১
ল্যাবরেটরিতে যারা গবেষণার কাজ করেন তাদেরকে বিভিন্ন রকম বিপদজনক বস্তু থেকে নিরাপদ থাকার জন্য সবসময় নানান রকম সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। এমনি একটি বিপদজনক বস্তুর নাম হচ্ছে ইথিডিয়াম ব্রোমাইড (Ethidium Bromide)। মলিকুলার বায়োলজি নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের জন্য ইথিডিয়াম ব্রোমাইড একটি অতি প্রয়োজনীয় বস্তু। কিন্তু প্রত্যহ ব্যবহার্য এই অতি প্রয়োজনীয় বস্তুটি নিয়ে অনেক গবেষককেই মহা আতঙ্কে থাকতে দেখা যায়। এই বুঝি হাতে লেগে গেলো! ল্যাবে ইথিডিয়াম ব্রোমাইড সংশ্লিষ্ট বস্তুগুলোকে অন্যান্য বস্তু থেকে সবসময় আলাদা করে রাখা হয়। অনেকটা একঘরে করে রাখার মতই। ব্যবহার করার সময় ইথিডিয়াম ব্রোমাইড যেন শরীরে কিংবা ল্যাবের অন্য কোনো অংশে না লাগে তার জন্যে বিশেষ সতর্ক থাকার নির্দেশনামাও দেয়া হয়ে থাকে অনেক সময়। কিন্তু ইথিডিয়াম ব্রোমাইড নিয়ে এই অতিরিক্ত সতর্কতা (এবং আতঙ্ক) কতটুকু সঠিক তা কি আমরা কখনো ভেবে দেখেছি?
চলুন প্রথমেই দেখে নেই ইথিডিয়াম ব্রোমাইড কিভাবে কাজ করে? ইথিডিয়াম ব্রোমাইড একটি রঞ্জক পদার্থ যা জিন বিশেষ করে ডিএনএ’র উপস্থিতি সনাক্তকরণের জেল ইলেক্ট্রোফোরেসিস পদ্ধতিতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ইংরেজিতে একে বলা হয় ইন্টারক্যালেটিং এজেন্ট। পরীক্ষাগারে ইথিডিয়াম ব্রোমাইডকে ডিএনএর সাথে মিশ্রিত করলে এটি ডিএনএর দুই হাতলে অবস্থিত এডিনিন ও থাইমিন বেসের মধ্যে নিবেশিত হয়ে থাকে এবং অতিবেগুনী রশ্মির উপস্থিতিতে উজ্জ্বল বর্ণ প্রদান করে যা আমাদেরকে ডিএনএ’র উপস্থিতি সনাক্তকরণে সহায়তা করে।
কিন্তু এই ইথিডিয়াম ব্রোমাইড নিয়ে কেন এতো সতর্কতা? এর কারণ হল সজীব কোষের ডিএনএ’র ভিতর ইথিডিয়াম ব্রোমাইডের এই উপস্থিতি কোষের ডিএনএ এর স্বাভাবিক কার্যক্রম যেমন এর প্রতিলিপন, অনুলিপন ইতাদিকে বাধাগ্রস্থ করে। বলা হয়ে থাকে যে, ইথিডিয়াম ব্রোমাইড হচ্ছে একই সাথে একটি মিউটাজেনিক এবং টেরাটোজেনিক পদার্থ। অর্থাৎ এটি একটি কোষের ডিএনএ-তে পরিবর্তন আনতে পারে এবং ভ্রুণের বৃদ্ধিকে ব্যহত করার মাধ্যমে ত্রুটিপূর্ণ সন্তান উৎপাদনেও ভূমিকা পালন করতে পারে।
২
বস্তুত এতক্ষণ যেসব কথা বলা হলো, তার সবই ল্যাবে উৎপাদিত কৃত্রিম টিস্যু এবং ভ্রুণের উপর করা পরীক্ষা থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জ্ঞান। খুবই গুরুত্বপূর্ণ সেসব পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, ইথিডিয়াম ব্রোমাইডের একই সাথে ফ্রেম শিফট মিউটেশন, ক্রোমোসোমের পুনর্বিন্যাস, কোষ বিভাজন রুদ্ধ করা এবং ভ্রুণের সঠিক বৃদ্ধিজনিত সমস্যা সৃষ্টি করবার ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু এই পরীক্ষাগুলোর প্রতিটিই কেবলমাত্র একটি কোষ বা অরক্ষিত কোনো ভ্রুণের উপর ইথিডিয়াম ব্রোমাইডের প্রভাব ব্যাখ্যা করতে পারে কিন্তু একটি জ্যান্ত প্রাণীতে সেই প্রভাব কতটুকু মাত্রায় হতে পারে তা ব্যাখ্যা করতে পারে না। আবার কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে, যতটুকু ক্ষতিকর প্রভাব দেখা যায় সেটিও সরাসরি ইথিডিয়াম ব্রোমাইডের দ্বারা হয়ে থাকে না বরং ইথিডিয়াম ব্রোমাইড হতে উৎপন্ন অন্য কোনো মেটাবোলাইট কর্তৃক হয়ে থাকে।
প্রকৃতপক্ষে বহু আগে থেকেই নানান রোগে ইথিডিয়াম ব্রোমাইড ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। গবাদি পশুর ক্ষেত্রে ইথিডিয়াম ব্রোমাইডের সহনীয় মাত্রা নির্ধারিত আছে ১ মিলিগ্রাম/কিলোগ্রাম। আর আমরা ল্যাবরেটরিতে গবেষণার কাজে যে ইথিডিয়াম ব্রোমাইড ব্যবহার করি তার আদর্শ মাত্রা হল ১ মাইক্রোগ্রাম/ লিটার। সূতরাং এটা সহজেই অনুমেয় যে আমরা গবেষণার কাজে যে ইথিডিয়াম ব্রোমাইড ব্যবহার করি তা খুবই স্বল্প মাত্রার। এ প্রসঙ্গে রোসি রেডফিল্ডের তুলনাটি উল্লেখ করা যায়। তিনি বলেছেন, “৫০ কিলোগ্রাম একজন ব্যক্তি ৫০,০০০ লিটার ইথিডিয়াম ব্রোমাইড খেলেও তা গবাদি পশুর জন্য নির্ধারিত ক্ষতিকর মাত্রার ডোজের চেয়ে কম মাত্রার হয়”।
