এই লেখাটি মূলত মিচিও কাকুর “Physics of the impossible” বইয়ের ৮ম অধ্যায়ের কিছু অংশের অনুবাদ, যা নিজের ভাষায় লেখার চেষ্টা করেছি।
১ম পর্ব
ধরুন, কয়েক মাইল বিস্তৃত একটি বিশাল স্পেসশিপ হঠাৎ করেই লস এঞ্জেলেস শহরের উপর আবির্ভূত হলো। এটা এতটাই বিশাল যে গোটা শহরের আকাশকে প্রায় ঢেকে ফেলেছে, ফলে গোটা শহর হয়ে পড়েছে অন্ধকারাচ্ছন্ন। একইভাবে পৃথিবীর প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ শহরের উপরেই এই সসার বা পিরিচসদৃশ দুর্গগুলো অবস্থান নিয়ে ফেলেছে। শত শত জনতা উল্লাসিত কণ্ঠে বড় বড় ভবনগুলোর ছাদে দাঁড়িয়ে লস এঞ্জেলেসের অপার্থিব অতিথিদেরকে অভিবাদন জানাচ্ছে।
তারপর কিছুদিন চুপচাপ থাকার পর হঠাৎ করেই স্পেসশিপগুলোর পেট চিরে ধ্বংসাত্মক লেজার লাইটের রশ্মি বেরিয়ে এলো, যার তাণ্ডবলীলায় সামনের উঁচু উঁচু ভবনগুলো এক মুহূর্তে ধুলোয় পরিণত হলো। সেকেন্ডের ভেতর গোটা শহর যেন মৃত্যুপুরী হয়ে গেলো।
Independence Day নামক মুভিতে অপার্থিব কল্পিত জীবগুলোর প্রতি পৃথিবীবাসীর ভয়টাকে এইভাবেই ফুটিয়ে তোলা হয়েছিলো। আবার E.T. the Extra-Terrestrial মুভিতে এলিয়েনের উপর পৃথিবীবাসীর আগ্রহ, কৌতূহল নিয়ে দেখানো হয়েছিলো। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় যে, এলিয়েন বা অপার্থিব কল্পিত জীবগুলো বরাবরই মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। ১৬১১ সালে জ্যোতির্বিদ জোহানেস কেপলার তার Somnium নামক বইয়ে উল্লেখ করেন, পৃথিবীর বাইরে কোনো ভ্রমণ, যেমন চাঁদে ভ্রমণ করতে গেলে কোনো অপার্থিব বস্তুর দ্বারা আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা রয়েছে। এদিকে পৃথিবীর বাইরে প্রাণ আছে কি নেই, এটা নিয়ে ধর্মতত্ত্ব এবং বিজ্ঞানের বরাবরই একটা দ্বন্দ্ব রয়েছে।
১৬০০ সালে ডোমিনিকান ধর্মযাজক এবং দার্শনিক জর্ডানো ব্রুনোকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। এই পৃথিবীর বাইরে কোনো জীবন থাকতে পারে কিনা তিনি এই বিষয়ক একটি প্রশ্ন করেছিলেন, আর এটিই ছিল তার অপরাধ। কোপার্নিকাসের মতো তিনি বিশ্বাস করতেন, এই পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। কিন্তু সেই সাথে এটাও বিশ্বাস করতেন যে, পৃথিবীর বাইরে আরও অসংখ্য পৃথিবী বা প্রাণ থাকতে পারে।
৪০০ বছর পর ব্রুনোর এমন মতবাদ আবার ফিরে এসেছে। এ যেন ব্রুনোর প্রতিশোধ! মহাবিশ্বে প্রায় ২৫০টি গ্রহের সন্ধান পাওয়া গেছে, যেগুলো কোনো না কোনো নক্ষত্রকে ঘিরে প্রদক্ষিণ করছে। ব্রুনোর কথা ফলে যাচ্ছে! কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যায়, আমাদের এই ছায়াপথে অনেকগুলো গ্রহ থাকলেও কোনো বুদ্ধিমান প্রাণ কি সেখানে বাস করতে সক্ষম?
