বিজ্ঞানযাত্রা ম্যাগাজিনের প্রথম ভলিউমের সম্পাদকীয়
বিজ্ঞানের জন্ম কীভাবে?
অন্য সকল মহাকাব্যের মতই বিজ্ঞানের গল্পও শুরু হয় “সে অনেককাল আগের কথা” দিয়ে। সেই প্রাচীনকালে, মানুষ যখন চিন্তা করার সক্ষমতা অর্জন করেছে; তখন থেকেই নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রকৃতিকে বুঝতে চেয়েছে, ব্যাখ্যা করতে চেয়েছে। মানবপ্রজাতির সেই চেষ্টার ধারাবাহিকতাতেই, ধীরে ধীরে আমরা আজকের বিজ্ঞানসম্মত চিন্তাগুলোতে উপনীত হয়েছি। সেই ধারাপ্রবাহের প্রথম ধাপ ছিলো পুরাণ বা Myth.
প্রাচীনকাল থেকে মানুষের মুখে মুখে উপাখ্যান তৈরি হয়েছে। এ ওকে বলে গেছে, সে তার পরের প্রজন্মকে বলেছে। প্রত্যেক প্রজন্মে গল্পগুলো একটু একটু করে পাল্টে গেছে, সাধারণ মানুষের বীরত্বের কাহিনীগুলো হয়ে গেছে দেবতাসুলভ। কাহিনী হয়ে গেছে কিংবদন্তী, কিংবদন্তী রুপান্তরিত হয়েছে পুরাণে। Lord of the rings: Fellowship of the ring চলচ্চিত্রের শুরুর দিকে এমন একটা উক্তি ছিলো – “History became legend, legend became myth”. রাহুল সাংকৃত্যায়নের “ভোলগা থেকে গঙ্গা” বইটার মধ্যে খুব চমৎকারভাবে পুরাণ তৈরি হওয়ার একটা ধারাপ্রবাহ দেখানো হয়েছে। যাদের বইটা পড়া নেই, তাদের সবাইকে বইটা পড়ার জন্য অনুরোধ করছি।
যাই হোক, এসব মিথ বা পুরাণ তৈরি হওয়ার পেছনে প্রাকৃতিক ঘটনাগুলো ব্যাখ্যা করার একটা প্রয়াস ছিলো। তাদের কাছে, প্রকৃতি ছিলো রহস্যে ভরপুর। সবসময়েই অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটছে প্রকৃতিতে। যেমন, পুরো আকাশ আলোকিত করে বজ্রপাত হচ্ছে, হঠাৎ হঠাৎ কেন যেন পানি পড়ছে, মাটিতে বীজ পড়লে সেখান থেকে কীভাবে যেন গাছ দাঁড়িয়ে যাচ্ছে বা ফসল ফলছে, রাতের বেলা সূর্য কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে। এগুলো দেখে মানুষ যারপরনাই অবাক হয়েছে। আমাদের সেই পূর্বপুরুষদের কাছে অতীতের কোনো ইতিহাস লিপিবদ্ধ করে রাখা ছিলোনা। তাদের কাছে এমন কোনো যন্ত্রপাতি ছিলোনা, যা দিয়ে তারা বিজ্ঞানসম্মতভাবে কিছু মেপে দেখতে পারে। তারা সবচেয়ে কম পরিশ্রমে যে ব্যাখ্যাটা দাঁড় করাতে পেরেছিলো, সেটাকেই গ্রহণ করেছিলো। অবশ্য গ্রহণ করার মত অন্য কোনো বিকল্প তো ছিলোই না। একমাত্র ব্যাখ্যাটাই ছিলো, রহস্যময় এক সত্তার প্রভাব—এমন এক সত্তা যার ক্ষমতা আছে সূর্যকে রাতের বেলা লুকিয়ে ফেলার, মাটি থেকে গাছ টেনে তোলার, বা চাঁদকে একেক সময়ে একেক আকৃতি দেয়ার। শুধু উর্বরতা আর বজ্রপাত নিয়েই বলি—নর্ডিক পুরাণে উর্বরতার দেবী ফ্রেইয়া, এবং বজ্রপাতের দেবতা থর। একই রকম দেব-দেবী গ্রীক (Demeter and Zeus), মিশরীয় (Amun or Isis, and Seth), রোমান (Fecunditus or Venus, and Jupiter), বা উপমহাদেশীয় (অদিতি/ভূমি আর ইন্দ্র) পুরাণেও পাওয়া যাবে।
