অনেকের ধারণা ভূ-তত্ত্ববিদ, বিশেষত, ভূ-প্রত্নতত্ববিদদের (Geo-archaeologist) কাজ খুব রোমাঞ্চকর। তারা ফুল টাইম ব্যস্ত থাকেন ছুঁচোর মতো মাটিতে গর্ত খুঁড়ে প্রাচীন সব ফসিল খুঁজে পাবার আশায়। আর পার্ট টাইম ব্যস্ত থাকেন সেই সব ফসিল যারা চুরি করতে চায়, তাদের চাবুক মেরে পশ্চাদ্দেশ ঘা করে দিতে।
কিন্তু সত্যটা হলো, ভূ-প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাজ চাবুক মারা কিংবা বন্দুক হতে গুলি ছোঁড়াছুঁড়ি করার চাইতেও আরো বেশী রোমাঞ্চকর। অন্তত একটা ফসিল মাটির নিচে খুঁজে বের করতে পারার আগ পর্যন্ত। ফসিল পেলেই তখন রোমাঞ্চের বদলে মাথায় ভর করবে একরাশ চিন্তা। শুরু হবে যুক্তি-পাল্টা যুক্তির খেলা। সাথে এক মুঠ ভৌগলিক জ্ঞান………আর এক চিমটি গণিত। হ্যাঁ, ‘ইন্ডিয়ানা জোনস’ কিংবা ‘টুম্ব রেইডার’ মুভিগুলোতে সবকিছু দেখালেও আসল যে জিনিসটা দেখায়নি, তা হলো- প্রত্নতাত্ত্বিক হতে গেলেও গণিত বেশ ভালোমতোই জানা লাগে! আসুন দেখি সেটা কীভাবে?
ধরুন, আপনার বাসার পেছনে বাগানে মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে অনেক নিচে গিয়ে একটা ডাইনোসরের ফসিল খুঁজে পেলেন। এখন আপনি কীভাবে বের করবেন ফসিলটা কত বছর আগের? নিচে আমরা দুটো ক্লু ধরে ব্যাপারটা নির্ণয়ের চেষ্টা করবো।
ক্লু-০১ঃ শিলাস্তরের গঠন
প্রথম ক্লু হচ্ছে- যেই স্তরে গিয়ে ফসিলটা পেয়েছেন, সেই স্তরের শিলার গঠন। এই শিলাস্তরের গঠনের ভিত্তিতে বিজ্ঞানীরা প্রাথমিকভাবে ধারণা করে নেন ফসিলটা কত বছর আগের হতে পারে। আমাদের পৃথিবীর এই শিলাস্তর হচ্ছে আসলে একটা স্মৃতিময় অ্যালবাম। মাটি খুঁড়ে একটার পর একটা স্তরে যাওয়া, আর বাসার পুরাতন ফটো অ্যালবামে পাতার পর পাতা ওল্টানো একই জিনিস। বিজ্ঞানীরা এই হাজারে হাজারে মাটি ও শিলার স্তরকে কয়েকটা প্রধান শ্রেণীতে ভাগ করেছেন। এই সবগুলো স্তরের মধ্যে ‘সবচেয়ে সাম্প্রতিক তিনটা স্তর’ হলো- Paleozoic, Mesozoic, and Cenozoic স্তর। সাম্প্রতিক বা সর্বশেষ সময়ের দিকের হলেও এই তিনটা শিলাস্তর ধরেই আপনি স্মৃতির পাতা হাতড়ে ৫০০ মিলিয়ন বছর আগের পৃথিবীতে চলে যেতে পারবেন (পৃথিবীর মোট বয়স সাড়ে চার বিলিয়ন বছর)!
উপরের ছবিটায় দেখুন। তিনটা স্তরের মাঝে সবচেয়ে নিচে আছে Paleozoic স্তর। তার মানে এই উল্লেখিত তিনটা ‘সাম্প্রতিককালের’ স্তরের মধ্যে Paleozoic স্তরটা সবচেয়ে পুরনো। ওটা ধরেই আপনি ৫০০ মিলিয়ন বছর আগের পৃথিবীতে টাইম ট্রাভেল করে চলে যেতে পারবেন (মনে মনে)! আপনি কোনোভাবে ঐ স্তরে পৌঁছাতে পারলে যেসব ফসিল খুঁজে পাবেন, সেগুলো হলো- সরীসৃপ, উভচর, মাছ এবং অমেরুদণ্ডী প্রাণী। এই স্তরে পাবেন না কোনো ডাইনোসর। কারণ ডাইনোসরেরা তখনো আসেনি পৃথিবীতে। ডাইনোসরদের পাবেন Mesozoic স্তরে। এই স্তর হলো ২৫০ মিলিয়ন বছরের পুরনো। তার মানে বলা যায় ডাইনোসররা এসেছিলো প্রায় ২৫০ মিলিয়ন বছর আগে। এই স্তরে কোনো স্তন্যপায়ী প্রাণী খুঁজে পাবেন না। তাদের পাবেন সবচেয়ে উপরের স্তরে, যেটার নাম Cenozoic স্তর। আমরা এখন এই স্তরের উপরেই বাস করছি। এই স্তরের বয়স মাত্র ৬৫ মিলিয়ন বছর।
কুইজ ০১- প্রথম স্তন্যপায়ী প্রাণী এসেছিলো কত বছর আগে, ছবি দেখে বলুন তো তাহলে?
