জুলহাস মান্নান ছিলেন বাংলাদেশের একমাত্র সমকামীতা এবং ট্রান্সজেন্ডার বিষয়ক ম্যাগাজিন “রূপবান”-এর সম্পাদক। ছিলেন সমকামী আর ট্রান্সজেন্ডার জনগণের অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে একজন অগ্রদূত। “ছিলেন” বলছি, কারণ ২৩ এপ্রিল ২০১৬ তারিখে তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ঠিক যেভাবে হত্যা করা হয়েছে ডঃ অভিজিৎ রায়, অনন্ত বিজয় দাশ, কিংবা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে। জুলহাস মান্নানের মৃত্যুর পর বিজ্ঞানযাত্রা ব্লগে “লিঙ্গ পরিবর্তন” করার যে অপারেশন আছে, সে সম্পর্কে কিছু তথ্য এবং এই অপারেশন সংক্রান্ত একটি এনিমেটেড ভিডিও (1) উপস্থাপন করাকে বেশ প্রাসঙ্গিক মনে করছি। বিজ্ঞানযাত্রী হিসেবে বিজ্ঞানসম্মত সঠিক তথ্য জানা আমাদের অধিকার, সে যত বিতর্কিতই হোক না কেন।
বেশ কিছুদিন একটি সংস্থা, যারা এই ধরনের LGBTQ (Lesbian, Gay, Bisexual, Transgender, Queer) সম্প্রদায়ের মানুষের জীবনের ওপর কাজ করে চলেছেন নানাভাবে, তাদের সাথে যুক্ত থাকার দরুণ এ রকম রূপান্তরকামী (Transgender) বেশ কিছু মানুষের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক আছে। তাদের সঙ্গে কথা বলার সময় তাদের জীবন সম্পর্কে, আর জৈবিক শরীরের আড়ালে অন্য এক মনের বন্দী হয়ে পড়ে থাকার গল্প শুনেছি। ফলে লিঙ্গ পরিবর্তনের অপারেশনের বিরোধিতা করা বাদ দিয়েছি। সময় আর পরিবেশ আমাকে অনেক কিছু বুঝতে আর ভাবতে শিখিয়েছে। নাহলে আমি অন্য পাঁচজনের মতই ভাবতাম!
রূপান্তরকামিতা সম্পর্কে প্রধান যে জিনিসটি জানতে পারি তা হলো, সেই মানুষটি অবশ্যই রূপান্তরকামী যে তার জৈবিক লিঙ্গকে অপছন্দ করে। তা সে লিঙ্গ পরিচয়ে পুরুষ হোক, বা নারী। আর মনের পরিচয়ে পুরুষালি নারী হোক, বা নারীসুলভ পুরুষ। এই রূপান্তরকামের ঠিক বিপরীতে যারা আছেন, তারা হলেন সিসজেন্ডার। অর্থাৎ যারা তাদের জৈবিক যৌনাঙ্গ নিয়ে খুশি। অর্থাৎ সেই লিঙ্গের স্বাভাবিক ব্যবহারের কথাই তিনি ভাবেন। সোজা করে বললে, যার পুংলিঙ্গ আছে, তিনি পুরুষালিভাবেই যৌনচারণের কথা ভাবেন।
রূপান্তরকামী বা ট্রান্সজেন্ডার অর্থাৎ LGBTQ -এর T-এর সঙ্গে কিন্তু বাকি এল, জি, বি, কিউ-এর কথা উঠে আসে। এখানে লেসবিয়ান, গে, আর বাইসেক্সুয়াল সম্পর্কে আমরা কম বেশি ওয়াকিবহাল। সামাজিক ট্যাবুর অন্তর্গত হলেও এই শব্দগুলি প্রচলিত। কিন্তু T এবং Q অক্ষর নিয়ে আমাদের চর্চা অনেক কম। অথচ এই T শ্রেণির মানুষকে আমরা সচরাচর দেখে থাকি এবং এদের বাহ্যিকভাবে চেনা খুব সহজ। হয়ত এদেরকে খুব বেশি দেখে থাকি বলেই, ভারতীয় উপমহাদেশের একটি প্রচলিত পেশার নামে অতি সহজ নামকরণ এবং শ্রেণীকরণ করে থাকি। খানিক মেরুকরণ করা হয় আসলে। হ্যাঁ, এই পেশার নাম হিজড়া। অর্থাৎ বিজ্ঞানসম্মতভাবে আমরা কখনই বলতে পারি না এরা হিজড়া। কারন হিজড়াবৃত্তি একটি পেশার নাম মাত্র। আমাদের উচিৎ এদের রূপান্তরকামী হিসেবে জানা। তবে এটাও জানা উচিৎ, এই পেশার সঙ্গে যুক্ত সব মানুষ রূপান্তরকামী হলেও সব রূপান্তরকামী মানুষ কিন্তু হিজড়া পেশার সাথে যুক্ত নয়।
