আদি মানবেরা আগুন আবিষ্কার করেছিলো লক্ষ লক্ষ বছর আগে। ক্রমান্বয়ে মানুষ আগুন নিয়ন্ত্রণ করে খাবার ঝলসে খেতে, তাপ ও আলো পেতে, এবং শিকারীদের দূরে রাখতে শিখলো। আগুন মানব জীবনে এত বড় আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো যে কিছু মানুষ আগুনের পূজা পর্যন্ত করতো। আধুনিক যুগেও খাবার তৈরি, তাপ ও আলো দেয়ার পাশাপাশি আগুন কখনো মোমবাতি বা, মশালে প্রতিবাদের প্রতীক, আবার কখনো ফানুস বা, আতশবাজিতে আনন্দের বহিঃপ্রকাশ। নৃবিজ্ঞানীদের ধারণা, বিবর্তনের মাধ্যমে আমাদের আজকের মানুষে পরিণত হওয়ায় আগুনের ভূমিকা অপরিসীম।
প্রাচীন গ্রীকদের ধারণা ছিল, আগুন চারটি মৌলিক উপাদানের একটি যা দিয়ে জগতের সব কিছু গঠিত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, আগুন মৌলিক তো নয়ই বরং আগুনের বিজ্ঞান যথেষ্ট জটিল। আগুনের শিখায় শত শত জটিল বিক্রিয়া ঘটতে থাকে এবং জটিল যৌগ উৎপন্ন ও পরিবর্তিত হতে থাকে।
আগুন কী?
আমরা জানি, অক্সিজেনের(অথবা, অন্য কোনো জারক) সাথে কোন কিছুর বিক্রিয়া হওয়াকে combustion বা, দহন বলা হয়। এটি একটি exothermic প্রক্রিয়া, অর্থাৎ এ বিক্রিয়ায় শক্তি নির্গত হয়। যখন কোনো জ্বালানি অক্সিজেনের উপস্থিতিতে নির্দিষ্ট পরিমাণ তাপ পায় তখন রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে এবং শক্তি উৎপন্ন হয়। এই প্রক্রিয়াটি হলো complete combustion. আবার আমরা এটাও জানি যে, পরমাণুতে ইলেকট্রনগুলো নির্দিষ্ট দুরত্বের ও নির্দিষ্ট শক্তির কিছু কক্ষপথে অবস্থানে করে। ইলেকট্রনগুলো পরিবেশ থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি গ্রহণ করে উপরের কক্ষপথে যেতে পারে। এই অবস্থা স্থায়ী নয় তাই ইলেকট্রনগুলো আবার নির্দিষ্ট শক্তির তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ বিকিরণ করে নিচের কক্ষপথে ফিরে আসে। এই তরঙ্গগুলো দৃশ্যমান আলোর সাথে মিলে গেলে আমরা সেই রঙের আলো দেখতে পাই। পরমাণুগুলো কাঁপতে থাকে, তাই আমরা তাপ পাই।
আবার পর্যাপ্ত অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে পরমাণুগুলো (সাধারণত, complete combustionএর পর অবশিষ্টাংশ) তাপে উত্তেজিত হলেও আমরা আগুন পাই। কারণ, সব উত্তপ্ত কণা আলো বিকিরণ করে।
আগুন জ্বালাতে মূলত তিনটি জিনিস প্রয়োজন- জ্বালানি, জারক (অধিকাংশ ক্ষেত্রে অক্সিজেন), আর তাপ। জ্বালানী আর অক্সিজেন সবসময় পাশাপাশি অবস্থান করলেও পর্যাপ্ত তাপের অনুপস্থিতিতে জ্বলে ওঠে না। প্রাথমিকভাবে এই তাপের যোগান দেয়া হয় ম্যাচের বারুদ ম্যাচবক্সে ঘষে উত্তেজিত করে আথবা লাইটারের পাথরে পাথর ঘষে। পরবর্তীতে chain reaction এর মতো উৎপন্ন তাপ বাকিটা জ্বালানিকে নিঃশেষ করে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রাথমিক তাপ দেয়ার প্রয়োজন হয় না, অর্থাৎ কক্ষ তাপমাত্রায়ই বিক্রিয়া হয়ে যায়; যেমন, পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট আর গ্লিসারিন মেশালে। আবার কখনো আলো বা, বিদ্যুৎ দরকার পড়ে। এবং সর্বোপরি, বিক্রিয়াগুলো হতে হবে দ্রুত- ধাতুতে জং পরা বা খাবার হজম হওয়াও এক প্রকার দহন, কিন্তু এত ধীর প্রক্রিয়া যে আগুন জ্বলে ওঠে না।
আগুন পদার্থ না, শক্তি?
