আলোচনাটা সমাজবিজ্ঞানের একদম বেসিক একটা টপিক দিয়েই শুরু করছি – বিচ্যুতি ও অপরাধ। সমাজতত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে খুব সহজভাবে বিচ্যুতি’র সংজ্ঞায়ন করা যায় না। একদম সাদামাটাভাবে বললে বলা যায়- জন্মগতভাবেই মানুষ সামাজিক জীব। সমাজের কিছু নিয়ম-কানুন মেনেই মানুষকে সমাজে টিকে থাকতে হয়। কিন্তু কখনো কখনো মানুষ নিয়ম বহির্ভূত আচরণ করে ফলে, সেটাই বিচ্যুতি (Deviance)। অপরাধ আর বিচ্যুতি কিন্তু এক জিনিস নয়। মনে রাখতে হবে যে, সকল অপরাধ-ই বিচ্যুতি। কিন্তু সকল বিচ্যুতি-ই অপরাধ নয়।
আমরা অনেক সময়ই অনেক নিয়ম মেনে চলি না। অথচ এই আমরাই কিন্তু সমাজে নিয়ম সৃষ্টিকারী, নিয়ম ভঙ্গকারী, নিয়ম অনুসরণকারী। চলুন এবার একটা উদাহরণ দিই-
ধরা যাক, একটি রাস্তায় গাড়ি চালানোর সর্বোচ্চ গতিসীমা ঘণ্টায় ৭০ কিলোমিটার। কিন্তু রাস্তা ভালো দেখে ড্রাইভার ৮০ কিলোমিটার স্পিডে চালালো। এটা ট্রাফিক আইন লংঘন। সেক্ষেত্রে এটা অপরাধ এবং বিচ্যুতি দুটোই। অন্যদিকে, আমরা মাঝে মাঝেই জেব্রা ক্রসিং ছাড়াই রাস্তা পার হই, এটা শুধু বিচ্যুতি।
বিচ্যুতির ধারণা অত্যন্ত ব্যাপক। এক্ষেত্রে একটা বাস্তব উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে-
টেন্ড বুন্ডি (Ted Bundy), সাধারণ দৃষ্টিতে একজন সুনাগরিক। তিনি অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপন করতেন। তা শুধু সাধারণই নয়, মূল্যবানও বটে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সামারিটানস (samaritans) সংস্থায় তাঁর সক্রিয় ভূমিকা ছিলো। যাঁরা দুঃখ কষ্টে থাকেন বা আত্মহত্যা করতে আগ্রহী তাঁদের রক্ষা করতে তিনি চব্বিশ ঘণ্টা ধরেই দূরভাষে সেবা দিতেন। কিন্তু এত গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক কাজ সত্ত্বেও, তিনি গোপনে অনেকগুলো হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেন। তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পরে প্রধান বিচারপতি বুন্ডি’র প্রশংসা করেন যে, কিভাবে তিনি তাঁর জীবনকে নষ্ট করেছেন। বুন্ডি স্বাভাবিক জীবনযাপন করলেও ভেতরে ভেতরে ছিলেন চরম বিচ্যুতিতে নিয়োজিত।
অন্যদিকে বলা যায়, যে সমস্ত বিচ্যুতিমূলক আচরণের জন্য সমাজে আইনগত শাস্তির বিধান রয়েছে, সেগুলোকেই অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।
অপরাধ ও বিচ্যুতি’র তত্ত্ব
- জীববিদ্যামূলক তত্ত্ব
