পূর্বকথা
যেহেতু আপনি এই আর্টিকেলটা পড়া শুরু করেছেন তাই আমি ধরে নিচ্ছি যে আপনি ড্রোন জিনিসটার ব্যাপারে আমার মত মোটামুটি উৎসাহী। আমি পদার্থবিদ্যার ছাত্র, সেই হিসেবে এই জিনিসটার ব্যাপারে আমার খুব বেশী জানাশোনা আছে তাও না। ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বা সমগোত্রীয় বিষয়ে যারা পড়াশোনা করছেন, তারা হয়ত এই জিনিসটার ব্যাপারে আরো ভালো বলতে পারবেন। তবে আমিও ড্রোন নিয়ে কিছু কাজকর্ম করেছি সেটার ভিত্তিতেই এখানে কিছু বলার চেষ্টা করেছি। আমার মূল উদ্দেশ্য আসলে অগ্নি নির্বাপণে ড্রোনের ব্যবহার করার ব্যাপারে আলোচনা করা। এখানে আমি দুইটা মডেল দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছি। আমার বিশ্বাস এই ধরণের মডেল বাস্তবায়ন করা গেলে আমরা বহুতল ভবনে অগ্ন্যুৎপাতজনিত দূর্বিপাকে আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতাকে হয়তো কমিয়ে আনতে পারবো।
ড্রোন
ড্রোন শব্দটার অর্থ গুণগুণ করা; এটা কোনো সায়েন্টিফিক নাম না। ড্রোনের অনেকগুলো নাম আছে। তন্মধ্যে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট নামটার যদি বাঙলা অর্থ করি তাহলে এটা দাঁড়াবে “মনুষ্যবিহীন উড়ন্ত যান” বা Unmanned Aerial Vehicle। এটার আরেকটা নাম মাল্টিরোটর। এটার জন্মটাই হয়েছে মূলত সামরিক কাজে যেখানে এটার নাম unmanned combat aerial vehicle। ড্রোন নামটা সাধারণ মানুষের দেয়া, কারণ প্রথম দিককার মনুষ্যবিহীন সামরিক উড়ন্ত যানগুলোর আওয়াজ নাকি অনেকটাই ছিল পুরুষ মৌমাছির (ড্রোন) ডানা ঝাপটানোর আওয়াজের মতোই। সমষ্টিগতভাবে দূর থেকে নিয়ন্ত্রিত যে কোনো মনুষ্যবিহীন যানই ড্রোনের আওতায় পড়ে। সে হিসাবে কিন্তু বাজারে খেলনা হিসেবে হেলিকপ্টারগুলোও কিন্তু এক ধরনের ড্রোন।
ড্রোনের মূল আইডিয়াটাই এসেছে ক্ষেপণাস্ত্র থেকে । ১৮৫০ সালেঅস্ট্রিয়ানরা যুদ্ধের সময় অনেকগুলো বেলুনে বিষ্ফোরক দ্রব্য বোঝাই করে সেটাকে উড়িয়ে ভেনিসে ফেলার চেষ্টা করেছিলো। কয়েকটা ঠিকমতো কাজও করেছিলো বটে তবে কিছু বেলুন আবার বাতাসে ঘুরে গিয়ে অস্ট্রিয়ানদের উপরেই পড়েছিলো।
নিকোলা টেসলা সর্বপ্রথম ১৯১৫ সালে দূরনিয়ন্ত্রিত মনুষ্যবিহীন সামরিক বিমানের ধারণা দিয়েছিলেন। ১৯৩৫ সালে প্রথম রিমোট কন্ট্রোলড উড়ন্ত যান নির্মাণে সফল হন হলিউড তারকা ও সৌখিন নির্মাতা রেজিন্যান্ড ড্যানি। বেতার তরঙ্গ ব্যবহারকারী এই যন্ত্রের নাম ছিল রেডিওপ্লেন বা আরো ভালোভাবে বুঝতে চাইলে বলা যেতে পারে “Remote piloted Aerial vehicles” এই রেডিওপ্লেনই মূলত ড্রোন তৈরি করার প্রথম পদক্ষেপ। ড্রোনের ব্যবহারটা সামরিক কাজেই ব্যবহার হয়েছে সবচেয়ে বেশি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই বিভিন্ন যুদ্ধে ড্রোনের বিভিন্ন সংস্করণ ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে বিভিন্ন দেশ। এবং তারা এটা এখনো করছে।
