আমরা কী মহাবিশ্বে একা?
এই প্রশ্নের উত্তর অনেক ভাবে দেয়া যায়। বৈজ্ঞানিক তথ্য-প্রমাণ এই প্রশ্নের কোনো সরাসরি উত্তর দেয় না। তবে পরিসংখ্যানের মতে আমরা এই মহাবিশ্বে একা হওয়ার কথা না। ভিনগ্রহবাসীর ব্যাপারে মানুষ অনেক আগে থেকেই উৎসাহী। গ্রীক দার্শনিক ক্রাইসোসিপাস (Chrysippus of Soli) বলেছিলেন- “মহাজগতে মানুষের চেয়ে উন্নত কোনো প্রাণী নেই, এমনটা ভাবা পাগলামির সমান ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে।” ভলতেয়ারের মিক্রোম্যাগাসের শিরোনাম চরিত্র একজন ভিনগ্রহবাসী প্রাণী। পরিসংখ্যানের দিক থেকে দেখতে গেলে মহাবিশ্বে অন্য প্রাণী থাকার সম্ভাবনা প্রবল। কিন্তু বৈজ্ঞানিক তথ্য-প্রমাণের খড়গ যে সম্ভাবনা মানে না, পাকাপোক্ত প্রমাণ চায়। আর সেই প্রমাণ সংগ্রহ করতে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গত ৩০-৪০ বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছে।
কিন্তু মানুষের চিন্তাশক্তি থেমে নেই। মানুষ ভেবে যাচ্ছে দুই দিকেই। ধর্মীয় মতকে প্রাধান্য দিয়ে অনেকেই ভাবছেন মহাবিশ্বে আর কোথাও প্রাণ নাই। অর্থোডক্স খ্রিষ্টান লেখক ডব্লিউ গ্যারি ক্র্যাম্পটন মনে করেন ভিনগ্রহে প্রাণী থাকা সম্ভব না, কারণ তাদের বাঁচাতে যিশু যাবেন না। যিশু পৃথিবীবাসিদের বাঁচাতে এসেছিলেন। তাদের বাঁচাতে নয়। আর যদি ধরে নেয়া হয় যে এলিয়েনদের বাঁচানোর প্রয়োজন নেই, তবে এও ধরে নিতে হবে যে তারা আমাদের চেয়ে উত্তম অথবা সমান শ্রেষ্ঠ, আর সেটা ক্র্যাম্পটন কোনো মতেই মেনে নিতে পারছেন না।
“Here we have an answer to the question concerning ET life on other planets: If there were such, who would redeem them? Certainly not Christ, who died once for all of Earth’s elect, a never to be repeated event (1 Peter 3:18). And if these alleged creatures had not fallen in sin, and thereby would not be in need of a savior, then we must conclude that God did not give earthly mankind the best representative in Adam. There would be someone on another planet who did not succumb to temptation, who was ethically superior to the first Adam, and at least, to some measure, the equal of the second and last Adam, JesusChrist (1 Corinthians 15:45-47). This is an untenable theory.”
নিজের অদম্য ইচ্ছা আর পরিস্থিতিগত তথ্যের অপ্রতুলতা তাকে খুব বোকা বানিয়ে রেখেছে। আবার অনেকে ভাবছেন মহাবিশ্বে প্রাণ আছে- তাদের এই ধারণার স্ফুলিঙ্গকে বাতাস দিয়ে আগুনে পরিণত করেছেন অপেশাদার বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর লেখকরা। এখানে মজার একটা তথ্য দেই- ঘরে বানানো টেলিস্কোপ দিয়ে শুক্র গ্রহ (Venus) দেখা যায়। ভিনাসের বায়ুমণ্ডলে মেঘের উপস্থিতি সহজেই বোঝা যায়। একজন বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী লেখক বললেন- মেঘ সৃষ্টি হয় পানি থেকে। সুতরাং ভিনাসে পানি আছে, আর পানি থাকলে প্রাণও আছে। হয়তো ডায়নোসরও! হাতে পোক্ত প্রমাণ- ০, ফলাফল- ডায়নোসর!
