কলেরাঃ মন্দ বায়ু থেকে দূষিত জল
টিকা আবিষ্কারের কাহিনী বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় জীবাণুর কথা। রোগসৃষ্টির কারণ হিসেবে জীবাণুর অন্তর্ভুক্তিকে বলা হয় জীবাণুতত্ত্ব। জীবাণুতত্ত্বের প্রকাশ ঘটেছে খুব বেশিদিন হয়নি। মনে করা হয় লুই পাস্তুরের সময়কাল থেকে মানুষ জীবাণুর মাধ্যমে প্রাণী থেকে প্রাণীতে রোগ সঞ্চারণের বিষয়টি বুঝতে শেখে। মধ্যযুগ থেকেই মানুষের মনে একটা বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে বিষাক্ত গ্যাস বা বাষ্প থেকে সংক্রামক রোগের উৎপত্তি ও বিস্তৃতি ঘটে। ১৮ শতক পর্যন্ত এই প্রত্যয় মানুষের মনে এমনভাবে গেঁথে গিয়েছিল যে কেউই এই কুসংস্কারের বাইরে গিয়ে সংক্রামক রোগগুলোকে বিজ্ঞানভিত্তিক উপায়ে বিচার-বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেনি। ম্যালেরিয়া রোগটির নামকরণও করা হয়েছিল এই নষ্ট বা দূষিত বায়ুর ধারণা থেকে; ইতালীয় ভাষায় mala অর্থ খারাপ এবং aria অর্থ বায়ু, অর্থাৎ ম্যালেরিয়াকে খারাপ বায়ুর প্রভাবে সৃষ্ট রোগ বলে মনে করা হতো। এখন আমরা জানি, ম্যালেরিয়া হয় প্লাজমোডিয়াম গণের অন্তর্ভূক্ত কয়েক প্রজাতির পরজীবীর দ্বারা এবং সঞ্চারিত হয় অ্যানোফেলিস মশার মাধ্যমে। ম্যালেরিয়া ছাড়াও ক্লামাইডিয়া (এক প্রকার যৌন রোগ), প্লেগ, কলেরা ইত্যাদি সংক্রামক রোগগুলো মন্দ বায়ুর কারণে হয় বলে মনে করা হতো। তৎকালীন অনেক পন্ডিত ব্যক্তি ও চিকিৎসক এই ধারণাকে অমূলক বলে দাবী করেন। ব্রিটিশ চিকিৎসক জন স্নো ছিলেন তাঁদের একজন। ১৮৫৪ সালে লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টরের সোহোতে কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে বিষয়টি অনুসন্ধানের দায়িত্ব গিয়ে পড়ে জন স্নো-এর ওপরে। বিস্তারিত গবেষণা শেষে তিনি এর কারণ হিসেবে নগরীর একটি খাবার পানি সরবরাহের নলকে দায়ী করেন। তিনি নগরকর্তাকে উক্ত নলের উৎস বন্ধ করে দেয়ার অনুরোধ জানান। উৎসটি বন্ধ করে দেয়ার পর কলেরার প্রকোপও ধীরে ধীরে কমে আসতে থাকে। স্নো-এর এই গবেষণাটিই আধুনিক ‘মহামারী-সংক্রান্ত বিদ্যা’ বা ‘এপিডেমিওলজির’ (Epidemiology) সূচনা করেছিল বলে ধরা হয়। তাছাড়া প্রাচীন একটা কুসংস্কারকে হটিয়ে সংক্রামক রোগকে বিজ্ঞানভিত্তিক দৃষ্টিতে দেখার পথও খুলে দিয়েছিলেন তিনি। উল্লেখ্য যে ১৮৮৪ সালে প্রথম কলেরার টিকা আবিষ্কার হয়। এর আগে পর্যন্ত নাগরিক সচেতনতা ও সাবধানতাই ছিল একমাত্র প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা।
বিচক্ষণ জেনার