আসলে ড্রোন ঠিক কি ধরণের হবে, সেটা নির্ধারিত হয় কতটুকু প্রয়োজন তার উপর; অথবা বলা যায়, নির্মাতার ডিজাইনের উপর যতটুকু করা যায় তার উপর। এই পৃথিবীতে কত বিচিত্র রকমের যে ড্রোন তৈরি হয়েছে এবং হচ্ছে সেটা হিসাব রাখাটাও দুষ্কর হয়ে পড়ছে। কয়েকদিন আগে মাত্র এক গ্রাম ওজন আর হাতের মুঠোয় রাখা যাবে এমন ড্রোন তৈরির দাবিও করা হয়েছে।
এখন উন্নত বিশ্বে ড্রোনের বাজার বেশ রমরমা। ২০১৫ সালে প্রায় চল্লিশ লাখ ড্রোন বিশ্বব্যাপী বিক্রি হয়েছে। বলা হচ্ছে ২০২০ নাগাদ সংখ্যাটা এক কোটি ষাট লাখে গিয়ে দাঁড়াবে। আমি যদি ব্যবহারের দৃষ্টিকোণ থেকে বলি তাহলে একে ছয় ভাগে ভাগ করতে পারি। এগুলো হলো –
১। লক্ষ্য ও ফাঁদ,
২। পরিদর্শন,
৩। যুদ্ধকালীন,
৪। লজিস্টিক,
৫। গবেষণা ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন, এবং
৬। বাণিজ্যিক।
বাণিজ্যিকের মধ্যে বিনোদন বাণিজ্যও হতে পারে। যেমন, আগে যেসব দৃশ্যধারণ করার জন্য হেলিকপ্টার লাগতো, এখন ড্রোনের সাথে ক্যামেরা লাগিয়ে সহজেই সেটা করা যাচ্ছে। যাই হোক, ব্যবহার বাদ দিয়ে যদি উচ্চতা ও দূরত্বকে মানদণ্ড ধরি – তাহলে বর্তমানে কয়েক ফুট উচ্চতা ও কয়েক মিটার রেঞ্জের ড্রোন থেকে পঞ্চাশ হাজার ফুট উচ্চতা ও দুইশো কিলোমিটার রেঞ্জের হাইপারসনিক (ম্যাক নাম্বার-৫) ড্রোনও আছে।
তবে যত ভাবেই ভাগ করা হোক না কেন ড্রোনের সবচেয়ে বেশী ব্যবহার করে বিভিন্ন সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা। ড্রোন এখন মার্কিন সেনাবাহিনীর অন্যতম ভরসার নাম। তবে গবেষণার কাজেও ড্রোনের ব্যবহার বেড়েছে। এখন ড্রোন দিয়ে ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রের ছবি তোলার কাজটাও করা যাচ্ছে। কিছুদিন আগেই অনলাইন শপ অ্যামাজন তাদের মালপত্র পৌঁছানোর জন্য পরীক্ষামূলকভাবে ড্রোনের ব্যবহার শুরু করেছে। যুদ্ধবিদ্ধস্ত সিরিয়াতে ড্রোন দিয়ে ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছানোর কাজও করা হচ্ছে।
এমনকি মাছেদের জীবন যাপন ভালোভাবে পর্যবেক্ষণের জন্য মাছসদৃশ আন্ডারওয়াটার ড্রোনও আছে।
