বেশ কয়েকটা বইয়ে বিবর্তনের সংজ্ঞা দেওয়া আছে অনেকটা এভাবে [সাবধানবাণী – সংজ্ঞাটা ভুয়া],
যে প্রক্রিয়ায় কোনো জীব বেঁচে থাকার জন্য, প্রকৃতি থেকে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা পাওয়ার জন্য নিজের পরিবর্তন ঘটায়, তাকে বিবর্তন বলে। অথবা, যে প্রক্রিয়ায় সহজতর জীব জটিল জীবে পরিণত হয় / অনুন্নত জীব আরো উন্নত হয়, তাকে বিবর্তন বলে।
একটা বুদ্ধিমান বানর (অনেকে যাকে ডারউইনের পূর্বপুরুষ বলে থাকেন) একদিন হাঁটতে হাঁটতে আবিষ্কার করল হেঁটে চলাটা কুঁজো হয়ে চলার চেয়ে সোজা। তার বংশধরেরা হাঁটতে শুরু করল। তারা দেখল লেজের কোনো প্রয়োজন নেই, বিবর্তনের একটা পর্যায়ে লেজ বিলুপ্ত হয়ে গেল।
মরুভূমির প্রাণীরা দেখল, সেখানে বেঁচে থাকার জন্য শরীরে পানি জমা করে রেখে দেওয়ার প্রয়োজন আছে। তাই তাদের পানি রাখার জন্য আলাদা অঙ্গ তৈরি হলো। বিভিন্ন প্রাণী শত্রুর হাত থেকে বাঁচার জন্য ছদ্মবেশ ধারন করল। কোষীয় অঙ্গাণুগুলো কোনো এক জৈবিক প্রক্রিয়ায় বুঝতে পারে তাদের উন্নত হতে হবে। তারা উন্নত হতে শুরু করল। বিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায়ে কেউ পেল ফুলকা, কেউ ফুসফুস। কেউ প্রোক্যারিওটিক অবস্থায় থেকে গেল, কেউ ইউক্যারিওটিকে পরিণত হলো।
বির্বতনের প্রতিটি ধাপে জীবগুলো নিজেদের পরিবেশের সাথে উন্নত করে ফেলতে লাগল। যারা পারল না, তারা প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী বিলুপ্ত হয়ে গেল। বানর একসময় মানুষে পরিণত হয়ে গেল, কিছু বানর অবশ্য বানরই থেকে গেল (ছোট্ট একটা কৌতুক: অনেকে বলে, মানুষ বানর থেকে এসেছে। আসলে কিছু কিছু মানুষ এখনও বানরই থেকে গেছে) ।

যেমন, জন ল্যামার্ক ব্যাপ্টিস্ট-এর মতবাদ অনুযায়ী, লম্বা গাছ থেকে পাতা খাওয়ার জন্য গলা উঁচিয়ে রাখতে রাখতে দেখা গেলো, কয়েক প্রজন্ম পরে খাটো গলাওয়ালা জিরাফগুলোর গলা লম্বা হয়ে গেছে!
উপরের সারমর্মটাকেই অনেকে (প্রায় সবাই) মনে করেন বিবর্তনের ধারণা।
আসলে বির্বতন বলতে এসবের কিছুই বুঝায় না। বিবর্তন পুরোপুরি একটি ভিন্ন প্রক্রিয়া।
ছোটবেলায় সম্ভবত ডিসকভারি চ্যানেলে বিবর্তন নিয়ে প্রথম প্রতিবেদন দেখেছিলাম। মনে অনেকবার প্রশ্ন জেগেছিল কোষগুলো, কোষীয় অঙ্গাণুগুলো কীভাবে বুঝে তাদের উন্নত হতে হবে? তারা কীভাবে বুঝে তাদের কী কী উন্নত করতে হবে, কোন অংশটুকু বদলিয়ে ফেলতে হবে? কোষ, জিন কেমন করে নিজেকে বদলিয়ে ফেলে? তাহলে কি কোষ অথবা জিনের স্বতন্ত্র জীবন আছে? তাদের কি বুদ্ধি আছে? হয়তো সেই বুদ্ধি দিয়ে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করছে!
