বিবর্তনের স্বপক্ষে প্রাপ্ত প্রমাণগুলো একত্র করলে এর বিরুদ্ধে কোনো যুক্তি উপস্থাপন অসম্ভব। বর্তমানকালে প্রতিনিয়তই যেন বিবর্তনের প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। চিকিৎসাবিজ্ঞান যত উন্নত হচ্ছে, জীববিজ্ঞান যত অগ্রসর হচ্ছে বিবর্তন তত বেশি প্রমাণ নিয়ে হাজির হচ্ছে। বিবর্তনের বই যদি মিলিয়ন পৃষ্ঠা সম্বলিত হয়, কোনো বইয়ের কয়েকটি পাতা শুধু পড়া বাকি বিবর্তন বিষয়ে। তবে, বর্তমানে এটা প্রমাণিত বিষয়। কেউ মানুক বা না মানুক, সত্য কিন্তু বদলে যায় না। চোখের সামনে প্রমাণ দেখে হয়তো চোখ বুজে আছে কোটি খানেক ভান ধরা মানুষ। তাদেরকে বলবো, তারা যেন জাগ্রত হয়। সেই লক্ষ্যে, আরো কিছু প্রমাণ নিয়ে হাজির হলাম।
অঙ্গসংস্থানিক প্রমাণ
অঙ্গসংস্থান জীববিজ্ঞানের এমন একটি শাখা যাতে জীবের গঠন ও আকৃতি (বাহ্যিক বা আভ্যন্তরীণ) সম্বন্ধে আলোচিত হয়। বিভিন্ন মেরুদণ্ডী প্রাণীর বাহ্যিক ও অন্তর্গঠন পর্যালোচনা করলে সুস্পষ্ট হয়, নিম্নশ্রেণীর প্রাণী হতে উচ্চশ্রেণীর প্রাণীদেহে অঙ্গসংস্থানজনিত জটিলতা ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে। অঙ্গসংস্থানিক প্রমাণকে নিম্নোক্ত কয়েকটি শিরোনামে আলোচনা করা যায়-
১) তুলনামূলক শারীরস্থানঃ বিভিন্ন মেরুদণ্ডী প্রাণীর হৃদপিণ্ডের গঠনের তুলনামূলক আলোচনা করলে দেখা যায়, মাছে দুইপ্রকোষ্ঠ বিশিষ্ট, ব্যাঙে তিন, সরীসৃপে আংশিক চার, পাখি ও স্তন্যপায়ীতে সম্পূর্ণ চার প্রকোষ্ঠ বিশিষ্ট হৃদপিণ্ড বিদ্যমান। বিবর্তনের ধাপে ধাপে অলিন্দ ও নিলয় বিভক্ত হওয়ায় দূষিত ও বিশুদ্ধ রক্ত মিশে যেতে পারে না। অভিযোজনের জন্য হৃদপিণ্ডের গঠন এভাবে ক্রমশ জটিল হয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন জীবের হৃদপিণ্ডের এই সামঞ্জস্য বিবর্তনের স্বপক্ষে একটা বড় প্রমাণ।
হৃদপিন্ডের মতো বিভিন্ন প্রাণীর মস্তিস্কের গঠন পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, মাছ থেকে শুরু করে স্তন্যপায়ীর মস্তিষ্ক পাঁচটি ভাগে বিভক্ত। বিবর্তনের সিড়ি ধরে আমরা যত উপরে উঠি, ততই অপেক্ষাকৃত সরল গঠনের মূল কাঠামোটির ক্রমিক জটিলতা দেখতে পাই। বিশেষ করে সেরেব্রেল হেমিস্ফিয়ার এবং সেরেবেলাম এর। (সেরেবেলাম 3D এনিমেশন, আর এটা আপনার মস্তিষ্কের পূর্ণাঙ্গ 3D এনিমেশন)
২) সমসংস্থ অঙ্গঃ বিভিন্ন প্রাণীর যেসব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ উৎপত্তির দিক থেকে সদৃশ, তাদেরকে সমসংস্থ অঙ্গ বলে। যেমনঃ পাখির ডানা, ঘোড়ার সামনের পা, মানুষের হাত, তিমির অগ্রপদ, বাদুড়ের ডানা ইত্যাদি। অন্যদিকে যেসব অঙ্গ একই ধরনের কাজ করে অথচ এদের গঠন পদ্ধতি, উৎপত্তি, আভ্যন্তরীণ গঠন ইত্যাদি ভিন্ন তাদেরকে সমবৃত্তি অঙ্গ বলে। যেমনঃ পাখির ডানা, প্রজাপতির ডানা ইত্যাদি। মাছ ছাড়া অন্যসব মেরুদন্ডী প্রাণীর অগ্রপদ যেমন- মানুষের হাত, ঘোড়ার সামনের পা, পাখির ডানা যতই ভিন্ন হোক না কেন এদের অস্থি, পেশী, রক্ত সঞ্চালন, স্নায়ু বিন্যাস ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য একই। একটি অঙ্গ ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীতে ভিন্ন ভিন্ন রূপ নিয়েছে।
