ভূমিকা
মস্তিষ্ক দেহের একটি জটিল আর রহস্যময় অঙ্গ। যুগ যুগ ধরে গবেষণার পরও বিজ্ঞানীদের কাছে এই অঙ্গটির অনেক কিছু অজানা। প্রায়ই আমরা মস্তিষ্ক সম্পর্কে নতুন তথ্য জানি, পুরনো ধারণাকে বাতিল করে নতুন জ্ঞান চালু হতে দেখি। আজ জানবো সেই জিনিসের ব্যাপারে, যা আমাদের প্রজাতির ব্যাপক উন্নতির পেছনে অবদান রেখেছে। পড়বো সেই মস্তিষ্কের খুঁটিনাটি, যা অন্য প্রাণীদের চেয়ে আমাদের আলাদা পরিচয় দিয়েছে। দেখবো মস্তিষ্কের গঠন, জানবো কীভাবে বিবর্তনের ধারায় একটার পর একটা স্তর এসেছে মস্তিষ্কে।
লেখাটি প্রস্তুত করতে আমাকে প্রচুর সাহায্য করেছেন অ্যাপালাচান কলেজ অফ ফার্মেসির রিসার্চ এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ডঃ মামুন রশীদ এবং লুইজিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটির এনভায়রনমেন্টাল ইকোনমিকসে পিএইচডি-রত ফরহাদ হোসেন মাসুম। এই দুজনের প্রতি আমি একটু বেশিই কৃতজ্ঞ!
একদম প্রাথমিক কিছু তথ্য
চর্বির তৈরি তুলতুলে এবং স্পঞ্জ ধরণের এক বস্তু এই মস্তিষ্ক। বিশ্বাস করা কষ্ট যে, আঙ্গুলের সামান্য ছোঁয়ায়ও এর আকার পরিবর্তিত হতে পারে, এতোটাই স্পর্শকাতর তিনি! তাই নিরাপদ থাকার জন্য এরা খুলির ভেতরে এক ধরনের ঘন তরলে (সেরেব্রো স্পাইনাল ফ্লুয়িড) ভেসে থাকে, যা এদেরকে খুলির স্পর্শ থেকে দূরে রাখে। প্রাপ্তবয়স্ক মস্তিষ্কের গড় ওজন প্রায় দেড় কেজি। মহিলা এবং পুরুষের মস্তিষ্কের আয়তন যথাক্রমে ১১৩০ এবং ১২৬০ ঘন সেন্টিমিটারের আশেপাশে। তবে ব্যক্তিবিশেষে প্রচুর পার্থক্য দেখা যায়। আয়তনের পার্থক্য মহিলা এবং পুরুষের আইকিউ কিংবা বোধশক্তিতে কোন প্রভাব ফেলে না।
একটা ঘোষণা দিয়ে রাখা ভালো যে, কার্ল সেগান তাঁর বিখ্যাত “কসমসঃ এ পার্সোনাল ভয়েজ” সিরিজের এগারোতম পর্ব “স্মৃতির স্থায়িত্ব”তে মস্তিষ্ক নিয়ে অসাধারণ আলোচনা করেছেন। সেই অংশটুকু না রাখলে এই লেখাটা অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে বলে ঐ পর্ব থেকে অনেক লাইনই এখানে হুবহু তুলে ধরা হয়েছে।
মস্তিষ্কের পূর্ণ চিত্রঃ আদি থেকে বর্তমান, ভেতর থেকে বাহির
অন্যান্য অঙ্গের মত মস্তিষ্কও বিবর্তিত হয়েছে। বেড়েছে আকারে, বেড়েছে জটিলতায় আর তথ্য সংরক্ষণে। এটার গঠন থেকেই বলে দেওয়া যায়, মস্তিষ্ক কীভাবে বিবর্তিত হলো!
