জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক মুহাম্মাদ আলী রেজা বিজ্ঞানযাত্রার ফেসবুক গ্রুপে তার একটা লেখা দিয়েছিলেন। লেখাটা ট্যাবলয়েড প্রকৃতির কাল্পনিক সুখপাঠ্য হলেও তাতে বিজ্ঞানের ছোঁয়া ছিলো নামে মাত্র। তিনি উৎস হিসেবে বিভিন্ন পত্রিকা বা সংবাদের কথা উল্লেখ করেছেন। আর আমার লেখায় তার ভুলগুলো বের করে দেখাচ্ছি। তিনি লিখেছেন,
বেবুন, গরিলা, শিম্পাঞ্জি, ওরাংওটাং এমনি সব প্রজাতির এক ধাপ থেকে অপর ধাপে উত্তরণের মাধ্যমে বিবর্তনের শেষ ধাপ ছিলো আমাদের।
আসলে বিবর্তন এভাবে ঘটে না। এভাবে ঘটেওনি। বেবুন, গরিলা, শিম্পাঞ্জি ইত্যাদি বিবর্তনের কোনো ধাপ নয়, আলাদা শাখা মাত্র। মানুষ এমনই একটি শাখা। মানুষ, বেবুন, গরিলা, শিম্পাঞ্জী ইত্যাদি প্রাণী একই পূর্বপুরুষ হতে আলাদা পরিবেশে, আলাদা জলবায়ুতে বিবর্তিত হয়েছে। এবং বিবর্তনের শেষ ধাপ বলে কিছু নেই। বিবর্তন একটি চলমান প্রক্রিয়া, যা এই মুহুর্তেও ঘটছে। মানুষ এখনও বিবর্তিত হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। বিবর্তন থেমে আছে এমনটা ভাবার কোনো সুযোগই নেই। তবে মানুষের ক্ষেত্রে বিবর্তনভিত্তিক সামান্য পরিবর্তন আসতেও বিশাল সময় লেগে যায়। এক্ষেত্রে একশো, দুইশো বছরে ভাবলে চলবে না, ভাবতে হবে মিলিয়ন বছরের মাপকাঠিতে। আজ থেকে মিলিয়ন বছর পর মানুষ এমন থাকবে না, বিবর্তনের কারণে পরিবর্তিত হয়ে যাবে – এই চিন্তাটাই সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত।
লেখক দুটো পত্রিকার দুটো খবর তার লেখার মূল ভিত্তি হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। দুটো প্রবন্ধের শিরোনাম বেশ রসালো। পত্রিকাগুলো কাটতি বাড়াতে এমন অনেক কিছুই করে থাকে। এমনকি ডিসকভারি চ্যানেলেও ভূত খোঁজার অনুষ্ঠান দেখানো হয়। এসব পত্রিকার বিনোদনমূলক সংবাদকে বিজ্ঞান সম্পর্কিত কোনো প্রবন্ধের উৎস হিসেবে উপস্থাপন করা বেশ দুঃখজনক। এছাড়াও এসব প্রবন্ধের কোনো বিশ্বাসযোগ্যতা নেই, এবং এরা কেবল রসালো অংশটুকুই প্রচার করে। তবুও পত্রিকার দাবীগুলো যাচাই করে দেখা যাক। লেখক লিখেছেন,
সাম্প্রতিক গবেষণায় একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, যা এএফপি, আল জাজিরা-সহ আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ১৮ লাখ বছরের পুরনো একটি খুলির ওপর গবেষণা চালিয়ে বিজ্ঞানীরা চাঞ্চল্যকর তথ্য জানিয়েছেন। তারা বলছেন, মানুষের পূর্বসূরি আদি প্রজাতি (হোমিনয়েড) আসলে তিনটি নয়, বরং একটিই ছিলো।
লেখক যে সাম্প্রতিক গবেষণার কথা বলছেন, তা গুগলে পাওয়া গেলো। কিন্তু ১৮ লাখ বছর আগের যে প্রজাতির কথা বলছেন লেখক, অর্থাৎ Homo Erectus, তা মানুষের সবচেয়ে প্রাচীন পূর্বপুরুষ নয়। Homo Habilis হচ্ছে এখন পর্যন্ত পাওয়া মানুষের সবচেয়ে প্রাচীনতম প্রজাতি, যারা পৃথিবীতে ছিলো ২১-১৫ লক্ষ বছর আগে।
