কয়েকদিন আগে একটা ডকু দেখার সময় চোখে পড়ল যে প্লাটিপ্লাসের কোনো স্তনবৃন্ত নাই। যদিও তারা স্তন্যপায়ী, তারপরও ছেলে/মেয়ে কারোই স্তনবৃন্ত নাই। প্লাটিপাস সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের স্তন্যপায়ী। এরা বাচ্চা দেয়ার বদলে ডিম দেয়। স্তন্যপায়ীদের যেই গ্রুপটা বাচ্চা দেয়ার বদলে ডিম দেয় তাদের “মনোট্রিম” (monotreme) গ্রুপে ফেলা হয়। এবং মজার ব্যাপার হলো – প্লাটিপ্লাস বাদেও এই গ্রুপে আরেক ধরনের প্রাণী দেখা যায়, এবং এরা প্লাটিপ্লাসের থেকেও অদ্ভুত, নাম “আখিডনা” (Echidna).
আমি সার্চ-দ্যা-খোঁজ করেছিলাম জানার জন্য যে কোন কোন পুরুষ স্তন্যপায়ীদের স্তনবৃন্ত নাই। বেশ কিছু তথ্য পেয়েছি এবং সেই সাথে জেনেছি আখিডনা নামক এই অদ্ভুত স্তন্যপায়ীদের সম্পর্কে কিছু তথ্য। স্তনবৃন্তবিহীন পুরুষ স্তন্যপায়ীদের ব্যাপারে আরেকদিন কথা বলা যাবে। আজ জানা যাক আখিডনা সম্পর্কে।
প্রথমেই বলেছিলাম, আখিডনা অদ্ভুত ধরণের একটা প্রাণী। এর কারণ – আখিডনার সজারুর মত কাঁটা, পাখির মত ঠোঁট, ক্যাংগারুর মত থলি, সরীসৃপ এর মত ডিম দেয়া। এই ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণীকে পাওয়া যায় তাসমানিয়া, অস্ট্রেলিয়া, এবং নিউ গিনিতে। এরা সাধারণত ১২-১৭ ইঞ্চি লম্বা হয় এবং ওজনে ৪-১০ পাউন্ড।
আখিডনার শরীরে সজারুর কাঁটার মত যেই কাঁটা দেখা যায় তা আসলে চুল। সজারুর কাঁটার মত নয়। শরীরের নীচের অংশ, মুখ এবং পা বাদে সারা শরীর এই দুই ইঞ্চি কাঁটার মত চুল দ্বারা ঢাকা থাকে ।
আখিডনার শরীরের তাপমাত্রা অন্য যে কোনো স্তন্যপায়ীর তুলনায় কম। এদের শরীরের তাপমাত্রা ৩২ ডিগ্রী সেলসিয়াস যেখানে মানুষের শরীরের গড় তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস। এবং এদের তাপমাত্রা অন্যান্য স্তন্যপায়ীদের মত নিয়ন্ত্রিত না, এদের শরীরের তাপমাত্রা ৬-৮ ডিগ্রী ওঠা নামা করে। এই কম তাপমাত্রা এবং ধীরগতির মেটাবোলিজমের কারণে তারা গড়ে ৪৫-৫০ বছর বাঁচে। এদের আরেকটা অদ্ভুত জিনিষ হল এদের ৪ মাথাওয়ালা লিঙ্গ। সঙ্গমের সময় পুরুষ আখিডনা দুইটা মাথা ব্যাবহার করে এবং বাকি দুইটা মাথা ব্যাবহার করে না। যে দুটো ব্যবহার করা হয় সেগুলো বড় হয় এবং সঙ্গমের সময়ে মাথা পরিবর্তন করে।
আরও মজার জিনিষ খেয়াল করা যায় এদের প্রজনন ঋতুর সময়। প্রায় ১২টি পুরুষ আখিডনা একটা ট্রেন তৈরি করে ১টি মহিলা আখিডনার পেছনে। এরকম একটা ট্রেন থাকে এক মাসের মত। কিছু পুরুষ চলে যায় আবার কিছু এসে যোগ দেয়। এবং যখন মহিলা আখিডনা সঙ্গমের জন্য তৈরি হয় তখন বাকি পুরুষেরা একটা সীমানা তৈরি করে মেয়েটাকে ঘিরে। তারপর তারা একজন আরেকজনকে এই সীমানার বাইরে বের করে দেয়। শেষ যে টিকে থাকে সীমানার ভেতরে সেই মহিলা আখিডনার সাথে সঙ্গমের সুযোগ পায়। এই ছোট ভিডিওটা দেখতে পারেন চাইলে।