এবারে আসি Q-এর কথায়। Q অর্থাৎ কুয়্যের। এই শব্দটির আক্ষরিক অর্থ খারাপ, মন্দ, বা অস্বাভাবিক গোছের কিছু। খানিক প্রতিবাদের সুরে ব্যঙ্গার্থকভাবেই এই LGBTQ শ্রেণির মানুষ নিজেদের Q বলে থাকে। এই Q শ্রেণির মানুষ কারা, সেটা সহজ ভাষায় বুঝানোর জন্য একটা উদাহরণ দিচ্ছি। ধরুন, একজন সিসজেন্ডার বা স্ট্রেইট ব্যক্তি জীবনের বিশেষ মুহুর্তে সমলিঙ্গের মানুষের প্রতি শারীরিক ও মানসিকভাবে আকৃষ্ট হয়ে থাকেন। অর্থাৎ একজন পুরুষ তার নারীর সঙ্গে স্বাভাবিক যৌনেচ্ছার বাইরেও কখনো হয়ত আরেকজন পুরুষকে ভাবতে পারেন। সেটা প্রতিনিয়ত, প্রতিক্ষণ না হলেও নিয়মমাফিক হতে পারে। তবে নিয়মটা এমন নয় যে, প্রতিমাসের একটা নির্দিষ্ট দিনে তার এমন ইচ্ছা জাগবে। আর যার ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত, প্রতিক্ষণে নারী-পুরুষ উভয়কেই ভালো লাগে, তিনি হলেন উভকামী। এই উভকামী আর Q কিন্তু এক নয়, যদিও পুরো সম্প্রদায় নিজেদেরকে Q বলে থাকেন। কারণটা তো আগেই বলেছি।
আবার একজন ট্রান্সজেন্ডার অর্থাৎ একজন পুরুষ নারীতে রূপান্তরিত হওয়ার পর আবার আরেকজন নারীকেই ভালোবাসতে পারেন। ইনিও তখন Q। এর খুব ভালো উদাহরণ হলো, যারা এই হিজড়া পেশায় যুক্ত থাকেন, তারা নিজেদের মধ্যেই প্রেমিকা খুঁজে নেন। ব্যাপারটা কিন্তু সবসময় এমন নয় যে, সামাজিকভাবে একজন পুরুষের কাছে অস্বীকৃতি পাবেন বলেই তারা নিজেদের মত করে বাঁচার পথ বেছে নিচ্ছেন। আসলে এটাও মনের একটা দিক।
‘বিচিত্র এ সংসারে, বিচিত্র মানুষ, বিচিত্র মানুষের মন’ – সম্ভবত এ রকমই বলেছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তার ‘তাসের ঘর’ নামক ছোট গল্পে। এ পৃথিবীতে মনের নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না। আর সম্ভব না বলেই হয়ত আজ বিজ্ঞানের বেঁচে থাকা, এত সৃষ্টি।
এতক্ষণ মনের কথা বললাম। এবার একটু শরীর বা বিজ্ঞানের কথা বলি। তাই বলে এমনটা বলছি না যে, মন বিজ্ঞানের বাইরে। রূপান্তরকামী ও হিজড়া পেশার একটি জটিলতা আছে। সেটা হলো, ইন্টারসেক্স। অর্থাৎ যে মানুষের লিঙ্গের পরিস্ফুটন ঘটে না জন্মের সময় থেকেই। আমাদের সমাজে সেই বাচ্চাটির বাঁচা দুষ্কর । বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হিজড়া পেশার মানুষ এই বাচ্চাদের নিয়ে চলে যান। সামাজিক জটিলতায় মা বাবাও রাজি হয়ে যান, যদিও ব্যতিক্রম ঘটনা আছে। এই বাচ্চাগুলির লিঙ্গের পরিস্ফুটন ঘটছে না মানেই কিন্তু এরা নারী, এমনটা নয়। এরা পুরুষও হতে পারেন। সেক্ষেত্রে এদের সাবালক বা সাবালিকা হওয়ার পর যথার্থ কাউন্সেলিং দিতে হয়। এরপর এদের মনের লিঙ্গের পরিচয়ে এদের লিঙ্গ প্রতিস্থাপন