নিচের চিত্রটি ভালো করে খেয়াল করুন। মস্তিষ্ক যে ভেতর থেকে বাইরের দিকে বিবর্তিত হয়েছে, সেটা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে এই চিত্র বেশ কাজে দেবে।
ব্রেইন স্টেমঃ মস্তিষ্কের সবচেয়ে ভিতরের অংশটি সবচেয়ে প্রাচীন, যাকে বলে ব্রেইন স্টেম। অনেক মৌলিক জৈবিক কাজ সম্পন্ন করে এটা। তার মধ্যে একটা হলো – প্রাণের ছন্দ! অর্থাৎ, হৃৎস্পন্দন এবং শ্বাসক্রিয়া। এছাড়া স্পাইনাল কর্ড এবং বাকী শরীরের সাথে মস্তিষ্কের যোগাযোগও রক্ষা করে এটি।
সেরেবেলামঃ ব্রেইন স্টেমের ওপরে আছে সেরেবেলাম। এটি ভূমিকা রাখে ভারসাম্য রক্ষা এবং গতি নিয়ন্ত্রণে। এর সাথে নিয়ন্ত্রণ করে মনোযোগ, ভাষা, ভয় এবং আনন্দের অনুভূতিকে। “কীভাবে?” সংক্রান্ত স্মৃতি প্রক্রিয়ার (একে বলে procedural memories) সাথেও এটি জড়িত।
সেরেব্রাম বা সেরেব্রাল হেমিস্ফিয়ারঃ সেরেবেলামের উপরে অবস্থিত এই অংশটি মস্তিষ্কের সবচেয়ে বড় অংশ। এটি পুরো মস্তিষ্কের আয়তনের ৭৫% এবং ওজনের ৮৫%। সেরেব্রাল কর্টেক্স নামক ভাঁজ খেলানো স্তর দ্বারা এটি আবৃত থাকে। এটাও ভেতর থেকে বাইরের দিকে বিবর্তিত হয়েছে।
“জটিলতর কাজগুলোর ক্ষমতা বিবর্তিত হয়েছে ৩টি ধাপে।” – ১৯৬০ সালে এই হাইপোথিসিসটা দিয়েছিলেন আমেরিকান জীববিজ্ঞানী পল ম্যাকলিন। তবে ২০০০ সালের পর থেকে নিউরোবিজ্ঞানীরা এই হাইপোথিসিসকে আর সমর্থন করেননি।
তবুও চলুন, আমরা মজার এই হাইপোথিসিসের বিষয়ে একটু পড়ি। ১৯৭৭ সালে কার্ল সেগানের পুলিতজার পুরষ্কার জয়ী বই “দা ড্রাগনস অফ ইডেন”-এর মাধ্যমে হাইপোথিসিসটি প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো।
এই হাইপোথিসিস অনুযায়ী, ব্রেইন স্টেমকে ঢেকে রেখেছে R-complex। “R” হচ্ছে Reptile বা সরীসৃপের R। এখান থেকেই আসে হিংস্রতা, অভ্যাস, দখলদারি, আর সামাজিক উচ্চতা। এটা বিবর্তিত হয়েছে ৩০ কোটি বছরেরও আগে, আমাদের সরীসৃপ পূর্বপুরুষদের মধ্যে। সুতরাং, আমাদের মস্তিষ্কের গভীরের অংশটা অনেকটা কুমীরের মস্তিষ্কের মত।
R-complex এর ওপরে আছে লিম্বিক সিস্টেম বা স্তন্যপায়ীর মস্তিষ্ক। এটা বিবর্তিত হয়েছে কয়েক কোটি বছর আগে। কাদের মধ্যে, জানেন? যেসব প্রাণী স্তন্যপায়ী ছিলো ঠিকই কিন্তু বানর বা এইপ-দের মত প্রাইমেট ছিলো না, তাদের মধ্যে। এই সিস্টেম থেকে আসে – আবেগ, অনুভূতি, উদ্বেগ, শিশুদের প্রতি ভালোবাসা।
সবশেষে মস্তিষ্কের ওপরের দিকটায়, আদি মস্তিষ্কের সাথে অনিচ্ছাকৃত সমঝোতা চুক্তিতে আছে সেরেব্রাল কর্টেক্স। এটা বিবর্তিত হয়েছিলো কয়েক মিলিয়ন বছর আগে, প্রাইমেট পূর্বপুরুষদের মধ্যে। এখান থেকেই আমাদের সকল মহাজাগতিক যাত্রার শুরু। কার্ল সেগান আদি মস্তিষ্ক আর নতুন মস্তিষ্কের মিলনকে অনিচ্ছাকৃত সমঝোতা চুক্তি বলেছেন, কারণ এটা বিবর্তিত হয়েছে সবার শেষে, আকারে হয়েছে আদি মস্তিষ্কের চেয়ে অনেক বড়, আর কাজও আদি মস্তিষ্কের চেয়ে অনেকখানি ভিন্ন।
সেরেব্রাল কর্টেক্স-এর গঠন
সেরেব্রাল কর্টেক্সে বস্তু অর্জন করেছে সচেতনতা। মস্তিষ্কের দুই তৃতীয়াংশের চেয়েও বেশি ভরযুক্ত এই জায়গাটাই অনুমান এবং জটিল বিশ্লেষণের রাজ্য। এখান থেকেই আমরা বুদ্ধি এবং প্রেরণা পাই। এটা দিয়েই লিখি, পড়ি, অংক কষি, বা গান করি। কর্টেক্স আমাদের সচেতনতা নিয়ন্ত্রণ করে। এখানেই অন্য প্রজাতির চেয়ে আমরা আলাদা। এখানেই মনুষ্যত্বের বসবাস। শিল্প এবং বিজ্ঞানের উৎস এটাই। সভ্যতার উৎপত্তি সেরেব্রাল কর্টেক্স থেকেই।
অবস্থান অনুসারে এটি চারটি অংশে বিভক্ত। এই অংশগুলো ডান ও বাম, উভয় গোলার্ধ বা হেমিস্ফেয়ারেই অবস্থিত। যথাঃ ফ্রন্টাল লোব, প্যারাইটাল লোব, টেম্পোরাল লোব, আর অক্সিপিটাল লোব।
১) ফ্রন্টাল লোব – কপালের পিছনেই আছে সেরেব্রাল কর্টেক্সের সম্মুখ অংশ (frontal lobe)। এটা সজ্ঞান চিন্তাভাবনা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, ক্ষণস্থায়ী ও দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতি সংরক্ষণ করার সাথে যুক্ত। এখান থেকেই হয়তো আমরা অনুমান করি একটি ঘটনার ভবিষ্যত কেমন হবে! ভবিষ্যৎ অশুভ মনে হলে ঘটনাটা এড়ানোর জন্য পদক্ষেপ নিই।
ফ্রন্টাল লোবের মধ্যেই হয়তো রয়েছে – মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার উপায়।
২) প্যারাইটাল লোব – ফ্রন্টাল লোবের ঠিক পেছনেই প্যারাইটাল লোবের অবস্থান। এটা বিভিন্ন ইন্দ্রিয় দ্বারা গৃহীত তথ্যের সমন্বয় সাধন, স্থান সম্পর্কে জ্ঞান এবং যাতায়াতের সাথে যুক্ত।
৩) টেম্পোরাল লোব – এর অবস্থান ফ্রন্টাল আর প্যারাইটাল লোবের নিচের দিকে। এটা ঘ্রাণ এবং শ্রবণ, কথা বলা ও দেখা, দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতি তৈরির সাথে যুক্ত।
৪) অক্সিপিটাল লোব – একদম পেছনের দিকে থাকে এটা। এই লোব দৃষ্টির সাথে যুক্ত।
ডান গোলার্ধ – বাম গোলার্ধ
মানুষের চিন্তার রাজ্য longitudinal fissure নামক খাঁজ দ্বারা দুটি গোলার্ধে বিভক্ত, যারা বাম গোলার্ধ বা Left Hemisphere আর ডান গোলার্ধ বা Right Hemisphere নামে পরিচিত।
ডান গোলার্ধের আসল কাজ – নকশা সনাক্তকরণ, অনুমান, সংবেদনশীলতা, আর সৃজনশীলতা।
বাম গোলার্ধের আসল কাজ – যুক্তি, বিশ্লেষণমূলক আর যাচাইমূলক চিন্তা নিয়ন্ত্রণ। এই দুটো অংশ, দুটো জরুরি বিপরীত শক্তিই মানুষের চিন্তার পরিচায়ক।
প্রশ্ন জাগতে পারে, পাশে কেন করপাস ক্যালোসাম নামক অদ্ভুত বস্তুর ছবি? জিনিসটা কী?
জিনিসটা চেনার জন্য চলুন নিচের বড় ছবিটার দিকে তাকাই। এটি আমাদের ধারণার জন্ম এবং যাচাই করার দুটো হাতিয়ারের (যারা ক্রমাগত আলাপ করতে থাকে এবং যাদেরকে আমরা ডান ও বাম গোলার্ধ হিসেবে চিনি) মধ্যে যোগাযোগ ঘটায়।
বিশাল এক স্নায়ুতন্ত্রের গুচ্ছ এই Corpus Callosum । এটা সৃজনশীলতা এবং বিশ্লেষণের মধ্যেকার সেতু। ক্যালাস (Callus) মানে শক্ত, করপাস (Corpus) মানে বস্তু; এর কাজ হলো তুলতুলে ব্রেইনকে নীচ থেকে শক্তভাবে ঠেকনা দিয়ে ধরে রাখা।
কিন্তু কী প্রয়োজন করপাস ক্যালোসামের এই ঠেকনা দিয়ে রাখার? প্রয়োজন কারণ, এই বিশ্বটাকে বোঝার জন্য দুটো গোলার্ধই আবশ্যক। যুক্তি ছাড়া সংবেদনশীলতা দিয়ে যেমন দুনিয়া চলবে না, তেমনি বিশ্লেষণমূলক চিন্তা ছাড়া শুধু অনুমান দিয়েও আপনি টিকতে পারবেন না। তাই দুটো গোলার্ধের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করাটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
সেরেব্রাল কর্টেক্সের ভাঁজ, গ্রে ম্যাটার আর হোয়াইট ম্যাটার
মানুষের সেরেব্রাল কর্টেক্সের উপরিভাগ গভীর ভাঁজ যুক্ত (নিচের ছবিটি দেখুন)।
এই ভাঁজ থাকার কারণটাও উপযুক্ত। এটা আমাদের ছোট্ট খুলিতে তথ্য সংরক্ষণের জায়গা অনেক গুণে বাড়িয়ে দেয়। অল্প জায়গায় অনেক লম্বা শীট রাখতে হলে তাকে যেমন ভাঁজ করে রাখতে হয় (কিংবা আপনি শাড়ীর কুচির কথাও চিন্তা করতে পারেন), মস্তিষ্কের খাঁজের ব্যাপারটাও তাই। চলুন জেনে নিই ভাজের উঁচু নিচু অংশগুলোকে কী বলে।
জাইরাসঃ এটি হল দুটো খাঁজের মধ্যবর্তী উঁচু অংশ।
সাল্কাসঃ এটি হল খাঁজের নিচু অংশ।
উল্লেখ্য যে, অন্যান্য প্রাইমেটদের তুলনায় মানুষের ব্রেইনে ভাঁজের পরিমাণ অনেক বেশি।
আসি গ্রে ম্যাটার আর হোয়াইট ম্যাটারে।
গ্রে ম্যাটারঃ এটি হল মায়েলিনবিহীন স্নায়ুকোষ যা সেরেব্রাল কর্টেক্সের বহির্ভাগের গাঠনিক উপাদান। ব্রেইনস্টেম, সেরেবেলাম এবং স্পাইনাল কর্ডেও এটি থাকে। নাম গ্রে বা ধূসর হলেও এটির আসল রঙ ঈষৎ গোলাপি (রক্তনালীর উপস্থিতির কারণে)।
হোয়াইট ম্যাটারঃ গ্রে ম্যাটারের মতোই আরেকটি অংশ হল হোয়াইট ম্যাটার। এটি মায়েলিনযুক্ত স্নায়ুকোষ যা সেরেব্রাল কর্টেক্সের ভেতরের দিকে থাকে। এটি মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের গ্রে ম্যাটারকে পরস্পরের সাথে সংযুক্ত করে এবং নিউরনসমূহের মধ্যে নার্ভ ইম্পালস আদান প্রদান করে।
নিউরনঃ মস্তিষ্কের ভাষা
