স্টেথোস্কোপের আবিষ্কার
এ যুগে ডাক্তার বলতেই চোখে ভাসে স্টেথোস্কোপ গলায় ঝুলিয়ে রাখা একজনকে। এই যন্ত্র ছাড়া ডাক্তারির কথা এখন ভাবাও যায় না। হয়তো গলায় ঝোলা স্টেথোস্কোপই এখন একজন ডাক্তারকে চেনার সবচেয়ে সহজ এবং প্রচলিত মাধ্যম! কিন্তু ঊনিশশো শতাব্দীতে এটি ছাড়াই ডাক্তারকে রোগীর হৃদস্পন্দনের হিসেব কষতে হতো। মূলত হাত দিয়ে নাড়ী অনুভব করে বা বুকে কান পেতে হৃদস্পন্দন শুনে ডাক্তারকে সিদ্ধান্ত নিতে হতো। একে বলা হয় Immediate auscultation (“অস্কাল্টেশন” হল দেহের আভ্যন্তরীণ শব্দ শোনার প্রক্রিয়া)।
১৮১৬ সালে ফরাসী ডাক্তার রেনে থিওফাইল হায়াসিন্থে লেনেক [René-Théophile-Hyacinthe Laennec, উরিব্বাস! নিজ দায়িত্বে উচ্চারণ করিবেন] এক রোগীর হৃদস্পন্দন পরীক্ষা করতে গিয়ে অদ্ভুত পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। রোগী অত্যধিক স্থূল হওয়ায় রেনে হাত দিয়ে নাড়ী পরীক্ষা করতে পারছিলেন না। আবার রোগী একজন তরুণী বলে রেনে তার বুকে কান পেতেও পরীক্ষাটি করতে পারছিলেন না। ফলে সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি শব্দবিজ্ঞানের আশ্রয় নেন।
তাঁর মনে পড়ে ওই পদ্ধতির কথা, যেখানে কাঠের টুকরার এক পাশে কান রেখে অন্য পাশে টোকা দিলে সেই শব্দ স্পষ্টভাবে শোনা যায়। সাথে সাথে তিনি এক দিস্তা কাগজ রোল করে সিলিন্ডারের মতো বানান এবং সেটার এক পাশ রোগীর বুকে রেখে অপর পাশে নিজের কান লাগান। বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করেন, এতে করে হৃদস্পন্দন যতটা স্পষ্টভাবে শোনা যাচ্ছে, বুকের উপর সরাসরি কান পেতেও ততটা স্পষ্ট কখনো শোনা যায়নি! কারণ বায়ু মাধ্যমের চেয়ে কঠিন মাধ্যমে শব্দের বেগ বেশি। আর এই যে বুকের উপর সরাসরি কান না পেতে বা হাত দিয়ে স্পর্শ না করে, মাঝখানে একটা মিডিয়া ব্যবহার করে হৃদস্পন্দন শোনার প্রক্রিয়া, একে বলা হয় Mediate auscultation ।
কথিত আছে, এই আইডিয়াটা রেনের মাথায় এসেছিলো ছোট বাচ্চাদের খেলা দেখে। ১৮১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা এক সকালে ল্যুভর প্রাসাদের আঙিনা দিয়ে হাঁটার সময় পঁয়ত্রিশ বছর বয়সী রেনে দেখেন দুটো বিদ্যালয় পড়ুয়া শিশু একটা লম্বা আর ফাঁপা কাঠ নিয়ে খেলছে। একজন এক প্রান্তে পিন দিয়ে আঁচড় কাটছে, অন্যজন আরেক প্রান্তে কান লাগিয়ে শুনছে। কাঠটি আঁচড়ের শব্দকে অ্যামপ্লিফাই করে অপর প্রান্তে পৌঁছে দিচ্ছে। এছাড়া ধারণা করা হয়, বংশীবাদক হিসেবে রেনের অভিজ্ঞতাও এই আইডিয়া জন্মানোর পিছে ভূমিকা রেখেছে।
রেনের তৈরি প্রথম স্টেথোস্কোপটি ছিল ২৫ সেন্টিমিটার লম্বা আর ২.৫ সেন্টিমিটার প্রস্থ বিশিষ্ট কাঠের ফাঁপা সিলিন্ডার। পরে তিনি তিনটা আলাদা টুকরায় ভাগ করেন এই যন্ত্রকে। এই যন্ত্রের নাম রেনে স্টেথোস্কোপ রেখেছিলেন কারণ Stethos মানে বুক এবং skopos মানে অনুসন্ধান। তবে এই যন্ত্রটিকে তৎকালীন চিকিৎসক সমাজ খুশী মনে গ্রহণ করেনি।
১৮৫১ সালে আর্থার লিরেড দুই এয়ার-পিস যুক্ত আধুনিক স্টেথোস্কোপ উদ্ভাবন করেন এবং বাণিজ্যিক উৎপাদনের জন্য এটির নকশাকে খুঁতমুক্ত করে তৈরি করেন জর্জ ক্যামান (১৮৫২ সালে)। তখন থেকেই শেষোক্তটি স্টেথোস্কোপের স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
রেনে লেনেক-এর ঘটনাবহুল জীবনী