ইতিহাসের প্রথম টিকা আবিষ্কারের কৃতিত্ব দেয়া হয় ব্রিটিশ শল্য-চিকিৎসক ডা. এডওয়ার্ড জেনারকে। সতের শতকের শেষভাগে তিনি লক্ষ করেন, গো-বসন্তে আক্রান্ত গোয়ালিনীদের গুটিবসন্ত হয় না। গো-বসন্ত আর গুটিবসন্তের মধ্যে বিশেষ কোন পার্থক্য নেই। গোয়ালিনীরা যখন গাভীর দুধ দোহন করতেন তখন দুধের বাঁট থেকে ভাইরাস তাদের হাতে গিয়ে ফুসকুড়ির মতো ছোট ছোট ক্ষতের সৃষ্টি করত। তিনি চিন্তা করলেন, গোয়ালিনীরা নিশ্চয়ই তাদের শরীরে গুটিবসন্তের বিরুদ্ধে এমন এক প্রতিরোধব্যবস্থা গড়ে তুলেছে যা তাদেরকে এই ভয়ানক সংক্রমণ থেকে রক্ষা করছে। এখানে উল্লেখ করা জরুরী যে তীব্রতার দিক থেকে গো-বসন্ত গুটিবসন্তের থেকে কম শক্তিশালী। ১৭৯৬ সালে তিনি একজন গোয়ালিনীর হাতের ক্ষত থেকে গো-বসন্তের জীবাণু নিয়ে আট বছরের ছেলের দেহে প্রবেশ করান। গুটিবসন্তে বেঁচে যাওয়া কারও পরবর্তীতে আর এই রোগ হয় না- এমন কথা চীন ও ভারতবর্ষে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। এজন্য জেনার কখনই গুটিবসন্ত হয়নি এমন একজনকে তাঁর পরীক্ষার জন্য বেছে নিয়েছিলেন। গো-বসন্তের জীবাণু ছেলেটির দেহে প্রবেশ করানোর পর ছেলেটি সামান্য অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং দশদিনের মাথায় পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যায়। এরও প্রায় দুই মাস পর জেনার ছেলেটির শরীরে গুটিবসন্তের শক্তিশালী জীবাণু ঢুকিয়ে দেন। তিনি বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করেন, গুটিবসন্তের জীবাণু ছেলেটিকে সংক্রমিত করতে পারেনি। ঝুকিপূর্ণ এই পরীক্ষাটির মাধ্যমে জেনার রোগ-প্রতিরোধসম্পর্কিত তাঁর চিন্তাধারাটিকে সঠিক বলে প্রমাণ করেন। এটাই ছিল টিকার একেবারে প্রাথমিক রূপ; অর্থাৎ রোগ সৃষ্টিকারী অথচ দুর্বল একটি জীবাণু দেহে অবস্থান করলে অনুরূপ অথচ অধিক শক্তিশালী জীবাণুও সেটা দ্বারা নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি কীভাবে সংঘটিত হয় সে বিষয়ে জেনার-এর কোন ধারণা ছিল না। শুধুমাত্র বাহ্যিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তিনি সংক্রামক রোগ প্রতিরোধের মূল যে প্রক্রিয়ার কথা বলে গিয়েছিলেন তা আজও টিকে আছে। পরে শুধু এর ব্যাখ্যা ও মানব দেহের রোগ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার সাথে এর সম্পর্কটা দেখানো হয়েছে মাত্র। ইংরেজি ‘ভ্যাকসিন’ শব্দটিও এসেছে গাভী ও এর সাথে সম্পর্কিত বসন্ত ভাইরাস থেকে। গোয়ালিনীর হাত থেকে পৃথকীকৃত ভাইরাসের জীবাণুসমৃদ্ধ পুঁজটিকে ভ্যাকসিন (ল্যাটিন ‘vaccinus) বলা হয়েছিল; যদিও সেটা ছিল ইতালীয় ভাষায়। বিংশ শতাব্দীর ৫০ ও ৬০-এর দশকে গুটিবসন্ত টিকার বহুল ব্যবহারের পরও খোদ ভারতীয় উপমহাদেশেই প্রতি বছর বহু মানুষ মারা যেত এই রোগে। বিশ্বে গুটিবসন্তের শেষ যে মহামারীটা হয় সেটাও এই ভারতীয় উপমহাদেশে, ১৯৭৪ সালে। এই মহামারী তখন ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছিল; আক্রান্ত হয়েছিল প্রায় এক লাখ দশ হাজার মানুষ এবং মারা গিয়েছিল বিশ হাজার মানুষ। এরপর সেখানে টিকাদানের কর্মসূচি আরও জোরদার করে প্রায় এক কোটি মানুষকে এই কর্মসূচির আওতায় আনা হয়। ১৯৮০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পৃথিবী থেকে গুটিবসন্ত নির্মুলের ঘোষণা দেয়।