ড্রোন কিভাবে কাজ করে বা এটার অভ্যন্তরীণ প্রত্যেকটা জিনিস নিয়ে কথা বলতে পারলে ভালোই লাগতো কিন্তু আপাতত সেদিকে যাচ্ছি না। ড্রোনের কাজটা কি এসম্পর্কে অনেকেরই অল্পবিস্তর ধারণা আছে বলে আমার বিশ্বাস। তবে একান্তই যদি জানার খুবই আগ্রহ থাকে সেক্ষেত্রে টেড- নির্মিত ভিডিও দেখতে পারেন অথবা flight evolved এর একটা চমৎকার সহজ ভাষায় প্রতিটা অংশের বর্ণনা আর কার্যপ্রণালী নিয়ে একটা আর্টিকেল আছে , সেটা পড়তে পারেন।
ফায়ারফাইটার ড্রোন
বহুতল ভবনে হঠাৎ লেগে যাওয়া আগুন তাৎক্ষণিকভাবে নেভানো বেশ কষ্টসাধ্য একটা ব্যাপার। সমস্যাটা অবশ্যই উচ্চতার । অধিকাংশ দেশে খুব বেশী উচুঁতে পানি ওঠানোর প্রযুক্তিটা এখনো ভালোভাবে বিকশিত হতে পারেনি। তবে আমার বিশ্বাস আমরা ড্রোন দিয়ে বেশ কিছু সমস্যাকে কাটিয়ে উঠতে পারি। আগুনের উপর নজরদারি বা কোথায় আগুন লেগেছে এইসব ব্যাপারে ড্রোনের ব্যবহার ইতোমধ্যে হয়ে গেছে। আমি চাচ্ছি আর ভালো কিছু তৈরি করা যায় কি না, যাতে আমরা আরো ভালো ফল পেতে পারি। আমি যতটুকু পড়েছি নাসা ফায়ারফাইটার ড্রোন নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে ২০১৪ সালের শেষদিকে, তবে এটার ফলাফল এখনো জানায়নি।
দক্ষিণ কোরিয়ার স্পাইডার ড্রোন নামের একধরনের ড্রোনের পরীক্ষামূলক ব্যবহার শুরু হয়েছে যেটা আগুন কোথায় লেগেছে সেটা জানার জন্য কেবলমাত্র উড়ে নয় , প্রয়োজনে দেয়ালের গা বেয়েও আগুনের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে অগ্নিনির্বাপণকর্মীদের অবহিত করবে। থার্মাল ক্যামেরাসমৃদ্ধ এই ড্রোন প্রায় দশ হাজার ডিগ্রী সেলসিয়াসেও বেশ কিছুক্ষণ টিকে থাকতে সক্ষম।
আমরা হয়তো ওদের মত উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন ড্রোন এখনই আমাদের দেশে আনতে পারবো না। তবে আমার বিশ্বাস মাঝারি মানের ফায়ারফাইটার ড্রোন আমাদের দেশের ইঞ্জিনিয়াররাই বানাতে পারবে। আমার ভাবনাগুলো শেয়ার করি।
অগ্নি নির্বাপকের মধ্যে যে অগ্নিনির্বাপনকারী পদার্থ (তরল কার্বন-ডাই-অক্সাইড বা নাইট্রোজেন মিশ্রিত ড্রাই পাউডার জাতীয় পদার্থ) থাকে সেটা যদি আমরা কোনোভাবে একটা পাত্রে বা বাক্সে নিয়ে ড্রোনের শরীরের সাথে সমন্বয় করতে পারি তাহলে এটার থেকে দুই তিনটা কাজ আদায় করে নিতে পারি।
প্রথমটা হলো, এটাকে আমরা ক্ষেপণাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারি। অর্থাৎ প্রথমে যে ড্রোনটার শরীরে আমরা তরল কার্বন-ডাই- অক্সাইড রাখলাম, সেটার সাথে একটা ক্যামেরা লাগিয়ে প্রথমে যে জায়গায় আগুন নেভাতে চাই সে জায়গায় লক্ষ্য কেন্দ্রীভূত করে এটাকে দ্রুতগতিতে সেই জায়গা বরাবর আঘাত করতে পারি। আমরা যদি যথেষ্ট পরিমাণ লিকুইড কার্বন পাঠাতে পারি তাহলে আগুনকে হয়তো কমানো সম্ভব হবে। তবে এটা আমাদের ড্রোনটাকে ধ্বংস করে ফেলবে নিশ্চিতভাবেই।