যাই হোক, উপরের ছবিতে বাঁ পাশের নিচের দিক হতে শুরু করে উপরে যেতে যেতে দেখতে পাবেন আমাদের পৃথিবীর স্মৃতিময় অ্যালবাম। সেখানে দেখানো হয়েছে কীভাবে এক স্তরের উপরে আরেক স্তরের শিলা তৈরি হয়েছে। কীভাবে পৃথিবী তার সন্তানদের সাথে সাথে নিজেও বিবর্তিত হয়েছে সময়ের স্রোত ধরে।
ক্লু-০২ঃ কার্বন ডেটিং
ফসিলের বয়স বের করার দ্বিতীয় ক্লু হলো- কার্বন ডেটিং পদ্ধতি। সাধারণ কার্বনকে ডাকা হয় কার্বন-১২ বলে। আর কার্বন-১২ এর আইসোটোপ হলো কার্বন-১৪। এই কার্বন-১৪ হলো তেজস্ক্রিয় পদার্থ। কার্বন-১৪ তৈরি হয় সবচেয়ে বেশী আমাদের বায়ুমণ্ডলে। মাত্র ৯-১৫ কিঃমিঃ উপরের বায়ুমণ্ডলেই তৈরি হয় এই কার্বন-১৪ নামক তেজস্ক্রিয় পদার্থ। আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই তেজস্ক্রিয় কার্বন বায়ুমণ্ডলে ঠিক যতটা ঘনত্বে আছে, আমাদের শরীরেও ঠিক সেই একই ঘনত্বে আছে। মানে আমাদের শরীরে কার্বন-১২ তো আছেই, সেই সাথে কার্বন-১৪ ও আছে।
এবার সবাই একটু মনোযোগ দিয়ে পড়ুন। আমরা যখন মারা যাই, তখন আমাদের শরীরে কার্বন-১২ এর মাত্রা স্থির থাকে। কিন্তু কার্বন-১৪ এর মাত্রা সময়ের সাথে ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে। কারণ সেটা তেজস্ক্রিয়। আর তেজস্ক্রিয় পদার্থের ক্ষেত্রে ‘অর্ধায়ু (Half-life)’ নামক একটা শব্দ প্রযোজ্য। এটার মানে হলো একটা নির্দিষ্ট সময়ে কোনো তেজস্ক্রিয় পদার্থ কমে গিয়ে পরিমাণে ঠিক অর্ধেক হয়ে যাওয়া। একেক তেজস্ক্রিয় পদার্থের ক্ষেত্রে হাফ-লাইফের মেয়াদ একেক রকম। কার্বন-১৪ এর ক্ষেত্রে হাফ-লাইফ হলো ৫৭০০ বছর। তার মানে ৫৭০০ বছরে কার্বন-১৪ বিকিরিত হতে হতে ঠিক অর্ধেক পরিমাণে গিয়ে দাঁড়াবে।
আমরা যখন মারা যাই, তখন কার্বন-১২ এবং কার্বন-১৪ সমান অনুপাতে থাকে। কিন্তু পরে কার্বন-১৪ ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে। আর কার্বন-১২ তার আগের পরিমাণেই স্থির থাকে। আপনি যদি কোনো ফসিলে এই কার্বন-১২ ও কার্বন-১৪ এর অনুপাত বের করে ফেলতে পারেন, তবে আপনি ফসিলটার বয়স জেনে যাবেন। এর জন্যে একটা সূত্র আছে। সেটা হলো-
t = [ ln (Nf/No) / (-0.693) ] x t1/2,
এখানে,
ln = Natural logarithm
Nf/No = Percentage of Carbon-14
t1/2 = Half-life of Carbon-14 = 5700 yrs
এখন ধরুন আপনি একটা ফসিল পেলেন যেটায় কার্বন-১৪ আছে ১০%। তাহলে ঐ ফসিলের বয়স হবে-
t = [ ln (0.10) / (-0.693) ] x 5,700 years
t = [ (-2.303) / (-0.693) ] x 5,700 years
t = [ 3.323 ] x 5,700 years
t = 18,940 years old
অর্থাৎ ১৮,৯৪০ বছরের পুরনো সেই ফসিল!
কুইজ ০২- কার্বন-১৪ এর পরিমাণ ৫% হলে ফসিলের বয়স কত?
——————————————————————————-
তথ্যসূত্রঃ
১। https://en.wikipedia.org/wiki/Geologic_time_scale
২। http://www.prehistoricplanet.com/news/index.php?id=48
৩। http://science.howstuffworks.com/environmental/earth/geology/carbon-142.htm