সূচনা বক্তব্য
২০১৬ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি একটা গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হলো, যাতে বলা হলো – বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মত দুটো কৃষ্ণগহ্বরকে ঝগড়া (সংঘর্ষ) করতে দেখেছেন, এরপর আবার মিলেমিশে (একীভূত হয়ে) যেতে দেখেছেন; এবং এই ঘটনা থেকে পেয়েছেন মহাকর্ষীয় তরঙ্গের সন্ধান, যে তরঙ্গকে বরাবর ১০০ বছর ধরে খুঁজছিলেন পদার্থবিদেরা। আমাদের মহাবিশ্বকে বোঝার ক্ষেত্রে এটা একটা বিশাল মাইলফলক। কেন এই আবিষ্কার গুরুত্বপূর্ণ, সেই ব্যাপারে যথাসময়ে আসছি। তবে এই প্রবন্ধের শিরোনাম যেহেতু সহজ ভাষায় প্রাথমিক জ্ঞান, তাই আগেই প্রাথমিক জ্ঞানগুলো সহজ ভাষায় বলে নেয়া দরকার – আমাদেরকে শুরুতেই জানতে হবে মহাকর্ষ কী। এটা নিয়ে ভালো করে না জানলে ঐ তরঙ্গের মা-বাপের খবর পাওয়া যাবে না। সেটা জেনে নিয়ে দেখবো তরঙ্গটা কী; এরপর দেখবো কেমনে মানুষ মহাজাগতিক গোয়েন্দার মত “হ্যান্ডস আপ” বলে ওকে সনাক্ত করে ফেললো। আসুন, শুরু করি…
মহাকর্ষ কী?
অত্যন্ত সংক্ষেপে – নিউটন বলেছিলেন, সবকিছু একে অপরকে আকর্ষণ করছে, এবং এই আকর্ষণ বলই হচ্ছে মহাকর্ষ। এই মহাকর্ষ বলের মাধ্যমেই সূর্য পৃথিবী এবং অন্যান্য গ্রহগুলোকে বলছে, “আমার চারপাশে ঘুর, ব্যাটা।” কিন্তু কিভাবে, সেটা তিনি জানতেন না। আইনস্টাইন এসে বললেন, আসলে আকর্ষণের জন্য নয়, মহাকর্ষ কাজ করে আরেকটু ভিন্নভাবে। কিভাবে? সংক্ষেপে, মহাকর্ষ হচ্ছে “স্থান-কাল চাদরের মধ্যে একটা বক্রতার প্রভাব”। এই ৭টা শব্দ প্রত্যেকটা আলাদা করে বুঝলেও একত্র করলে অনেকেরই বুঝতে বেশ ঘাপলা হয়। তাই আসুন, জিনিসটাকে আরেকটু ভালো করে দেখি।
স্থান বলতে আমরা (ত্রিমাত্রিক প্রাণীরা) যা বুঝি, তা হলো দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, ও উচ্চতার সমন্বয়। এই তিনটা জিনিস আমরা উপলব্ধি করতে পারি, এবং এগুলোতে আমাদের চলাফেরা নিয়ন্ত্রণও করতে পারি। মানে, আমরা সামনে-পিছে (দৈর্ঘ্য), ডানে-বামে (প্রস্থ), আর উপরে-নিচে (উচ্চতা) নড়াচড়া করতে পারি। আইনস্টাইনের মতে, সময়ও এখানে আরেকটা মাত্রা হিসেবে কাজ করে। তিনটি মাত্রার স্থান আর আরেক মাত্রা সময়, দুটো মিলিয়ে চতুর্মাত্রিক পর্দা তৈরি হয়, যার নাম Space-Time Continuum বা স্থান-কালের চাদর। আমরা ত্রিমাত্রিক প্রাণী, আমাদের জন্য চারটা বস্তুগত মাত্রা কল্পনা করা অত্যাধিক কঠিন। তাই, আসুন আমরা ত্রিমাত্রিকভাবেই চিন্তা করি।
মনে করুন, একটা বিশাল এবং মোটা কাপড়ের পর্দাকে টানটান করে ঘরের চারকোণার খুঁটিতে বেঁধে রাখা হয়েছে। ধরুন, এই চাদরটাই হচ্ছে স্থান-কালের চাদর। এখানে আপনি যত ভারী বস্তু রাখবেন, তত বেশি বক্রতা তৈরি হবে। আর এই বাঁকের মধ্যে যারা আসে, তারা সেই বাঁকে আটকে যাবে। অর্থাৎ, বক্রতার কারণে এখন যা যা ঘটবে, সেটাকেই আমরা মহাকর্ষ বলি। এখন, কম ভরের বস্তুগুলো বেশি ভরের বস্তুর চারপাশে উপবৃত্তাকার কক্ষপথে ঘোরা শুরু করবে। আর এভাবেই মহাকর্ষ কাজ করে, কোনো আকর্ষণের বালাই নেই। আইনস্টাইন তার সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে এই ব্যাখ্যাটা দিয়েছিলেন।
মহাকর্ষ ছাড়া এই চাদরটা কিভাবে কাজ করতো, আর মহাকর্ষ সহ এই চাদরটা কিভাবে কাজ করে, এই জিনিসটা ইউটিউবে একজন খুব সুন্দর করে বুঝিয়েছে –
আশা করি, মহাকর্ষ সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা পেয়ে গেছেন।
মহাকর্ষীয় তরঙ্গ কী?
সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণীতে থাকতে যে জিনিস পড়েছিলাম, সেখান থেকে ঘুরে আসি। তরঙ্গের ব্যাপারে দেখেছিলাম, সেটা নাকি দুই প্রকার –
১) অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ বা longitudinal wave – যেটা এগিয়ে যায় সংকোচন আর প্রসারণের মাধ্যমে। যেমন – শব্দ।
২) অনুপ্রস্থ তরঙ্গ বা transverse wave – যেটা এগিয়ে যায় শীর্ষ এবং খাদের মাধ্যমে। যেমন, আলোর তরঙ্গ রুপ, তাড়িৎ-চৌম্বক তরঙ্গ, পানির তরঙ্গ, ইত্যাদি।
এই অনুপ্রস্থে শুধু একটি মাত্রায় (উচ্চতায়) নড়াচড়া ফলে তরঙ্গটা আরেকটি মাত্রায় (দৈর্ঘ্যে) এগিয়ে যাচ্ছে। এই দুটো তরঙ্গ দ্বিমাত্রিক তলে দেখানো গেলেও মহাকর্ষীয় তরঙ্গের জন্য নিচের ত্রিমাত্রিক চিত্রটা প্রয়োজন হবে। এর মধ্যেও সংকোচন-প্রসারণ হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু দুটো মাত্রায়, একই সাথে প্রস্থে এবং উচ্চতায়। যখন এই তরঙ্গ কোনোকিছুর মধ্য দিয়ে যাবে, তখন সেই জিনিসটাও এভাবে মুচড়ে যাবে। মোচড়ানোর পরিমাণ অত্যাধিক সামান্য। এতো সামান্য যে সেটা সনাক্ত করার জন্য আমাদেরকে প্রায় ১০০ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। এতোদিন আমাদের সেই যান্ত্রিক সক্ষমতাই ছিলো না।
এবং এভাবেই এই তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ছে স্থান-কালের চাদরে, আলোর গতিতে। আমরা জানলাম যে, যে কোনো বস্তুই স্থান-কালের চাদরে বক্রতা তৈরি করে। আর এভাবেই মহাকর্ষ তৈরি হয়। যখন ভরযুক্ত বস্তু স্থান-কালের চাদরে ভেসে বেড়ায়, তখন এই বক্রতার প্রভাবও কিন্তু সেই বস্তুর সাথে সাথে চলতে থাকে – তুমি যেখানে, আমি সেখানে স্টাইলে। কিন্তু কখনো কখনো, কোনো বস্তুর ত্বরণ বা গতিবৃদ্ধির হার বেড়ে যায়। কিভাবে বেড়ে যায়? যখন একটা বিশাল ভরের বস্তু আরেকটা বিশাল ভরের কাছাকাছি আসে। যেমন – দুটো কৃষ্ণগহ্বর, একটা কৃষ্ণগহ্বর এবং একটা বিশালাকার নক্ষত্র, ইত্যাদি। একটা আরেকটার বক্রতার মধ্যে আটকা পড়ে যায়। পাইরেটস অফ ক্যারিবিয়ানের শেষ দিকে যে দুটো জাহাজের যুদ্ধ হয়, মনে আছে? তেমন করে একজন আরেকজনকে চক্কর খেতে থাকে, ত্বরণও বাড়তে থাকে।
যাই হোক, ত্বরণ বেড়ে গেলে স্থান-কালের ঐ চাদরে একটা ঘূর্ণির সৃষ্টি হয়, যা ঢেউ আকারে আলোর গতিতে সবদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এই ঢেউকেই বলে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ। প্রথমবারের মত দুটো কৃষ্ণগহবরকে এই কাহিনী করতে দেখেছি আমরা।
কিভাবে এটা সনাক্ত করা হলো?