কোনো বইয়ে (সম্ভবত অষ্টম শ্রেণীর সাধারণ বিজ্ঞান বইয়ে) পড়েছিলাম, অথবা কোনো এক স্যার বলেছিল, এই কাজটা প্রকৃতি করছে। প্রকৃতিই ঠিক করছে, কে বেঁচে থাকবে আর কে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কোন জীবের কী কী অঙ্গাণুর পরিবর্তন ঘটাতে হবে, তাও প্রকৃতিই নির্বাচন করছে। যেহেতু প্রকৃতি তার ইচ্ছেমত এটা করছে, সেহেতু এটা প্রাকৃতিক নির্বাচন। আচ্ছা, প্রকৃতির কি জীবন আছে? প্রকৃতি কিভাবে ঠিক করবে কখন কী করতে হবে? আগে কিছু (এবং এখনও) মানুষ প্রতিবাদ করত, তারা বানর থেকে আসেনি। অবশ্য শুধু ডারউইনের পূর্বপুরুষ বানর হলেও হতে পারে। ইদানিং খুব সম্ভবত বানরেরাও প্রতিবাদ করছে, তাদের থেকে মানুষ কোনোভাবেই আসতে পারে না। মজার ব্যাপার, স্বয়ং ডারউইনও বানরদের প্রতিবাদ মেনে নিয়েছেন, কারণ তিনি বলেননি, মানুষ বানর থেকে এসেছে।
ডারউইন বলেছিলেন, মানুষ আর বানরের পূর্বসূরী এক। এই কথাটাও বিবর্তনের মাধ্যমে যখন আমাদের কানে এসে পৌঁছেছে, তখন আমরা শুনেছি, মানুষ বানর থেকে এসেছে। এই অর্থেও বিবর্তন মানেই পরিবর্তন হওয়া। এবং পরিবর্তন হয়ে কী হবে, সেটা আগে থেকে জানা যাবে না (এখানে জীব নয়, কথারও বিবর্তন হচ্ছে)।
মিউটেশন
বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই রেডিয়েশনের কারণে, ট্রান্সক্রিপশন কিংবা কোষ বিভাজনের সময়ে রেপ্লিকেশনের ফলে জীবের বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন হয়, জীব মারা যায়, বিকলাঙ্গ হয়। মাতৃ জননকোষে মিয়োসিস কোষ বিভাজনের সময় [প্রোফেজ-১] ক্রসিং ওভার ঘটে। অপত্য কোষের ক্রোমোসোমের কিছু অংশে জেনেটিক পরিবর্তন হয়। পরিবর্তনটা কীরকম হবে, আগে থেকে বলা সম্ভব না। কারণ এটি একটি র্যান্ডম/দৈব পরিবর্তন। এই দৈব (এবং অপ্রত্যাশিত) পরিবর্তনটাই মিউটেশন।
যখন কোনো একটা কাগজের মূলকপি থেকে ফটোকপি করতে থাকবেন, আবার ওই ফটোকপি থেকে আরেকটা কপি… এভাবে করতে থাকলে দেখবেন প্রতি ধাপে কপি করার সময় ডকুমেন্টের গায়ে অপ্রত্যাশিত কালি যোগ হচ্ছে, কখনো বা উজ্জ্বলতার পরিবর্তন হচ্ছে। একসময় দেখা যাবে n তম রেপ্লিকেশনে বা ফটোকপিতে, মূল কপি থেকে ওই কপির অনেক পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। এই পরিবর্তনটাকে মিউটেশন বলা যেতে পারে, যার পুরো পরিবর্তনই অপ্রত্যাশিত।
