ভলকানো ডিসকভারির ওয়েবসাইটটা চমৎকার। প্রতিদিন মোট কয়টা ভূমিকম্প হচ্ছে, কোথায় হচ্ছে, মাত্রা কেমন ছিলো, এগুলো সব দেখা যায়। যেমন ধরুন, ২০১৬ সালের ১৩ই এপ্রিল, এই একদিনে ২ মাত্রার অধিক মোট কয়টা ভূমিকম্প হয়েছিলো জানতে চাইলে চলে যান ওদের ওয়েবসাইটে। গেলে দেখবেন, মোট ভূমিকম্পের সংখ্যা ১৩০ এর মত। একই তথ্য USGS (United States Geological Survey) এর ওয়েবসাইটে গেলেও পাবেন। বাংলা নববর্ষের ঠিক আগের দিনেই ৬.৯ মাত্রার একটা ভূমিকম্প হয়েছে, এটা অনেকেই জানেন, স্থানীয়রা অনুভবও করেছেন ভালোভাবেই।
২০১৫ সালের এপ্রিলও কিন্তু ভূ-তাত্ত্বিকদের জন্য ব্যস্ত ছিলো। প্রথমে চিলির Calbuco আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ, এরপর দক্ষিণ এশিয়াতে ভূমিকম্প। এপ্রিলের ২৫ তারিখ, শনিবার নেপালের সময় সকাল ১১টা ৫৬ মিনিটে ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চল আর নেপাল কেঁপে উঠেছিলো, মানুষের মনও কেঁপে উঠেছিলো ব্যাপক আতংকে। এটার কথা নিশ্চয়ই আপনাদের সবার মনে আছে। ৭.৯ মাত্রার একটা ভূমিকম্প হয়ে গিয়েছিলো। এটার উপকেন্দ্র ছিলো নেপালের কাঠমাণ্ডু উপত্যকাতে, রাজধানী কাঠমাণ্ডুর একদম কাছেই, ভারতের সাথে সীমান্তের কাছাকাছি। কম্পন এতোই ভয়াবহ ছিলো যে, কলকাতা হাই কোর্টে বসেও মানুষ নিজ নিজ আসন থেকে ছিটকে পড়েছে। আমার নেপালি বন্ধুরা আমেরিকাতে বসে নেপালের জন্য ত্রাণের অর্থ সংগ্রহ করেছিলো তখন।
যে কোনো ভূমিকম্প হলেই আমরা কিছু শব্দ খুব বেশি শুনতে পাই, যেমন – ভূমিকম্পের মাত্রা, ভূমিকম্পের তীব্রতা, রিখটার স্কেল, ইত্যাদি। কিন্তু কথা হচ্ছে, আসলে এগুলো দিয়ে কী বোঝায়, তা নিয়ে অনেকেরই ধারণা নেই। রিখটার স্কেল বলতে যা বোঝায়, সেটাও আসলে রিখটার নয়। আর ভূমিকম্পের কারণ হিসেবে তো যে যার ইচ্ছামত কথা বলে। বিজ্ঞান যে অনেক আগেই ভূমিকম্পের কারণ আবিষ্কার করেছে, সেদিকে তাদের কোনো খেয়ালই নেই। আজ আমরা সেগুলো নিয়েই কথা বলবো।
ভূমিকম্পের কারণ
ভূমিকম্প কারো পাপের শাস্তি নয়। যারা এসব কথা বলে, তাদের যুক্তির ধরন বেশ হাস্যকর। সম্পূর্ণ কাকতালীয়ভাবে, তাদের মতাদর্শের বিপরীত দলের উল্লেখযোগ্য ঘটনার সময় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে তারা দাবি করে, এটা নাকি ওদের আচরণের শাস্তি। আবার যখন, সম্পূর্ণ কাকতালীয়ভাবে, ওদের কোনো উল্লেখযোগ্য উৎসবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসে, সেটাকে কেন যেন নিজের ঘাড়ে নেয় না। তখনো অন্যদের ওপরেই চাপিয়ে দিয়ে বলে – “দিনকাল খারাপ চলে এসেছে, ঘোর কলিকাল! এখন ভালো কাজ করতে গেলে শুধু বাধা আসে।” তাদের সকলের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, ভূমিকম্পের প্রধান কারণ মাত্র দুটো শব্দের মাধ্যমেই জানা যায় – প্লেট টেকটোনিকস। একেবারে সহজে বোঝানোর জন্য USGS এর আণ্ডাবাচ্চা সেকশনের সহায়তা নিচ্ছি। মানে, এটা দিয়ে ওরা বাচ্চাদেরকে বোঝায়। আপনিও বুঝবেন, আশা করি।
গোলাকার এই পৃথিবী প্রস্থচ্ছেদ করলে চারটা অংশ পাওয়া যায়। সবার ওপরে খোসা (Crust), এর নিচে বহিঃআবরণ (Upper Mantle), এর নিচে অন্তঃআবরণ (Lower Mantle), এরপর কেন্দ্র (Core).
