যৌথভাবে লিখেছেন – ইসমাইল হাসান এবং ফরহাদ হোসেন মাসুম
সূচনা
ভুল বক্তব্য – ১
“একটা মহাদেশ, মানুষ নাই জন নাই, মহাদেশটা শুধু পানি-বরফের পাহাড় দিয়া আল্লাহ বানায়া রাখছেন। নাম কী? এন্টার্কটিকা। এখানে শুধু আছে শ্বেত ভাল্লুক আর আছে পেঙ্গুইন!”
ভুল বক্তব্যের সূত্র – [১] সাঈদীর ওয়াজ ১ (নিচে তালিকা দেখুন) [ ২৪ সেকেন্ড থেকে শুরু ]
প্রকৃত তথ্য – দক্ষিণ মেরুতে কোনো শ্বেত ভল্লুক নেই। শ্বেত ভল্লুক থাকে উত্তর মেরুতে।
উত্তর আর দক্ষিণ মেরুর জন্য north and south pole ছাড়াও আরো পরিচিত একটা করে নাম আছে – Arctic Circle, Antarctic Circle. দক্ষিণ মেরুতে যে মহাদেশ, সেটার নামই তো এন্টার্কটিকা, তাই না? এই নামগুলো কোত্থেকে এসেছে, জানেন?
পরিচিত বাদামী ভল্লুকের বৈজ্ঞানিক নাম Ursus arctos। নামটার প্রথম অংশ এসেছে ল্যাটিন থেকে, পরের অংশ গ্রীক থেকে। দুটো অংশের অর্থই ভল্লুক। তো, “আর্কটোস” যেখানে বা যে মেরুতে আছে, সেটার নাম দেওয়া হলো “আর্কটিক”। আর যেখানে নেই, সেটা এন্টি-আর্কটিক বা সংক্ষেপে এন্টার্কটিক।
ভুল বক্তব্য – ২
“পেঙ্গুইন পাখি পানির মধ্যেও ডুবাইতে পারে, আকাশ দিয়াও উড়তে পারে!”
ভুল বক্তব্যের সূত্র – [১] সাঈদীর ওয়াজ ১ [ ৪০ সেকেন্ড থেকে শুরু ]
প্রকৃত তথ্য – পারে না।
পেঙ্গুইন অনেক কিছু পারে। যেমন, এন্টার্কটিকের ভয়ানক ঠাণ্ডা সহ্য করে টিকে থাকতে পারে, পানির মধ্যে বেশ অবলীলায় সাঁতরাতে পারে, সাগর থেকে উদর ভর্তি করে মাছ খেয়ে এসে সন্তানের মুখে উগরে দিতে পারে। কিন্তু যে জিনিসটা ওরা পারে না, সেটা হচ্ছে আকাশে ওড়া। শরীরের ভর ওদেরকে ওড়ার ক্ষমতা দেয়নি। প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে ওদের পাখা দুটোর কাজ কী? উত্তর হলো, পাখা দুটোকে ওরা মাছের পাখনার মত ব্যবহার করে পানির মধ্য দিয়ে চলাচলের জন্য।
হতে পারে ২০০৮-এ টেলিগ্রাফ পত্রিকার ছড়ানো এপ্রিল ফুল সংবাদে পাওয়া ভিডিও [২] থেকে এই জ্ঞানের উৎপত্তি! ওখানে মজা করার জন্য টেলিগ্রাফ পত্রিকা এমন একটা বিষয় বেছে নিয়েছিলো, যেটা সবাই জানে যে মিথ্যা। কিন্তু সাঈদী সাহেব নামকরণের সার্থকতা রক্ষা করতে পারলেন না।
ভুল বক্তব্য – ৩
“পেঙ্গুইন পাখিগুলো আমি দেখেছি। সে ডিম পেড়ে ৩ মাস, ৯০ দিন তাকে তা দিতে হয়।”
ভুল বক্তব্যের সূত্র – [১] সাঈদীর ওয়াজ ১ [ ৪৪ সেকেন্ড থেকে শুরু ]
প্রকৃত তথ্য – ৩০ দিন থেকে সর্বোচ্চ ৬৬ দিন পর্যন্ত লাগে।
বিভিন্ন তথ্যসূত্র [৩, ৪] থেকে আমরা দেখেছি যে, পেঙ্গুইনের বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে ডিমে তা দেয়ার সময়টা ভিন্ন ভিন্ন হলেও সেটা এক মাস থেকে সর্বোচ্চ ৬৬ দিনের মধ্যে ঘটে।
ভুল বক্তব্য – ৪
“৩ মাস, ৯০ দিন তাকে (পেঙ্গুইন মাকে) দাঁড়ায়া থাকতে হবে। এই ৯০ দিন সে খাবে কী? ওর স্বামীকে, পুরুষ পেঙ্গুইনকে আল্লাহ এত দয়া দিছেন, ও মাছ ধরে ধরে এনে প্রত্যেকদিন ওর বউরে খাওয়ায়।”
