প্রযুক্তির মহাসাফল্যের এই সময়ে এসে ১ সেকেন্ডে আমরা কী করতে পারি তা বলার অপেক্ষা রাখে না! কেউ চাইলেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে মুহূর্তেই বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে চলে যেতে পারে। হাজার হাজার হিসেব নিকেশ করা যাবে ১ সেকেন্ডেই। আরো কত কি করা যায়! কিন্তু এই ১ সেকেন্ডে এমন কোন কাজ কি করা যায় – যা পরিবেশের জন্য কল্যাণকর? হয়ত কপালে কিছুটা চিন্তার ভাঁজ পরে যাবে! কিন্তু না, ১ সেকেন্ডেই এমন কাজ করে দেখাচ্ছে সার্চ ইঞ্জিন ‘ইকোশিয়া’।
পৃথিবীতে জনসংখ্যা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। একই হারে কমছে গাছপালা। স্বার্থের লোভে উজাড় করা হচ্ছে বন। হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির সজীবতা। ফলে দেখা যাচ্ছে বন্যা, খরাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিবর্তন হচ্ছে জলবায়ু। ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। ঠিক এরই মাঝে আশার সুবাতাস নিয়ে এসেছে ‘ইকোশিয়া’। স্বপ্ন বুনেছে সবুজে পূর্ণ নতুন এক পৃথিবী গড়ার।
এই স্বপ্নের যাত্রা শুরু হয় ২০০৭ সালে। সবেমাত্র জার্মানির নুরেমবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবসা প্রশাসন নিয়ে পড়াশোনা শেষ হয়েছে ক্রিস্টিয়ান ক্রোলের। শখ জেগেছে বিশ্ব ভ্রমণের। সেই ভ্রমণের উদ্দেশ্য ব্যবসা সংক্রান্ত অভিনব সকল আইডিয়া সংগ্রহ। ভারত, থাইল্যান্ড ঘুরে নেপালে যান ক্রোল। সেখানে ‘জ্যাভেল’ নামক একটি সার্চ ইঞ্জিন চালু করেন। সার্চ ইঞ্জিনটি স্থানীয় এনজিওর জন্য তহবিল গঠনে সহায়তা করত। তবে নেপালের বিদ্যুৎস্বল্পতা ব্যাঘাত ঘটায় তার কাজে। জ্যাভেলের কার্যক্রম বন্ধ করে ক্রোল পাড়ি জমান দক্ষিণ আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনায়। পার্শ্ববর্তী দেশ ব্রাজিলের একটি বিশাল অংশজুড়ে আছে অ্যামাজনের অবস্থান। সেখানে নির্বিচারে গাছকাটার মহোৎসব চলছে। এই দৃশ্য তার হৃদয়ে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। মাথায় ঘুরপাক খেলে বনায়নের কথা। ততদিনে তিনি উপলব্ধি করে ফেলেছেন যে- পৃথিবী প্রযুক্তির দাসত্ব গ্রহণ করছে দ্রুতগতিতে। প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে এ সমস্যা দূর করা যায়, সেটি ভাবতে ভাবতেই মাথায় আসে অভিনব এক ভাবনা।
২০০৯ সালের ৭ ডিসেম্বর কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় জলবায়ু সম্মেলন। সেদিন আনুষ্ঠানিকভাবে পথচলা শুরু হয় ক্রোলের আবিষ্কৃত নতুন এক সার্চ ইঞ্জিন ‘ইকোশিয়া’র। শুরুতে টিম ইকোশিয়া বিভিন্ন সেমিনারে বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করে। সেমিনারে বিভিন্ন গাছের চারা উপহার হিসেবে দেয়। প্রতিষ্ঠাতা সদস্য টিম শুম্যাচারকে সাথে নিয়ে বৃহৎ পরিসরে বনায়নের পরিকল্পনা করেন ক্রোল। অর্থের যোগান আসে সার্চ ইঞ্জিন ‘ইকোশিয়া’ থেকে প্রাপ্ত আয়ের লভ্যাংশ থেকে।
ক্রোলের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে এগিয়ে আসতে থাকে বিং, ইয়াহু। শুরু হয় এক চ্যালেঞ্জিং যাত্রা। ব্রাজিলের জুরুয়েনা জাতীয় উদ্যান ও আমাজনের একটা অংশে বৃক্ষ রোপণের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বৃহৎ পরিসরে যাত্রা। এরপর পেরু, উগান্ডা, হাইতি, স্পেন, মরক্কো, ইন্দোনেশিয়াসহ বর্তমানে ১৬টি দেশে তাদের কার্যক্রম চলমান আছে। ইতোমধ্যে তারা ১২ কোটি বৃক্ষ রোপণের মাইলফলক স্পর্শ করেছে। এবং প্রতি সেকেন্ডে এই সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। (সূত্রঃ ‘ইকোশিয়া’)
কীভাবে কাজ করে ইকোশিয়া? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে জানতে হবে সার্চ ইঞ্জিনের বিজ্ঞাপন রেভিন্যুউ সম্পর্কে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর প্রতি সার্চে বিভিন্ন কোম্পানি তাদের পন্যের বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করে। বিনিময়ে কোম্পানি সার্চ ইঞ্জিন প্রতিষ্ঠানকে একটি অর্থ সরবরাহ করে। ইকোশিয়া কর্তৃক প্রাপ্ত আয়ের লভ্যাংশের ৮০% ব্যয় করে বনায়ন কর্মসূচিতে। যেসব এলাকা ভয়াবহ বিরানভূমিতে পরিনত হয়েছে সেখানে স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে বনায়ন কার্যক্রম পরিচালনা করে টিম ইকোশিয়া।
ব্যবহারকারীর প্রতি ৪৫ টি সার্চের জন্য ইকোশিয়ার পক্ষে একটি করে বৃক্ষ রোপণ করা সম্ভব হয়। ইকোশিয়ার নিজস্ব এপ্লিকেশন প্লেস্টোরে পাওয়া যায়। উইন্ডোজ এর জন্য রয়েছে আলাদা সফটওয়্যার। এছাড়াও গুগল ক্রোম, মজিলা ফায়ারফক্সের জন্য ইকোশিয়ার এক্সটেনশন পাওয়া যায়। এর ফলে যে কেউ অন্য ব্রাঊজার দিয়েও সার্চ ইঞ্জিন ইকোশিয়াকে ব্যবহার করতে পারবে। একজন ব্যবহারকারী কতগুলো সার্চ করল তা ইন্টারফেসের ডান দিকে দেখা যায়। ফলে যে কেউ হিসেব করতে পারবে কতগুলো বৃক্ষ রোপণে সে সহায়তা করলো।
ইকোশিয়া নিয়মিত ব্লগ প্রকাশ করে। সেখানে তাদের কাজের সম্পূর্ণ হিসেব উল্লেখ করে। ২০১৩ সাল, যাত্রার ৪ বছরের মধ্যে তে ইকোশিয়া ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২ লক্ষ হলেও ২০১৮ তে এসে সেই সংখ্যা ৮০ লক্ষ ছাড়িয়ে যায়। ২০১৫ তে তাদের রোপণ করা বৃক্ষের সংখ্যা ছিল মাত্র ২০ লক্ষ। অথচ ২০১৯ এ এসে সেই সংখ্যা হয় ৫ কোটি। বর্তমানে এই সংখ্যা ১২ কোটি ছাড়িয়েছে। এর মূল কারণ ব্যবহারকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি। তাদের এই উল্লেখযোগ্য কাজের স্বীকৃতিস্বরুপ তারা কিছু আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেছে। তাদের কাজকে আরো এগিয়ে নিতে বিশ্বের ৪৭ টি দেশ ইকোশিয়াকে প্রধান সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে ব্যবহার করার ঘোষণা দিয়েছে। (সূত্রঃ উইকিপিডিয়া)
২০১৮ সালে ইকোশিয়া ব্যবহারকারীদের গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। বর্তমানে ব্যবহারকারীদের অনুসন্ধানকৃত বিষয়বস্তু এনক্রিপ্টেড করা হয়ে থাকে। ফলে ব্যবহারকারীদের তথ্য কর্তৃপক্ষের সংগ্রহে থাকে না। এছাড়াও এটি ব্যবহারকারীদের তথ্য তৃতীয় কোনো পক্ষের কাছে বিক্রিও করে না। তাই বর্তমানে ইকোশিয়া একটি পরিবেশবাদী ও ইউজার ফ্রেন্ডলি সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
প্রযুক্তির অব্যাহত উৎকর্ষে আমাদের বিলাসিতার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। হারিয়ে ফেলেছি প্রকৃতির প্রতি আগ্রহ। কিন্তু এই বিলাসিতা বৃদ্ধি করেছে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, যার প্রভাব সুস্পষ্ট। এই অবস্থাকে পাল্টে দিতে, পৃথিবীকে আবার নতুন করে সবুজায়ন করতে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি সুন্দর বাসযোগ্য ভূমি উপহার দিতে বনায়নের কোন বিকল্প নেই। আর এই জন্য এক যুগ আগে ক্রিস্টিয়ান ক্রোলের হাত ধরে যাত্রা করা ইকোশিয়ার অগ্রযাত্রা আবশ্যক।
এক সাক্ষাৎকারে ইকোশিয়ার প্রধান নির্বাহী ক্রিস্টিয়ানো ক্রোল বলেন, ‘ইকোশিয়া যদি গুগলের বাজার অবস্থানের ১০ শতাংশও পেয়ে যায় তাহলেও অর্ধেক পৃথিবীকে তারা সবুজায়ন করতে পারবে’। হয়ত অচিরেই আরো সাফল্য অর্জন করবে ইকোশিয়া। বৃদ্ধি পাবে ব্যবহারকারীর সংখ্যা। চলমান থাকবে প্রতি সেকেন্ডে পৃথিবীর কোন এক কোনে বৃক্ষ রোপণের অব্যহত যাত্রা। পৃথিবী আবার হয়ে উঠবে সবুজ অরণ্যভূমিতে পূর্ণ জীববৈচিত্রের এক স্বর্গভূমি!!