ইতালীয় অপরাধবিজ্ঞানী Cesare Lombroso ১৮৭০ এর দশকে বিশ্বাস করতেন যে অপরাধের প্রকারভেদকে মাথার খুলির আয়তনের ভিত্তিতে চিহ্নিত করা যায়। তিনি অপরাধের পেছনে বংশগত কারণকে দায়ী করতেন। সামাজিক শিক্ষা দ্বারাও যাবতীয় অপরাধ সংঘটিত হতে পারে বলে মনে করতেন। এই মতামত অনুযায়ী বাবা-মা অপরাধী হলে তাঁদের সন্তানও অপরাধী হতে পারে। কিন্তু সমাজবিজ্ঞান মহলে এই তত্ত্বটি সম্পূর্ণভাবে গৃহীত না হলেও একেবারে মূল্যহীন হয়ে পড়ে থাকেনি।
এই তত্ত্বকে আরো বিকশিত করে পরবর্তীতে মানুষের শরীরের বিভিন্ন ধরনের বিভাজন করে অপরাধের ধরন বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন, বলা হয় যে পেশীবহুল অর্থাৎ শক্ত-সামর্থ্য লোকেরা রোগা শরীরের মানুষ অপেক্ষা বেশি অপরাধ সংঘটিত করে থাকে। অর্থাৎ যাদের শরীর বেশ শক্তপোক্ত, তাঁরা শরীরকে কাজে লাগিয়ে নানা ধরনের অপরাধ কর্ম সংঘটিত করে থাকে। এটিও সমাজবিজ্ঞান মহলে নানা ধরনের সমালোচনার সম্মুখীন হয়।
- মনোবিদ্যাগত তত্ত্ব
জীববিদ্যাগত তত্ত্ব’র মতোও এখানে বলা হয় যে, অপরাধ কতগুলো নির্দিষ্ট ব্যক্তির উপর নির্ভরশীল। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, কিছু মানুষের মধ্যে অনৈতিক মনোবিকারমূলক ব্যক্তিত্ব বিকশিত হয়। এরা এক ধরনের মানসিক রোগী। এবং এই মানসিক রোগীরাই নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত করে থাকে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, কয়েদীদের এমন কিছু মানসিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যেগুলো ত্রুটিপূর্ণ। অর্থাৎ সমাজের অন্য মানুষগুলোর মতো এরা স্রোতের অনুকূলে চলেনি।
এ দুটো ছাড়াও অপরাধ আর বিচ্যুতি নিয়ে নানা ধরনের তত্ত্ব প্রদান করেছেন সমাজবিজ্ঞানীরা।
এবার আসি শাস্তির ব্যপারটাতে।
কারাগার ও শাস্তিদণ্ড
অপরাধীর অপরাধ প্রমাণিত হলে তাকে কারাগারে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রেরণ করা হয়। ঊনিশ শতকের প্রথম ভাগে অপরাধীকে শাস্তি দেয়ার জন্য কারাগারের ব্যবহার ছিলো অত্যন্ত কম। ঊনিশ শতক পর্যন্ত অপরাধীদের শাস্তির ধরন ছিলো বেত্রাঘাত করা, বেড়ি পরানো, গরম লোহার ছেঁকা দেওয়া, ফাঁসি দেওয়া। এবং এগুলো করা হতো জনসম্মুখেই। বর্তমান প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ আলাদা। এখন অন্যায়কারীদের শাস্তি দিয়ে জেলখানায় প্রেরণ করা হয়। এই জেলব্যবস্থার অন্তর্নিহিত অর্থ হলো “ব্যক্তি যাতে সমাজে যথাযথ ও সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারে, সেজন্য তার উন্নতি ঘটানো।” কিন্তু এখন সত্যিই কি জেলখানায় সেটা হয়? আমাদের বাংলাদেশের জেলখানাগুলোর দিকে তাকালেই সেই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া সম্ভব। কারাগার থেকে অপরাধী “অপরাধ না করার মানসিকতা” নিয়ে বের হতে পারে কি?