বহির্জাগতিক জীবন নিয়ে বিভিন্ন কাল্পনিক কথাবার্তা/সায়েন্স ফিকশন/মুভি দর্শক বা পাঠক মনে একটি চিত্রকল্প তৈরি করে দেয়। ১৯৩৮ সালের ৩০ অক্টোবর এটা নিয়ে একটি মজার ঘটনা ঘটে যখন অরসন ওয়েলস আমেরিকায় হ্যালোউইন উৎসবের অংশ হিসেবে CBS জাতীয় রেডিওতে এইচ জি ওয়েলস-এর ওয়ার অব দি ওয়ার্ল্ডস উপন্যাসটি খবর পাঠের আকারে সম্প্রচার করেন। ফলে ‘মঙ্গলবাসী দ্বারা পৃথিবী আক্রান্ত’ গুজবটি খুব দ্রুত ছড়িয়ে পরে, লাখ লাখ আমেরিকান এই খবরে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে, তারা ধরে নেয় মঙ্গলবাসী হয়তো সত্যি সত্যি পৃথিবীর দখল নেওয়ার জন্য নিউ জার্সির গ্রোভারস মিলে ল্যান্ড করেছে আর প্রাণঘাতি রশ্মি ছুঁড়ছে। মানুষজন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ওই এলাকা ত্যাগ করে অন্য কোথাও আশ্রয় নেয়। যদিও রেডিওতে পরে বলা হয় এটা কোনো খবর ছিল না, পৃথিবী আসলে আক্রান্ত হয়নি, তবুও কিছু কিছু মানুষ তখন বলেছিল যে তারা বিষাক্ত গ্যাসের গন্ধ পেয়েছে আবার প্রাণঘাতী রশ্মির চোখ ধাঁধানো আলোও নাকি প্রত্যক্ষ করেছে!
মঙ্গল গ্রহ নিয়ে আগ্রহ আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে যখন ১৯৫০ সালে একজন নভোচারী মঙ্গলের গায়ে M আকৃতির বিশাল এক চিহ্ন দেখতে পান। কেউ কেউ বলেন এই M চিহ্ন দ্বারা Mars বা মঙ্গল বুঝায়, অর্থাৎ মঙ্গল গ্রহবাসী শান্তিপূর্ণভাবে পৃথিবীকে তাদের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। আবার কেউ কেউ বলেন, এই M চিহ্নটি অশুভ, কারণ উলটো করলে W এর মতো দেখায়, যা WAR বা যুদ্ধকে নির্দেশ করে। অর্থাৎ মঙ্গলবাসী আসলে পৃথিবীকে যুদ্ধ করার আমন্ত্রণ জানাচ্ছে!!
তো এইসব ধারণার অবসান ঘটে যখন ওই চিহ্নটি যেভাবে এসেছিল, সেভাবেই হঠাৎ করে গায়েব হয়ে যায়। আসলে ঐসময় মঙ্গল গ্রহে একটি ধুলি ঝড় হয়, যা ৪টি বিশাল আগ্নেয়গিরির চূড়া ছাড়া গোটা গ্রহকেই ঢেকে ফেলে। আর ওই চূড়াগুলো মিলেই M বা W চিহ্নের জন্ম দিয়েছিল।
পৃথিবীর খ্যাপাটে কিছু বিজ্ঞানীর বহির্জাগতিক প্রাণের অস্তিত্ব/সম্ভাবনা নিয়ে লিখিত গবেষণাগুলো বলছে যে, বহির্জাগতিক প্রাণ নিয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলা অসম্ভব। কিন্তু ধরে নেওয়া যায়, তাদের অস্তিত্ব আছে। তো এখন আমরা ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, এবং বায়োলজির উপর অর্জিত জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে এলিয়েনদের জীবন প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে পারি।
প্রথমে বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে, পানি হলো এই মহাবিশ্বে জীবন সূচনার মূল চাবিকাঠি। তাই মহাশূন্যে জীবনের অস্তিত্ব খুঁজতে গেলে পানিকে অনুসরণ করতে হবে। পানিকে বলা হয় সার্বজনীন দ্রাবক, যা যেকোনো কিছুকে দ্রবীভূত করতে পারে। জটিল অণু তৈরি করার জন্য পানি একটি আদর্শ মাধ্যম, সেই সাথে পানির অণুকে মহাবিশ্বে যেকোনো জায়গায় খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।