জেনেটিক পরিবর্তন বিভিন্নভাবে হয়ে থাকে। কিন্তু যে পরিবর্তনটা সবচেয়ে বেশী প্রভাব ফেলে, সেটা মাতৃ জননকোষ বিভাজনের সময়। উন্নত জীবে শুক্রাণু ও ডিম্বাণুতে মিয়োসিস বিভাজন হয়। এই কোষগুলোকে জননকোষ বলা হয়। মিয়োসিস বিভাজনের ফলে জীবের জিনগত বৈশিষ্টের পরিবর্তন হয়। এই জননকোষই পরবর্তীতে জাইগোট সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। অনেক সময় জাইগোটের অস্বাভাবিক বিভাজনের ফলে দেখা যায় দুই মাথাবিশিষ্ট শিশু, চার হাত বিশিষ্ট শিশু জন্ম নিচ্ছে।
কিছু প্রশ্ন / চিন্তার খেলা
ধরে নিলাম, একটা বানর থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে মানুষের সৃষ্টি হলো (যা আসলে সত্যি নয়)। কিন্তু আমরা জানি হেরিডিটির বা বংশক্রমের প্রত্যেকটি ধাপে ভেরিয়েশন সৃষ্টি হয়। তবে উন্নত মানুষ তৈরি করার পর কেন বানরগুলো বদলে যায়নি, বা বিবর্তনের সংজ্ঞা (আপনার জানা সংজ্ঞা) মেনে বানরগুলি বিলুপ্তি হয়ে যায়নি কেন? অথবা মানুষ কেন নিজেকে আরো উন্নত করে ফেলছে না? বছরের পর বছর ধরে দেখছি মানুষেরা একই রকম আছে। যৌন জননে যদি ভেরিয়েশনের সৃষ্টি হয়, তবে কেন তাদের পরিবর্তন ঘটছে না?
উত্তরটা লেখার পরের অংশে দেব।
আসুন বিবর্তনকে অনুভব করি
এতক্ষণ যে কথাগুলো বললাম, সেগুলো বিবর্তনের ধারণাটা বুঝার জন্য প্রয়োজন ছিল। বিবর্তনকে সংজ্ঞায়িত করার চেয়ে বিবর্তন কীভাবে কাজ করে, সেটা আমরা একটু দেখি।
বুঝার সুবিধার্থে একটা বহুকোষী জীব দিয়ে শুরু করা যেতে পারে।
ধরুন, একটা বনের মধ্যে অনেক জীববৈচিত্র্য আছে। বিভিন্ন শিকারী প্রাণী আছে কোনোভাবে অন্য একটা জীব বনের মধ্যে চলে আসলো। সে যখন বংশধরের সৃষ্টি করলো, তখন জেনেটিক কোডের মিউটেশনের কারণেকারণে তার কোনো বংশধর হল লাল রঙের, কেউ সবুজ, কেউ হলুদ, কেউ নীল। কিছুদিন পর কিছু শিকারী প্রাণী এসে জীবগুলোকে খেতে শুরু করল। লাল, নীল জীবগুলি সহজেই ধরা পড়লো। সবুজ আর হলুদ জীবগুলোর রঙ গাছের পাতার রংয়ের মতো হওয়ার কারণে তারা সহজে নজরে আসল না। এই ধাপে তারা (সবুজ,হলুদ) বেঁচে গেল। তারা বংশবিস্তার করল। কয়েকদিন পর মনে হবে, বনের ওই প্রজাতির সব জীব শিকারের হাত থেকে বাঁচার জন্য নিজের রঙয়ের পরিবর্তন ঘটিয়ে সবুজ, হলুদ করে ফেলেছে। আসলেই কি তা ঘটেছে? না। তারা নিজের কোন পরিবর্তনই করেনি। তারা দৈব উপায়ে বেঁচে গেছে। যদি গাছের পাতার রঙ নীল হত, তবে হয়ত নীল জীবগুলি বেঁচে যেত।

প্রথম ছবিতে দেখা যাচ্ছে, একটা পরিবেশে সবুজ আর হলুদ পোকা সমান সংখ্যায় আছে। কিন্তু একটা কাক একটা সবুজ পোকাকে খাওয়ার জন্য শিকার করেছে।