এরপরে ভিনাসের প্রাণীরা মানুষের সাথে “যোগাযোগও” করা শুরু করলো, টেলিপ্যাথি দিয়ে! এই ঘটনাপ্রবাহ শেষ হলো সোভিয়েত মহাকাশ মিশন স্পুটনিক ১’র ভিনাসে অবতরণ আর সেখানকার ছবির প্রকাশের মাধ্যমে। ৯০০ ডিগ্রী তাপমাত্রায় যেখানে সীসাও গলে যায় সেখানে কোনো প্রাণ থাকা অসম্ভব এটা মানুষ বুঝার পর থেকে ভিনাসের প্রাণীরা আমাদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলো।
পরে আমরা তাকালাম মঙ্গলের দিকে। সেটা আরেক দিনের জন্য থাক। ক্রপ সার্কেল নিয়ে লিখবো ভেবেছিলাম। পরিপ্রেক্ষিত তৈরি করতে অনেক সময় লাগিয়ে ফেললাম। তো- ১৯৫০’র কাছাকাছি এসে ফ্লাইং সসার আর UFO মানুষের সংস্কৃতিতে স্থান করে নিতে লাগলো। সেই সময়ে বহু মানুষ আকাশে সসার আর UFO দেখতে শুরু করলেন। মনস্তত্তবিদরা যদি এই দাবীকে দৃষ্টিভ্রম বলেই দাবি করলেন।
৭০ দশকের শেষভাগটাতে এসে দেখা গেলো নতুন এক জিনিস। গ্রেট ব্রিটেনের ফসলের ক্ষেতে বিরাট বড় বড় জ্যামিতিক চিত্র! কৃষকরা জানালেন এক রাতের মধ্যে এই চিত্র কেউ বা কিছু বানিয়ে গেছে। সময় বাড়ার সাথে সাথে যেন এই চিত্রগুলো আরো জটিল হতে শুরু করলো। সাইটগুলো দেখে বৈজ্ঞানিক ব্যাখা দাঁড় করানোর চেষ্টা করলেন অনেকেই। Columnar vortices আর ring vortices এর কথা বলা হলো। Ball lightning এর সম্ভাবনাও বাদ গেলো না। জাপানী গবেষকরা পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাতে শুরু করলেন এ নিয়ে। এর একটা প্রাকৃতিক ব্যাখা অবশ্যই আছে, আর সেটা বের করতে হবে।
কিন্তু কে শোনে কার কথা! মিডিয়া প্রচার করতে শুরু করলো এগুলো ফ্লাইং সসার/UFO’র অবতরণের ফলে হয়েছে। আর কোনো ব্যাখাই নাকি সম্ভব না। কেউ মনে করলেন এটা শয়তানের কাজ। কেউ ভাবলেন ইলুমিনাতি, বা নাইটস টেমপ্লারদের কাজ। ব্রিটিশ সংসদে এ নিয়ে তর্ক বিতর্ক হয়ে গেলো এক চোট।
এক নতুন ধরনের বিশেষজ্ঞের আবির্ভাব ঘটলো, Cerealogists, তারা প্রায় নিশ্চিত- এটা এলিয়েনদের কাজ, তাদের সসার অবতরণ করে এই ছাপগুলো বানিয়ে গেছে। অপবিজ্ঞান অনেক ক্ষেত্রেই একে অন্যের সহায়ক হয়। এক্ষেত্রেও এর ভিন্ন কিছু ঘটলো না, ডাউসার (Dowser) যারা কিনা দুইটি স্টিলের পাত হাতে নিয়ে সেই পাতের গতি প্রকৃতি দেখে অনেক ব্যাখা দিতে পারেন বলে দাবি করেন, আর চ্যানেলারস, যারা মহাবিশ্বের যে কোনো প্রাণের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন বলে দাবি করেন- তারা বললেন- হ্যাঁ, এলিয়েনরাই করেছে এটা! শ’য়ে শ’য়ে বই প্রকাশিত হলো ক্রপ সার্কেল নিয়ে। মারাত্নক কাটতি!
বিশেষজ্ঞরা এই চিত্রগুলো দেখে ভাবলেন- ঘড়ির কাটার ঘূর্ণনের দিকে ফসলকে চেপে বানানো বৃত্ত- হয়তো প্রাকৃতিক হতে পারে! সেটা মিডিয়ায় প্রচার হওয়ার পরেই দেখা গেলো ঘড়ির কাটার ঘূর্ণনের বিপরীত দিকে বানানো বৃত্ত। আজব! এগুলোর শুরু ইউরোপে হলেও আস্তে আস্তে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়লো। মিডিয়ার কল্যাণে সারা বিশ্বজুড়ে শুরু হলো মাস হিস্টিরিয়া! অ্যামেচাররা বলতে শুরু করলো এই প্যাটার্নগুলো খুবই জটিল, মানুষের পক্ষে করা সম্ভব না। তারা মানুষের সৃষ্টিশীলতা আর বুদ্ধিমত্তা নিয়ে টিটকারি করলো কি না, কে জানে! একটা এমন ক্রপ সার্কেলে দেখা গেলো ইংরেজী হরফে লিখা “WE ARE NOT ALONE”, আমরা একা নই! এলিয়েনরা লিখেছে “আমরা একা নই”, যদিও তারা যদি লিখতো “তোমরা একা নও” তবে হয়তো বার্তাটা অর্থবহ হতো, কিন্তু মানুষ সেটা বুঝতে রাজি হলো না!