LIGO – Laser Interferometer Gravitational-wave Observatory এই জিনিসটা শেষ পর্যন্ত সনাক্ত/আবিষ্কার করতে পেরেছে। কিভাবে? গল্পটা কোনো খুনের রহস্য সমাধানের চেয়ে কম রোমাঞ্চকর না।
১৩০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে, অর্থাৎ ১২৩০ ট্রিলিয়ন মাইলের মত বিশাল এক দূরত্বে দুটো কৃষ্ণগহ্বর একটা আরেকটার সাথে সংঘর্ষ করে একীভূত হয়ে গেলো। দুই কালা মিয়ার একটার ভর ছিলো আমাদের সূর্যের ২৯ গুণ, অন্যটা ৩৬ গুণ। সূর্যের ভর চিন্তা করলেই খাবি খেতে হয়। সূর্য আয়তনে অনেক বড় একটা জিনিস, এটাতে অনেক ভর ধরে। সেটার ভরকে ২৯ আর ৩৬ দিয়ে মনে মনে গুণ দিন। এবার চিন্তা করুন, সেই ভরের দুটো জিনিস (যদিও আয়তনে অনেক ছোটো, কম জায়গায় বেশি বস্তু নিয়ে চলে কৃষ্ণগহবর) সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে।
সংঘর্ষে দুটো মিলে একটি কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হলো, যার ভর দাঁড়ালো আমাদের সূর্যের ৬২ গুণ; বাকি ৩ গুণ ভর শক্তিতে পরিণত হলো। এই সংঘর্ষের ঘটনাটা স্থান-কালের চাদরে বইয়ে দিলো মহাকর্ষীয় তরঙ্গ। সেই তরঙ্গ আলোর গতিতে, অর্থাৎ ১৩০ কোটি বছর সময় অতিক্রম করে এসে পৌঁছালো পৃথিবীতে। এ ধরনের ঘটনাগুলো থেকে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ বের হয়, তা আইনস্টাইনই প্রস্তাব করেছিলেন ১৯১৬ সালে। এরপর থেকে চলছিলো সনাক্ত করার চেষ্টা। আমরা জানি, এই তরঙ্গ স্থান-কালকে মুচড়ে দেবে। অর্থাৎ, পৃথিবীতেও আমরা স্থান দেখি, সেই স্থানের সংকোচন-প্রসারণ ঘটবে। আমরা সেই সংকোচন-প্রসারণ বুঝবো না, কারণ সেটা খুবই সামান্য।
আর মাপার জটিলতাতে কাহিনী আরো একটা আছে। মনে করুন, আপনার কাছে একটা স্কেল আছে যেটা দিয়ে আপনি বারো ইঞ্চি মাপতে পারেন। এখন বারো ইঞ্চির দুদিকে দুটো খুঁটি পুঁতলেন। এই দুই খুঁটির মধ্যে দূরত্বটা মহাকর্ষীয় তরঙ্গ আসার পর বাড়লো নাকি কমলো, সেটা ঐ স্কেল দিয়ে বোঝা যাবে না। কারণ, তরঙ্গের কারণে ঐ দূরত্বটা যদি বাড়ে, তাহলে স্কেলেরও ততটুকু প্রসারণ ঘটবে। আপনার কাছে তখনও সেটাকে ১২ ইঞ্চিই মনে হবে। মহাবিশ্বে শুধু একটা মানদণ্ডই আছে, যা এই তরঙ্গে পরিবর্তিত হবে না। শুধু সেই মানদণ্ড দিয়েই আপনি সংকোচন বা প্রসারণ মাপতে পারবেন। সেই মানদণ্ড হচ্ছে – আলো। আলোর গতি একই থাকবে, এবং আলোর যাওয়া-আসার সময় দিয়ে আপনি বুঝতে পারবেন দূরত্ব কতটুকু। ধরুন, আগে স্থান-১ থেকে স্থান-২ পর্যন্ত যেতে যদি আলোর ০.০০১ সেকেন্ড সময় লাগতো, দূরত্বটা প্রসারিত হলে ০.০০১ সেকেন্ডের চেয়ে একটু বেশি লাগবে।
দৃশ্যপটে এলো LIGO. চার কিলোমিটার লম্বা ইংরেজি L আকৃতির সুড়ঙ্গ বানালো ওরা। সুড়ঙ্গের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় ওরা আলো (লেজার) ছুঁড়ে মারে। এরপর অন্য মাথায় গিয়ে সেটা ফিরে আসতে কতক্ষণ লাগে, সেটা বিচার করে দেখে যে আসলেই দূরত্বটা এখনো ৪ কিলোমিটারই আছে কিনা। যদি সময় কমবেশি লাগে, তাহলেই বোঝা যাবে যে স্থান মুচড়ে গেছে, সংকোচন-প্রসারণ হয়েছে। এক মাত্রায় (ধরুন ডানে-বামে) যদি প্রসারিত হয়, তাহলে অন্য মাত্রায় (সামনে-পিছনে) সংকুচিত হবে। অর্থাৎ, L এর এক বাহুতে আলো যেতে বেশি সময় নেবে, আরেক বাহুতে আলো যেতে কম সময় নেবে। দুটোই মিলতে হবে।