লেখকের উল্লেখ করা খবরটাতে কেবল এক মতের বিজ্ঞানীদের কথা বলা হয়েছে, যারা মনে করেছিলেন, ওই সময়টাতে একাধিক হোমিনিন প্রজাতি নয়, কেবল একটা হোমিনিন প্রজাতি বাস করতো। এটা কেবল ঐ সকল বিজ্ঞানীর ধারণা মাত্র, অকাট্য প্রমাণ নয়। লেখকের উল্লেখ করা পত্রিকা যে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে গেছে তা হলো, একই সাথে অন্যান্য জীবাশ্ম বিজ্ঞানী (প্যালেওন্টোলজিস্ট) এই দাবির সমর্থক নন। কারণ Homo Erectus-দের কেবল আফ্রিকাতে নয়, ইউরেশিয়া অঞ্চলেও দেখা গেছে। সুতরাং Homo Erectus-দের মাত্র একটা সংস্করণ গোটা পৃথিবীতে ছিলো, এটা প্রমাণিত নয় – স্রেফ একপাক্ষিক ধারণা মাত্র।
আর যদি একটি নির্দিষ্ট প্রজাতি হয়ও, তাতেও লেখকের লেখার দাবি পরিপূর্ণ হয় না। কারণ একটা প্রজাতিতে মাত্র দুইজন নারী পুরুষ থাকে না – থাকে অগুণতি সদস্য। আদিমাতার অস্তিত্ব নাকচ হয়ে যায় এখানে।
আবার নিউজউইকের আরেকটা রিপোর্টের কথা উল্লেখ করেছেন লেখক। এখানেও তিনি “বিজ্ঞানীরা বলেছেন”, “দাবি করেছেন” ইত্যাদি অস্পষ্ট কথা লিখেছেন। কোন বিজ্ঞানী বলেছেন, তার পিছে যুক্তি কী, এসব কিছুই বলা নেই। নিউজউইকের ওই রিপোর্টটা নিয়ে পরবর্তীতে অনেক তর্ক বিতর্ক হয়েছে। এবং শেষমেশ বিশেষজ্ঞরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, মিডিয়া কীভাবে তিলকে তাল বানিয়ে গুলে খায়, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে নিউজউইকের এই রিপোর্ট। আমিও তাল মিলিয়ে অমুকে বলেছেন, তমুকে বলেছেন বলে চালিয়ে দিলাম, কেমন?
কিন্তু নাহ। বিজ্ঞানযাত্রা অস্পষ্ট, উড়ো কথায় বিশ্বাস করে না। আমি লেখার নিচে উৎসগুলো উল্লেখ করে দিচ্ছি।
আবার আসি একই মা/একই বাবা হতে সমগ্র মানবজাতির আগমন সম্পর্কে। তবে তার আগে বিবর্তন কীভাবে কাজ করে সে ব্যপারে আরেকটু ধারণা নেয়া যাক। কারণ লেখক বিবর্তনকে সাক্ষী হিসেবে ধরে নিয়ে তার একই আদিমাতা/একই আদিপিতা অর্থাৎ আদম-হাওয়ার রূপকথা হাসিল করতে চাচ্ছেন। লেখকের মতে ব্যপারটা ঘটেছিলো ঠিক এভাবে,
‘আদম হাওয়া টুপ করে স্বর্গ থেকে পড়লো। তাদের একগাদা ছেলেপুলে হলো। এরপর বিবর্তন শুরু হলো, এবং এক পর্যায়ে থেমে গেলো। এবং বর্তমান মানুষেরা বিবর্তনের সর্বশেষ রূপ।’
আইডিয়াটা যদিও চমকপ্রদ, এবং একে কেন্দ্র করে সিনেমা বানানো যায়, সাহিত্য রচনা করা যায়, বিকেলবেলা ছোট বাচ্চাদের রপকথার গল্প শোনানো যায়, কিন্তু বাস্তবতার সাথে মেলানো যায় না।
আগেই বলেছি, বিবর্তন হুট করে শুরু হয় না, হুট করে শেষও হয় না। কালের বিবর্তনে বিভিন্ন অর্গানিজমের গাঠনিক, শারীরিক, চারিত্রিক এবং মানসিক পরিবর্তন আসে। হুট করে আদম-হাওয়ার উদয় হওয়া সম্ভব নয়। মানুষের আদি অবস্থা যেমনই হোক না কেন, চার বিলিয়ন বছরের বিবর্তনের মাধ্যমে ওই পর্যায়ে আসতে হয়েছে।
আচ্ছা, তর্কের খাতিরে ধরে নিই আদম-হাওয়া দুটো ‘গ্রেট এইপ’, যারা ১৫ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীতে ছিলো। মাত্র দুটো এইপ, আর কেউ নেই পুরো দুনিয়ায়। ব্যাপারটা তাহলে বিবর্তনের দৃষ্টিতে কেমন দেখায়?
