ইলন মাস্কঃ মানবিক পৃথিবীর স্বপ্নদ্রষ্টা

­­

লিখেছেনঃ রুবেল রানা

খুব ছোটবেলায় লোকটির জীবনে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। দুটি ঘটনার একটি আনন্দের, অপরটি কষ্টের। ১৯৮৪ সালে তাঁর বয়স যখন ১২ বছর, তখন তিনি ‘ব্লাস্টার’ নামে একটি ভিডিও গেম নির্মাণ করেন এবং কোন এক ম্যাগাজিনের কাছে সেই গেম বিক্রি করে  ৫০০ ডলার আয় করেন। কষ্টের ঘটনাটি হচ্ছে, কিছু দুষ্টু ছেলে তাকে সিঁড়ি থেকে ফেলে দেয় এবং পিটিয়ে অজ্ঞান করে ফেলে রেখে চলে যায়। ১২ বছর বয়সেই ভিডিও গেম নির্মাণ করা সেই বিস্ময় বালক হলেন আজকের বিখ্যাত ইলন মাস্ক।

১৯৭১ সালে ২৮ জুন, সাউথ আফ্রিকার প্রিটোরিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন ইলন মাস্ক। ছোট বেলা থেকেই তিনি ছিলেন অন্য সবার চেয়ে আলাদা। তাঁর জানার আগ্রহ ছিল প্রচুর। তিনি দিনের ১০ ঘণ্টা সময় কাটাতেন তাঁর পছন্দের সব বই পড়ে; বেশির ভাগ বইগুলো ছিল পদার্থ এবং অর্থনীতি বিষয়ক। বই তাঁকে খুব সাহায্য করেছে বলে তিনি মনে করেন। বই সম্পর্কে মাস্ক বলেন, একটা সময় তিনি অন্ধকার ভয় পেতেন। কিন্তু বই পড়ে তিনি আবিষ্কার করলেন, অন্ধকার হচ্ছে ফোটনের অনুপস্থিতি মাত্র। কাজেই অন্ধকারকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এভাবে তিনি বই থেকে অর্জিত জ্ঞান এবং নিজস্ব চিন্তা-চেতনা বাস্তবে প্রয়োগ করতে চেষ্টা করতেন।

বর্তমানে অনেকগুলো পরিচয়ে পরিচিত ইলন মাস্ক। তিনি একাধারে একজন উদ্যোক্তা, প্রকৌশলী, বিনিয়োগকারী, উদ্ভাবক এবং ব্যবসায়ী। ‘মানব কল্যাণে বিজ্ঞান’’ এই ধারণা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন প্রতিনিয়ত। বাংলাদেশে বসে যখন তাঁকে নিয়ে লিখছি, নিশ্চয়তা দিয়ে বলা যায় তিনিও পৃথিবীর কোনো এক প্রান্তে বসে মানুষের কল্যাণের কথা ভেবে কাজ করে চলেছেন। সম্পূর্ণ একটি মানবিক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেন তিনি। স্বপ্নদ্রষ্টা এ মানুষটি সোলার সিটি, স্পেসএক্স আর টেসলা মটর নিয়ে বলেন, “আমি যেসব জিনিস নিয়ে কাজ করি তাঁর পেছনে রয়েছে এক স্বপ্ন। আমার স্বপ্ন এক পরিবর্তিত নতুন পৃথিবীর যা হবে আরও মানবিক।” তার লক্ষ্য বৈশ্বিক উষ্ণতা কমিয়ে এনে যান্ত্রিক শক্তি উৎপাদন ও ব্যবহার করা। তার নতুন স্বপ্ন তো কল্পনাকে হার মানানোর মত – ‘মানব জাতির টিকে থাকার ঝুঁকি’ মোকাবেলায় ভিন গ্রহে বসতি স্থাপন। তার প্রথম লক্ষ্য হলো মঙ্গল গ্রহে মানব বসতি গড়ে তোলা। ইলন মাস্কের এই স্বপ্নটি সারা বিশ্বে পরিচিত ‘মেকিং লাইফ মাল্টিপ্ল্যানেটারি’ নামে।