কারাগারের বিকল্প:
কারাগার যখন একজন অপরাধীকে শুদ্ধ করতেই পারে না, তার ভিতরের অপরাধ প্রবণতাকে ধ্বংস করতে পারে না, সেক্ষেত্রে কারাগারের প্রয়োজনীয়তা আছে কি? সুতরাং, অপরাধীকে মোকাবিলা করার জন্য আমরা এর বিকল্প ভাববো না? হ্যাঁ, বিশ্বের অনেক দেশেই এর বিকল্প ব্যবস্থা শুরু হয়ে গেছে।
একটি হলো বিকল্প হলো, লোকসমাজের মধ্যে অপরাধীকে পর্যবেক্ষণে রাখা- Probation, Parole আর Bail Supervision ব্যবস্থা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কোন সময়ে একসাথে অনেক লোকের সাজা হলে তাঁদেরকে জেলের বদলে probation বা parole-এ পাঠানো হয়।
মৃত্যুদণ্ডঃ
অপরাধের মাত্রা বেশি হলে অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু বিশ্বের সকলে দেশেই কিন্তু ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় না। একেক দেশে একেকভাবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়ে থাকে। এখন তেমন কিছু মৃত্যুদণ্ডের ধরন উল্লেখ করছি-
বৈদ্যুতিক শক্তি প্রয়োগ করে
কার্যকরণ- প্রথমে আসামীকে চেয়ারে বসানো হয়। তারপর তার মাথায় ও পায়ে বৈদ্যুতিক সংযোগ দেওয়া হয় এবং ১৫০০-২০০০ ভোল্ট বিদ্যুত তার দেহের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
প্রচলন- ১২ টি মার্কিন প্রদেশে
শিরশ্ছেদ
কার্যকরণ- তলোয়ার দিয়ে মাথাটা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। প্রয়োজনে একাধিকবার কোপ দিয়ে শিরশ্ছেদ করা হয়।
প্রচলন- সৌদি আরব
গ্যাস চেম্বার
কার্যকরণ- আসামীর চেয়ারের তলায় সালফিউরিক এসিডের পাত্রে সায়নাইডের ক্ষুদ্র বড়ি ফেলে দেওয়া হয়। ঘরটি বিষাক্ত গ্যাসে ভর্তি হয়ে যায় এবং সেই সাথে দমবন্ধ হয়ে মারা যায়।
প্রচলন- তিনটি মার্কিন প্রদেশে (এরিজোনা, ক্যালিফোর্নিয়া, মিসৌরি) এটাই মুখ্য, আর দুটাতে (ওয়াইওমিং আর ওকলাহোমা-তে) গৌণ। পাশাপাশি উত্তর কোরিয়াতে চালু আছে।
ইনজেকশান
কার্যকরণ- বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ আসামীর দেহে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়। বহু প্রদেশে এনাস্থেসিয়া ব্যবহার করে কয়েদীকে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হয়; তারপর ফুসফুস ও হৃৎপিণ্ড বন্ধ করে মৃত্যু ঘটানো হয়।
প্রচলন- ৩৮ টি মার্কিন প্রদেশে
ফাঁসি
কার্যকরণ- গলার চারদিকে দড়ি দিয়ে বেঁধে আসামীকে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। দেহের ভারে গলায় ফাঁস লেগে মৃত্যু হয়।
প্রচলন- বাংলাদেশ, ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান, জ্যামাইকা, জাপান, মালয়েশিয়া, ভারত
পাথর ছোঁড়া
কার্যকরণ- জনগনকে পাথর ছোঁড়ার জন্য আমন্ত্রণ করা হয়। কিন্তু পাথর বাছাইয়ের ক্ষেত্রে খুব ছোট (কার্যকর হয় না), কিংবা খুব বড় (প্রথম আঘাতেই মারা যেতে পারে) পাথর কার্যকর হয় না।
প্রচলন- ইরান
গুলি করে হত্যা
কার্যকরণ- আসামীকে চেয়ারে বসিয়ে, বেঁধে, বোরখা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। তার বুকে তাক করে বন্দুক হাতে পাঁচজন দাঁড়িয়ে থাকে। যে কোনো একজন গুলি করে।
প্রচলন- নাইজেরিয়া, তাইওয়ান, ২ টি মার্কিন প্রদেশ।
বিচ্যুতি ও অপরাধ, সমাজবিজ্ঞানে এত বড় আলোচনার বিষয় যে শুধুমাত্র একটি পোস্টে সেটির সম্পূর্ণ আলোচনা প্রায় অসম্ভব। আর তাই আরো অনেক মজার ও দরকারি আলোচনা আজকের মতো না বলেই সমাপ্ত করতে হচ্ছে। যেমন- পুরুষ ধর্ষণ, বিত্তশালীদের অপরাধ, অপরাধের শিকার কারা হয়? লিঙ্গ ও অপরাধ- কারা বেশি অপরাধ করে? নারী না পুরুষ? কেন করে? অপরাধমুক্ত সমাজ কি আসলেই সম্ভব?