দ্বিতীয় ছবিতে, কাকের খাবার হিসেবে সবুজ পোকার সংখ্যা ক্রমশ কমছে। তৃতীয় ছবিতে, হলুদ পোকার সংখ্যা সবুজ পোকার চেয়ে বেশি হওয়ায়, তারা সবুজ পোকার চেয়ে বেশি সংখ্যক বাচ্চার জন্ম দিচ্ছে। ফলে পরিবেশে তাদের সংখ্যা বাড়ছে।
পরের ধাপে দেখা গেল, সবুজ আর হলুদ রঙয়ের জীবগুলোর মধ্যেও ভ্যারিয়েশনের (বিভিন্নতা/প্রকরণ) সৃষ্টি হল। তাদের কারো পিছনে লেজের মতো কিছু একটা যুক্ত হল, কারো হলো না। কেউ দৃষ্টিশক্তি পেল, কেউ মিউটেশনের কারণে আরো উন্নত কোনো বৈশিষ্ট্য পেল, যদিও সে এখনও জানে না তার এই বৈশিষ্ট্য কোন কাজে লাগবে। যারা লেজ পেল, তারা লেজ দিয়ে পোকামাকড় তাড়িয়ে দিতে পারল। ফলে পরিবেশে যখন পোকামাকড়ের উৎপাত বেড়ে গেল, লেজের সুবিধার কারণে শুধু তারাই বেঁচে গেল।
কিন্তু হঠাৎ করে দেখলে মনে হবে, জীবটা নিজেকে উন্নত করে ফেলেছে। সে চলার জন্য পা সৃষ্টি করে ফেলেছে; লেজ, ফুসফুস/ফুলকা ইত্যাদি অঙ্গ তৈরি করেছে। অর্থাৎ নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলেছে। আসলে ঘটনাটা এরকম না। বরং ঠিক বিপরীত ঘটনাই ঘটেছে। যাদের এসব অঙ্গ আগে থেকেই ছিল, শুধু তারাই বেঁচে গেছে, বাকিরা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এ প্রক্রিয়াটা লক্ষ লক্ষ বছরের প্রক্রিয়া (মাইক্রোস্কোপিক লেভেলে যেটা খুব তাড়াতাড়ি হয়, যেমন HIV Virus), আর প্রক্রিয়াটা ঘটে কোটি কোটি বংশধরদের মধ্যে।
একটা স্যামন (Salmon) মাছ দুই কোটির বেশি ডিম পাড়ে। কিন্তু খুব সম্ভবত কিছু সংখ্যক (শ’খানেক) বেঁচে যায়। যারা র্যান্ডম পরিবর্তনের মাধ্যমে পরিবেশের অনুকূলে আগে থেকেই রয়েছে, তারাই বেঁচে যায়। অর্থাৎ দুই কোটি মাছের মধ্যে শুধু শ’খানেক মাছ এমন ছিল, যা পরিবেশের অনুকুলে। অনেকটা লুডুর ছক্কার মত, কী হবে কেউ জানে না।
উল্লেখ্য, অভিযোজন বিবর্তনের একটা ধাপ।
বিবর্তনের আগের ধাপে কী হয়েছিল, বা পরের ধাপে কী হবে, তা বলা সম্ভব না। কারণ পুরো প্রক্রিয়াটাই র্যান্ডম। তবে একটা সম্ভবনা নির্ভর করে, তাও শুধুমাত্র আগের বা পরের দু/এক ধাপকে ব্যাখ্যা করার জন্য। আর এটা বিবর্তনের সীমাবদ্ধতা নয়, এটাই বিবর্তন তত্ত্বের সাফল্য। তবে ফসিল উদ্ধারের মাধ্যমে বিবর্তন প্রক্রিয়ার ব্যাখা দেওয়াটা আরো সুবিধাজনক হচ্ছে।
চিন্তা সমস্যার সমাধান
মানুষ বানর থেকে আসেনি। মানুষ আর বানরের পূর্বসূরি এক। কয়েক (কয়েক’শো/হাজার/লাখ) ধাপ আগে একই জীব থেকে বিভিন্ন বংশধর, তাদের বংশধর… এভাবে heredity বা বংশানুক্রম চলতে চলতে এক পাশে চলে আসল বানর, আর অন্য পাশে মানুষ। আবার মানুষের হোমো গণের (গণ – genus) ভিতরেও অনেক diversity বা বৈচিত্র্য আছে।