কতটুকু সংকোচন/প্রসারণ হয়েছিলো? একটা প্রোটনকে ১০ হাজার ভাগে ভাগ করলে যে দৈর্ঘ্য পাওয়া যায়, ততটুকু পরিমাণ দৈর্ঘ্যের পার্থক্য যদি আপনি মাপতে পারেন, তাহলে আপনি এই সংকোচন আর প্রসারণ মাপতে পারবেন। বোঝা গেলো না মনে হয়? আরেকটা উদাহরণ দেই – ধরুন, আপনার কাছে ১ বিলিয়ন ট্রিলিয়ন কিলোমিটার লম্বা একটা ট্রেন আছে। সেটার মধ্যে যদি মাত্র ৫ মিটার লম্বা আরেকটা বগি লাগাতে হয়, তাহলে দৈর্ঘ্যের যেমন পার্থক্য হবে, সেটা আপনাকে মাপতে পারতে হবে। অত্যন্ত সংবেদনশীল যন্ত্র ছাড়া এই পার্থক্য মাপা সম্ভব না।
মাপার মধ্যে আরেকটা সমস্যা তো ছিলোই, সেটা হলো হৈচৈ। যে কোনো জিনিস, যার আয়তন আছে, অথবা যার তাপমাত্রা পরম শূন্য তাপমাত্রার ওপরে, সেটাই কাঁপে, সর্বদাই কাঁপছে। এগুলোকে যন্ত্রের হিসেব থেকে বাদ দিতে হবে। তারপর অন্যান্য তরঙ্গ আছে, সেগুলোকেও বাদ দিতে হবে। তার ওপর যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে এইরকম কাকতালীয় ঘটনা ঘটলো কিনা, তাও দেখতে হবে। তাই, এই ধরনের পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র বানানো হলো দুটো। একটা যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানাতে, আরেকটা চার হাজার কিলোমিটার দূরে ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যে। নিশ্চিত হবার জন্য দুটো পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রেই একই পরিমাপ পেতে হবে।
২০০২ থেকে ২০১০ পর্যন্ত LIGO এর তথ্য সংগ্রহের প্রথম অধিবেশন চললো। কিন্তু ওরা কোনো ফলাফল পায়নি। আগেই বলেছি, কাজটা কঠিন। এরপর ২০১০ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত ওরা অনেক যান্ত্রিক ত্রুটি সারালো। এই ত্রুটি সারাতে, সংবেদনশীলতা বাড়াতে, ৫ বছরে খরচ হয়েছিলো ২০০ মিলিয়ন ডলারের ওপরে। ২০১৫ তে যখন তথ্য সংগ্রহের দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু হলো, তখন ওরা প্রায় সাথে সাথেই মহাকর্ষীয় তরঙ্গের সন্ধান পেয়েছিলো। কিন্তু সেটা আসলেই মহাকর্ষীয় তরঙ্গ কিনা, সেটা নিয়ে বারবার পরীক্ষা চলতে লাগলো। অবশেষে ২০১৫ এর সেপ্টেম্বর মাসে ওরা নিশ্চিতভাবেই এই কৃষ্ণগহ্বর সংঘর্ষের ফলে সৃষ্ট তরঙ্গের ব্যাপারে নিশ্চিত হলো। শুরু হলো গবেষণা প্রবন্ধ লেখার কাজ। গবেষকদের বিশাল একটা দল Physical Review নামক গবেষণা পত্রিকায় একটা প্রবন্ধ জমা দিলো ২০১৬ সালের জানুয়ারির ২১ তারিখে। সেই প্রবন্ধ প্রকাশনার জন্য নির্বাচিত হলো ফেব্রুয়ারির ১১ তারিখ। সেই প্রবন্ধে একটা রেখাচিত্র (গ্রাফ) আছে, যেখানে দুই পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রতেই একই ফলাফল পাওয়ার ব্যাপারটা দেখানো হয়েছে।
এই তরঙ্গ আবিষ্কার হওয়াটা কেন গুরুত্বপূর্ণ?