অণুজীববিজ্ঞানী পাস্তুর
১৮ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত গুটিবসন্তই ছিল একমাত্র সংক্রামক রোগ যেটাকে টিকার মাধ্যমে প্রতিহত করা যেত। আগেই বলেছি এই প্রতিরোধের মূলমূন্ত্র ছিল অনুরূপ কিন্তু অপেক্ষাকৃত কম তীব্র বসন্তের জীবাণু। প্রাকৃতিকভাবে গরুর শরীরে এই জীবাণু পাওয়া যায়। প্রকৃতিগতভাবেও এটা ছিল দুর্বল ঘরানার জীবাণু। তখনও পর্যন্ত জীবাণুকে কৃত্রিমভাবে দুর্বল বা রোগাক্রান্ত না করার উপযোগী করে প্রস্তুত করার পদ্ধতি আবিষ্কার হয়নি। প্রথম যিনি কৃত্রিম উপায়ে একটি ব্যাকটেরিয়াকে কৃত্রিমভাবে দুর্বল করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন তিনি ফরাসী রসায়নবিদ ও অণুজীববিজ্ঞানী লুই পাস্তুর। শুধু টিকার ক্ষেত্রেই না, গুটিপোকার হাত থেকে রেশমশিল্পকে রক্ষা করে ফ্রান্সের বস্ত্রশিল্পকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছিলেন তিনি। তরল দুধ জীবাণুমুক্তকরণের পদ্ধতি “পাস্তুরাইজেশনের”ও আবিষ্কারক তিনি। তাঁকে চিকিৎসা অণুজীববিদ্যার অগ্রদূত বলা হয়, কেননা তিনিই প্রথম দেখিয়েছিলেন যে আণুবীক্ষনিক জীব গাঁজন ও রোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী। ছত্রাক কৃত্রিম ও অবাত স্থানেও বংশবিস্তার করতে পারে- তাঁর এই ধারণাটি ‘পাস্তুর প্রভাব’ নামে পরিচিত। তাছাড়া দুধে বাহির থেকে অণুজীব ছেড়ে দিলে দুধ টক স্বাদযুক্ত হয় এবং কেন হয় সেটার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন তিনি। পাস্তুর ১৮৬২ সালে তাপ ও রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে সক্রিয় ব্যাকটেরিয়ার তীব্রতা কিছুটা কমিয়ে আনতে সক্ষম হন। ১৮৭৯ সালে হাঁস-মুরগির কলেরা রোগ নিয়ে গবেষণাকালে তিনি জেনার-এর অনুরূপ ফলাফল দেখতে পান। তিনি উক্ত রোগের জীবাণু প্রথমত পৃথক এবং পরে দুর্বল করে পুনরায় মুরগীর দেহে প্রবেশ করান; মুরগীগুলো রোগমুক্ত হয়। একই প্রক্রিয়া তিনি অ্যানথ্রাক্স ও জলাতঙ্ক রোগের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেলজয়ী চিকিৎসক রবার্ট কচ ১৮৭৫ সালে প্রথম অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু আবিষ্কার করেন। এদিকে অ্যানথ্রাক্সের টিকা ব্যবহার করে ১৮৮১ সালে পাস্তুর একটি ভেড়ার পালকে অ্যানথ্রাক্সমুক্ত করেন। পাস্তুর আক্রান্ত পশুর লালা পরীক্ষা করে সিদ্ধান্তে আসেন যে জলাতঙ্ক সৃষ্টিকারী ভাইরাস স্নায়ুকেন্দ্র পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। তিনি রোগাক্রান্ত পশুর মস্তিষ্কের মেডুলা অবলাঙ্গাটা সুস্থ পশুর দেহে প্রবেশ করিয়ে আক্রান্ত পশুর অনুরূপ উপসর্গ দেখতে পান। তাছাড়া আক্রান্ত পশুর শুষ্ক টিস্যুর ওপরে সময় ও তাপমাত্রার প্রভাব এবং সেখান থেকে দুর্বল বৈশিষ্টপূর্ণ ভাইরাস আলাদা করে সেগুলোকে টিকার উপাদান হিসেবে ব্যবহার করেন। পাস্তুর জলাতঙ্কের টিকা আবিষ্কার করেন ১৮৮৫ সালে। তাঁর প্রথম রোগী ছিল নয় বছর বয়সী জোসেফ মেইস্টার যাকে পাগলা কুকুর কামড়ে দিয়েছিল। ছেলেটি রোগমুক্ত হওয়ার পর পাস্তুরের খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এর দুই বছর পর সংক্রামক রোগ নিয়ে বিস্তর গবেষণার লক্ষ্যে তিনি প্যারিসে ‘পাস্তুর ইনস্টিটিউট’ গড়ে তোলেন। প্রতিষ্ঠানটি এখনও বেশ সুনামের সাথে সংক্রামক রোগ সংক্রান্ত বিষয়াদি নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছে। ১৯৮৩ সালে এখানেই প্রথম সফলভাবে এইচ-আই-ভি ভাইরাস পৃথক করা হয়। এখন পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠান থেকে দশজন বিজ্ঞানী মেডিসিন ও ফিজিওলজিতে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
শেষ কথা
পৃথিবী হচ্ছে জীবাণুর আঁতুড়ঘর। মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীকে এইসকল জীবাণুর সাথে লড়াই করে টিকে থাকতে হয়। সেজন্য চাই উপযুক্ত পরিবেশ ও প্রস্তুতি। টিকা ছিল এই প্রস্তুতির প্রথম ধাপ। পরবর্তীতে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, পরজীবী, ছত্রাক ইত্যাদির জন্য আরও বিস্তৃত পরিসরে ঔষধ আবিষ্কৃত হয়েছে, যদিও কার্যপ্রণালী ও উপযোগিতাসহ অনেককিছুতেই আছে বিস্তর তফাৎ। টিকা যেরূপ আমাদের আজীবন বা দীর্ঘস্থায়ী একটা সমাধান দেয়, এইসকল ঔষধ থেকে আমরা তা পাই না, কেননা এদের মাধ্যমে আমাদের ক্ষণস্থায়ী আরোগ্যলাভ হয় ঠিক কিন্তু আমরা যখন আবার সক্রিয় একটা জীবাণুর সংস্পর্শে আসি তখন পুনরায় অসুস্থ হয়ে পড়ি। টিকার আবিষ্কার মানুষকে অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করবার শক্তি যুগিয়েছে, জীবনকে করেছে দীর্ঘস্থায়ী, শিশুদেরকে দিয়েছে রোগমুক্ত নিরাপদ ভবিষ্যৎ। । গুটিবসন্তকে পৃথিবী থেকে নির্মুল করা সম্ভব হয়েছে। এদিকে পোলিওকে নির্মুল করার চেষ্টা চলছে। আমরা পৃথিবীর সকল জীবাণুকে পুরোপুরি জয় করতে সক্ষম হয়েছি বলা যাবে না। এদিকে চিকিৎসাবিজ্ঞানও থেমে নেই। লুই পাস্তুরের পর থেকে আজ পর্যন্ত আরও বেশ কিছু টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে। এইসব টিকার প্রস্তুতপ্রণালীতেও এসেছে পরিবর্তন, লেগেছে আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া। কিছু রোগের টিকা শুধুমাত্র তাদের আচরণগত বৈশিষ্ট্যের কারণে আবিষ্কার করা সম্ভবপর হয়ে উঠছে না। এইসব রোগকে এখন আমরা ‘ভয়ঙ্কর’ বলে আখ্যায়িত করি। যেদিন এই রোগগুলোর টিকাও আবিষ্কার হয়ে যাবে সেদিন হয়ত সেগুলোও আর ভয়ঙ্কর থাকবে না।