অর্থাৎ, সমসংস্থ অঙ্গসমূহ নিশ্চিতভাবেই প্রাণীদের মধ্যে আসল জ্ঞাতিতাত্ত্বিক সম্পর্কের প্রমাণ বহন করে। অর্থাৎ সমসংস্থ অঙ্গধারীরা একটি সাধারণ পূর্বপুরুষ হতে উদ্ভূত।
৩) নিষ্ক্রিয় অঙ্গঃ প্রাণীদেহে এমন কিছু অঙ্গ দেখা যায়, যা আপাতদৃষ্টিতে নিষ্ক্রিয় বা কার্যক্ষম নয় বলে মনে হয়। এসব অঙ্গকে নিষ্ক্রিয় অঙ্গ বলে। মানবদেহে শতাধিক নিষ্ক্রিয় অঙ্গের সন্ধান পাওয়া গেছে।
যেমনঃ-
*চোখের ভিতরের দিকের কোণায় উপপল্লব।
*আক্কেল দাঁতসহ কয়েক ধরনের দাঁত। (বিবর্তনের বড় একটা প্রমাণ আপনার মুখে! আমরা একসময় লেজ হারিয়েছি, কারণ তার বদলে হাত দুইটার চমৎকার ব্যবহার শিখেছি। এখন দাঁত হারানো শুরু করেছি। আগে ৩৬ টা দাঁত ছিলো আমাদের। এখন ৩২ টা দাঁত বেশিরভাগ লোকের। তবে, বর্তমান কালে ২৮ টা দাঁতের কাঠামো নিয়ে জন্ম নেওয়া মানবসন্তানও দেখছি আমরা। এই নিষ্ক্রিয় অঙ্গের পতনের চাক্ষুষ প্রমাণ এটা।)
*গায়ের লোম।
*বহিঃকর্ণের তিনটি করে কর্ণ পেশী।
*লেজের বিলুপ্তি হলেও পুচ্ছাস্থির এখনো সম্পূর্ণ বিলুপ্তি হয়নি।
*বৃহদান্ত্রের সাথে যুক্ত অ্যাপেন্ডিক্স।
ইত্যাদি…
বিভিন্ন স্তন্যপায়ী প্রাণীতে এদের সক্রিয় ভূমিকা এখনো দেখা যায় না। গরু কান নাড়াতে পারে, মানুষ তা পারে না। মানুষের লেজের কশেরুকাগুলো একত্রিত হয়ে ছোট অস্থি পিন্ড বা কক্কিক্স হিসেবে মেরুদন্ডের পশ্চাৎপ্রান্তে এখনো অবস্থান করছে। পরিবেশগত কারণে মানুষের এসব অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো প্রয়োজনে না আসায় বিবর্তনের মাধ্যমে নিষ্ক্রিয় অঙ্গে রুপান্তরিত হয়েছে।
কোষতাত্ত্বিক প্রমাণ
উদ্ভিদ ও প্রাণীর কোষের মৌলিকগঠন ও কোষ বিভাজন পদ্ধতি প্রায় একই রকম। আণবিক পর্যায়ে সজীব কোষ – অঙ্গাণুগুলো, যেমন- মাইটোকন্ড্রিয়া, রাইবোজোম, ক্রোমোজোম, লাইসোজোম, গলজি বস্তু প্রভৃতির গঠন প্রায় সদৃশ্য। তাই বলা যায়, উদ্ভিদ ও প্রাণী একই পূর্বপুরুষ হতে উদ্ভূত।
জিনতাত্ত্বিক প্রমাণ
জীবদেহের বৈশিষ্ট্যের ধারক ও বাহক জিন। জিনের সঞ্চারণক্ষম স্থায়ী পরিবর্তনই মিউটেশন। অতিবেগুনী রশ্মি, এক্স-রে, মাস্টার্ড গ্যাস ইত্যাদি প্রয়োগে জিনের গঠনের পরিবর্তন আসে। জিনের পার্থক্যজনিত কারণে একটি প্রজাতি অন্য প্রজাতি হতে সম্পূর্ণ ভিন্ন। কৃত্রিম উপায়ে এখন অহরহ জিন পরিবর্তন করা হচ্ছে। এটা বিবর্তনের সুস্পষ্ট প্রমাণ যে, জিন প্রাকৃতিক ভাবে লক্ষ বছর ধরে পরিবর্তন হতে পারে ও হয়েছে। প্রয়োজনীয়তা ও পরিবেশ কোটি কোটি বছরের পরিবর্তনের মাধ্যমে নতুন নতুন বহু প্রজাতি তৈরি করেছে। বিলুপ্ত হয়েছে বহু প্রজাতি। বিবর্তনের এর চেয়ে চাক্ষুষ প্রমাণ আর কি হতে পারে?