করার প্রয়োজন ঘটে। তার আগে আমার মতে এদের যথার্থ শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। এদেরকে সামাজিক শোষণের শিকার না হতে দেওয়া দরকার। আর প্রসঙ্গত, রাস্তাঘাটে যেসব হিজড়া পেশার মানুষ আমরা দেখি, তাদের মধ্যে কিন্তু কেউ ইন্টারসেক্স থাকেন না। কারণ এদের বেরোতে দেওয়া হয় না হিজড়া খোলের বাইরে। এরা খানিক দলের সম্পদের মত, আর এদেরকে এটাও বলা হয় না যে, পেশাটা আসলে তাদেরই হওয়া উচিৎ ছিলো। যদিও এদের জন্মানোর সংখ্যা অত্যন্ত কম।
এক দাদা, যে তার দেহে পুরুষ থেকে নারী হতে যাওয়ার অপারেশন প্রক্রিয়া শুরু করেছিলো, তার থেকে জানতে পারি, একজন পুরুষ যখন নারীতে পরিণত হতে চায়, তখন তাকে বিভিন্ন কাউন্সেলিং দ্বারা কনফার্ম করার পর ‘Hormone Replacement Surgery (male-to-female type)’ বা MTF HRT শুরু করতে হয়। কাউন্সেলিং দ্বারা এটা স্থির করা হয় যে, ওই মানুষটি সত্যি সত্যি নিজেকে অন্য লিঙ্গের মানুষ ভাবেন কি না। আবার একজন নারী যখন পুরুষে পরিণত হতে চায়, তখন তাকে বিভিন্ন কাউন্সেলিং দ্বারা কনফার্ম করার পর ‘Hormone Replacement Surgery (female-to-male type)’ শুরু করতে হয়। এরপর যারা পুরুষ থেকে নারী হতে চায়, তাদের উপর ইস্ট্রোজেন হরমোন প্রয়োগ করা হতে থাকে, আর টেস্টোস্টেরন দেওয়া হয় মহিলা থেকে পুরুষ হতে চাওয়া মানুষদের।
ইস্ট্রোজেনের প্রভাবে কয়েক মাস পর থেকে নারীসুলভ স্তনের গঠন শুরু হয়। শরীরের, বিশেষত হাতের বাহুমূলের, আর পায়ের শক্ত পেশী নমনীয় হতে শুরু করে; বুক-পেট-পিঠের লোম এবং দাড়ি গোঁফ নরম হতে শুরু করে। টেস্টোস্টেরনের প্রভাবে শরীরে পুরুষালী পেশীময় হাত, আর লোমের আধিক্য দেখা যায়। এমনকি যোনির ভেতর থেকে একটি টিউমার বা সিস্টের মত অংশ তৈরী হয়, যেটাকে বলে ‘অপরিস্ফুটিত পুরুষাঙ্গ’।
তবে ঐ দাদা এটাও জানান, যেহেতু বাইরে থেকে শরীরে মাসের পর মাস মাত্রাতিরিক্ত হরমোন ঢুকছে, কিন্তু শরীর সেই হরমোন বহন করার উপযুক্ত কাঠামো নিয়ে তৈরী হয়নি, তাই শরীর সর্বতোভাবে এই পদ্ধতিতে সাড়া নাও দিতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হয়, এবং নারীসুলভ বা পুরুষালি শরীরের বিকাশ বন্ধ হয়ে কিছু মাস পর আবার আগের স্বাভাবিক গঠনে ফিরে যায়। কারণ তা না হলে অনেক ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। ভারতের প্রখ্যাত বাংলা চলচ্চিত্র পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ এই পদ্ধতি শুরু করেছিলেন এবং প্রচার আছে তার অকাল মৃত্যুর এটি একটি কারণ।
যদি হরমোন থেরাপি যথাযথ ভাবে সাড়া দেয়, তাহলে পরের অপারেশনে (1) যাওয়া হয়। এই অপারেশনের নাম Sex Reassignment Surgery বা SRS। এর মাধ্যমে রূপান্তরকামী মানুষকে তার মনের পরিচয়ের লিঙ্গের রূপ দেওয়া হয়। এই হরমোন থেরাপি এবং লিঙ্গ পরিবর্তনকারী অপারেশন ভীষণ সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। ধাপে ধাপে নানা পর্যায়ে নানা অপারেশন করা হয়ে থাকে। যেমন,
Hysterectomy: যাতে নারী শরীর থেকে ডিম্বাশয়, জরায়ু, যোনিপথ, ফ্যালোপিয়ান টিউব অপসারণ করা হয়ে থাকে।Phalloplasty: যার মাধ্যমে লিঙ্গ গঠন করা হয়ে থাকে।
Metodioplasty: টেস্টোস্টেরনের প্রভাবে ক্লিটোরিস বড় হয়ে যাবার পর তাকে লেবিয়া মাইনোরা (অর্থাৎ ভ্যাজাইনার ভেতরের ঠোটের মত অংশ যা বাইরের লেবিয়া মেজরা বা বাইরের ঠোঁটের পেছনে অবস্থান করে) থেকে আলাদা করা হয় এবং পরে পেনিসের অবস্থান নির্ণয় করে।
Orchiectomy: এই অপারেশনের মাধ্যমে শুক্রাশয়কে বাতিল করা হয়ে থাকে।
Penectomy: এতে পুং লিঙ্গচ্ছেদ ঘটানো হয়।
Vaginectomy: স্ত্রী লিঙ্গের সামগ্রিক অপসারণ ঘটানো হয়।
Masectomy: এতে স্তন বাদ দেওয়া হয়।
Breast Augmentation: স্তন তৈরী করা হয়।
Facial feminization surgery (FFS): পুরুষালি মুখমণ্ডলকে নারীর ন্যায় কোমল করা হয়ে থাকে।
এই বেসিক অপারেশন ছাড়াও আরো জটিল অপারেশন করতে হতে পারে। সাথে স্টেরয়েড হরমোন প্রদান করা হয়। এক্ষেত্রে যে মানুষটি এই পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন, তার নানারকম শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন আসতে পারে। সেসবের জন্য আবার নানারকম মেডিকেশন এবং মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শনের প্রয়োজন পড়ে। তবে এরপর যে নতুন যৌনাঙ্গ পাওয়া যায়, সেখানে কৃত্রিমভাবে নার্ভ প্রতিস্থাপন করা হয়। তাতে নাকি একই রকম যৌনানুভূতি পাওয়া যায়। নারী থেকে পুরুষ হওয়ার ক্ষেত্রেও একই অভিমত। গলার স্বরও পরিবর্তন সম্ভব।
কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই এরা সন্তান উৎপাদন ও ধারণে অক্ষম হয়। কারণ স্ত্রী যৌনাঙ্গ পেলেও ডিম্বাশয়, ফ্যালোপিয়ান টিউব, কিংবা জরায়ু কৃত্রিমভাবে বানানো সম্ভব হয়নি, বা বানানো হলেও তার প্রয়োগ সম্ভব হয়নি। সেক্ষেত্রে কোনো মহিলা যদি ডোনার হন, তাহলে হয়ত সম্ভব। মহিলা থেকে পুরুষ হওয়ার ক্ষেত্রেও একইভাবে একজন পুরুষকে তার শুক্রাশয় দান করতে হবে এবং উভয় ক্ষেত্রেই ওই ডিম্বাণু বা শুক্রানুর ডিএনএ কিন্তু দাতার ডিএনএ হবে। অর্থাৎ এসব নানা প্রতিস্থাপনের পরেও সেই সন্তান তাদের একজনের হবে না। অর্থাৎ রূপান্তরিত পুরুষ হলে সে তার শুক্রের দ্বারা উৎপন্ন সন্তানের পিতা নয়, এবং রূপান্তরিত মহিলার ক্ষেত্রে সেই মহিলা তার গর্ভে ধারণ করা সন্তানের মাতা নয়। এটা খানিকটা সারোগেট মাদারের মত কন্সেপ্ট। তবে আমার অনেক প্রশ্ন থেকে গেছে। যেমন, একজন মহিলা কেন কম বয়সে তার এসব অঙ্গগুলো দান করবেন? আর বেশি বয়সে মরণোত্তর এই অঙ্গগুলো প্রতিস্থাপন করলে তা আদৌ কাজে লাগবে কি না? আবার জোর জবরদস্তি বা অভাবের শিকার হয়ে কিডনি বেচার মত এগুলিও ভবিষ্যতে ব্যবসা হয়ে দাঁড়াবে কি না?