আরেকটা পদ্ধতি হলো – আমরা যদি ড্রোনে তরল কার্বন ডাই অক্সাইড নিয়ে ড্রোনের মধ্যেই ট্রিগারের ব্যাবস্থা করতে পারি তাহলে একটা জায়গাকে লক্ষ্য করে হয়তো ছুঁড়ে ফেলা সম্ভব হতে পারে। তবে পরিমাণ এখানেও প্রশ্নবিদ্ধ। আমার আইডিয়ার কাছাকাছি একটা পরীক্ষা অলরেডি ফ্লাইট টেস্ট ওয়েবসাইটে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে, এই ওয়েবসাইটাতে গেলে দুনিয়া জুড়ে যত রকমের ড্রোন নিয়ে কাজ হচ্ছে সেগুলোর ব্যাপারে একটা আইডিয়া পাবেন।
আরেকটা মডেল যেটাতে সরাসরি পানি আমরা কোনো পাইপ দিয়ে ড্রোনের মাধ্যমে উপরে ওঠাতে পারি কিনা সেটা ভেবে দেখেছি। ধরুন আমি যদি একটা মোটামুটি ব্যাসের একটা পাইপ (যেটার দৈর্ঘ্য আমি কমাতে বাড়াতে পারবো) আমার ড্রোনের সাথে সমন্বয় করে ওঠাতে পারি আর নিচ থেকে পানির সরবরাহ করতে পারি তাহলে কাজ হতেও পারে। ব্যাপারটা হাস্যকর ঠেকতে পারে। কিন্তু আমি যদি পানিকে নিচ থেকে বেশ দ্রুতগতিতে উপরে ড্রোনের দিকে পাঠাতে পারি (যেটা খুবই সম্ভব) আর আমার ড্রোন যদি পানির অতটুকু ধাক্কা সামলে পানিটা একটা নির্দিষ্ট দিকে প্রবাহিত করতে পারে তাহলে দুয়ে দুয়ে চার মিলতেও পারে। আমরা এখানে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন মোটর ব্যবহার করতে পারি। আমি ছবিতে এটা দেখাতে চেষ্টা করেছি।
আমি মেনে নিচ্ছি যে ড্রোন বিরাট ধরনের পানির পাইপ নিতে পারবে না; কিংবা ভূমি থেকে মোটরের সাহায্যে তার দিকে দ্রুতগতিতে পাঠানো পানির ধাক্কা সামলানো কঠিন হবে। কিন্তু সেটার জন্য আমরা কম ব্যাসের পাইপ ব্যবহার করতে পারি, একসাথে কয়েকটা ড্রোনকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করতে পারি। এমন কাজ করতে হবে যাতে ড্রোনগুলো মাটিতে বসে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো। সেটা মোটেই অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে না। বহুতল ভবনে যেহেতু আমাদের এখনো আগুন নির্বাপণে অতটা ভালো প্রযুক্তি আসেনি, তাহলে এই প্রযুক্তি কাজে লাগানোর চেষ্টা করে দেখাই যেতে পারে।
সবশেষে
আমি জানি না এগুলো বাস্তবায়ন করা কতটা কঠিন হবে! তবে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এই ধরণের ড্রোন বানানোর চেষ্টা করা অসম্ভবের কাছাকাছি, আমি এমনটা মানতে রাজি নই। তবে হ্যাঁ, এসব নিয়ে কাজ করার জন্য যে আর্থিক সহযোগিতা দরকার সেটা পাওয়াটা বেশ কঠিন। তবে আমি বিশ্বাস করি এই ধরনের প্রযুক্ত একদিন না একদিন আসবেই। হুবহু না হোক, কিছুটা তো বটেই।