ্কৃত এই প্রযুক্তি কতটা আশাব্যাঞ্জক! চলুন জানি, কীভাবে এই প্রযুক্তি আদতে কাজ করে।
যখন কোনো কোষ ভাইরাস আক্রান্ত আহয়, ভাইরাস মূলত নিজেদের ডিএনএ কোষের ভেতরে ইনজেকশনের মত ঢুকিয়ে দেয়। ব্যাক্টেরিয়ার ক্ষেত্রে যা হয়, ব্যাক্টেরিয়া ভাইরাস থেকে ডিএনএকে একেবারে তুলে ফেলে থেকে কিছু ছোট টুকরো নিয়ে নিজের ডিএনএতে যোগ করে নেয়। এই ভাইরাল ডিএনএর ছোট টুকরোগুলো যেই অংশে গিয়ে যুক্ত হয়, তাকে বলে Clustered Regularly Interspaced Short Palindromic Repeats.
পুরো নামটি পড়েছেন? পরিচিত লাগছে কি? হ্যাঁ, এটাই সংক্ষেপে CRISPR (ক্রিসপার)। এই পদ্ধতি কোষকে যেসব ভাইরাস আক্রমণ করেছে, তার রেকর্ড রাখতে সাহায্য করে। সবচেয়ে বড় কথা, ঐ যে ছোট ডিএনএর টুকরা যুক্ত হলো? তা কোষ বিভাজনের সময় নতুন কোষেও চলে যায়। ফলে তা ভাইরাস থেকে কোষকে যুগের পর যুগ রক্ষা করে। তাই আবিষ্কারক দলের একজন CRISPR locus (ক্রিসপার লোকাস)কে কার্যতপক্ষে কোষের জিনেটিক ভ্যাক্সিনেশন (টিকা) কার্ড বলেছেন।
একবার ডিএনএর টুকরাগুলো ব্যাক্টেরিয়াল ক্রোমোজোমে ঢুকে গেলে আরএনএ কপি তৈরি করে। ছবিতে কমলা রঙের আরএনএ যা একেবারে ভাইরাল ডিএনএ প্রতিরূপ। আরএনএ’কে ডিএনএ’র রাসায়নিক কাজিন বলা যায়। এই আরএনএ সাদৃশ্যপূর্ণ ধারার (matching sequence এর) অধিকারী ডিএনএর সাথে মিথস্ক্রিয়া করে। ছবিতে যে সাদা রঙের প্রোটিন দেখা যাচ্ছে তা হলো Cas9 (ক্যাস-নাইন), ক্রিসপার লোকাসের ছোট আরএনএর টুকরাগুলো গিয়ে এই প্রোটিনের সাথে যুক্ত হয়। এই জটিল গঠনটি প্রহরীর মতো কাজ করে আর কোষের সব ডিএনএতে যুক্ত হতে পারার মত ধারা খুঁজে বেড়ায়।
যদি কোনো ডিএনএর ধারা মিলে যায় তাহলে ছবিতে যে দেখা যাচ্ছে, সেভাবেই যুক্ত হয়ে যায়। শুধু যুক্ত হয়েই চুপ থাকে না, Cas9 (ক্যাস-নাইন) প্রোটিন তখন নিজের কাজ শুরু করে দেয় অর্থাৎ ভাইরাল ডিএনএকে ছেঁটে ফেলে।
Cas9 (ক্যাস-নাইন) আরএনএ প্রহরী সুনির্দিষ্টভাবে ভাইরাল ডিএনএকে কেটে ফেলে আর ডাবল-স্ট্রান্ড ডিএনএ হেলিক্সে ভাঙন ধরায়। মজার ব্যাপার হলো, এই প্রক্রিয়াটি কম্পিউটার প্রোগ্রামের নিজের মতো করে ডিজাইন করা যায়। অর্থাৎ “Cas9 (ক্যাস-নাইন) আরএনএ প্রহরী নির্দিষ্ট ডিএনএ ধারাতে গিয়ে কাজ করবে” চাইলেই এভাবে নকশা করা যায়। পুরো ব্যাপারটা আরো ভালোভাবে বুঝতে নিচের ভিডিওটি দেখতে পারেন।
আমরা এখন এমন একটা পর্যায়ে আছি, যখন চাইলেই যেকোন ডাবল-স্ট্র্যান্ড ডিএনএকে সংস্কার করতে পারি। অর্থাৎ, যে কোনো ধরনের জিনেটিক মিউটেশন পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। বলা বাহুল্য, জিনেটিক মিউটেশনজনিত রোগ সারাতে যেমন sickle cell anemia বা Huntington Disease এর ক্ষেত্রে এই CRISPR-Cas9 (ক্রিসপার-ক্যাস-নাইন ) খুব শীঘ্রই ব্যবহার হতে যাচ্ছে।