আসলে আমরা ভাবুক বলে আমাদের মনে ভবিষ্যত নিয়ে এত প্রশ্ন। তা সে অবান্তর হোক, বা যুক্তিযুক্ত। তবে যদি রূপান্তরকামী পুরুষ আরেকজন রূপান্তরকামী নারীকে তার শুক্রাশয় প্রদান করেন এবং বদলে ওই রূপান্তরকামী নারী তার অঙ্গ সেই পুরুষকে দান করেন, তাহলে হয়ত উপরোক্ত সমস্যার অনেকখানি সমাধান হয়ে যাবে।
এ বিষয়ে আরো খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করতে পারবেন যারা সরাসরি বায়ো-সায়েন্সের সঙ্গে যুক্ত। অর্থাৎ শারীরবিদ্যা, মাইক্রোবায়োলজি, বায়োকেমিস্ট্রি বা মেডিসিন নিয়ে যারা পড়েছেন বা চর্চায় আছেন বা পেশাতে আছেন, তারা। আর শরীর মন দুত্টোই বোঝাতে পারবেন সেই সব মানুষ, যারা রূপান্তরকামী এবং এই চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন বা গেছেন।
সবশেষে, সবার আগে আমি মনকে প্রাধান্য দিই, কিন্তু তা অবশ্যই শরীরের ক্ষতি না করে। আমার কাছে মানুষ শুধু সন্তান উৎপাদনের জন্যই জন্মগ্রহণ করেনি। এছাড়াও অনেক কাজ তার আছে। তাই সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতা বা অক্ষমতার বিচারেও আমি রূপান্তরকামী মানুষদের অস্তিত্ব, সাফল্য ইত্যাদি বিচার করতে চাই না। আমার কাছে রূপান্তরকামী, সমকামী, বিষমকামী, উভকামী – এগুলো মানুষের পরিচয় না। তাদের ‘কাজ’ তাদের পরিচয়। আমি কিছু প্রশ্ন এবং ঋতুপর্ণের মৃত্যু দিয়ে এই পদ্ধতির নেতিবাচক দিক দেখাতে চাইনি। আমি শুধুই আমার জানা তথ্য এবং উদ্বেগের প্রকাশ করেছি মাত্র। ইনাদের কাজের দু’একটি উদাহরণও দেওয়া দরকার। দেখানো দরকার যে, এই মানুষগুলো আর পাঁচজনের মতই স্বাভাবিক এবং সাধারণ কাজ করে সমাজের মূল স্রোতে চলতে সক্ষম।
বিখ্যাত বিদেশি মানুষের পরিবর্তে আমাদের চোখের সামনে উপস্থিত দেশি মানুষের উদাহরণ দিই। যেমনঃ পশ্চিমবঙ্গের প্রথম রূপান্তরিত মানুষ সোমনাথ, রূপান্তরিত হয়ে একজন মানবী হন এবং নাম রাখেন মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি পিএইচডি করে বর্তমানের কৃষ্ণনগর উইমেন্স কলেজের অধ্যক্ষা।
পিঙ্কি প্রামাণিক, যিনি একজন ইন্টার সেক্সের উদাহরণ, এবং বর্তমানে একজন মেয়ে, তিনি কমনওয়েলথ গেমস, এশিয়ান গেমমে দৌড়ে ভারত কাঁপিয়েছেন। বর্তমানে উনি শিয়ালদা রেলস্টেশনের একজন টিকিট পরীক্ষক। মধু বাই, ছত্তিশগড় রাজ্যের রায়গঢ় শহরের পৌর প্রশাসিকা। অর্থাৎ রাজনীতি করতেও এরা সক্ষম এবং মানুষের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধি। তামিলনাডুর চেন্নাই শহরে এ বছর প্রথম রূপান্তরিত পৃথিকা ইয়াশিনি, পুলিশ অফিসার পদে যোগদান করেন। এরা পারেন, আর দশজনের মত করেই পারেন।
আর বারবার আমি ‘স্বাভাবিক’ কথাটা ব্যবহার করেছি বটে, কিন্তু কোন মানুষের জন্য কোনটা স্বাভাবিক, সেটা শুধু সেই মানুষটিই জানতে পারে।