দ্বিতীয়ত, কার্বন হল জীবন গঠনের একটি উপাদান। এর যোজনী ৪ হবার কারণে এটি ৪ টি ভিন্ন ভিন্ন মৌলের সাথে বন্ধন গঠনে সক্ষম। নির্দিষ্ট করে বললে, কার্বন দীর্ঘ শিকল বন্ধন গঠনে সক্ষম, যা জৈব যৌগ গঠনের মূল ভিত্তি।
কার্বনের প্রয়োজনীয়তা টানতে গেলে স্ট্যানলি মিলার আর হ্যারল্ড উরে-এর ১৯৫৩ সালে করা এক্সপেরিমেন্টটি আগে চলে আসে। ওই পরীক্ষায় তারা দেখান, জীবনের স্বতঃস্ফূর্ত গঠন হয়তো কার্বন রসায়নের কোনো উপজাত। তারা প্রথমে অ্যামোনিয়া, মিথেন এবং আরও কিছু বিষাক্ত কেমিক্যালের দ্রবণ নেন, ফ্লাক্সে ঢালেন, কারেন্ট চালনা করেন দ্রবণে, তারপন কী ঘটে দেখার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। এক সপ্তাহ পর তারা দেখেন, ফ্লাক্সে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অ্যামিনো অ্যাসিড তৈরি হয়েছে। প্রবাহিত কারেন্ট অ্যামোনিয়া এবং মিথেনের মধ্যকার কার্বন বন্ধন ভেঙ্গে ফেলে এবং অণুগুলোকে পুনরায় বিন্যস্ত করে অ্যামিনো অ্যাসিডে পরিণত করে। এই অ্যামিনো অ্যাসিড হল প্রোটিন তৈরির মূল উপাদান। বলে রাখা ভাল, পৃথিবীতে উল্কাপাত হতে প্রাপ্ত উল্কায় এবং মহাজাগতিক মেঘেও (নীহারিকা) অ্যামিনো অ্যাসিডের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছে।
তৃতীয়ত, জীবনের ভিত্তি হল DNA অণু যা নিজ প্রতিলিপি তৈরিতে সক্ষম। রসায়নে নিজ প্রতিলিপি তৈরিতে সক্ষম এমন অণু নেই বললেই চলে। পৃথিবীর প্রথম DNA অণু তৈরিতে প্রায় কয়েকশো মিলিয়ন বছর সময় লেগেছিল। সম্ভবত এটি তৈরি হয়েছিল সাগরের গভীরে। ধারণা করা হয় মিলার-উরে-এর পরীক্ষাটি যদি কেউ ১ মিলিয়ন বছর ধরে সাগরের গভীরে চালাতে পারে, তবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে DNA অণু তৈরি হতে পারে। একটি জনপ্রিয় মতবাদ হচ্ছে, পৃথিবীর প্রথম DNA অণুর গঠনটা হয়তো সাগরের তলদেশে আগ্নেয়গিরির মুখে হয়েছিল, কারণ সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া তৈরির আগে আগ্নেয়গিরির মুখ হয়তো সৃষ্টির শুরুতে DNA অণু এবং কোষের জন্য শক্তির অবিরাম উৎস হিসেবে কাজ করত। তাই বলা যায়, জীবন গঠনের জন্য প্রয়োজন পানি, জৈব যৌগ এবং DNA এর মতো নিজ প্রতিলিপি তৈরিকারী অণু। এই শর্তগুলো ব্যবহার করেই মহাবিশ্বে প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া সম্ভব।
১৯৬১ সালে করনেল ভার্সিটির জ্যোতির্বিদ ফ্রাঙ্ক ড্রেইক একটি খসড়া হিসাব উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, “যদি তুমি এই মিলকিওয়ের ১০০ বিলিয়ন তারা থেকে শুরু কর, তাহলে তাদের মধ্যে কতোটি সূর্যের মতো তারা আছে তার একটা হিসাব পাবে। এরপর সূর্যের মতো তারাগুলোর মধ্যে তাদের কতোটি অংশ আবার এক একটি সৌরজগত বহন করে, তার একটা হিসাব পাবে তুমি।”