শীতকালে এরা বিচেতন অবস্থায় থাকে। এবং শীতনিদ্রা অবস্থা থেকে যেসব ছেলে আখিডনা আগেই সচেতন হয়ে ওঠে তারা মাঝে মাঝে শীতনিদ্রা অবস্থায় থাকা মেয়ে আখিডনার সাথে মিলিত হয়। এবং এই কারণে শীতনিদ্রা থেকে সচেতন হওয়ার পর মাঝে মাঝে মেয়ে আখিডনারা বুঝতে পারে তারা গর্ভবতী।
আগেই বলেছিলাম, প্লাটিপ্লাসের মতই এই স্তন্যপায়ী বাচ্চা দেয়ার বদলে ডিম দেয়। গর্ভবতী হওয়ার পর আখিডনা একটা পাতলা চামড়ার আবরণের ডিম পাড়ে তার ক্যাংগারুর মত থলেতে। ডিম পারার দশ দিন পর বাচ্চা ডিম ফুটে বের হয়ে আসে।
যেহেতু তারা স্তন্যপায়ী তার মানে বাচ্চাদের মায়ের দুধ খাওয়াতে হবে, কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। বাকি সব স্তন্যপায়ীদের মত এদের স্তনবৃন্ত নাই। মেয়েদেরই নাই, আর ছেলেদের তো প্রশ্নই আসে না। তাহলে দুধ খাওয়াবে কিভাবে? আমাদের মত ওরা তো ফিডার খাওয়াতে পারে না, কিন্তু এটার সমাধান প্রকৃতির কাছে আছে। মেয়ে আখিডনাদের থলিতে বিশেষ ধরণের গ্রন্থি আছে যার দ্বারা আমাদের শরীর থেকে যেভাবে ঘাম বের হয় সেরকম ভাবে দুধ বেরিয়ে আসে। কিন্তু ঘামের মত সারা শরীর থেকে না বরং থলের নির্দিষ্ট জায়গা থেকে। যেখান থেকে আহখিডনার বাচ্চারা চুষে চুষে দুধ পান করে।
এসব অদ্ভুত ব্যাপার ছাড়াও আখিডনার মাঝে আরও কিছু অস্বাভাবিক ব্যাপার লক্ষ করা যায়। যেমন এদের দাঁত নেই, এদের জিহ্বা বেশ আঠালো এবং লম্বা। এই আঠালো এবং লম্বা জিহ্বার দিয়ে পিপড়া, টার্মাইট, পোকা ইত্যাদি খায়। এদের শরীরের তুলনায় মস্তিষ্ক বেশ বড়। একটা লম্বা সময় পর্যন্ত ধারণা করা হত আখিডনাদের ঘুমে REM (Rapid Eye Movement) এর স্তর পর্যন্ত যায় না। কিন্তু এখন জানা গেছে তারাও ঘুমের মাঝে ঐ স্তরে যায় শুধুমাত্র যখন তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রী থাকে। এর কম বেশী হলে তারা REM sleep এ যেতে পারে না।
এবং আরেকটা মজার ব্যাপার হল এই ছোট স্তন্যপায়ীর শরীরে বাস করে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ফ্লী (মাছিজাতীয় ডানাবিহীন পোকা, যা বিভিন্ন প্রাণীর শরীরের রক্ত খেয়ে বেঁচে থাকে)। এদের নাম Bradiopsylla echidnae বা সহজে “আখিডনা ফ্লী”। এরা লম্বায় ৪ মিলিমিটার কিংবা ০.১৫ ইঞ্চি।
মনোট্রিম দের নিয়ে আগ্রহ থাকলে এই ডকুটা দেখতে পারেন।
তথ্যসূত্র
www.wikipedia.com,
www.wired.com
http://www.nationalgeographic.com/
সৃষ্টিকর্তা পারমুটেশন-কম্বিনেশন এর ধারনা আবিস্কার করে কয়েকদিন খুবই এক্সাইটেড ছিলেন। সেই সময় যেসব প্রাণী তৈরী করেছেন তার মধ্যে একটা হল প্লাটিপাস, আরেকটা হল এই আখিডনা।