যে ব্যক্তিটি চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিপ্লব এনে দিলেন, তার জীবন সম্পর্কে কিছু না লিখলে লেখাটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আর বোনাস হল, রেনের জীবনটা বেশ ঘটনাবহুল! পড়তে গেলে মোটেও বিরক্ত লাগবে না।
রেনে লেনেক ১৭৮১ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি, ফ্রান্সের কুইম্পারে জন্মগ্রহণ করেন। রেনে যখন পাঁচ বছরের শিশু, তখন যক্ষ্মায় ভুগে তার মা “মিশেল ফেলিচিতে লেনেক” মারা যান। পেশায় আইনজীবী এবং খরুচে হিসেবে দুর্নাম কুড়ানো বাবা “থিওফাইল মারি লেনেক” তার দুই ছেলের দেখাশোনা করতে অপারগ ছিলেন। ফলে রেনে তার গ্র্যান্ড আঙ্কেল অ্যাবে লেনেক (বাবার আঙ্কেল, যিনি ছিলেন একজন ধর্ম প্রচারক)-এর কাছে চলে যান।
ছোটবেলায় রেনের স্বাস্থ্য খুবই খারাপ ছিল। তিনি অবসন্নতায় ভুগতেন আর মাঝে মাঝে অনেকদিনের জন্য তার জ্বর আসতো। ধারণা করা হয়েছিলো তার হাঁপানিও আছে। ভগ্ন স্বাস্থ্যের কারণে বিষণ্ণতায় ভুগলেও সংগীতের ভেতর তিনি মানসিক শান্তি খুঁজে পেতেন। তার অবসর সময় কাটত বাঁশি বাজিয়ে কিংবা কবিতা লিখে।
গ্র্যান্ড আঙ্কেলের কাছে কয়েক বছর থাকার পর ১৭৯৩ সালে ফরাসি বিপ্লবের সময়, বারো বছর বয়সে রেনে পশ্চিম ফ্রান্সের নঁত (Nantes) শহরে যান। আঙ্কেল (বাবার ভাই) “ডাঃ গুইলাউমে লেনেক” সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন ফ্যাকাল্টির ডীন ছিলেন।
বিপ্লবের উত্তাল সময়েও রেনের লেখাপড়ায় কোনো ফাঁকিবাজি ছিল না। তিনি দক্ষতার সাথে ইংরেজি এবং জার্মান ভাষা রপ্ত করেন এবং অনেক পুরস্কারও জেতেন। গুইলাউমে তাকে ডাক্তারি পড়তে উৎসাহ দেন। রেনেও আঙ্কেলের আন্ডারে ডাক্তারি পড়া শুরু করেন। ১৭৯৫ সালে, মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে রেনে নঁত শহরের Hôtel Dieu-তে অবস্থানরত অসুস্থ এবং আঘাতপ্রাপ্ত রোগীদের সেবা করতে শুরু করেন। ১৭৯৯ সালে, আঠারো বছর বয়সে Hôtel Dieu-তেই তিনি তৃতীয় শ্রেণির সার্জন হিসেবে চাকরি শুরু করেন। এর কিছুদিন পর অবশ্য Hospice de la Fraternité-তে চলে যান।
রেনে ছিলেন প্রচণ্ড মেধাবী একজন ছাত্র। তিনি ইংরেজি, ল্যাটিন, জার্মান এবং গ্রিক ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। ১৮০০ সালে তিনি প্যারিসে অবস্থিত ইকোল প্রাতিক (École Pratique) নামক প্রতিষ্ঠানে অঙ্গ ব্যবচ্ছেদ বিদ্যা শেখার জন্য ভর্তি হন। রেনের শিক্ষক ছিলেন বিখ্যাত গবেষক Guillaume Dupuytren, সম্রাট নেপোলিয়নের ব্যক্তিগত চিকিৎসক Nicolas Marest প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ! প্রথম বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষায় (১৮০১) রেনে মেডিসিন এবং সার্জারি উভয় বিষয়েই প্রথম হন। ১৮০২ সালে, মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি তার প্রথম গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন এবং ১৮০৪ সালে ডাক্তারি পাশ করেন।
পারিবারিক হাঙ্গামা, যক্ষ্মায় ভুগে আঙ্কেলের মৃত্যু, Guillaume Dupuytren-এর আন্ডার থেকে বেরিয়ে আসার ফলে আর্থিক টানাপোড়েনের সৃষ্টি ইত্যাদি নেতিবাচক ঘটনা রেনের কাজের ধারাবাহিকতাকে নষ্ট করে দেয়। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। সুস্থ হওয়ার আশায় তিনি ব্রিটানি নামক অঞ্চলের গ্রাম্য এলাকায় চলে যান। সেখানকার সজীব বায়ু তাকে সুস্থ করে তোলে।