আরও সুস্পষ্ট করে বললে, ড্রেইক সাহেব একটি গ্যালাক্সিতে কতোটি বুদ্ধিমান সভ্যতা থাকতে পারে, তার সম্ভাবনা বের করার জন্য একটি সমীকরণ বের করেন। সমীকরণটি হল-
N = R * fp * ne * fl * fi * fc * L
এখানে, N=আমাদের গ্যালাক্সিতে যোগাযোগক্ষম সভ্যতার সংখ্যা
R=আমাদের গ্যালাক্সিতে প্রতিবছর নক্ষত্র জন্মের হার
fp=যত শতাংশ নক্ষত্রে সোলার সিস্টেম আছে
ne=গড় গ্রহের সংখ্যা যারা প্রাণ ধারন করতে পারে
fl=যত শতাংশ গ্রহ সত্যিকার অর্থে প্রাণ ধারন করেছে
fi=যত শতাংশ গ্রহে বুদ্ধিমান সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে
fc=যত শতাংশ গ্রহের বুদ্ধিমান প্রাণীরা যোগাযোগের জন্য মহাবিশ্বে নিজেদের অস্তিত্বের কথা জানান দিয়েছে
L=যত সময় ধরে গ্রহের বুদ্ধিমান প্রাণীরা যোগাযোগের জন্য মহাবিশ্বে নিজেদের অস্তিত্বের কথা জানান দিয়েছে
এবার যুক্তিসঙ্গত মান/হিসাব বসিয়ে গুণ করলেই সম্ভাবনা পাওয়া যাবে। তো এই সমীকরণ মতে আমাদের গ্যালাক্সিতে/ছায়াপথে ১০০ থেকে ১০০০ টি প্রাণ বিকাশে সক্ষম গ্রহ থাকতে পারে। এখন এই বুদ্ধিমান প্রাণীগুলো যদি ছায়াপথে সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ে, তবে আমরা আশা করতে পারি, পৃথিবী থেকে কয়েকশো আলোকবর্ষ দূরেই আমরা এমন গ্রহের সন্ধান পাব। ১৯৭৪ সালে কার্ল সেগান ধারণা করেন, আমাদের ছায়াপথে ১ মিলিয়ন বুদ্ধিমান সভ্যতা থাকতে পারে।
এই থিউরিগুলো বহির্জাগতিক প্রাণের পক্ষেই আঙ্গুল নির্দেশ করে। বিজ্ঞানীরা বর্তমানে ঐসব গ্রহ থেকে নির্গত রেডিও সিগন্যালের সন্ধান খোঁজা শুরু করে দিয়েছেন, যেমনভাবে আমাদের গ্রহ থেকেও বিগত ৫০ বছর ধরে প্রতিনিয়ত রেডিও/টিভি সিগন্যাল নির্গত হচ্ছে।
১৯৫৯ সালে The Search for Extraterrestrial Intelligence (SETI) project বা ‘বহির্জাগতিক বুদ্ধিমান প্রাণীর সন্ধানে’ নামক প্রজেক্টের উপর গিউসেপ্পি কোক্কনি এবং ফিলিপ মরিসন একটি পেপার পাবলিশ করেন। তারা এতে উল্লেখ করেন, বহির্জাগতিক প্রাণীগুলোর মধ্যকার যোগাযোগে আড়ি পাতার জন্য ১-১০ গিগাহার্জের মাইক্রোওয়েভ বিকিরণ হল মোক্ষম উপায়। কারণ বহির্জাগতিক কোনো সভ্যতা যদি আমাদের মত রেডিও বা মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গ তৈরিতে সক্ষম হয়, তাহলে তাকে সহজেই সনাক্ত করা সম্ভব।
তবে বুদ্ধিমান প্রাণীর কাছ থেকে দুই ধরণের সংকেত আশা করা যেতে পারে – উদ্দেশ্যমূলক আর উদ্দেশ্যবিহীন। নিজেদের উপস্থিতি জানান দেয়ার জন্য যদি কোনো বাইরের প্রাণী ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের তৈরি সিগন্যাল মহাশূন্যে সম্প্রচার করে তবে তা হবে উদ্দেশমূলক। আর যদি তাদের গ্রহে স্থানীয় সম্প্রচারের কাজে ব্যবহৃত বেতার ও মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গ যদি তাদের গ্রহের বায়ুমণ্ডল ভেদ করে মহাশূন্যে ছড়িয়ে পড়ে, আর আমাদের রাডারে ধরা পরে, তবে তা হবে উদ্দেশ্যবিহীন সিগন্যাল। উদ্দেশ্যমূলক সংকেত তুলনামূলক কম কম্পাংকের বেতার ব্যান্ডে সীমাবদ্ধ থাকবে। বিজ্ঞানীদের অনুমান, উদ্দেশ্যমূলক সংকেতের ব্যান্ডের কম্পাঙ্ক ১ হার্জ থেকে ১ কিলোহার্জের মধ্যে থাকার কথা। সংকেতটির প্রকৃত কম্পাঙ্ক উদ্দেশ্যমূলকের ক্ষেত্রে উচ্চ এবং উদ্দেশ্যবিহীনের ক্ষেত্রে নিম্ন হওয়ার কথা। সে হিসেবে উদ্দেশ্যবিহীন সংকেত পাওয়া যেতে পারে ১ গিগাহার্জের কাছাকাছি কম্পাঙ্কে। তবে ১ থেকে ১০ গিগাহার্জ বিশাল একটি ব্যান্ড, পুরোটা নিয়ে কাজ করা কষ্টসাধ্য। তাই এর মধ্যে কোন কম্পাঙ্কে সংকেত আদান-প্রদান সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ, সেটাও ভেবে দেখা হয়েছে। ফলাফল হচ্ছে ১৪২০ মেগাহার্জ। নিরপেক্ষ হাইড্রোজেন এই কম্পাঙ্কের তরঙ্গ নিঃসরণ করে এবং মহাবিশ্বের এমন কোনো স্থান নেই যেখানে এটা পাওয়া যায় না।
১৯৬০ সালে ফ্রাঙ্ক ড্রেইক Ozma নামে একটি প্রজেক্ট হাতে নেন বহির্জাগতিক সিগন্যাল খোঁজার জন্য। এতে তিনি ব্যবহার করেন ২৫ মিটারের রেডিও টেলিস্কোপ। তবে দুর্ভাগ্যের বিষয়, প্রজেক্ট Ozma-তে সে রকম সিগন্যালের হদিস খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এরপর ১৯৭১ সালে নাসা SETI প্রজেক্টকে ফান্ড দেওয়ার জন্য বিশাল প্রস্তাব দিয়ে বসে। এই প্রজেক্টের নতুন নাম দেওয়া হয় সাইক্লপস। এই প্রকল্পে প্রস্তাব করা হয়েছিল ১৫০০টি রেডিও টেলিস্কোপ বসানোর, যাতে আনুমানিক খরচ ধরা হয় মাত্র ১০ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এটিও আলোর মুখ দেখেনি। ১৯৭৪ সালে বহির্জাগতিক প্রাণীদের উদ্দেশ্যে পুয়ের্তো রিকোর আরেসিব নামক বিশাল রেডিও টেলিস্কোপের মাধ্যমে ১৬৭৯ বিটের একটি বাইনারি কোডেড মেসেজ পাঠানো হয়। এই মেসেজটি ছুঁড়ে দেয়া হয় M13 নামক মহাজাগতিক ক্লাস্টারকে লক্ষ্য করে, যা কিনা পৃথিবী থেকে ২৫১০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। এই মেসেজটি বিজ্ঞানীরা তৈরি করেছিলেন ২৩*৭৩ ডাইমেনশনাল গ্রিড প্যাটার্নের মাধ্যমে, যেখানে আমাদের সৌরজগতের অবস্থানসহ মানবজাতির সাধারণ কিছু তথ্যের উল্লেখ ছিল। এই প্যাটার্ন বেছে নেওয়া হয়েছিল এই কারণে যে, এটি ২৩ ও ৭৩ দুটি মৌলিক সংখ্যার গুণফল। এটিকে যদি কোনো বহির্জাগতিক প্রাণী রিসিভ করতে পারে, তবে শুধুমাত্র দুইভাবে সাজাতে পারবে। যেমন, ২৩ টি সারি ও ৭৩ টি কলাম অথবা ৭৩ টি সারি ও ২৩ টি কলাম। প্রথম বিন্যাসটির কোনো অর্থ হবে না, কিন্তু দ্বিতীয় বিন্যাসের সাহায্যে এমন একটি ছবি তৈরি হবে যা বর্ণনা করে এই মেসেজটা। এই মেসেজটা যদি কোন বুদ্ধিমান প্রাণী খুঁজে পায়ও, তার রিপ্লাই পৃথিবীতে আসতে ৫২ হাজার বছর সময় লেগে যাবে!! ততদিন কি মানবজাতি আদৌ টিকে থাকবে?