ভ্রূণতাত্ত্বিক প্রমাণ
বিবর্তনের প্রত্যক্ষ প্রমাণের মধ্যে ভ্রূণতাত্ত্বিক প্রমাণ খুবই শক্তিশালী। প্রতিটি বহুকোষী প্রাণী একটি জাইগোট (একটি একক কোষ) থেকে পরিস্ফূটিত হয়। জাইগোটের বিভাজন মানুষসহ সকল বহুকোষীতে একই রকম।
যে সব পূর্ণাঙ্গ প্রাণী গঠনগত দিক থেকে একরকম, তাদের পরিস্ফূটন পদ্ধতিও সদৃশ! পরে বিভিন্ন গোষ্ঠীতে পরিস্ফূটন রীতি আলাদা আলাদা রূপ নেয়। এ বিভিন্নতা অনেকটা গাছের শাখা-প্রশাখা বিস্তারের মতো অগ্রসর হতে থাকে।
উপরের চিত্রটি লক্ষ্য করুন। মাছ, উভচর,সরীসৃপ, পাখি ও স্তন্যপায়ীর প্রাথমিক অবস্থার ভ্রূণকে পৃথক প্রায় অসম্ভব। পরিস্ফূটন পরবর্তী পর্যায়ে প্রত্যেক শ্রেণীর বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকাশিত হয়।
ভ্রূণের এই অদ্ভুত মিল লক্ষ্য করে জার্মান বিজ্ঞানী কার্ল ভন বেয়ার (Karl von Baer, 1818) বলেছেন যে, ভ্রূণাবস্থায় একটি জীব আদি ইতিহাসকে সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করে থাকে। তার মতে-
১) বিশেষ বৈশিষ্ট্য আগমনের আগে সাধারণ বৈশিষ্ট্যের উদ্ভব ঘটে।
২) সাধারণ বৈশিষ্ট্য হতে ধাপে ধাপে বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো দেখা যায়।
৩) ভ্রূণাবস্থায় একটি প্রাণী অতি দ্রুত অন্যান্য প্রাণীর গঠন ত্যাগ করে।
৪) একটি শিশু প্রাণীকে তার নিম্নস্তরের প্রাণীগোষ্ঠীর পূর্ণাঙ্গ দশার মতো নয় বরং শিশু বা ভ্রূণীয় দশার মতো দেখায়।
এই বিশেষ ঘটনা এটা প্রমাণ করে, সকল মেরুদণ্ডী প্রাণী একই পূর্বপুরুষ থেকে সৃষ্টি হয়ে পরে বিভিন্নভাবে প্রকাশিত হয়েছে।
পরবর্তীকালে হেকেল (Haeckel) ১৮৬৬ সালে বিভিন্ন প্রাণীর জীবন-ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করে এই মত দেন যে, কোনো একটি জীবের ভ্রূণের পরিস্ফুটনকালে তার পূর্বপুরুষের ক্রমবিকাশের ঘটনাবলি পুনরাবৃত্তি করে। এই মতবাদকে পুনরাবৃত্তি মতবাদ (Recapitulation Theory) বলে।
শারীরবৃত্তীয় প্রমাণ
এই প্রমাণটিকে সুস্পষ্ট করতে কয়েক ভাগে ভাগ করা হয়। যেমনঃ-
১) জীবের রাসায়নিক গঠনঃ প্রতিটি জীব কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, সালফার, ফসফরাস ইত্যাদি মৌলের সমন্বয়ে গঠিত। আপনি যদি একজন সুস্থ সবল মানুষ হয়ে থাকেন, তাহলে আপনার শরীরে এই উপাদান গুলো আছে-