পরে একবার দেখা গেলো এইরকম সার্কেলের নিচে “DD” লিখা, কিন্তু সেটার কৃতিত্বও এলিয়েনদের দেয়া হলো। পত্রিকারাও নকল ক্রপ সার্কেল বানিয়ে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের বোকা বানানোর চেষ্টা করেন। এমন কি ব্রিটেনের রাজপরিবারও এ বিষয় নিয়ে চিন্তিত! কোনো ব্যাখা কারো কাছেই নাই। আর “মানবসৃষ্ট” এর কোনো ব্যাখাই না!
১৯৯১ সাল- সাউথ হ্যাম্পটনে দুইজন ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তি Doug Bower আর David Chorley স্বীকার করেন তারা তাদের যৌবনকালে ২৫০’র বেশী ক্রপ সার্কেল বানিয়েছেন। তারা UFO নিয়ে মানুষের উৎসাহ দেখে ভেবেছিলেন এ নিয়ে আরেকটু মজা করবেন। ২০/৩০ বছর পার হয়ে গেছে মাঝে, তাদের সৃষ্টিশীলতার ক্রেডিট এলিয়েনরা পাচ্ছে- প্রথম দিকে তাদের ব্যাপারটা মজার মনে হলেও পরে তারা বুঝতে পারলেন তারা কোনো ক্রেডিটই পাচ্ছেন না। এছাড়াও অন্যান্য prankster’রা ক্রপ সার্কেল বানানো শুরু করেন, তাতে তাদের সৃষ্টিশীলতা বিশেষত্ব হারাচ্ছিল। তারা শেষের দিকে তাদের “শিল্পকর্মে” তাদের নামের আদ্যাক্ষর দিয়ে দিতেন- “DD”!
স্টিলের বড় একটা পাত নিয়ে তারা দেখিয়েও দেন কীভাবে তারা সার্কেল বানাতেন।
বুড়ো হয়ে যাওয়ায় তারা এসব করা বাদ দিয়ে দেন, আর মানুষের মধ্যে এসব বিষয় নিয়ে ভীতির পরিমাণ দেখে তারা বেশী দেরী হওয়ার আগে সিদ্ধান্ত নেন সামনে আসার। ভেবেছেন মিডিয়া হয়তো ব্যাপারটাকে খুব বড় করে দেখবে?? জ্বি না, মিডিয়া খুব কমই পাত্তা দিয়েছিল এই খবরটিকে। তবে মানুষের মাঝে কিছুটা পরিবর্তন আসায় ক্রপ সার্কেলের পরিমাণ ধীরে ধীরে কমে আসে।
এখানে মানুষের মাঝে যে বিষয়টার অভাব দেখা যায় সেটা হচ্ছে- সন্দেহবাদিতা। আপনি একটা কিছু কিনতে গেলেন- আপনি অনেক যাচাই বাছাই করেই কিনবেন। একটা জামা কিনতে গেলেন, দেখেই কিনে ফেলছেন না আপনি। হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছেন। দরদাম করছেন। আরেকটু কমে পাওয়া যায় কিনা!
আমাদের সন্দেহবাদ শিখানো হয় না, আমরা এটা ব্যবহার করি কম। তবে আমরা সেই ক্ষমতা নিয়ে জন্মাই। এলিয়েনদের একটা মহাকাশযান এসে চিত্র বানিয়ে এক রাতের মধ্যে উধাও হয়ে গেলো, রাডার টেলিস্কোপে ধরা পড়লো না! এতো উন্নত প্রযুক্তি নিয়ে কেনো তারা আমাদের ফসলের ক্ষেতে ছবি এঁকে যাবে? তারা সরাসরি যোগাযোগের চেষ্টা করবে না কেনো? এইটুকু সন্দেহবাদ কিন্তু খারাপ কিছু না।
তথ্যসূত্র-
The Demon Haunted World: Science as a Candle in the Dark, Carl Sagan, 1997
Rationalwiki