কিন্তু কথা হল, এতো কিছুর পরেও ন্যাশনাল কংগ্রেস এইসব প্রজেক্টের গুরুত্ব নিয়ে খুব একটা ইমপ্রেসড হতে পারেনি, এমনকি ১৯৭৭ সালে একটা বহির্জাগতিক সিগন্যাল পাওয়ার পরেও, যেটাকে ওয়াও সিগন্যাল নামে অভিহিত করা হয়।
বইয়ে ওয়াও সিগন্যাল নিয়ে বিস্তারিত কিছু লেখা নেই, তাই আপনাদেরকে এ ব্যাপারে সামান্য ধারণা দিচ্ছি।
জেরি এহম্যান ছিলেন SETI (Search for Extraterrestrial Intelligence) প্রজেক্টের এর সেচ্ছাসেবক। এর আগে আমরা বলেছি, বিজ্ঞানীরা M13 ক্লাস্টারকে লক্ষ্য করে ২৩*৭৩ ডাইমেনশনাল গ্রিড প্যাটার্নের কোডেড মেসেজ পাঠিয়েছিলেন। জেরির দায়িত্ব ছিল প্রতি রাতে ওই মেসেজের ফিরতি সংকেতের জন্য অপেক্ষা করা। দিনের পর দিন কেটে গেলেও ফিরতি মেসেজের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। কিন্তু ১৯৭৭ সালের ১৫ অগাস্ট রাতটি ছিল ভিন্ন। ঐ রাতে হঠাৎ করেই রেডিওর রিসিভার বেজে ওঠে। জেরি সাহেব দেখলেন, বেতার তরঙ্গ রিসিভ করেছে রিসিভার। যদিও দিনের পর দিন এই সময়ের জন্যেই তিনি অপেক্ষা করছিলেন, তবুও তার বিশ্বাস হচ্ছিল না যে সত্যিই কোনো বহির্জাগতিক সংকেত আসছে। একটানা ৭২ রিসিভার টোন বাজার পর থেমে গেল। জেরি প্রিন্টার থেকে সিগন্যালের প্রিন্ট হাতে নিয়ে কিছু দূর্বোধ্য কোড দেখলেন, যার কিছুই তিনি বুঝতে পারলেন না। তাই হতভম্ব অবস্থায় প্রিন্টআউটের এক কোনায় লিখলেন “ওয়াও”! এরপর থেকেই এটি পরিচিতি পেল “দি ওয়াও সিগন্যাল” নামে। পরে জানা গেল সংকেতটি এসেছে স্যাগিট্যারিয়াস নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে, যা পৃথিবী থেকে ১২০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। তবে কী অর্থ ছিল ঐ সংকেতের, তা সুস্পষ্ট জানা যায়নি।
১৯৯৫ সালে ফেডারেল সরকার থেকে ফান্ডিংয়ের অভাবে জ্যোতির্বিদরা প্রাইভেট কিছু অর্গানাইজেশনের পৃষ্ঠপোষকতায় ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্টেইন ভিউতে SETI Institute নামে অলাভজনক একটি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম শুরু করেন। এর লক্ষ্য ছিল SETI প্রজেক্টকে পুনরায় ত্বরান্বিত করা এবং প্রজেক্ট ফিনিক্স নামে নতুন প্রজেক্ট শুরু করা। এই প্রজেক্ট ফিনিক্সের উদ্দেশ্য ছিল ১২০০-৩০০০ মেগাহার্জ রেঞ্জের মধ্যে পৃথিবীর আশেপাশের ১০০০টি সূর্যের ন্যায় গ্রহে রিসার্চ করা। এর ডিরেক্টর ছিলেন ড. জিল টারটার। বলে রাখি, এই প্রজেক্টে ব্যবহৃত ইকুইপমেন্টগুলো এতই সংবেদনশীল ছিল যে, ২০০ আলোকবর্ষ দূর থেকে আসা বিকিরণ শনাক্ত করতে পারত।