হাইপার-লুপ নামের এক ধরনের যোগাযোগ প্রযুক্তির কথা ভাবছেন মাস্ক, যা হবে অত্যন্ত দ্রুতগতির (তাঁর ব্যাখ্যানুযায়ী ঘণ্টায় ৬০০ মাইল)। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, হাইপার-লুপের মাধ্যমে আমেরিকার নিউইয়র্ক থেকে লস এঞ্জেলস যেতে সময় প্রয়োজন হবে ৪৫ মিনিট। তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়, এটি কিভাবে কাজ করবে! জবাবে তিনি বলেন, এটি হবে একটি টিউব কেন্দ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থা। টিউবটি একটি দেশের বিভিন্ন শহরে কিংবা কয়েকটি ভিন্ন দেশে যুক্ত থাকবে। টিউবের ভেতর থাকবে ক্যাপসুল আকৃতির যান, এ ধরনের ক্যাপসুলে চড়ে ঘণ্টায় ৬০০ মাইল বেগে ভ্রমণ করা সম্ভব হবে। যেহেতু টিউবটি হবে সম্পূর্ণ বায়ু-মুক্ত, কাজেই এতে ঘর্ষণ থাকবে না বললেই চলে।

এমন স্বপ্নের কথা তিনি অহরহ বলে চলেছেন। তিনি যে শুধু স্বপ্নের কথা বলে চলেছেন তা নয়, তিনি স্বপ্ন বাস্তবায়নও করে দেখিয়েছেন। বিশ্বব্যাপী টাকা লেনদেনের সবচেয়ে নিখুঁত উপায়গুলোর একটি ‘পেপ্যাল’-এর কথা আমরা প্রায় সবাই জানলেও হয়তো অনেকেই জানি না পেপ্যাল-এর প্রতিষ্ঠাতা কে! ক্যান হুয়ারি, ম্যাক্স লেভচিন, লিউক নসেক, পিটার থিয়েল এবং ইউ প্যানকে সাথে নিয়ে ১৯৯৮ সালে ‘পেপ্যাল’ প্রতিষ্ঠা করেন ইলন মাস্ক। পেপ্যাল নিয়ে তিনি বলেন, আমরা যখন কিছু তরুণ পেপ্যাল প্রতিষ্ঠা করি তখন মানুষ আমাদের এই সেবাকে মেনে নিতে পারেনি। পরে আমরা যখন তাদেরকে বিষয়টা বুঝিয়ে বলি, তখন ধীরে ধীরে মানুষ এই সেবা গ্রহণ করতে থাকে। আজ যদি আপনারা পেপ্যালের দিকে তাকান তাহলে দেখতে পাবেন, প্রতিষ্ঠানটি কত সুন্দর সেবা দিয়ে চলেছে।

বর্তমানের ইলন মাস্ককে শুধুমাত্র একজন ব্যক্তি হিসেবে দেখলে অন্যায় হবে। তিনি একটি প্রতিষ্ঠান। মহাকাশ নিয়ে তিনি এবং তাঁর রকেট নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ‘স্পেসএক্স’ যা করে চলেছেন, তা অকল্পনীয়। স্পেসএক্স নামের প্রতিষ্ঠান থেকে রকেট বানিয়ে সেই রকেটে করে মঙ্গলে ইঁদুর পাঠানো হবে। মঙ্গলে ইঁদুরের বংশ বৃদ্ধির চিন্তা থেকে তিনি প্রথমে রকেট বানাতে শুরু করেন। মাঝে এসে তিনি দেখলেন এখানে ব্যয় বেশি। এ কারণে সেখান থেকে তিনি সরে আসেন, কিন্তু রকেট বানানো থেকে তিনি সরে আসেননি। এমনকি মঙ্গলে মানুষের বসতি গড়নের পরিকল্পনা থেকেও মাস্ক সরে আসেননি। তিনি কয়েক বছর আগে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন, “আমি নাসার আশায় বসে থাকবো না। মানবজাতির স্বার্থেই আমরা মঙ্গলে বসতি গড়নের পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে পারি না।”