ওপরের এই খোসাটাকে আপাতদৃষ্টিতে স্থির মনে হলেও আসলে ঘটনা কিন্তু সেটা নয়। পৃথিবীর যতটুকু স্থলভাগ আছে, সেগুলো এখন সমুদ্র দিয়ে আলাদা করা মনে হলেও একসময় এগুলো একত্রে ছিলো। সেটাকে একসময় রডেনিয়া বলতো, প্রায় ১ বিলিয়ন বছর আগের কথা। ৬০০ মিলিয়ন বছর আগে সেটা ভেঙে যায়। পরে সেটা আবার একত্রিত হয়েছিলো, সেটাকে আমরা বলি প্যানজিয়া। এটাও সরে গিয়ে আলাদা হয়ে যেতে শুরু করে ১৭৫ মিলিয়ন বছর আগে। সোজা কথায়, ওপরের এই চামড়া আসলে কখনোই খুব একটা শান্ত ছিলো না। বিভিন্ন প্লেটে প্লেটে আলাদা হয়ে এরা ঘোরাফেরা করছে।
অনেক জায়গাতে প্লেটগুলো খুব কাছাকাছি অবস্থান করছে। এতো কাছাকাছি যে দুইটা প্লেটের সীমানাই আপনি দেখতে পান, এবং আপনার কাছে মনে হয় যে এখানে একটা ফাটল (fault) হয়েছে। এই দুইটা প্লেট যখন একে অপরের সাথে ঘর্ষণ করে। যেহেতু প্লেটের সীমানাটা অন্য জায়গার তুলনায় অসমান বা উঁচুনিচু, এটা আটকে যায়। কিন্তু প্লেটের বাকি অংশ কিন্তু তখনো চলমান। এটা এই মুহূর্তেও (যখন আপনি কিছু অনুভব করছেন না, তখনো) চলছে।, তখন মাটি কেঁপে ওঠে। শেষ পর্যন্ত, যখন প্লেট বেশ কিছুদূর সরে যায়, আর সীমানাটাও ছিটকে পড়ে, তখন বেশ জোর কাঁপুনি হয়। আর সেটাকেই আপনি বলেন ভূমিকম্প।
বাসায় বসে ছোট্ট একটা গবেষণা করে ফেলুন নিজে নিজেই…
১) টিভি, ল্যাপটপ এগুলো যে বাক্সে করে আনেন, সেগুলোতে রাবার ফোম থাকে না? তেমন একটা রাবার ফোম নিন।
২) মাঝখান থেকে ভেঙে ফেলুন।
৩) এরপর একটা টেবিলের ওপর দুটো অংশকেই রাখুন, ভাঙার আগে টুকরোগুলো যে অবস্থানে থাকার কথা, ওভাবেই লাগিয়ে রাখুন।
৪) এরপর একটা অংশকে ঠেলুন, আরেকটা অংশকে টানুন।
৫) মাঝের ঘর্ষণের অংশতে (fault line) কিছু ফোম রাবার ভেঙে যাচ্ছে, তাই তো?