জীবনে এতো প্রাপ্তি আর সফলতা সত্ত্বেও রেনের মস্ত এক আক্ষেপ ছিল। প্যারিসের কোনো বড় হাসপাতালে তিনি জ্যোষ্ঠ চিকিৎসক হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছিলেন না। এটা তাকে হতাশ করে ফেলছিলো। অবশেষে ১৮১৬ সালে প্যারিসের নেক্টার হাসপাতালে তিনি নিয়োগ পান এবং খুব খুশি হয়েই সেখানে যোগ দেন। এখানে আসার পরই তিনি বৈপ্লবিক আবিষ্কারটি করেন। এরপর তার জীবনে একটার পর একটা সাফল্য আসতে থাকে।
রেনেকে বলা হয় ক্লিনিক্যাল অস্কাল্টেশনের (auscultation) জনক। তিনিই সর্বপ্রথম নিজের আবিষ্কৃত স্টেথোস্কোপ ব্যবহার করে হৃদস্পন্দনের শব্দ শুনে Bronchiectasis এবং Cirrhosis (ফুসফুসের সাথে সম্পর্কিত মেডিক্যাল কন্ডিশন) সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা দেন। এছাড়া তিনি স্টেথোস্কোপ ব্যবহার করে ফুসফুসের বিভিন্ন রোগ, যেমন – নিউমোনিয়া, যক্ষ্মা, bronchiectasis, pleurisy, emphysema, pneumothorax ইত্যাদির শ্রেণিবিভাগ করেন।
১৮২৪ সালে ৪৩ বছর বয়সী রেনে বিয়ে করেন মিস আর্গনকে। এরপর ক্রমান্বয়ে রেনের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে থাকে। তিনি খুব দুর্বল হয়ে পড়েন এবং ধরা পড়ে যে, তার যক্ষ্মা হয়েছে। সে আমলে “যার হয় যক্ষ্মা, তার ছিল না রক্ষা”। ১৮২৬ সালের মে মাসে রেনের জ্বর, কাশি আর শ্বাসকষ্ট চরম আকার ধারণ করে। তিনি সুস্থ হওয়ার আশায় আবারও ব্রিটানিতে যান। কিন্তু এবারের সফর তাকে পুরোপুরি সুস্থ করতে পারে না। ব্রিটানির আবহাওয়া তাকে কিছুটা উজ্জীবিত করলেও চার মাস পর আগস্টের তেরো তারিখে, মাত্র ৪৫ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
রেনে, তার আবিষ্কার এবং The Irony is…
নিজের শেষ দিনগুলোতে রেনে তার ভাস্তে বা ভাগ্নে “মেরিয়াদেক”কে বলেছিলেন স্টেথোস্কোপ দিয়ে তার বুক পরীক্ষা করতে, এবং সে কী শুনতে পাচ্ছে সেটা বলতে। মেরিয়াদেক যখন কাজটি করলেন, তখন রেনে খুব সহজেই বুঝতে পারলেন শব্দের নির্দিষ্ট প্রকৃতিটি। তিনি এই প্যাটার্নের শব্দ বহুবার বহুজনের বুকে স্টেথোস্কোপ লাগিয়ে শুনেছেন। আর এই শব্দের ধরন থেকে তিনি বুঝে গেলেন, তার ডায়াগনোসিস ভুল হওয়ার কোনো কারণ নেই। তিনি যক্ষ্মায় আক্রান্ত। অ্যান্ড দা আইরনি ইজ… রেনে তার আবিষ্কার দিয়ে পরিষ্কার আর নির্ভুলভাবে যক্ষ্মা রোগ নির্ণয় করতে পারতেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিনা নিজের দেহেই তাকে ব্যবহার করতে হল নিজের আবিষ্কারকে, আর ব্যবহারের পর কিনা শনাক্ত করা হল ঐ রোগকেই!
রেনে লেনেক এবং মিস আর্গন ছিলেন নিঃসন্তান। তাই রেনে উইল মারফৎ তার সমস্ত কিছু মেরিয়াদেককে দিয়ে গিয়েছিলেন। তার সব গবেষণাপত্র, ঘড়ি, আংটি, সর্বোপরি স্টেথোস্কোপ, যাকে তিনি আখ্যায়িত করেছিলেন “The greatest legacy of my life” বলে।
সূত্রঃ ১) উইকিপিডিয়া
পুরোটাই এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম। চমৎকার লিখেছিস, নীরু।
ধন্যবাদ মানু।
তোর প্রশংসা মানে, সত্যিই ভালো লিখেছি। হাহা!
খুব ভালো লিখেছেন। চালিয়ে যান।শুভকামনা থাকল।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ!