কিছু মানুষ তাদের মতবাদকে বিজ্ঞানসম্মত বলে প্রচার করে, অনেক ক্ষেত্রেই সেগুলো বিজ্ঞানসম্মত না, ধারেকাছেও না। কিছু ক্ষেত্রে তারা নিরীহ দাবি, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেগুলো বড় বড় ওয়াদা করে আপনাকে বোকা বানিয়ে হাতিয়ে নিতে পারে আপনার টাকাপয়সা। ২০১০ সালে প্রকাশিত এক রিপোর্ট অনুযায়ী ইটালিয়ানরা প্রতিবছর ৫ বিলিয়ন ইউরো খরচ করে এস্ট্রলজি বা জ্যোতিষশাস্ত্রের খাতে। হোমিওপ্যাথিতে ফ্রান্স খরচ করে ১.৫ বিলিয়ন ফ্রাঙ্ক, প্রতি বছরে; অথচ ফ্রান্সের ৪০% মানুষ অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাস করেন না!
আপনি যতই চালাক হোন, আপনাকেও বোকা বানানো সম্ভব।
অথচ একটু জানলেই আপনি পারবেন এসব অপবিজ্ঞানের ফাঁদে পড়া থেকে বাঁচতে। মাত্র কয়েকটি ব্যাপার খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন কোনো কিছু অপবৈজ্ঞানিক কী না-
১) বৈজ্ঞানিক শোনায় এমন শব্দ ব্যবহারঃ ইংরেজিতে যাকে বলে psychobabble। দাবিকৃত ব্যাপারটির সাথে সম্পূর্ণ অসামঞ্জস্যপূর্ণ শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করে আপনাদের সামনে সেটিকে বৈজ্ঞানিক বলে উপস্থাপন করার চেষ্টা করা। যেমন Quantum Healing, Crystall Healing, Ancient Astronaut, Aroma Therapy, Colon Hydrotheraphy, Reflexology, Therapeutic Touch, ইত্যাদি। এদের সাথে বিজ্ঞানের কোনো সম্পর্ক নেই; কিন্তু এদের নামকরণ আমাদের বলে দেয়, এগুলো অবশ্যই বৈজ্ঞানিক হবে। এসব শব্দের ব্যাপারে সাবধান।
২) ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার চেয়ে বেশী মূল্য পায়ঃ ইংরেজিতে যাকে বলে Anecdotal Evidence, অমুকের ক্ষেত্রে কাজ হয়েছে, সুতরাং এটা কার্যকর! বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার চেয়ে অমুক-তমুকের ক্ষেত্রে এটি কার্যকরের পরিমাণ যদি বেশী হয়, তবে বুঝে নিবেন, ব্যাপারটা অপবৈজ্ঞানিক। অনেক ক্ষেত্রে আবার পরীক্ষাকারীকে নিজেও সেই অপবিজ্ঞানে বিশ্বাসীও হতে হয়, নইলে নাকি এর কার্যকারিতা বোঝা যাবে না।
৩) মানবতার সকল সমস্যার সমাধান বলে দাবি করবেঃ চিকিৎসার ক্ষেত্রে যারা দাবি করবে তাদের ঔষুধ অনেকগুলো রোগের/সর্বরোগের মহৌষধ, অন্যান্য ক্ষেত্রে যারা দাবি করবে বহু সমস্যার এক সমাধান, তারা সাধারণত, সাধারণত, অপবৈজ্ঞানিক জিনিস বিক্রি করার ধান্ধায় আছে। কার্যকরী ক্ষেত্রের তালিকা যত বড় হবে সেটি প্রতারণা হবার সম্ভাবনা তত বেশী হবে।
৪) তাদের অসাধারণ দাবির পক্ষে অসাধারণ প্রমাণ থাকবে নাঃ অধিকাংশ ক্ষেত্রে যদিও দুই একটা সফলতার ঘটনা সামনে নিয়ে আসবে, তবে তাদের মোট অসফলতা হিসাব করলে সফলতাগুলোকে দৈবাৎ বলেও বিবেচনা করা যায়। তাদের দাবিগুলো হবে অসাধারণ, তবে সেটির পক্ষে তারা অসাধারণ নিশ্ছিদ্র প্রমাণ হাজির করতে পারবে না।