১৯৯৫ সাল থেকেই SETI Institute ১০০০ টির উপর তারার উপর বহির্জাগতিক সিগন্যালের সন্ধানে চষে বেড়াচ্ছিল। এর জন্য প্রতি বছর গুনতে হচ্ছিল ৫ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু এর ফলাফল খুশি করার মতো কিছুই ছিল না। তবে SETI প্রজেক্টের সিনিয়র জ্যোতির্বিদ সেথ সোস্থাক খুব আশাবাদী ছিলেন এই ভেবে যে, অ্যালেন টেলিস্কোপ অ্যারে নামের ৩৫০ টি অ্যান্টেনা যদি সান ফ্রান্সিস্কো থেকে আরও ২৫০ মাইল উত্তরে স্থাপন করা যায়, তবে হয়তো আমরা ২০২৫ সালের মধ্যেই কোনো না কোনো বহির্জাগতিক সিগন্যালের সন্ধান পেতে পারি।
SETI প্রজেক্টের একটি প্রকল্প হিসবে ১৯৭৯ সালে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার জ্যোতির্বিদগণ SETI@home প্রজেক্ট হাতে নেন। এই প্রকল্পে যে কেউ ইচ্ছে করলে ঘরে বসেই কম্পিউটারে যুক্ত হতে পারত। এর জন্য প্রয়োজন ছিল কম্পিউটারে একটি সফটওয়্যার ডাউনলোড করা। যেহেতু এই প্রজেক্টে রেডিও টেলিস্কোপের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ ডাটা কালেক্ট করতে হত, তাই এইসব ডাটা বিশ্লেষণ করে বহির্জাগতিক কোনো সিগন্যাল পাওয়া গেল কিনা তা যাচাই বাছাইয়ের প্রয়োজন ছিল। এই প্রকল্পের সাথে শতাধিক দেশের প্রায় ৫০ লক্ষেরও বেশি মানুষ যুক্ত হয়েছিল। তবে যতদূর জানা যায়, এই প্রকল্পেও এরকম কোন বহির্জাগতিক সিগন্যালের সন্ধান পাওয়া যায়নি।
কয়েক দশক ধরে এতো খাটাখাটনির পরও যখন SETI প্রজেক্ট কোনো আলোর মুখ দেখল না, তখন এটাকে কিছু কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। ব্যর্থতার কারণ হিসেবে কেউ কেউ বলেন, বিজ্ঞানীরা ওই বহির্জাগতিক সিগন্যাল খোঁজার জন্য যে নির্দিষ্ট কম্পাংকের একটি রেডিও সিগন্যাল ধরে নিয়েছিলেন, সেটা হয়তো পুরপুরি ঠিক না যার জন্যের আমরা বহির্জাগতিক সিগন্যাল ক্যাচ করতে পারছি না। আবার কেউ মনে করেন, ঐসব বহির্জাগতিক প্রাণীরা হয়তো রেডিও সিগন্যাল ব্যবহার না করে লেজার সিগন্যাল ব্যবহার করে, কিন্তু আমরা কিনা রেডিও সিগন্যালকেই আদর্শ ধরে বসে আছি। আবার কেউ কেউ বলছে, এই বহির্জাগতিক প্রাণীরা হয়তো কমপ্রেসড মেসেজের মাধ্যমে যোগাযোগ করে নিজেদের মধ্যে। এই টেকনিকটা হয়তো ওয়েব ব্রাউজারের ব্রাউজিং টেকনিকের মতো। আমরা যখন ওয়েব ব্রাউজারে কোনকিছু সার্চ দিই, তখন ওয়েব ব্রাউজার সাধারণত হাইপার টেক্সট ট্রান্সফার প্রটোকল (HTTP) ব্যবহার করে ওয়েব সার্ভারের সাথে যুক্ত হয় এবং ওয়েব পেজ আমাদের সামনে প্রদর্শন করে। ইন্টারনেটে ব্রাউজিংটা একটি প্রোটোকল ব্যবস্থার মাধ্যমে হয়, এটাই হল HTTP।
তবে এতো ব্যর্থতার পরেও SETI প্রজেক্ট আশা ছাড়তে রাজি নয়। তাদের ধারণা এই শতাব্দীতেই হয়তো কোনো বহির্জাগতিক সিগন্যাল শনাক্তকরণ সম্ভব হবে, আর এটা যখন হবে তখন মানবজাতির ইতিহাসে একটা মাইলফলক হিসেবে থাকবে।
(চলবে…)
মন্তব্য