এখান থেকে কাহিনী দু ভাগ হয়ে গেলো। প্রায় সব সভ্যতাতেই এই ধারণাগুলোকে আরো বেশি আঁকড়ে ধরার মাধ্যমে তৈরি হলো সুসংগঠিত ধর্ম। আর প্রাচীন গ্রীসে কয়েকজনের মনে হলো, এই ব্যাখ্যাগুলোর কোনো ভিত্তি নেই। তারা বললেন, সবকিছুকে নতুন করে চিন্তা করতে হবে। এই পুরাণকে ভেঙ্গে ফেলার মাধ্যমেই জন্ম নিলো দর্শন। এরিস্টটলের মতে, ৬০০ খ্রিস্টপূর্বের দিকে পৃথিবীর বুকে পদচারণা করে যাওয়া থেলিস ছিলেন আমাদের প্রথম দার্শনিক। তবে একজনের আবির্ভাবের আগে পুরো জিনিসটাই খাপছাড়া ছিলো। তিনি এসে এটাকে একটা শক্ত ভিত্তি দিলেন। এজন্য এখনো অনেকে তাকেই প্রথম দার্শনিক বা ফিলোসফার বলে অভিহিত করেন—তার নাম সক্রেটিস। কম কষ্ট সহ্য করেননি তিনি তার ধারণাগুলো প্রকাশ করার জন্য। কিন্তু, সেজন্যেই হয়তো আমরা এখনো সক্রেটিসের নাম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। উনি একটা আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন, যেটা আজো জ্বলছে।
ধর্ম আর দর্শন, দুটোই প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছে। ধর্ম যেখানে গুরুত্ব আরোপ করেছে নিজেকে সংঘবদ্ধ রুপ দান করতে, পুরাতন ব্যাখ্যাগুলোকে আঁকড়ে ধরতে; দর্শন চেয়েছে কোথাও ভুল হচ্ছে কিনা, সেটাকে চিহ্নিত করতে। স্বাভাবিকভাবেই ধর্ম মানুষের কাছে পৌঁছে গেলো খুব দ্রুত। দর্শন রয়ে গেলো কেবল ছিদ্রান্বেষীদের হাতে, অবশ্য এর গতি কমলোনা কিন্তু। কারণ, দর্শনের ঝাণ্ডা হাতে নিয়েছিলেন ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত ব্যক্তিরা, যেমন – সক্রেটিসের শিষ্য প্লেটো, এবং প্লেটোর শিষ্য এরিস্টটল, এমন আরো অনেকে। ধর্ম পুরনো গল্পগুলোকে নতুন রুপে উপস্থাপন করলো, আর Philosophy (Phil + Sophie = Love + Wisdom) নিজেকে যুক্ত করলো জ্ঞানের ভালোবাসায়, নতুন জ্ঞান তৈরির কাজে।
আর এভাবেই জন্ম বিজ্ঞানের। যদিও মাঝখানে আরেকটা ধাপ আছে, Naturalism, তবুও সেটাকে আলোচনার জটিলতা কমাতে বাদ দিয়ে গেলাম। তবে এটা জেনে রাখা ভালো, এখনকার যুগে আমরা যাদেরকে বিজ্ঞানী বলে আখ্যা দেই, একসময় তাদেরকে ন্যাচারালিস্ট বলেই অভিহিত করা হতো। আরেকটা বিষয় উল্লেখ করার মত, বিজ্ঞানও আসলে দর্শনই, তবে আরেকটু কঠোর রুপ।
