মৃত সাগর নিয়ে একটি বিখ্যাত মিথ চালু আছে, যে এখানে নাকি কোনো প্রাণের অস্তিত্ব নেই বা কোনো প্রাণী বাঁচে না। এই পোস্টে সেই মিথটাকে ভাঙা হবে। সবাই হাতুড়ি-বাটালি নিয়ে রেডি তো? আসুন তার আগে একটু মৃত সাগরের নাম-ঠিকানা জেনে বুঝে নিই।
মৃত সাগর বা Dead Sea মূলত একটি অতিলবণাক্ত হ্রদ (hypersaline lake)। পৃথিবীতে এরকম বেশ কিছু সাগর, হ্রদ ও পুকুর আছে যেখানে অতিমাত্রায় লবণ পাওয়া যায়। সাধারণত সমুদ্রে বিভিন্ন লবণের মোট পরিমাণ ৩% থেকে ৬% হয়ে থাকে। কিন্তু এসব অতিলবণাক্ত সমুদ্র বা হ্রদে তা ২০% থেকে ৪৪% পর্যন্ত হতে পারে। শুনতে আশ্চর্য শোনালেও এই বিখ্যাত ‘মৃত সাগর’ পৃথিবীর সবচেয়ে লবণাক্ত সাগর না। সেই কৃতিত্বের অধিকারী হ্রদের নাম ডন হুয়ানের পুকুর (Don Juan Pond)। সুদূর অ্যান্টার্কটিকার ম্যাকমার্ডো নামক শুষ্ক উপত্যকায় এই পুকুরটা অবস্থিত, আয়তনে ৩০০০ ঘনমিটার। এই পুকুরের লবণাক্ততা ৪৪%, আর এত বেশি লবণ থাকার কারণেই শূন্যের নিচে -৫০°সে. তাপমাত্রাতেও এর পানি বরফ হয় না! ম্যাকমার্ডো উপত্যকাতেই এরকম আরো কয়েকটি অতিলবণাক্ত হ্রদ পাওয়া গেছে। ডন হুয়ানের পুকুরের পরেই যে অতিলবণাক্ত পানির আধার, সেটা অ্যান্টার্কটিকার বাইরে অবস্থিত। জিবুতি রাষ্ট্রের আস্যাল হ্রদের (Lake Assal) লবণাক্ততা ৩৪.৮%। এর কাছাকাছিই আছে ইজরায়েল, পশ্চিম তীর ও জর্ডানের মাঝে অবস্থিত মৃত সাগর (৩৪.২%) এবং আমেরিকার ইউটাহ স্টেটে অবস্থিত গ্রেট সল্ট লেক (৫%~২৭%)।
এরকম অতিলবণাক্ত হ্রদ পৃথিবীর সব মহাদেশেই আছে। কোনটা বিখ্যাত তার গভীরতা ও লবণাক্ততার কারণে, কোনটা বিখ্যাত তার অবস্থানের কারণে। ভৌগলিক কারণ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, যে এসব অতিলবণাক্ত হ্রদ সৃষ্টি হয়ে শুষ্ক ও বৃষ্টিপাতহীন (arid) এলাকা এবং পানিস্বল্প (semi-arid) এলাকায়। এধরণের এলাকার পুকুর বা হ্রদগুলোতে পানির উৎস খুবই সীমিত থাকে আর বাষ্পীকরণের ফলে বদ্ধ পানির চারপাশের মাটি থেকে লবণের ঘনত্ব ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। অথবা পানির উৎস পর্যাপ্ত থাকলেও যত দ্রুততায় পানি জমা হয়, তার চেয়ে দ্রুততায় পানি সূর্যের তাপে বাষ্প হয়ে যেতে থাকে। যেমন, দেখা গেছে মৃত সাগর ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাচ্ছে। প্রধান উৎস জর্ডান নদী থেকে পানি এখানে জমা হতো, কিন্তু ১৯৫০ সালের পর থেকে জর্ডান আর ইজরায়েল মিলে এই নদীর দিক পরিবর্তন করে খাবার পানি হিসেবে নিয়ে নিচ্ছে। বিভিন্ন বাঁধ ও পানি-প্রকৌশলের কারণে সেসব নদী-নালার সব পানি এখানে আসছে না। আর সারা বছর তীব্র রোদ ও গরমে পানি দ্রুত বাষ্পীভূত হচ্ছে। হিসাব করে দেখা গেছে যে, গত ৪০ বছরে এর পানির উচ্চতা প্রায় ৮০ ফুট কমে গেছে। পানির স্বল্পতায় ইতোমধ্যেই এর জায়গায় জায়গায় বিশাল অংশ জুড়ে খনিজ লবণের স্ফটিক জমা হতে দেখা যাচ্ছে।
এবারে আসি সেই মিথের ব্যাপারে। ভুলে যাননি নিশ্চয়ই? মৃত সাগরে কোন প্রাণের অস্তিত্ব নেই বা কোন প্রাণী বাঁচে না। কথাটা আংশিক সত্য। অতিমাত্রায় লবণ থাকার কারণে মৃত সাগরে কোন মাছ বা অন্যান্য জীবজন্তু টিকতে পারে না। এমনকি মানুষরাও এই সাগরে ডুবসাঁতার দিতে গিয়ে পানি খেয়ে ফেললে শ্বাস আটকে মারা যেতে পারে। তবে গত তিন-চার বছরে গভীর তলদেশে ডাইভ করে বিজ্ঞানীরা বেশ কিছু ব্যাক্টেরিয়ার পুরু স্তর পেয়েছেন। এছাড়াও পাওয়া গেছে অণুজীবের কলোনি। এর কারণ মৃত সাগরের তলদেশে কিছু ছোট ছোট স্বাদুপানির “ফোয়ারা” বা জেটস্ট্রিম আছে। ব্যস, স্বাদুপানি যতখানি জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে, সেখানে লবণাক্ততা কম। জায়গাগুলো প্রায় ৩৩ ফুট চওড়া ও ৪৩ ফুট গভীর। এরকম বেশ কিছু স্পটে একই রকমের ব্যাকটেরিয়ার প্রাচুর্য সংগ্রহ করা হয়েছে। সুতরাং এটা দিনের আলোর মতই পরিষ্কার যে মৃত সাগরের অতিমাত্রায় লবণই প্রাণীদের জন্য ক্ষতিকর, আর যেখানে লবণের পরিমাণ কম, সেখানে প্রাণ জন্মাতে সময় লাগে নি। এর সাথে কোনো অলৌকিক ব্যাপার-স্যাপার জড়িত না।
বিস্তারিত জানতে পড়ুন ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের এই আর্টিকেলটিঃ Nat Geo Article
অতিলবণাক্ত হ্রদের ব্যাপারে আরো জানতে চাইলে পড়ুনঃ
১. WLC13 papers
২. Oxford Journals
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পত্রিকা
আমাদের আশেপাশে অনেক পুকুর দীঘি আছে,
এসবের পানিও গরমে বাষ্প হয়ে যায়, কই তখন তো এসব পুকুর দীঘির পানি তো লবণাক্ত হয় না!
এর কারণ টা কী বলবেন?
কারণ, সাগরের তলদেশে লবণ তৈরির কারখানা আছে বলা যায়, যেখানে পানি লেগে লবণাক্ত হয়ে যায়। এখন পানি যদি কমে যায়, লবণটার অনুপাত বেড়ে যায় শুধু। এখন সেই লবণ যদি নাই থাকে, তাহলে পানি কমলে বা বাড়লে লবণাক্ততা (যথাক্রমে) বাড়বে বা কমবে না।