এটাই ভূমিকম্প।
ভূমিকম্পের মাত্রা/তীব্রতা
একটা সাধারণ ভুল ধারণা হচ্ছে – “উৎপত্তিস্থল থেকে যত দূরে যাওয়া যাবে, ভূমিকম্পের মাত্রা তত কমবে।” কিন্তু সেটা আসলে সত্যি নয়। ২০১৬ এর ১৩ই এপ্রিলের ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিলো মায়ানমার। এটার মাত্রা বলা হলো ৬.৯। তাহলে কি বাংলাদেশে আসতে আসতে বা কলকাতায় পৌঁছুতে পৌঁছুতে এটার মাত্রা কমে গেছে? জ্বি না। ভূমিকম্পের মাত্রা একটাই, এবং সেটা বিচার করা হয় উৎপত্তিস্থলেই। অনেক আগে উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেছিলাম, সূর্যের তাপমাত্রা মাপতে গেলে কিন্তু আমরা সূর্যের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা পরিমাপ করি অথবা কেন্দ্রের তাপমাত্রা পরিমাপ করি। পৃথিবীতে যে তাপটুকু আসে, সেটাকে ধরে নিয়ে কিন্তু সূর্যের তাপমাত্রা হিসাব করি না।
তাহলে কেন উৎপত্তিস্থলে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়? কেন উৎপত্তিস্থল থেকে দূরে ক্ষয়ক্ষতি কম হয়? কিছু একটা নিশ্চয়ই কমে যায়! হ্যাঁ, কমে যায়, আর সেটাই হচ্ছে ভূমিকম্পের তীব্রতা। কেন্দ্রে এই তীব্রতা সবচেয়ে বেশি থাকে এবং কেন্দ্র/উৎপত্তিস্থল থেকে যত দূরে যাওয়া যায়, ভূমিকম্পের তীব্রতা (intensity) তত কমতে থাকে। ২০১৫ সালের এপ্রিলের ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল নেপালে ছিলো বলে ওখানে তীব্রতা বেশি ছিলো, ক্ষতিও হয়েছে বেশি। বাংলাদেশে তীব্রতা ছিলো কম, ক্ষতি হয়েছে কম। এটা আমাদের সবার জানা রিখটার দিয়ে পরিমাপ করা হয় না। অন্য একটা স্কেল আছে, সেটার ব্যাপারে যথাসময়ে আসছি।
রিখটার স্কেল
১৯৩৫ সালে, ভূমিকম্পের আসল মাত্রা নির্ণয়ের চেষ্টা করেছিলেন চার্লস রিখটার এবং বেনো গুটেনবার্গ, দুজনেই ক্যালটেকের ভূমিকম্পবিদ। সীসমোগ্রাফ (যে গ্রাফ বা লেখচিত্রে মাটির কম্পন ধরা পড়ে)- এর মধ্যে তরঙ্গ আসে, সেটার লগারিদম নিয়ে রিখটার মাত্রা নির্ধারণ করা হয়। অর্থাৎ, মূলত কতটুকু কাঁপছে আমাদের সীসমোগ্রামের ঠিক নির্দিষ্ট বিন্দুতে, সেটাই আর কী! রিখটার স্কেলের ৪ মাত্রার ভূমিকম্পতে ৩ মাত্রার চেয়ে ১০ গুণ বেশি কাঁপে, একইভাবে ৫ মাত্রার ভূমিকম্পতে ৪ মাত্রার ভূমিকম্পের চেয়ে ১০ গুণ বেশি কাঁপে। এই স্কেলকে এখন লোকাল ম্যাগনিচিউড (local magnitude) স্কেল বলে।