ইন্টারনেটে দেখা যায় অনেকেই বাম পাশের ছবিটি দিয়ে প্রমাণ করে ফেলতে চান আগুন আসলে পদার্থ না, কারন আগুনের ছায়া পড়ছে না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যথেষ্ট উজ্জ্বল আলোতে আগুনেরও ছায়া পড়ে।
যদিও শিখার আলো আর তাপ পদার্থ না, তবুও শিখার ভেতরে অবশ্যই পদার্থ আছে। এটা বোঝার আরো সহজ উপায় আছে- শিখা সবসময় বাতাসে নড়ে ওঠে। এর ভেতরে পদার্থ না থাকলে কখনোই ‘বল প্রয়োগে বাধা দান’ করতো না, অর্থাৎ জড়তা থাকতো না। এই পদার্থগুলো জ্বালানিভেদে বিভিন্ন রকম হতে পারে, নিচের প্যারায় এবং শেষ প্যারায় কিছুটা ব্যাখ্যা করা হল।
আগুনের রং, তাপমাত্রা ও প্রকারভেদ
আমরা সাধারণত দৈনন্দিন জীবনে দুই ধরনের আগুন দেখতে পাই।
CH3-(CH2)n-CH3 + O2 -> CO2 + H2O
মোমবাতির মোম আর চুলার মিথেন বা, বিউটেন হলো হাইড্রোকার্বন। এই অণুগুলো তাপের কারণে কার্বন ও হাইড্রোজেন পরমাণুতে বিয়োজিত হয়ে যায় এবং অক্সিজেন পরমাণুর সাথে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও পানি উৎপন্ন করে। হাইড্রোকার্বন ও অক্সিজেনের বন্ধন শক্তি কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও পানির শক্তির চেয়ে বেশি, তাই এ বিক্রিয়ায় শক্তি নির্গত হয়। এই শক্তিতে পরমাণুগুলোর ইলেকট্রন উপরের শক্তিস্তরে চলে যায় এবং নিচের স্তরে আসার সময় নীল আলো বিকিরণ করে। এখানে প্রায় ৩০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা উৎপন্ন হয়। এটাই complete combustion. গ্যাস বার্নারে আর মোমবাতির গোড়ায় এই ধরনের আগুন তৈরি হয়।
জ্বালানির কার্বন সংখ্যা বেশি হলে complete combustion ঘটতে পারে না। অবশিষ্ট পরমাণুগুলো রিং আকৃতির Polycyclic Aromatic Hydrocarbon এবং পরে ‘সুট’(soot) গঠন করে। সুট মূলত কার্বন পরমাণুর স্তূপ। এই পরমাণুগুলোর তাপে উত্তেজিত হয়ে কমলাটে হলুদ আলো বিকিরণ করে। এখানে প্রায় ১০০০-১২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা উৎপন্ন হয়। এই প্রক্রিয়াকে Incandescence বলে। এটি এক প্রকার Black-body Radiation. মোমবাতির উপরের অংশে, কেরোসিন, পেট্রোল, ডিজেলে বা, কাঠে এ ধরনের আগুন তৈরি হয়।
প্রসঙ্গত, Incomplete Combustion-এ কার্বন মনোক্সাইড ও অন্যান্য জটিল যৌগ উৎপন্ন হয়, এগুলো এবং অবশিষ্ট হাইড্রোকার্বনগুলো ধোঁয়া হিসেবে পরিচিত। Complete combustion-এ ধোঁয়া হয় না। এছাড়া জ্বালানী ও পরিবেশভেদে লাল ও সাদা শিখাও তৈরি হতে পারে। এখানে যথাক্রমে প্রায় ৫০০ ও ১৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা উৎপন্ন হতে পারে। আবার কখনো কখনো জ্বালানী কঠিন হলে শিখা ছাড়াও জ্বলে, যেমন, সিগারেটের আগুন। সেক্ষেত্রে কার্বন মনোক্সাইড বেশি উৎপন্ন হয়।
শিখার আকৃতি
সব ধরনের আগুনই উপরে সূঁচালো আকৃতির হয়ে থাকে। কারণটা খুব সহজ। শিখার অত্যন্ত উত্তপ্ত গ্যাস এবং আশেপাশের গ্যাস গরম হয়ে উপরে উঠতে থাকে। আশেপাশের গ্যাসগুলোর স্থান পূরণ করতে নিচ থেকে ঠাণ্ডা গ্যাস আসে এবং আবারও গরম হয়ে উপরে উঠে। এই ক্রমাগত পরিচলনের কারণে শিখা এরকম সূঁচালো হয়।