ভুল বক্তব্যের সূত্র – [১] সাঈদীর ওয়াজ ১ [ ১ মিনিট ২৩ সেকেন্ড থেকে ]
প্রকৃত তথ্য – সাধারণত বাবা-মা দুজনেই তা দেয়। একটি প্রজাতিতে শুধু বাবা তা দেয়।
মা ডিম পাড়ে, এবং সেটা সাধারণত বাবা-মা দুজন মিলেই তা দেয় [৫]। একমাত্র ব্যতিক্রম হলো এম্পেরর পেঙ্গুইন। এদের মধ্যে কাজটা করে শুধু বাবা পেঙ্গুইনরাই! মানে, মা একেবারেই তা দেয় না। বাবাকে ডিমটা গছিয়ে দিয়ে মা সাগরে চলে যায় খাবার সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। দক্ষিণ মেরুর শীতকালের ভয়াবহ ঠাণ্ডার এই সময়টা বাবারা ডিমে তা দেয়, নিজেরাও কিছু খায় না।
সাগর থেকে পেট ভর্তি করে মায়েরা যখন ফিরে আসে, ততদিনে ডিম ফুটে বাচ্চা বেরিয়ে এসেছে। মায়ের কাছে তাকে বুঝিয়ে দিয়ে আস্তে ধীরে বাবারা চলে যায় সাগরে শিকার করতে।
ভুল বক্তব্য – ৫
“এই মশা কী জন্য বানাইছেন আল্লাহ? এখন দেখেন এই মশা মারার জন্য কত রকমের কোম্পানি। মরটিন, এরোসোল, আইসিআই কোম্পানি, মশারি, কত রকমের ওষুধ আর মশারি- এইগুলা বানাবার পিছনে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক কাজ করে আর লক্ষ লক্ষ মানুষের পেটের ভাত জোটে। … … … … মশা আছে বলেই তো মশারি, মশা আছে বলেই তো মরটিন বিক্রি হয় জম্মের মত।
এখন চিন্তা করতে পারেন, তাইলে সাপ বানাইছে ক্যান? সাপ বানাইছে ক্যান তা জানো না? সাপের চামড়ার মেলা দাম, এ দিয়া ভ্যানিটি ব্যাগ তৈরি হয়। মহিলারা ব্যবহার করে। খুব দামী। আর সাপের বিষ, এইটা দিয়া ঔষধ তৈরি হয়।”
ভুল বক্তব্যের সূত্র – [৬] সাঈদীর ওয়াজ ২ [ ৩৫ সেকেন্ড থেকে শুরু ]
প্রকৃত তথ্য – Ecology, Ecosystem, Evolution
সাঈদী তার বক্তব্যে বললেন, মশা থাকার কারণ হচ্ছে মশার কয়েল আর মশারি বানানোর কোম্পানিগুলোতে অনেক অনেক মানুষের কর্মসংস্থান করা। আচ্ছা? তাহলে মশারি আর কয়েল বানানোর প্রায় ১০০ মিলিয়ন বছর আগে থেকে মশা কেন আছে, কে জানে!
৭৯ মিলিয়ন বছর আগের ফসিল পাওয়া গেছে [৭]। ধারণা করা হচ্ছে, মশার বিস্তার আরো আগে, এখনকার চেয়ে প্রায় ২২৬ মিলিয়ন বছর আগে। আর প্রথম কয়েলের ধারণা পাওয়া গেলো ১৮৯০ সালে [৮]।
যা-ই হোক, “কেন”-এর উত্তর কেউ সঠিকভাবে দিতে পারবে না, কারণ কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে প্রকৃতি কাজ করে না। এখন ওরা যে উদ্দেশ্যগুলো পূরণ করছে, তার ধারণা পাওয়া যায় ইকোসিস্টেম বা বাস্তুসংস্থানের কাছ থেকে।
তবে যেটা আমরা আসলেই খুঁজে বের করতে পারি, যেটার উত্তর আমরা দিতে পারি, তা হলো – “কীভাবে”।
মশার উৎপত্তি আর বিবর্তনের ব্যাপারটা হয়তো কর্মসংস্থান ব্যাখ্যার মত অত সহজ না। একই ভাবে সাপের উৎপত্তি আর বিবর্তনের ব্যাপারটা হয়তো মানুষের উপকারের জন্য ওষুধ আর ব্যাগের ব্যাখ্যার মত এক লাইনে বলে দেয়া যায় না। কিন্তু পড়াশোনা [৭, ৯] করতে দোষ কী?