এখন, খেয়াল করার মত বিষয় হচ্ছে ক্যালটেক বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে ক্যালিফোর্নিয়াতে। ক্যালিফোর্নিয়ার মত যেসব জায়গায় মাটির ১৬ কিলোমিটারের মধ্যে ভূমিকম্প হয়, সেগুলোর জন্য এই স্কেল ডিজাইন করা হয়েছিলো। কিন্তু সারা পৃথিবীর ভূমিকম্প যাচাই করে দেখা গেছে, এটার কেন্দ্র ০ থেকে ৭০০ কিলোমিটার নিচ পর্যন্ত হতে পারে। আধুনিক যুগের যন্ত্রপাতি পৃথিবীর যে কোনো জায়গার কম্পন সঠিকভাবে হিসেব করতে পারে, তাই আসল রিখটার স্কেলের পুনঃর্নির্মাণ করা জরুরি হয়ে পড়েছিলো।
রিখটার আসলে মোমেন্ট ম্যাগনিচিউড
মোমেন্ট ম্যাগনিচিউড (moment magnitude) স্কেল, নির্মাণ করা হয়েছিলো ১৯৭০ এর দিকে, করেছিলেন ক্যালটেকেরই বেশ কিছু বিজ্ঞানী। এটা ভূমিকম্পের প্রভাব আরো ভালো করে হিসেব করতে পারে। এই স্কেল কম্পনের ভ্রামক (moment) এবং শক্তি দুটোই ব্যবহার করে, এবং ভূমিকম্পের মোট উৎসারিত শক্তি নির্ণয় করে। বিভিন্ন দূরত্বে তরঙ্গের বিভিন্ন আকৃতি এবং দিকের তথ্য থেকে ফাটল প্রণালীর জ্যামিতি (fault geometry) নির্ণয় করা হয়। এই তরঙ্গের মানগুলো থেকেই ভূমিকম্পের ভ্রামক নির্ধারণ করা হয়।
এই স্কেলের মানকে এডজাস্ট করা হয়েছিলো, যাতে রিখটার স্কেলের সাথে মিলে যায়, কারণ রিখটার ততদিনে অনেক জনপ্রিয়। এখনো যখন আমরা বলি যে, রিখটার স্কেলে এতো মাত্রা, তখন কিন্তু আসলে আমরা মডিফায়েড মোমেন্ট ম্যাগনিচিউড স্কেলের কথাই বলছি।
মার্কেলি ম্যাগনিচিউড স্কেল
কম্পনের উৎস, মাত্রা, গভীরতা, ফাটলের দিক, এলাকার স্থাপত্য – এসব বিবেচনা করে আমেরিকার জিওলজিক্যাল সার্ভে (USGS) একটা স্কেল প্রণয়ন করেছিলো, যাকে মার্কেলি ম্যাগনিচিউড স্কেল (Mercalli magnitude scale) বলে। এই স্কেলের কাজ হচ্ছে, একটা এলাকার মানুষের ওপর ঐ ভূমিকম্পের কেমন প্রভাব পড়বে, সেটা পরিমাপ করা। এটার একটা সংস্কারকৃত সংস্করণ হচ্ছে মডিফায়েড মার্কেলি ইন্টেনসিটি স্কেল (Modified Mercalli Intensity scale বা MMI)। এই স্কেল দিয়েই ভূমিকম্পের তীব্রতা পরিমাপ করা হয়। ভূপৃষ্ঠে, মানুষের উপর, প্রকৃতিতে এবং মনুষ্য সৃষ্ট জিনিসপত্রের উপর ভূমিকম্পের প্রভাবকে MMI দ্বারা নির্ণয় করা হয়। এই স্কেলের সর্বনিম্ন মান হচ্ছে I, অর্থাৎ কিছুই অনুভূত হয়নি; সর্বোচ্চ মান হচ্ছে XII, অর্থাৎ সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেছে।
তথ্যসূত্র
১) http://goo.gl/5sHwfA
২) http://goo.gl/cUVWaK
৩) http://bit.ly/1Dn3356 (ছবি)
৪) http://usat.ly/1KeVTWP
৫) http://bit.ly/1Onzw7g
৬) http://bit.ly/1bsb6aX
৭) http://on.doi.gov/1hVppRQ