কল্পনাপ্রবণ এ মানুষটি ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির সমাবর্তনে দেয়া এক বক্তৃতায় বলেন, “আমি চাই তরুণরা ‘কল্পনাপ্রবণ’ হোক, তোমরা কল্পনাপ্রবণ হও। আজ থেকে অনেক বছর আগে ফিরে গেলে হয়তো দেখা যাবে, তখন কেউ প্লেন উড়ানোর কথা চিন্তা করলে তাঁকে হয়তো হত্যা করা হচ্ছে। কিন্তু আজ যদি তোমরা আরও বড় কোনো কল্পনা করো, তবে তেমন কিছু হবে না।”

নো রিক্স, নো গেইন

৪৫ বছর বয়সী এই বিজনেস ম্যাগনেট ২০১৬ সালে পৃথিবীর সেরা ১০০ ধনী ব্যক্তির তালিকায় ৮৩ তম ধনী ব্যক্তি হিসেবে জায়গা করে নেন। বিল গেটস, মার্ক জুকারবার্গের মত তিনিও একজন লোকহিতৈষী ব্যক্তি (ফিলানথ্রপিস্ট)। বিভিন্ন মানব সেবামূলক অলাভজনক সংস্থার সাথে তিনি যুক্ত।

মহৎ বিজ্ঞানী নিকোলা টেসলা ইলন মাস্কের প্রিয় ব্যক্তিত্বের একজন। ইলন মাস্ক নিকোলা টেসলার একটি উক্তি সর্বদা মেনে চলেন – “অর্থ মানুষের কাছে যেমন গুরুত্ব বহন করে, আমার কাছে অর্থের গুরুত্ব তেমন নয়। আমার অর্জিত সমস্ত অর্থ ব্যয় করা হয় আমার পরবর্তী আবিষ্কারের পেছনে, যাতে করে মানুষের জীবন আরও সহজ হয়।”

ইলন মাস্ক যেখানেই হাত দিয়েছেন, সেখানেই সফলতা পেয়েছেন। ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, শত শত বাধা বিপত্তির মাঝে যুদ্ধ করে যান ইলন মাস্ক। আবার দ্রুত হাল ছেড়ে দিয়ে পথ পরিবর্তনও করেন। নিজেকে মানিয়ে নেন, কোনো কিছু যদি তাঁর পথ আগলে দাঁড়ায়, তবে তিনি সেখানে গাপ্পি মাছের মত জান বাজি রেখে মারামারি করার বদলে জাত বিজ্ঞানীর মত একটু পিছিয়ে এসে দেখতে চেষ্টা করেন সেখানে কোন ভুল হয়েছে কিনা; বা ঐ একই পথে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য কোনো সুযোগ তৈরি হয়েছে কিনা। তিনি নিজেকে নিজের স্বপ্নের সাথে, সামর্থ্যের সাথে মানিয়ে যায় এমনভাবে প্রয়োজনমত বদলে নেন। একারণে তিনি ব্যর্থ হবার পরও সফল হবার জন্য বারবার সুযোগ পান।

আগ্রহী পাঠকেরা নিচের গ্রাফটি দেখতে পারেন, যেখানে ইলন মাস্কের “ইলন মাস্ক” হয়ে উঠার ধাপ দেখানো হয়েছে।

শুরু হয় ছোট থেকেই…

তথ্যসূত্রঃ

নিউইয়র্ক টাইমস, বিজনেস ইনসাইডার, হাফিংটন পোস্ট ডট কম, ইউটিউব চ্যানেল এলাক্স ডট কম এবং উইকিপিডিয়া।

Comments

বিজ্ঞানযাত্রা

বিজ্ঞানযাত্রা

বিজ্ঞানযাত্রা কর্তৃপক্ষ।

আপনার আরো পছন্দ হতে পারে...

3 1 vote
Article Rating
Subscribe
জানান আমাকে যখন আসবে -
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x