সেরেব্রাল কর্টেক্সের ভিতরে রয়েছে চিন্তার মাইক্রোস্কোপিক গঠন। অর্থাৎ চিন্তা কীভাবে তৈরি হয়, সেটা জানা যায় সেরেব্রাল কর্টেক্স থেকে।
মস্তিষ্ক আর জিনের DNA – দুটোর ভাষা এক নয়। মস্তিষ্কের ভাষাকে বলে নিউরন। আমরা যা শিখি, তা লেখা হয় নিউরন নামক কোষে। এরা হলো সংযোগকারী উপাদান। প্রতিটি সংযোগ = এক বিট তথ্য।
কতটা নিউরন আছে আমাদের? হয়তো ১০০ বিলিয়ন। সংখ্যাটা আকাশগঙ্গার নক্ষত্রের সংখ্যার কাছাকাছি। আর নিউরন সংযোগের সংখ্যা প্রায় ১০০ ট্রিলিয়ন। এমনকি ঘুমের মধ্যেও মস্তিষ্ক দোলে, পিটপিট করে, মিটমিট করে। চালাতে থাকে মানুষের জটিল কাজগুলো; যেমন – স্বপ্ন দেখা, মনে রাখা, অনুমান করা। ভাবা যায় আমাদের চিন্তা, লক্ষ্য, কল্পনা – এগুলোর বাস্তব ও বস্তুগত অস্তিত্ব রয়েছে? জ্বী হ্যাঁ, শুনতে অদ্ভুত শোনালেও অবস্তুগত বিষয় হিসেবে পরিচিত এই ব্যাপারগুলোর বাস্তব ও বস্তুগত অস্তিত্ব রয়েছে।
জিজ্ঞেস করতে পারেন, “চিন্তা” জিনিসটা দেখতে তাহলে কেমন?
বেশ, উত্তর হবে – এটা শত শত তড়িৎ রাসায়নিক বিচ্ছুরণ দিয়ে তৈরি!
অনেক বছর ধরে একটা ধারণা প্রচলিত ছিল যে, মস্তিষ্কের কোষ নতুনভাবে উৎপাদিত হয় না। যে কয়টা নিউরন নিয়ে জন্মেছি, সে কয়টা নিউরন নিয়েই আজীবন চলতে হবে। কিন্তু এখন আমরা জানি যে, নিউরোজেনেসিস প্রক্রিয়ায় সারাজীবনই নিউরন উৎপন্ন হতে থাকে।
তবে সব নিউরনই যে বিভাজিত হয়ে বাচ্চা দেয়, তা নয়। মজার ব্যাপার হল, প্রায় সব নিউরনই টার্মিনালি ডিফারেনশিয়েটেড। মানে এরা আর বিভাজিত হয় না। ডালপালা গজানো লতার মতো আকৃতি হবার কারণে পরিণত নিউরনের পক্ষে স্বাভাবিক মাইটোসিস করা অসম্ভব। তবে ব্রেইনের কিছু অংশে আদিকোষ (প্রোজেনিটোর সেল) থেকে নতুন নিউরন সৃষ্টি বা নিউরো-রিজেনারেশন হয়।
ভ্রূণ অবস্থায় এবং জন্মের পরপরই নিউরনগুলো দ্বিবিভাজিত হতে থাকে (কারণ তখন ওরা গোলাকার থাকে)। পরে সময়ের সাথে গোল নিউরন লতার মত লম্বা হয়ে যায়, যার পক্ষে দ্বিবিভাজন অসম্ভব। মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাস নামক অংশেও নতুন নিউরনের জন্ম হতে পারে। আমাদের স্মৃতি ও শিক্ষণ প্রক্রিয়ায় হিপোক্যাম্পাসের বিরাট ভূমিকা। আরো মজার তথ্য হলো, নিউরন বাচ্চা (গোল) অবস্থায় মাইগ্রেট করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় গিয়ে আস্তানা গাড়তে পারে। তবে হাত পা (অ্যাক্সন, ডেনড্রাইট) গজিয়ে গেলে তাকে সেখানেই থিতু হয়ে যেতে হয়। কারণ নিউরনের শরীরে আঠাসদৃশ কিছু কোষ পেঁচিয়ে থাকে যাদের বলে গ্লিয়া। আঠা বা গ্লু থেকেই গ্লিয়া শব্দটা এসেছে। পরিণত নিউরন (নীচের ছবি দ্রষ্টব্য) বাড়েও না, দ্বিভাজিতও হয় না।