যাই হোক, চিন্তাভাবনা করে হাইপোথিসিস দাঁড় করানোটাকে দর্শনের কাছ থেকে ধার করলো বিজ্ঞান, কিন্তু মনোনিবেশ করলো সেই হাইপোথিসিসগুলোকে যুক্তি দ্বারা প্রমাণ করে তত্ত্ব বা থিওরিতে রুপান্তরিত করতে। বিজ্ঞান বললো, “আমরা এখনো তেমন কিছুই জানি না, এবং সেগুলো নিয়ে গবেষণা করাই আমাদের প্রধান দায়িত্ব”। এই পদ্ধতিটাই আমাদেরকে পাল্টে দিলো।
“কেন আমাদের বিজ্ঞান বোঝা দরকার” শীর্ষক প্রবন্ধে কার্ল সেগান বলেছিলেন, “বিজ্ঞান শুধু জ্ঞানের একটা ভাণ্ডার নয়, এটা আসলে চিন্তার একটা প্রক্রিয়া। বিজ্ঞানের সার্থকতা এই চিন্তন প্রক্রিয়ার মধ্যেই নিহিত। বিজ্ঞান বাস্তবতাকে গ্রহণ করতে শেখায়, আমাদের পূর্ববর্তী ধারণা সেগুলো সমর্থন না করলেও। বিজ্ঞান আমাদেরকে পরামর্শ দেয় অন্যান্য ব্যাখ্যাগুলোকেও যাচাই করে দেখতে; যাতে সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যাখ্যাটা বের করা যায়। যতই প্রচলিত জনমতবিরোধী হোক না কেন, নতুন ধারণার প্রতি আমাদেরকে উদার হতে শেখায় এটা। নতুন ধারণা বা প্রতিষ্ঠিত সত্য, দুটোকেই কঠোরভাবে বিশ্লেষণ করতে শেখায়।”
এটা ছিলো বিজ্ঞানের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। আমাদেরকে দুটো জিনিস মনে রাখতে হবে। এক, এই যাত্রা সম্ভব হয়েছে পরিচিত ধারণার বাইরে বের হয়ে নতুন চিন্তা করতে সক্ষম হওয়া ব্যক্তিদের জন্য। আমরা তাদেরকে শ্রদ্ধা জানাই। দুই, যাত্রা শেষ হয়ে যায়নি। একজনের পর একজন নতুন চিন্তার মশাল বহন করেছেন বলেই আজ আমরা এ পর্যন্ত আসতে পেরেছি। আমাদের প্রজন্মকে আরো বেশি করে বিজ্ঞানঘেঁষা হতে হবে, আরো বেশি করে বিজ্ঞানচর্চা করতে হবে। সেই চিন্তার জায়গা থেকেই আমাদের ম্যাগাজিন “বিজ্ঞানযাত্রা”-র সূত্রপাত।
এখানে আমরা চেষ্টা করেছি, একদম সহজ ভাষায় বিজ্ঞানের বিভিন্ন দিক তুলে ধরার জন্য, যাতে বিজ্ঞানের প্রতি তরুণ সমাজ আগ্রহী হয়। ছোটোবেলা থেকে বিজ্ঞানের সংস্পর্শে থাকতে থাকতে একসময় ওরাই বড় বিজ্ঞানী হয়ে উঠবে। পাশাপাশি চেষ্টা করেছি, ওপরে উল্লেখ করা চিন্তা-পদ্ধতির সেই রাস্তাটার সন্ধান দিতে। তবে আশা করি, সব বয়সীদের কাছেই সমানভাবে উপভোগ্য হবে আমাদের প্রয়াস। আর অনুরোধ থাকবে, আপনারা প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে বিজ্ঞানের এই যাত্রাকে শক্তিশালী করবেন।
বিঃদ্রঃ ফেসবুকের “বইয়ের পোকা” গ্রুপে পুরাণ>দর্শন/ধর্ম>বিজ্ঞান এর জন্য প্রয়োজনীয় বইগুলোর একটা তালিকা করতে গিয়ে ফাঁকে ফাঁকে আপন খেয়ালে কিছু টেক্সট জুড়ে দিয়েছিলাম। সেটাকে কংকাল হিসেবে ব্যবহার করে রক্তমাংস জুড়ে এই সম্পাদকীয় লিখলাম।
বিজ্ঞানযাত্রা ম্যাগাজিন সংগ্রহ করার ডিটেইলস