বিভিন্ন মৌল মিলিত হয়ে সজীব প্রোটোপ্লাজম গঠন করে। প্রতিটা জীবে রাসায়নিক সদৃশ এত বেশি যে, তারা যে এক পূর্বপুরুষজাত এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।
২) রক্তের মিলঃ বানরের রক্তের সাথে গ্লেসিয়াল এসিটিক এসিড মিশ্রিত করে উত্তপ্ত করলে হিমোগ্লোবিন স্ফটিক গঠিত হয়। মানুষ ও বানরের হিমোগ্লোবিন স্ফটিক একই। এটা দৃঢ় ভাবে প্রমাণ করে যে, মানুষ ও বানর নিকটাত্মীয়।
৩) হরমোনের সমতাঃ আরেকটা অকাট্য প্রমাণ। বিভিন্ন মেরুদণ্ডী প্রাণীতে যে হরমোন পাওয়া যায় তাদের গঠন ও কর্মপদ্ধতি একইরকম। এটা প্রমাণ করে, আমরা সবাই একই পূর্বপু্রুষজাত।
৪) সেরামের গঠনঃ মানুষের সাথে বানরের যতটা, তার চেয়ে শিম্পাঞ্জীর সেরামের মিল বেশি। এ ঘটনা বিবর্তনের চাক্ষুষ প্রমাণ।
৫) রক্ত আমিষের সাদৃশ্যঃ বিভিন্ন প্রাণীর রক্ত আমিষ বিবর্তনের জোরালো দাবিদার।
৬) পরজীবি ও রোগঃ পরজীবি ঘনিষ্ট সম্পর্কযুক্ত প্রাণীদিগকে আক্রান্ত করে। আবার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত প্রাণীরাই একই ধরনের রোগে আক্রান্ত! কোনো এক ভাইরাস বা ব্যকটেরিয়ার কথা ধরুন, প্রতিনিয়ত ওষুধের মান হালনাগাদ হচ্ছে। কোনো ভাইরাস দীর্ঘদিন ধরে একই ওষুধের মোকাবেলা করে, তা মানিয়ে নিচ্ছে। প্রয়োজন হচ্ছে নতুন ও শক্তিশালী ওষুধের। এর পরেও কি “বিবর্তন তো এখন ঘটছে না, দেখছি না! আমাকে দেখাও!” বলবেন?
এত এত প্রমাণ, অকাট্য দলিল! আর কতদিন মিথ্যাকে, কুসংস্কারকে আঁকড়ে রাখবেন? নিজেকে প্রশ্ন করুন। ঘুমের ভান করে আর কত? সময় হয়েছে জাগার। আমাদের শপথ হোক একটাই, আমরা সত্য খুঁজবো, জানবো, বুঝবো; সত্যকে অনুসরণ করবো, তা আমাদের যেদিকেই নিয়ে যাক না কেন।
লজ্জা পাচ্ছেন, বর্জ্য হতে নিজের সৃষ্টি মেনে নিতে? অহংকারী মনোভাব নিয়ে আর কতদিন জাতি ঘুমাবে? কোনো অতিপ্রাকৃতিক শক্তি না, বরং এই মহাবিশ্বের টুকরো দিয়েই আপনি, আপনার প্রিয় বিড়াল, কুকুর বা হাজার টাকা দিয়ে কেনা জুতা ইত্যাদি তৈরী। আসুন অহংকার, হিংসা, হানাহানি বর্জন করি। আমরা সবাই যে নিকটাত্মীয়, এই প্রমাণিত বিষয়টা মেনে নিই। সবাইকে ভালবাসি। পৃথিবীটা বসবাসযোগ্য রাখি। জাতিগত বিদ্বেষ, ধর্মীয় প্রতিহিংসা, বর্ণবাদ, আন্তর্জাতিক সীমারেখার চরম বন্ধন ভেদ করে সুস্থ মানসিকতার একটা বিশাল সমাজ, রাষ্ট্র গড়ে তুলি।