তিনটি উপাদান দিয়ে মস্তিষ্ক বা ঘিলু গঠিত – নিউরন, গ্লিয়া কোষ (নিউরন ছাড়া যেসব কোষ আছে) এবং রক্তনালী।
মস্তিষ্কে নিউরনের সংখ্যা কতো হতে পারে, সেটা ওপরেই বলা হয়েছে। সাথে প্রায় একই সংখ্যক গ্লিয়া থাকে। আগে মনে করা হতো গ্লিয়ার সংখ্যা নিউরনের ১০ গুণ, কিন্তু এখন বিবেচনা করা হয় তাদের সংখ্যা নিউরনের সংখ্যার প্রায় কাছাকাছি (২০১৫ সালের গবেষণা)।
উপরে বলেছি যে, গ্লিয়া নামক আঠাসদৃশ কোষ নিউরনের শরীর পেঁচিয়ে থাকে। এদের প্রধান কাজ হলঃ
– নিউরনের চারপাশে থেকে তাদেরকে এক জায়গায় স্থির রাখা,
– নিউরনে অক্সিজেন এবং পুষ্টি সরবরাহ করা,
– জীবাণু ধ্বংস করা,
– মৃত নিউরনকে অপসারণ করা,
– এক নিউরন থেকে আরেক নিউরনকে দূরে রাখা (কারেন্টের তারে আমরা কী দেখি? কপারের বাইরে প্লাস্টিকের আবরণ লাগানো। তেমনি নিউরনগুলোকেও পরষ্পর থেকে দূরে রাখা দরকার, যা গ্লিয়া বা শুয়ান সেল করে থাকে)।
নিউরন সংযোগ
মানব মস্তিষ্কের তথ্য উপাদানের একক হচ্ছে বিট। এটার তুলনা চলে কর্টেক্সের নিউরন সংযোগের সাথে (নিচের চিত্র দ্রষ্টব্য), যা প্রায় ১০০ ট্রিলিয়ন বিট, অর্থাৎ ১০^১৪। ইংরেজিতে সবগুলো বিট লিখতে চাইলে জায়গা লাগবে ২ কোটি ভলিউমের বইয়ের সমান, যা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় লাইব্রেরির সমান। এর মানে কী? মানে হল, ২০ মিলিয়ন ভলিউম বইয়ের সমান তথ্য আছে আমাদের প্রত্যেকের মগজে!

নিউরনগুলো পরস্পরের সাথে কীভাবে সংযুক্ত থাকে, তার একটি আণুবীক্ষণিক চিত্র।
এভাবে যুক্ত থেকে নিউরনগুলো অন্যান্য কোষের মধ্যে ইলেক্ট্রনিক ইম্পালস এবং তথ্য আদান প্রদান করে।
মস্তিষ্ক, একটুখানি জায়গার মধ্যে বিশাল এক রাজ্য। বেশিরভাগ বই এখানে কোথায় থাকে, জানেন? সেরেব্রাল কর্টেক্সে। আর মস্তিষ্কের নিচতলায় আছে পূর্বপুরুষদের টিকে থাকার কার্যকলাপগুলো। যেমন – আগ্রাসন, শিশু পালন, যৌনতা, কিংবা নেতাকে অন্ধ অনুসরণ করার প্রবণতা। এগুলোর বেশিরভাগই এখনো আমাদের দৈনন্দিন জীবনে দেখা যায়। তবে মস্তিষ্কের উচ্চতর কাজগুলো, যেমন – পড়া, লেখা, কথা বলা, এগুলো সেরেব্রাল কর্টেক্সের একটি নির্দিষ্ট স্থানের কাজ।
মজার ব্যাপার হল, আমাদের স্মৃতিগুলো ছড়িয়ে থাকে মস্তিষ্কের এখানে ওখানে। অর্থাৎ পুরনো স্মৃতিগুলো মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট কোনো স্থানে না থেকে থাকে একেক জায়গায়!