আফ্রিকার দেশগুলোতে ১৯৫০ সাল থেকে গবাদি পশুর পরজীবীঘটিত রোগ স্লিপিং সিকনেস (ট্রাইপানোসোমিয়াসিস) এর চিকিৎসায় ইথিডিয়াম ব্রোমাইড ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এই চিকিৎসায় ইথিডিয়াম ব্রোমাইডকে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে রক্তে প্রবাহিত করা হয়। কিন্তু এর ফলেও গবাদি পশুর মধ্যে টিউমারের আধিক্য কিংবা জন্মগত ত্রুটির বিস্তার ঘটেছে বলে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। যা গবেষণাগারে কৃত্রিম টিস্যু এবং ভ্রুণের উপর করা পরীক্ষার সাথে বৈপরীত্য প্রকাশ করে। উপরন্তু সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে ইথিডিয়াম ব্রোমাইডের ক্যান্সার কোষের মাইটোকন্ড্রিয়াকে অকার্যকর করার ক্ষমতা এবং টপোআইসোমারেজের ১ এর মতো কার্যকারিতা আছে যা কিনা ক্যান্সারের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হতে পারে।
৩
ইথিডিয়াম ব্রোমাইড নিয়ে আসল ভয়ের ব্যাপার হল এই যে, প্রকৃতপক্ষে ইথিডিয়াম ব্রোমাইড আমাদের জন্য যতটা না ক্ষতিকর, একে নিয়ে অতিরিক্ত আতঙ্কের ফলে আমরা যে সতর্কতাগুলো অবলম্বন করি সেগুলোই আমাদেরকে আরো বড় স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিতে পারে। যেমন ব্যবহৃত ইথিডিয়াম ব্রোমাইডকে নিষ্ক্রিয় করার জন্য বর্তমান পদ্ধতিতে প্রথমে একে চারকোল দ্বারা শোষণ করা হয় অতঃপর পোড়ানো হয়। কিন্তু চারকোল দ্বারা শোষণ করার ফলে ইথিডিয়াম ব্রোমাইডের শক্তিমাত্রা না কমে বরং বেড়ে যায়, যা ঝুঁকিকে না কমিয়ে আরও বাড়িয়ে তোলে। ইথিডিয়াম ব্রোমাইডের শোধনের আরেকটি প্রচলিত পদ্ধতি হল ফসফরিক এসিড, হাইড্রোক্লোরিক এসিড, ব্লিচিং পাউডার ইত্যাদির সাথে মিশ্রণ করা। কিন্তু এই পদার্থগুলো নিজেরাই অনেক বেশি বিপদজনক। উপরন্তু মিশ্রণের পর তারা ইথিডিয়াম ব্রোমাইডের চেয়েও ক্ষতিকর কোনো পদার্থ তৈরি করতে পারে। আবার ইথিডিয়াম ব্রোমাইডের প্রতি এই অতিমাত্রার ভীতির সুযোগ নিয়ে অনেক অসাধু প্রতিষ্ঠান কেবল “সেফ” শব্দ যুক্ত করেই ইথিডিয়াম ব্রোমাইডের বিকল্প হিসেবে আরও বেশি ক্ষতিকর কিছু বাজারজাত করার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ “SYBR safe” এর কথা বলা যায়। ইঁদুরের উপর পরীক্ষা করে দেখা গেছে এটির বিষাক্তটা ইথিডিয়াম ব্রোমাইডের চাইতেও বেশি।
মলিকুলার বায়োলজির গবেষণায় ইথিডিয়াম ব্রোমাইড একটি অপরিহার্য উপাদান। এই বস্তুটি যে গবেষণার কাজে কতখানি গুরুত্ব বহন করে তা এর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিমাত্রই জানে। এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে ইথিডিয়াম ব্রোমাইড একটি ক্ষতিকর ও বিপদজনক পদার্থ। কিন্তু এই বস্তুটি নিয়ে গবেষকদের মধ্যে যে পরিমাণ ভীতি কাজ করে সেটাও একটু বাহুল্যই বটে। সুতরাং ইথিডিয়াম ব্রোমাইড নিয়ে প্রচলিত মিথগুলো থেকে বের হয়ে এসে আমাদেরকে আরও সচেতন হতে হবে এবং যতদিন পর্যন্ত এর বিকল্প হিসেবে অধিক নিরাপদ ও কার্যকরী কোনো রঞ্জক পদার্থের আগমন না ঘটছে ততদিন পর্যন্ত এই ইথিডিয়াম ব্রোমাইডকেই আমাদেরকে আরও সঠিক উপায়ে ব্যবহার করার পন্থা বের করতে হবে।
তথ্যসূত্রঃ
https://en.wikipedia.org/wiki/Ethidium_bromide
http://www.bitesizebio.com/95/ethidium-bromide-a-reality-check/
http://blogs.sciencemag.org/pipeline/archives/2016/04/18/the-myth-of-ethidium-bromide