আপনার চাচাতো ভাই এবং আপনার পূর্বসূরি একই। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, আপনি আপনার চাচাতো ভাই থেকে এসেছেন। এর মানে হল, কোনো না কোনো সময় আপনাদের আদি পিতা বা মাতা একজনই ছিল।
বানর বিলুপ্ত হয়নি, কেননা এখনো এমন কোনো পরিবেশ আসেনি যা বানরকে বিলুপ্ত করে দিবে। কিন্তু ডায়নোসোর বহু বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে গেছে পরিবেশের কারণে। এমন কোনো পরিবেশ এসেছিল, যা ডায়নোসোরদের অনুকূলে ছিল না। তাই তাদেরকে হারিয়ে যেতে হয়েছে।
কেন অমুক জীব থেকে তমুক জীবের উদ্ভব হলেও অমুক জীবগুলো তমুক জীবে পরিণত হলো না?
“বিবর্তনের প্রাকৃতিক নির্বাচন একক জীবের ওপর হয় না, বরং কোনো একটা এলাকার জনপুঞ্জের ওপর হয়। অন্য এলাকার একই প্রজাতির ওপর যদি বিবর্তনীয় চাপ না আসে, তাহলে ঐ জনপুঞ্জের মধ্যে কোনো মিউটেশন আসলেও তা প্রজন্মান্তরে সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে না। এ কারণেই একটি প্রজাতি থেকে অন্য একটি প্রজাতির উদ্ভব হলেও আগের প্রজাতিটাও টিকে থাকে, অন্য পরিবেশে। সবারই একসাথে বিবর্তন হয় না। ” (কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ সাজেদুল ওয়াহিদ নিটোল)
মানুষের পরিবর্তন কেন দেখছি না ?
মানুষের পরিবর্তন চট করে দেখা যাচ্ছে না, কারণ এটা লক্ষ বছরের প্রক্রিয়া। মানুষের জিনগত পরিবর্তনের ব্যাপারটা পলিজেনিক ইনহেরিট্যান্স দিয়ে ভালোভাবে ব্যাখা করা যেতে পারে।
দ্বিতীয়ত, আফ্রিকার মানুষ কালো, আমেরিকার মানুষ সাদা। মেরুর ভালুক সাদা, বুনো ভালুক কালো। এটাই চোখের সামনে ঘটা বিবর্তনের ফলাফলের উদাহরণ। এর অর্থ এই না, মেরুর ভালুক মেরুতে যেয়ে সাদা হয়েছে। সে সাদা বলেই মেরুতে টিকতে পেরেছে। গায়ের রঙ বরফের মত সাদা হলে বরফের মধ্যে শিকার করতে সুবিধা হয়; শিকার বুঝতে পারে না যে শিকারী ওঁত পেতে আছে।
আমরা চিকিৎসাবিজ্ঞানে অনেক এগিয়ে গিয়েছি। কোনো ভাইরাসের বা অণুজীবের গঠন জানলে আমরা সেই ভাইরাসের জন্য এন্টিবডি বানিয়ে ভাইরাসটাকে শেষ করে দিতে পারি। তবুও আমরা কিছু কিছু এন্টিজেনের বিরুদ্ধে কোনো কৃত্রিম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিতে পারি না। কেন? কারণ এই মিউটেশন।
HIV ভাইরাসের গঠন যেহেতু আমরা জানি, কেন আমরা এই ভাইরাসকে শেষ করে দিতে পারি না?