৫) তাদের দাবি মিথ্যা প্রমাণ করা যায় নাঃ বিজ্ঞানের যে কোনো দাবি বা হাইপোথিসিসের একটা বৈশিষ্ট্য থাকতে হয়, মিথ্যা প্রমাণ করার সুযোগ। ইংরেজিতে এটাকে বলা হয় falsifiability. কিন্তু অপবিজ্ঞানীরা যে দাবিগুলো করবে সে দাবিগুলোকে তারা যদিও সত্য হিসাবে প্রমাণ করতে পারে না, আপনি মিথ্যা হিসাবে প্রমাণও করতে পারবেন না। এগুলোকে যাচাই করার এবং যাচাই করে সত্য/মিথ্যা প্রমাণ করার কোনো সুযোগই নেই। যেমন-
-“আমার অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা আছে, এটা দিয়ে আমি মৃতদের সাথে যোগাযোগ করি।”
-“প্রমাণ করে দেখান আপনার অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা আছে।”
-“প্রমাণ করে দেখান আমার অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা নেই।”
আবার, সাইকিক আর মিডিয়ামদের আরেকটি প্রিয় কৌশল হচ্ছে “আপনার ক্ষেত্রে আমি যা পড়ছি তা হয়তো এখনো আপনার সাথে ঘটেনি, ভবিষ্যতে ঘটবে।”, এই কথা বলে সে সেই মূহুর্তে মিথ্যা প্রমাণিত হওয়া থেকে বেঁচে গেলো কিন্তু!
৬) অমুক বিজ্ঞানী, তমুক জনপ্রিয় ব্যক্তি আমাদের সুফল লাভ করেছেনঃ এটা হচ্ছে appeal to authority, কোনো একজন কর্তৃপক্ষকে নিজেদের সাক্ষী ধরে নিয়ে আপনাকে অপবিজ্ঞান গেলানো চেষ্টা।
৭) কার্যকর হতে অতিপ্রাকৃতিক বা প্যারানরমাল কোনো কিছুর সাহায্য ব্যবহারের দাবি, অথবা প্রাচীন জ্ঞান থেকে তাদের পণ্য বানানোঃ তাদের উৎপাদিত পণ্য স্বপ্নে প্রাপ্ত, কোনো আত্না দিয়ে গেছে, এলিয়েনরা এই জ্ঞান দিয়েছে, অথবা প্রাচীন কোনো সভ্যতালব্ধ জ্ঞান এখানে কাজ করছে বলে দাবি করা।
৮) তাদের উপর নির্যাতন নিপীড়ন চলছে, বিরুদ্ধচারীরা বিশেষ কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের টাকা খেয়ে তাদের বিরুদ্ধে কথা বলছেঃ বিশ্বব্যাপী বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়, বিশেষ কোন সরকার বা রাজনৈতিক দলের দ্বারা তারা নির্যাতিত, নিষ্পেষিত হচ্ছে বলে দাবি করা। বড় বড় ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানী তাদের ব্যবসা বাঁচানোর স্বার্থে ওদের বিরুদ্ধাচরণ করছে!
৯) পরীক্ষাভীতিঃ সকল প্রকারের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার প্রতি তাদের ঘৃণা, সন্দেহ থাকবে। প্রায়শই দাবি করবে বিজ্ঞান এখনো এটা বুঝে উঠতে পারেনি।
আশেপাশে যে কোনো অসাধারণ দাবি শুনলেই মিলিয়ে নেবেন এই নয়টি পয়েন্ট, যদি একাধিক মিল পান তবে সেই দাবি আর দাবিকর্তা থেকে দূরে থাকুন, আর না হয় ওদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন।
তথ্যসূত্র- Rationalwiki আর skepdic ।