সর্বোপরি, আমি যতদুর জানি এই ধরনের অপারেশন নাকি ভীষণ ব্যয়বহুল। ভারত-সহ পৃথিবীর নানা দেশের সরকার এই অপারেশনের জন্য অনেকটা খরচ বহন করে এবং বর্তমানে ভারতের সুপ্রীম কোর্ট লিঙ্গের অধিকার সূচক রায়ে এই অপারেশনের খরচ বিনামূল্যে করার প্রস্তাবনা এনেছে। রূপান্তরকামী মানুষদের জন্য ভারতের সুপ্রীম কোর্ট সমস্ত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থাৎ উচ্চশিক্ষা কেন্দ্রে তারা যেন তাদের মনের পরিচয়ে অর্থাৎ তৃতীয় লিংগের পরিচয়ে (যেসব ক্ষেত্রে তারা অপারেশন করাতে অক্ষম বা অনিচ্ছুক, কিন্তু নিজেদের পুরুষের শরীরে আবদ্ধ বলেই পুরুষ মানতে নারাজ অথবা নারী শরীরেও নিজেকে নারী ভাবেন না) ভর্তি হতে পারেন, তার নিয়ম ২০১৫ থেকেই চালু করেছে, উচ্চশিক্ষায় তাদের আসনও সংরক্ষণ করা হয়েছে বিশেষ কোটার মধ্যে। যেখানে দেশের সরকার মানুষের মনের দাম দিতে চাইছে, সেখানে আমরা বিজ্ঞানযাত্রীরাও যুক্তিসম্মতভাবে এগিয়ে আসতে পারি। আর আলোচনা আমরা করবোই। এক শ্রেণীর মানুষকে পেছনে ফেলে দেশ এগোতে পারে না। বিজ্ঞানযাত্রীরা তো তাদের পেছনে ফেলার কথা ভাবতেই পারেন না।
আলোচনা, যুক্তি, যুক্তি খণ্ডন এসবের মধ্যে দিয়েই আসবে বিজ্ঞানযাত্রীদের সাফল্য। তবে বিজ্ঞান সাধনার পাশে পাশে সমাজ, মানুষের মন এসবের দিকেও নজর রাখতে হবে। ভারতের খুব জনপ্রিয় এবং বিতর্কিত টিভি অনুষ্ঠান ‘সত্যমেব জয়তে’-তে এই ধরনের মানুষ নিয়ে অসাধারণ একটি প্রতিবেদন দেখানো হয়, যা অনেক বিতর্কের সৃষ্টি করলেও মানুষের মনে বিশেষ প্রভাব ফেলে। সেখানে এ ধরনের একজন রুপান্তরিত মহিলাকে দেখা্নো হয়েছিলো, তার কথা শোনানো হয়েছিলো। একবার দেখুন, বিশ্বাস হবে না এই মেয়েটি কখনও ছেলে ছিলো বলে! অথবা ভাবতে বাধ্য হবেন, যা হয়েছে ভালো হয়েছে। প্রাসঙ্গিকতার খাতিরেই আজ এত বকলাম। মাফ করবেন, কিন্তু দেখুন ভিডিওটা। এখানে হয়ত অনেকেই এই শো দেখেছেন। কিন্তু যারা দেখেননি তাদের জন্য লিঙ্ক দিলাম। হিন্দি বুঝতে অসুবিধা হলে ইংরেজী সাবটাইটেল আছে। আশা করি ভালো লাগবে।
1) রুপান্তরের শল্যচিকিৎসা (এনিমেটেড)
2) “সত্যমেব জয়তে”- ভিন্ন যৌনতা বিষয়ক প্রতিবেদন।
খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি লেখা।প্রত্যেক মানুষের তার নিজ পরিচয়ে বাঁচার অধিকার আছে।একজন মানুষের পরিচয় কখনো তার লিঙ্গ হতে পারে না।আমাদের সমাজে এই বিষয় গুলো নিয়ে অনেক কুৎসা আর ভুল ধারনা আছে।হিজড়া আমাদের সমাজে গালি হিসাবে ব্যবহার হয়।গে,লেসবিয়ান এই জাতীয় মানুষ আমাদের সমাজে আনাচে কানাচে লুকিয়ে আছে যারা সমাজের ভয়ে নিজেদের প্রকাশ করে না। অন্য আর দশজন মানুষের মত এদের ও স্বাভাবিক জীবন যাপনের অধিকার আছে। এরা সমাজে নিষিদ্ধ নয়। বিজ্ঞান যাত্রায় মুছে যাক সব কুসংস্কার। ধন্যবাদ লেখক কে এইরকম একটি লেখা উপহার দেয়ার জন্য।