অণুজীববিজ্ঞানে (Microbiology) কিছু কিছু ভাইরাস খুবই স্বল্প সময়ের মধ্যে নিজেদের পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলে। যেমন, আমরা যে মুহূর্তে একটি HIV-1 ভাইরাসের গঠন শনাক্ত করছি, তার পরের মুহূর্তেই ভাইরাসটি তার জেনেটিক গঠন বদলে ফেলছে। ফলে আমরা যে ভাইরাসটাকে শনাক্ত করেছিলাম, তার এন্টিবডি দিয়ে কোনো লাভ হচ্ছে না। এ কারণেই HIV-1 এর স্থায়ী চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয়নি। HIV-1 ভাইরাসের এন্টিজেন খুব দ্রুত নিজের পরিবর্তন করে ফেলে। এ কারণে এর এন্টিবডি তৈরি করা সম্ভব হয় না।
জীবাণুর বিরুদ্ধে ঢিসুম ঢিসুম
ছোটবেলায় শুনতাম, একই এন্টিবায়োটিক বেশ কয়েকবার খেলে একসময় সেই এন্টিবায়োটিক আর কাজ করে না, জীবাণুরা সেই এন্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে। একই এন্টিবায়োটিক বারবার দেহে গেলে জীবাণুরা কোনো এক দৈব উপায়ে আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ফলে একসময় এন্টিবায়োটিকটি কাজ করে না। একইভাবে মনে প্রশ্ন জাগত, জীবাণুরা কেমন করে বুঝে যে, তাদের শক্তিশালী হয়ে উঠতে হবে? কেমন করেই বা বুঝে, নিজেদের গঠন এভাবে পরিবর্তন করলে ওই নির্দিষ্ট এন্টিবায়োটিকটি আর কাজ করবে না?
আসলে জীবাণুর ক্ষেত্রে বুঝাবুঝির কোনো ব্যাপার নেই। জীবাণুগুলো জানেও না কী ঘটছে। ধরি, শরীরে একই ধরনের অনেক জীবাণু প্রবেশ করেছে। আমরা জীবাণুটির গঠন জেনে ফেলে তার জন্য একটি নির্দিষ্ট এন্টিবায়োটিক বানিয়ে ফেললাম। সেই এন্টিবায়োটিক দেহে প্রবেশ করালে জীবাণুগুলো মরে যাবে।
কিন্তু এখনো কিছু কিছু জীবাণু আছে, যাদের শরীরে ওই এন্টিবায়োটিক কাজ করেনি। কারণ, এত এত জীবাণুর মধ্যে দু’একটা জীবাণুর গঠন সামান্য আলাদা থাকতেই পারে। কোনো প্রজাতির প্রত্যেকটা প্রাণীর জেনেটিক কোড একে অপরের থেকে সামান্য হলেও আলাদা হবে। এই জেনেটিক ভ্যারিয়েশন প্রতিবার বিভাজনের সময়ই তৈরী হয়। সামান্য আলাদা এই জেনেটিক পার্থক্যের কারণে এন্টিবায়োটিকটি ওই দু’একটা জীবাণুর কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।
ওই জীবাণুগুলো যেহেতু মরে যায়নি, স্বাভাবিকভাবেই তারা বংশবৃদ্ধি করবে। কিছুদিন পর বংশবৃদ্ধির মাধ্যমে পুরো দেহে আবার অসংখ্য জীবাণু ছড়িয়ে যাবে, সেই বেঁচে যাওয়া দুই একটা আদি জীবাণুর কারণেই। এখন যদি দেহে আবার ওই একই এন্টিবায়োটিক দেওয়া হয়, সেটা আর কোনো কাজ করবে না। কারণ এন্টিবায়োটিকটা একটা নির্দিষ্ট গঠনের জীবাণুর জন্য বানানো হয়েছিল। সেটা কেন এই ‘অনেকটা নতুন ধরনের’ জীবাণুর বিরুদ্ধে কাজ করবে, যার আদি পিতামাতাকেও এই এন্টিবায়োটিক মেরে ফেলতে পারেনি? অথচ হঠাৎ করে দেখলে মনে হতে পারে, কোনো এক দৈব উপায়ে জীবাণুরা নিজেদের মধ্যে ওই এন্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। তারা নিজেদের শক্তিশালী করে তুলেছে।