প্রত্যেকটা তরঙ্গ আমাদেরকে নতুন কিছু শেখায়। প্রথমে আমরা শুধুমাত্র চোখের দেখাতে যা যা দেখা যায়, তাই দেখতাম। অর্থাৎ, আমাদের দৃষ্টিশক্তিতে যে তরঙ্গদৈর্ঘ্যগুলো ধরা পড়ে, সেই দৃশ্যমান আলোক তরঙ্গেই দেখতাম। এরপর যখন অবলোহিত (infrared), অতিবেগুনী (ultraviolet), বেতার (radio) এমন তরঙ্গগুলো আবিষ্কৃত হলো, আমাদের দেখার দৃষ্টিভঙ্গিই পাল্টে গেলো। আর সেগুলোর প্রভাব নিশ্চয়ই নতুন করে বলতে হবে না। আর মহাকর্ষীয় তরঙ্গ তো একেবারে আলাদা এক ধরনের তরঙ্গ। এই তরঙ্গ ব্যবহার করে যে সামনে আমরা কী কী দেখবো, তা এখন অনুমানও হয়তো করা যাচ্ছে না। একদম কম করে বললেও, আমরা বুঝতে পারবো – আমাদের এই মহাবিশ্ব কিভাবে কাজ করে, মহাকর্ষ কিভাবে কাজ করে। সায়েন্স ম্যাগাজিনের ভিডিও-তে বলা হয়েছে, এটা জন্ম দিয়েছে জ্যোতির্বিদ্যার একদম নতুন একটা শাখা।
হয়তো একদিন এটার মাধ্যমেই আমরা মহাকর্ষকে কাজে লাগাতে শিখবো। মহাকর্ষকে যদি কাজে লাগানো যায়, কোনোভাবে যদি স্থান-কাল চাদরের নিয়ন্ত্রণ নেয়া যায়, তাহলে কী হবে, আন্দাজ করতে পারছেন? হয়তো আমরা ওয়ার্মহোল বা কীটগহ্বর তৈরি করতে পারবো, আলোকবর্ষ ভ্রমণ করতে পারবো মুহূর্তের হিসেবে।
সমাপনী বক্তব্য
স্টিফেন হকিং একটা মন্তব্য করেছেন এই আবিষ্কারটা প্রকাশিত হবার পর। তিনি বলেছেন,
LIGO দলকে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ আবিষ্কারের জন্য ধন্যবাদ। এটা হিগস বোসন কণা আবিষ্কারের মতই গুরুত্বপূর্ণ। ওরা প্রথমবারের মত মহাকর্ষীয় তরঙ্গ পর্যবেক্ষণ করেছে, দুটো কৃষ্ণগহ্বরের সংঘর্ষ এবং মিশে এক হয়ে যাওয়া পর্যবেক্ষণ করেছে। LIGO এর বর্ধিত সংবেদনশীল যন্ত্র দিয়ে আমরা হয়তো সামনে এমন আরো ঘটনা সনাক্ত করতে পারবো, হয়তো এই ব্রহ্মাণ্ড নিয়ে আমাদের জ্ঞান আরো বাড়াতে পারবো।
এই নিরীক্ষাধর্মী পর্যবেক্ষণগুলো, ১৯৭০ সালে কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে আমার করা কাজগুলোর সাথে সংগতিপূর্ণ। একজন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ হিসেবে, আমি নিজের সারাজীবন ব্যয় করেছি এই ব্রহ্মাণ্ডটাকে বোঝার জন্য যাতে কিছুটা অবদান রাখতে পারি। ব্যাপারটা ভাবতেই রোমাঞ্চ হয় যে, আমি কৃষ্ণগহ্বরের ক্ষেত্রফল আর অনন্যতা তত্ত্ব নিয়ে যে ভবিষ্যদ্বাণীগুলো ৪০ বছর আগে করেছিলাম, সেগুলো আমার জীবদ্দশাতেই পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