চার বিলিয়ন বছর আগে প্রথম জীবন > ২.১ বিলিয়ন বছর আগে ইউক্যারিওটা > ৫৯০ মিলিয়ন বছর আগে কর্ডাটা > ২২০ মিলিয়ন বছর আগে ম্যামালিয়া > ৭৫ মিলিয়ন বছর আগে প্রাইমেট হয়ে অবশেষে ১৫ মিলিয়ন বছর আগে গ্রেট এইপ বা মানুষের আদিরূপে বিবর্তিত হতে সময় লেগেছে মোট চার বিলিয়ন বছর। এত জটিল এবং দীর্ঘ সময়ের বিবর্তনের ফসল মাত্র দুইটা এইপ, তাও যার কিনা একটা পুরুষ আরেকটা নারী, এমন ভাবনা কেবলই হাস্যকর নয়, বিজ্ঞানমনস্ক কেউ যে মাথায় আনবে – এটাও ভাবা যায় না। ব্যাপারটা অনেকটা জোর করে নিজেকে প্রবোধ দেয়ার মতো। অহংকারবশত, আগে বিবর্তনের বৃক্ষ এমনভাবে আঁকা হতো যেখানে মানুষকে সবার ওপরে রাখা হতো, দেখে নিজেদেরকে সর্বশেষ ফলাফল হিসেবে ভুল করাটাই স্বাভাবিক। চিত্রটা অনেকটা এরকম…
এখন বিবর্তনের চিত্রটা দেখানো হয় নিচের ছবিটার মত করে যেখানে মানুষও অন্যান্য প্রাণীর মতই অন্য একটি প্রাণী যারা সবাই একইসাথে এই মুহূর্তে এই পৃথিবীটাতে ভাগাভাগি করে আছে। লাল দাগে দেখা যাচ্ছে, আমাদের অবস্থান কোথায়।
শেষ কথা – কেবল একজোড়া নারী পুরুষ নয়, গ্রেট এইপদের সংখ্যা ছিলো একাধিক এবং অনেক। তারা ছিলো বিবর্তনের একটা অবস্থা মাত্র এবং যাদের থেকে আরো অনেকগুলো প্রজাতি বিবর্তিত হয়েছে, এবং আমরা মানুষেরা তার মধ্যে একটি। সুতরাং, না, মানুষের আদিমাতা বা আদিপিতা একজন নয়, বরং একটা প্রজাতি, যাদের মধ্যে ছিলো নানা বৈচিত্র এবং দীর্ঘ সময় ধরে তাদের বিবর্তন হয়েছে পৃথিবীর একাধিক যায়গায়। যাদেরকে আমরা গ্রেট এইপ বলে জানি, তাদের সংখ্যা ছিলো অসংখ্য।
উৎস
লেখকের উল্লেখ করা ১৮ লাখ বছর আগের Homo Erectus এর দুই-দিকের বক্তব্য
মাইট্রোকন্ড্রিয়াল ইভ বা আদিমাতা থাকা সম্ভব নয় কেন এবং প্রাসঙ্গিক লেখার ঠিকানা