অভিযোজনের গল্প
মেরু ভাল্লুক মরুভূমিতে,আর বুনো ভাল্লুক বনে জঙ্গলে খাপ খাইয়ে নেয়। এবারও সেই একই প্রশ্ন, কেমন করে বুঝে এদের “এভাবেই” অভিযোজিত হতে হবে? তারা কীভাবে নিজেকে পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়? [একটা প্রাণীকে আমি প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্যে নিয়ে গেলাম। এখন ওই প্রাণীটি ঠাণ্ডার কারণে মরে যাবে, নাকি ঠাণ্ডা পরিবেশের সাথে নিজেকে অভিযোজিত করে নিবে?]
আসলে ভাল্লুকেরা নিজেদেরকে পরিবেশের সাথে নতুন করে খাপ খাইয়ে নেয় না। যেসব ভাল্লুকের দেহে আগে থেকেই নতুন ওই প্রতিকূল পরিবেশের বিরুদ্ধে “খাপ খাইয়ে নেওয়ার উপাদান”টি ছিল, তারাই সেই নতুন পরিবেশে টিকে থাকে। মেরু পরিবেশে সাদা রঙয়ের প্রাণী খুব সহজেই বরফের মধ্যে শিকারীর হাত থেকে লুকিয়ে থাকতে পারে। সাদা প্রাণীর জন্য পরিবেশটা অনুকূল। যারা কালো, তারা শিকারীর হাতে খুব তাড়াতাড়িই মারা পড়বে। অথচ বানরের গল্পের মতো এখানেও আমাদের মনে হয়, মেরু ভাল্লুকটি মেরুতে যেয়ে দেখলো, “এখানে খুব ঠাণ্ডা। আমি যদি আমার গায়ের লোম সাদা করে ফেলি, অথবা প্রকৃতি যদি আমার গায়ের রঙ সাদা করে দেয়, তবে আমি এখানে টিকে থাকতে পারব।” তারপর হঠাৎ করে মনে হয়, ভাল্লুকের বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছা অথবা, ভেবেচিন্তে নিজের পরিবর্তন করার ক্ষমতাই তাকে সাদা বানিয়ে দেয়।
“যে ধারাবাহিক এবং মন্থর প্রক্রিয়ায় সহজতর জীব থেকে জটিল জীবের উদ্ভব হয় / অনুন্নত জীব আরো উন্নত হয়, তাকে বিবর্তন বলে” (আলিম স্যার, আজমল স্যারের বইয়ে দেওয়া বিবর্তনের সংজ্ঞা )
মনে হতেই পারে একটা অনুন্নত প্রাণী উন্নত প্রাণীতে পরিণত হচ্ছে। কিন্তু জেনে রাখা দরকার, বিবর্তনে অনুন্নত বা উন্নত বলে কোনো কথা নেই। এখানে আসল কথা হলো, পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার ক্ষমতা।
সবশেষে প্রশ্ন
১) বিল ব্রাইসনের “প্রায় সবকিছুর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস” বইটাতে পড়েছিলাম, ডায়নোসর বেঁচে থাকলে এখন মানুষের উচ্চতা হত দুই থেকে তিন ফিট। মানুষ গর্তে বসবাস করত। বলতে হবে ডায়নোসরের বেঁচে থাকার সাথে মানুষের উচ্চতার সম্পর্ক কী?
লেখাটি প্রথম লিখেছিলাম দশম শ্রেণীতে থাকতে। সময়ের সাথে সাথে লেখাটির অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সম্ভবত এখন মূল লেখাটির সাথে এই লেখাটির কোনো মিলই নেই। বিজ্ঞানের লেখাগুলো এবং বইগুলো এরকমই হওয়া উচিৎ। প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হয়ে যাওয়া…
যেসব বইয়ের কভার পিকচারে দেওয়া আছে – একটা বানর হাঁটতে হাঁটতে বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে মানুষে পরিণত হল (সম্ভবত আমাদের সময়ের ক্লাস এইটের সাধারণ বিজ্ঞান বইয়ে), নিশ্চিত থাকা যায় – বইয়ের লেখক বিবর্তন সম্পর্কে তেমন কিছুই জানেন না। মজার ব্যাপার হল, বেশীরভাগ বইগুলোতে বিবর্তনের পক্ষে বা বিপক্ষে প্রমাণ দেওয়া আছে, বিবর্তন সম্পর্কিত বিভিন্ন মতবাদ দেওয়া আছে (যদিও তা ল্যামার্ক আর ডারউইনিজম পর্যন্ত, অথচ বিবর্তন কীভাবে কাজ করে সেটা কোনো পাঠ্যপুস্তকেই পরিষ্কার করে দেওয়া নেই। বিবর্তনের পক্ষে প্রমাণ দিয়ে কী করব, যেখানে আমি বিবর্তন কী তাই-ই জানি না?)
লেখাটি লিখতে সাহায্য নিতে হয়েছে –
- খান একাডেমীর বিবর্তন, মাইক্রোবায়োলজী সম্পর্কিত ভিডিও
- জীন, বংশধারা ও বিবর্তন – প্রথম খন্ড –সুহিতা গুহ
- প্রায় সবকিছুর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস- বিল ব্রাইসন
- অন্যরকম পাঠশালার ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া সম্পর্কিত লেকচার
I feel happy after reading this. There are lots of people with the wrong conception of evolution even when they are in a science domain. This article could help those poor people with right concept.
লেখার প্রথম অংশ পড়েই ( একটা বুদ্ধিমান বানর (অনেকে যাকে ডারউইনের পূর্বপুরুষ বলে থাকেন) একদিন হাঁটতে হাঁটতে আবিষ্কার করল হেঁটে চলাটা কুঁজো হয়ে চলার চেয়ে সোজা। তার বংশধরেরা হাঁটতে শুরু করল। তারা দেখল লেজের কোনো প্রয়োজন নেই, বিবর্তনের একটা পর্যায়ে লেজ বিলুপ্ত হয়ে গেল।) মনে ধারনা আসছে যে মানুষ সবচেয়ে যেই অভাব ফিল করে সেটা হচ্ছে, যদি আমাদের পাখা থাকতো তাহলে কত ভালোই না হত! কই মানুষের তো পাখা গজানো শুরু হয়নি!! লেখাটা পুরোটা পড়ে অনেক অনেক ভালো লাগলো। বিবর্তন সম্পর্কে এই প্রথম বিশ্বাসযোগ্য আকারে উপস্থাপিত কোন লেখা পেলাম। এবং এটাই ঠিক মনে হচ্ছে। অর্ণব দাদাকে অনেক ধন্যবাদ একটা অবিশ্বাস্য… আরো পড়ুন
উপরের সারমর্মটাকেই অনেকে (প্রায় সবাই) মনে করেন বিবর্তনের ধারণা।
আসলে বির্বতন বলতে এসবের কিছুই বুঝায় না। বিবর্তন পুরোপুরি একটি ভিন্ন প্রক্রিয়া।
— এর পর থেকে পড়ুন।