বিজ্ঞান আমাদের জীবনযাত্রাকে পাল্টে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই ধরনের বিশাল আবিষ্কার আমাদের জীবদ্দশায় আবার হবে কিনা, তা বলা বেশ মুশকিল। এটাই হয়তো আপনার আর আমার জীবনের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞানভিত্তিক মুহূর্ত – এতোটাই বিশাল এই আবিষ্কার। অবশ্য আমি বেশ আশাবাদী। আমার ভবিষ্যদ্বাণী হচ্ছে – ঠিক এই মাত্রার পরবর্তী বিশাল আবিষ্কার হচ্ছে পৃথিবীর বাইরে প্রাণের সন্ধান খুঁজে পাওয়া, আর সেটা হয়তো ঘটবে আমার জীবদ্দশাতেই।
বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত প্রচেষ্টাকে ধন্যবাদ, আইনস্টাইনকে ধন্যবাদ, LIGO গবেষকদেরকে ধন্যবাদ – এরকম গা শিরশির করা একটা আবিষ্কার আমাদেরকে উপহার দেয়ার জন্য। পুরো জিনিসটা সংক্ষেপে (৩ মিনিটে) একবার ঝালাই করে নিতে চান? তাহলে পিএইচডি কমিকসের বানানো অল্প সময়ে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে যাওয়া এই ভিডিওটা দেখুন।
ভাই অনেক ভালো লেখছেন
ধন্যবাদ, ভাই। ভালো করে পড়ে ভুল-টুল থাকলে ধরায়ে দেন।
মুক্তমনাতে গিয়েও পড়ে আসলাম এই বিষয়ে।বিজ্ঞানযাত্রায় ও এরকম একটা লেখা ছেয়েছিলাম। অনেক ভালো লাগলো।
ধন্যবাদ। মুক্তমনার লেখাটাও বেশ হয়েছে।
অসাধারণ ভাই!! অসংখ্য ধন্যবাদ এতো সুন্দর করে বুঝিয়ে দেয়ার জন্যে।
আপনাকেও ধন্যবাদ।
(বিজ্ঞানযাত্রা_চলবে)
অনেক ভাল লাগলো লেখাটি।
I am speechless.thannnnnnks a lot.Please write about ‘A brief history of time’
You mean, a review about the book?
Not review.সহজ ভাষায় যাতে বোঝা যায়
আচ্ছা, লিখবো। সাজেশনের জন্য ধন্যবাদ।
nice presentation thanks…………….
Very nice & interesting article that should be read & studied by every person.
I am glad you thought so. Means a lot.
আমার একটা ছোট প্রশ্ন,উত্তর দিলে খুশি হব।এই দুটো কৃষ্ণগহ্বরকে সংঘর্ষ এর পর, এ তরংগ কতদিন বা কত সময় লাগে পৃথিবীতে আসতে নাকি সাথে সাথে পোঁছে যায়??
আলোর গতির চেয়ে বেশি গতিতে তো আসতে পারবে না। ওটা ১৩০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে, আলোর আসতেই সময় লাগে ১৩০ কোটি বছর। তরঙ্গ আসতেও ততই সময় লাগে। আর তরঙ্গ মানে তো বুঝতেই পারছেন, এটা তো আর one time event না। পৌঁছানোর পর, আসছে তো আসছেই… একসময় মিলিয়ে যাবে ঠিকই অবশ্য!
লেখাটা তিনবারবার পড়লাম।প্রথমবারে মনে হয়েছিল পানির মত সহজ।দ্বিতীয়বারে মাথায় কিছু প্রশ্ন আসতে শুরু করল আর তৃতীয়বারে মনে হল যে প্রথমবারে আমি আসলে তেমন কিছুই বুঝি নাই।
কয়টা ব্যাপার একটু পরিষ্কার করবেন প্লিজ!(যেহেতু আমি পদার্থবিদ্যার ছাত্র না)
১.সব ভরযুক্ত বস্তুই(ছোট/বড়) কি স্পেস-টাইম কন্টিনামকে নিজের দিকে টানতে পারে?