সিদ্ধান্ত
আমরা শুধু দুটো ভিডিও নিয়ে কাজ করেছি। আরো ভিডিও খুঁজলে এমন আরো অনেক ভুল তথ্য পাওয়াটা খুব কঠিন কিছু হবে না। এই প্রবন্ধে সাঈদীর ধর্ম সংক্রান্ত দাবিদাওয়া নিয়ে কোনো ভুল ধরা হয়নি, তার প্রদত্ত বৈজ্ঞানিক তথ্যের ভুল ধরা হয়েছে। আমরা বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করি, তাই আমরা তাকে বিজ্ঞান দিয়েই মাপার চেষ্টা করেছি। যদি এইসব বিষয়ে বলা না হতো, তাহলে আমাদেরও ভুল ধরিয়ে দেয়ার দরকার পড়তো না। এবং আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, সাঈদী “আল্লামা” নন, তার মধ্যে জ্ঞানের কোনো ছিঁটেফোঁটাও নেই। মনগড়া বানোয়াট কাহিনী বলার মধ্যে কোনো জ্ঞান প্রকাশ পায় না। সে-ই জ্ঞানী, যে নিজের অজ্ঞানতার ব্যাপারে সচেতন।
সমাপ্তি ও করণীয়
একটা গ্রামে কেউ ইংরেজি জানতো না। একজন শুধু “টুইংকল টুইংকল লিটল স্টার” লাইনটা জানে। তাই গ্রামের বাকি সবাই ওর ইংরেজির খুব প্রশংসা করে। যে যাই বলুক, ওর উত্তর একটাই – “টুইংকল টুইংকল লিটল স্টার”। কেউ তাকে শুদ্ধ করবে কী করে? ওরা নিজেরাই তো জানে না। সাঈদীর ওয়াজে দর্শকদের দেখলে এটাই মনে পড়ে যায়। যারা এসব ভাষণ শুনে তাকে বাহবা দিচ্ছেন, যারা তার কথায় সুবহানাল্লাহ বলে ওখানে চিৎকার দিয়েছেন, তাদের সবার প্রতি অনুরোধ –
১) পড়াশোনা করুন, জানার চেষ্টা করুন। তাহলে নিজের মনগড়া বিজ্ঞান আর মিথ্যে তথ্য দিয়ে সাঈদীর মত লোকেরা আপনাদের মগজ ধোলাই করতে পারবে না।
২) স্কুল বা কলেজে যখন বিজ্ঞান পড়বেন, তখন শুধু পরীক্ষায় পাশের জন্য না পড়ে বিজ্ঞানমনষ্ক হওয়ার জন্য পড়ুন। ধরে নিচ্ছি, এই লেখার বেশিরভাগ পাঠকই স্কুল বা কলেজের গণ্ডি পার করে এসেছেন। সেক্ষেত্রে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে সেই অনুরোধ করুন। ওদেরকে বিজ্ঞানমনস্ক করে তোলার দায়িত্ব আমাদের।
৩) যেখানেই ভুল তথ্য দেখবেন, সেখানেই “ভুয়া” বলে চিৎকার করে ওঠার মত সৎ সাহস রাখুন। ভুল তথ্যকে এভাবে গণহারে বিলানো বন্ধ করতে না পারলে, এই মিথ্যা তথ্য সরবরাহকারীদের গ্রহণযোগ্যতা শূন্যে নামিয়ে আনতে না পারলে, সত্যের জয়গান ধামাচাপা পড়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত সত্য কখনো চাপা থাকে না। তবে যাতে না থাকে, সেই দায়িত্ব আমাদের। এই বিষয়ে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলন শুরু করতে হবে আমাদেরকেই।
জয় হোক জ্ঞানের। জয় হোক বিজ্ঞানের। চলুক বিজ্ঞানের পথে এই জয়যাত্রা।
#বিজ্ঞানযাত্রা_চলবে।
তথ্যসূত্রসমূহ –
[১] সাঈদীর ওয়াজ ১ – https://www.youtube.com/
[২] http://www.telegraph.co.uk/
[৩] http://www.seaworld.org/
[৪] http://
[৫] http://en.wikipedia.org/wiki/
[৬] সাঈদীর ওয়াজ ২ – https://www.youtube.com/
[৭] https://en.wikipedia.org/wiki/
“যেখানেই ভুল তথ্য দেখবেন, সেখানেই “ভুয়া” বলে চিৎকার করে ওঠার মত সৎ সাহস রাখুন। ভুল তথ্যকে এভাবে গণহারে বিলানো বন্ধ করতে না পারলে, এই মিথ্যা তথ্য সরবরাহকারীদের গ্রহণযোগ্যতা শূন্যে নামিয়ে আনতে না পারলে, সত্যের জয়গান ধামাচাপা পড়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত সত্য কখনো চাপা থাকে না। তবে যাতে না থাকে, সেই দায়িত্ব আমাদের। এই বিষয়ে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলন শুরু করতে হবে আমাদেরকেই।” বাম কানে বাম হাতচাপা দিয়ে ডান হাত প্রসারিত করে মধুর স্বরে লম্বা একটা টান খিচ্ছা ভুলভাব যা বলে ওতে আমরা যেন ‘ছুবাহানাল্লা’ না বলি। ছুবাহানাল্লা বলার পরিবর্তে আমরা যেন চিৎকার করে বলতে পারি ‘ঐ মিয়া তুমি যা বলছ… আরো পড়ুন