শিখার এই আকৃতির পেছনে যেহেতু মাধ্যাকর্ষণের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি, তাই অবশ্যই মহাশূন্যে শিখার আকৃতি এরকম হবে না। নাসার গবেষণায় দেখা গেছে, International Space Station-এ Microgravity তে মোমবাতির শিখা ছোট গোলকে পরিণত হয়। আবার হেপ্টেনের শিখা-গোলক অদৃশ্য হয়ে ক্রমশ বড় হয়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এখানে আগুনের রসায়নও পুরাপুরি আলাদা। বিস্তারিত পাওয়া যাবে নাসার ওয়েবসাইটে।
আগুন নিভে কিভাবে
আগুন নেভাতে হলে চারটির যে কোনো একটি বন্ধ করতে হবে- জ্বালানি, তাপ, অক্সিজেন, চেইন রিয়েকশন না শেকল বিক্রিয়া। জ্বালানি বন্ধ করতে চুলা বা গ্যাস বার্নারের সুইচ অফ করা হয়। তাপ কমাতে পানি ঢালা হয়। কার্বন-ডাই-অক্সাইড স্প্রে করলে অক্সিজেন প্রতিস্থাপিত হয় কারণ, এটি অক্সিজেনের চেয়ে ভারী। আর ফু দিয়ে গ্যাস সরিয়ে দিলে শেকল বিক্রিয়া বন্ধ হয়।
আগুনের পদার্থগুলো এবং কিছু মজার তথ্য
আগেই বলা হয়েছে আগুনের রসায়ন যথেষ্ট জটিল এবং শিখার ভেতরে অনেক ধরনের রাসায়নিক উৎপন্ন ও পরিবর্তিত হতে থাকে। বিজ্ঞানীদের মতে আমরা আগুন সম্পর্কে মাত্র জানা শুরু করছি। নিচে আমাদের পরিচিত কিছু আগুনের কিছু বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করা হলো –
১। আমরা ইতিমধ্যে জেনেছি শিখার ভেতরে বাষ্প ও সুট (soot) থাকতে পারে এবং জ্বালানি থাকতে পারে। মজার ব্যাপার হলো, সেগুলো পরীক্ষা ও সনাক্ত করতে আপানার প্রয়োজন হবে শুধু এক টুকরা ধাতু, যেমন কয়েন। কয়েনটিকে শুধু শিখার বিভিন্ন স্থানে দুই-এক সেকেন্ডের জন্য ধরুন এবং বাইরে আনুন। বিশ্বাস না হলে করেই দেখুন।
২। আগুনের ভেতরে অসংখ্য জটিল যৌগের মধ্যে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক আয়ন পাশাপাশি অবস্থান করে, অনেকটা প্লাজমার মতো। তাই উচ্চ বিভবে বা হাই ভোল্টেজে মোমবাতির শিখা চ্যাপ্টা হয়ে ইলেক্ট্রোডের দিকে চলে যেতে চায়। শিখা বাতাসের পরিবাহিতাও অনেক বাড়িয়ে দেয়। এটি নিয়ে ভেরিটাযিয়ামের একটি ভিডিও আছে।
৩। শিখাকে নিরেট মনে হলেও এটি আসলে ফাঁপা। কারণটা খুব সহজ- বিক্রিয়াগুলো অবশ্যই হতে হবে বাতাসের সংস্পর্শে। এটা পরীক্ষা করার উপায় হল, শিখার মাঝখানে ধাতব জালী ঢুকিয়ে দেয়া।
৪। আপনি জানতেন কি- মোমবাতি নেভানোর পরে পুনরায় জ্বালাতে ম্যাচের শিখাকে মোমবাতির সুতায় স্পর্শ করানোর প্রয়োজন নেই, শিখাকে মোমের সাদা ধোঁয়ায় স্পর্শ করানোই যথেষ্ট। এর ব্যাখ্যাটাও সহজ, সেটা না হয় আপনাদের জন্যই রেখে দেই।
৫। আপনার টেবিলে যদি একটি জ্বলন্ত মোমবাতি থাকে তাহলে টেকনিক্যালি, আপনার কাছে হীরা আছে! তাও আবার একটি নয়- প্রায় ১৫ লক্ষটি প্রতি সেকেন্ডে! University of St Andrews-এ Professor Wuzong Zhuo দেখান যে, হাইড্রোকার্বন থেকে CO2 উৎপন্ন হওয়ার এক ধাপে এগুলো উৎপন্ন হয়। কিন্তু সমস্যা হলো – এগুলো আসলে Nanodiamond এবং শিখার ভেতরেই বাতাসে পুরে সাথে সাথে কার্বন-ডাই-অক্সাইড হয়ে যায়!
তথ্য সূত্র –
[১] http://science.nasa.gov/science-news/science-at-nasa/2013/18jun_strangeflames/
[২] http://www.rsc.org/suppdata/cc/c0/c0cc05785a/c0cc05785a.pdf
[৩] http://www.thenakedscientists.com/HTML/experiments/exp/-25aeab656d/
[৪] http://www.doctorfire.com/flametmp.html
[৫] https://goo.gl/Eoc8kd