কিন্তু মস্তিষ্ক কি শুধু মনে রাখার কাজ করে?
না। এটা তুলনা করে, তথ্যের অর্থ বের করে, বিশ্লেষণ করে, বিমূর্ত ধারণা তৈরি করে।
সরলতম ভাবনাগুলো, যেমন ১ সংখ্যাটির ধারণারও একটা বিশাল আর যৌক্তিক কাঠামো রয়েছে! বিশ্বের গঠন আর সঙ্গতি বিবেচনার জন্য মস্তিষ্কের নিজস্ব ভাষা আছে। কিন্তু আমরা কখনোই বিশ্লেষণের কৌশলটা দেখি না, শুধু ফলাফল দেখি। আর এজন্যই আমাদেরকে আরো অনেক কিছুতে সক্ষম হতে হবে, যা জিন (gene) পারে না।
মস্তিষ্কের লাইব্রেরিতে তথ্যের পরিমাণ জিন লাইব্রেরির চেয়ে ১০,০০০ গুণ বেশি। জিন লাইব্রেরিতে এক শতাব্দীতে একটা শব্দও ঠিকমত পাল্টায় না। অন্যদিকে মস্তিষ্ক হচ্ছে বাঁধাইবিহীন বই। আমরা প্রতিনিয়ত নতুন পৃষ্ঠা, নতুন ভলিউম যোগ করছি। কারণ শিখতে চাওয়ার প্রবল ইচ্ছাই আমাদের টিকে থাকার হাতিয়ার।
উপসংহার
আবেগ এবং সামাজিক আচরণের শেকড় আমাদের গভীরে প্রোথিত। এগুলো মানব সভ্যতারই অংশ, কিন্তু মানুষের সনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য নয়। কারণ অনুভূতি তো আরো অনেক প্রাণীরই আছে। কিন্তু আমাদেরকে আলাদা করে কোন বিষয়টা?
উত্তরঃ চিন্তা করার ক্ষমতা।
সেরেব্রাল কর্টেক্স জিনিসটা যেন এক ধরনের স্বাধীনতা! আমাদেরকে আর গিরগিটি বা বেবুনের জেনেটিক স্বভাবে (দখলদারি আর আগ্রাসী মনোভাব, কর্তৃত্বের মানসিকতা) আটকে থাকতে হবে না। আমাদের মস্তিষ্কে কী ঢুকছে, সেটার পেছনে আমরা নিজেরাই অনেকাংশে দায়ী। বড় হয়ে কী চাইবো, কী জানবো – এই ক্ষেত্রেও তাই। আমরা চাইলেই নিজেদের পাল্টাতে পারি।
একবার ভাবুন তো – এই মস্তিষ্কের কারণে কী অসীম আমাদের সম্ভাবনা! এই সম্ভাবনাকে বাস্তবায়ন করা যাবে তখনই, যখন আমরা মস্তিষ্কের ক্ষমতার ব্যবহার আরও বাড়াতে পারবো।
নিউরন বিভাজি না হলে ব্রেইন ক্যান্সার হয় কিভাবে
আমরা আমাদের অভ্যাস র দ্বারা আমাদের মস্তিস্কের নিউরনগুলোর মধ্যে কানেকশান র পরিবর্তন করতে পারি, সেরুপ কিভাবে আমাদের জেনেটিক কোড পরিবর্তিত হয় যদি বলেন, উপকৃত হব ?
মস্তিস্কের এই নিখুত, ত্রুটিমুক্ত গঠন প্রক্রিয়াই বলে দেই তাকে কেউ সৃষ্টি করেছে
গঠন যে নিখুঁত বা ত্রুটিমুক্ত নয়, সেটা নিয়ে বিশাল বিশাল রচনা লেখা যায়। সকল নিউরোলজিক্যাল ডিজঅর্ডার সেই গল্পই বলে।
[…] একদম নিচের দিকে যে অংশটা থাকে, তাকে ব্রেইন স্টেম বলে। স্পাইনাল কর্ড এবং বাকি শরীরের […]