তথ্যসূত্রসমূহঃ
Giddens, Anthoy, 2011. Sociology. 5th ed. Cambridge: Polity press.
H, Stephen, E, peter 1992. A sociology of crime. 1st ed. London: Routledge
Lethal Injection, Gas Chamber, Capital Punishment.
সুখপাঠ্য চমৎকার একটি আর্টিকেল। অপরাধ ও বিচ্যুতির পার্থক্য ও মৃত্যুদন্ডের বিভিন্ন পদ্ধতি দারুন উপভোগ করেছি। পরেরটার অপেক্ষায় রইলাম।
ধন্যবাদ। আরো ভালো কিছু দেওয়ার চেষ্টা নিশ্চয়ই অব্যাহত রাখবো।
অসাধারণ লেখা ! এতদিন এই প্রতিভা লুকিয়ে রাখছিলেন ক্যামনে?!!?
আলোচনা খুব বেশী ছড়িয়ে না দিয়ে পিনপয়েন্টেড কয়েকটা দিকে ইন-ডেপথ আলোচনা করলে উপকার হবে।
অপরাধের সঙ্গাটা আমার কাছে ক্লিয়ার হলো না। অপরাধকে চিহ্নিত/সঙ্গায়িত করতে আইনকে টেনে আনলে মনে হয় ঝামেলা হয়ে যাচ্ছে। আইনপ্রণেতারাও তো অপরাধপ্রবণ হতে পারে। কোন একটা অকাজ করার উদ্দেশ্যে বা কোন বদমাশকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে আইন প্রণীত হতে পারে। দেশে তো একসময় এমন আইনও ছিলো যে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচার করা যাবে না। আবার ধরুন, আইসিটি এক্ট। এই আইন এমন অনেককেই অপরাধী বলছে যাদেরকে আমরা অনেকেই আদৌ অপরাধী ভাবি না। সুতরাং ‘নৈতিকতা’ বিবেচনা না করে ‘আইন’কে মানদন্ড ধরে অপরাধ চিহ্নিত করলে সেটা কি একটা বড়রকমের বিচ্যুতি হবে না?
আইনের বাহিরে থেকে আপনি কিভাবে অপরাধকে সংজ্ঞায়িত করবেন? প্রতিটা দেশেরই কিছু নিয়ম কানুন আছে, সংবিধান আছে, আইন আছে। এগুলোর বাহিরে যেতে হলে আপনাকে এই চেইনটা ভেঙ্গে ফেলতে হবে। শুধুমাত্র নৈতিকতাকে মানদণ্ড হিসেবে ধরে অপরাধের সংজ্ঞায়ন ও বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। অপরাধের ধরণ দেশ ও অঞ্চল ভেদে আলাদা হয়। এই যেমন ধরুণ, আমাদের দেশে প্রকাশে্য মদ্যপান করা অপরাধ এবং নৈতিকতা বিরোধীও বটে , কিন্তু অনেক দেশেই কিন্তু মদ একটি সাধারণ পানীয়, এবং আইনসিদ্ধও। সেক্ষেত্রে এক দেশে যেটা অপরাধ, অন্যদেশে সেটা বৈধ।
দারুণ পোস্ট। সারাদিন সায়েন্স আর হাবল টেলিস্কোপ দেখতে দেখতে সমাজতত্ত্ব নিয়ে পোস্ট পড়ে স্বাদবদল হলো।
ধন্যবাদ ভাইয়া। স্বাদবদল করে দেওয়ার মত রসদ দিতে পেরেছি শুনে ভালো লাগলো।
Wsm
good