২.ব্যাপারটা কি এরকম-অধিক ভরযুক্ত বস্তু স্পেস-টাইম কন্টিনামকে নিজের দিকে টেনে বাঁকা করে নেয়,আর তার সাপেক্ষে তুলনামূলক ক্ষুদ্র ভরের বস্তুর অপেক্ষাকৃত নির্বিকার থাকার লব্ধি ফলাফলটুকুই মহাকর্ষ?
৩.আর ভরযুক্ত বস্তু ছাড়াও শক্তি(মহাকর্ষীয় তরঙ্গ)ও কি তাহলে স্পেস-টাইম কন্টিনামে বাঁক ধরাতে পারে?
১) হ্যাঁ, পারে। ভর যত বেশি, বাঁক তত বেশি হয়।
২) না, ক্ষুদ্র বা কম ভরবিশিষ্ট বস্তুদেরও নিজের বানানো বাঁক থাকে। ওরা নিজেদের চেয়ে কম ভরযুক্তদেরকে নিজের চারপাশে ঘোরাতে পারে। যেমন, সূর্য পৃথিবীকে ঘোরাচ্ছে; আবার পৃথিবী চাঁদকে ঘোরাচ্ছে।
৩) বস্তুটার ঘূর্ণনই তো তরঙ্গের সৃষ্টি করছে। আর সেই তরঙ্গটাই তো বাঁক, চলমান কম্পন।
ধন্যবাদ। আরেকটা প্রশ্ন করি ভাইয়া,যদি কিছু মনে না করেন।তাহলে এই দুটো
কৃষ্ণগহ্বরের সংঘর্ষ হয়েছিল কত বছর আগে?১৩০ কোটি বছর আগে? নাকি অন্য কিছু??
হ্যাঁ, সংঘর্ষটা প্রায় ১৩০ কোটি বছর আগেই হয়েছিলো।
লেখাটা সহজ সুন্দর কিন্তু আমি এই বিষয়ে কিছুই জানি না। আপনার এই লেখাটা পড়ার আগে বলতে গেলে এইটা সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিলো না। তাই পড়তে গিয়ে অনেক হোচট খাইলাম। আর অনেক প্রশ্ন মনে প্রসব করলাম। আমাকে একটা বিষয় একটু জানাবেন প্লিজ- যেহেতু আমরা বলছি টাইম স্পেস চতুর্থ মাত্রার চাদর সেক্ষেত্রে এমন কোন সম্ভাবনা কি আছে যে স্পেসের পরিবর্তে টাইমের সঙ্কোচন বা প্রসারণ ঘটবে এই গ্রাভিট্যাশনাল ওয়েভের কারনে?
খুবই সুন্দর এবং জটিল প্রশ্ন। সময় আসলে অমন বস্তুগত মাত্রা নয়। বাকি তিনটা মাত্রার মত চার নাম্বার মাত্রাটা আসলে কোনদিকে, সেটা তো আমরা জানি না। সময়, আমরা যা দেখছি, এটা চলছেই। কোনো বস্তু তার প্রসঙ্গ কাঠামোর সাপেক্ষে কোনো মাত্রায় ভ্রমণ না করলেও এই একটা মাত্রাতে সর্বদাই ভ্রমণ করে চলেছে।
সময় তো মহাকর্ষের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। মহাকর্ষের টানে সময় ধীরে চলে, এই আপেক্ষিকতা তো আমরা জানিই। সময় সংকোচন বা প্রসারণ (time dilation) তো খুব স্বাভাবিক (আর এখন প্রাত্যাহিক, স্যাটেলাইটের সাথে আমাদের সময়ের পার্থক্য তৈরি হওয়ার মত সরল) ঘটনা।
ভাইয়া,আর দুইটা বোকা বোকা প্রশ্ন করি,বিরক্ত হয়েন না প্লিজ…
ত্রিমাত্রিক জগতের টানটান চাদরে ছোটবড় বলগুলো ছেড়ে দেওয়ার পর তারা চাদরে যে বক্রতা তৈরি করে,চাদরের নিচ থেকে পৃথিবীর গ্রাভিটি কাজ না করলেও বলগুলো কি সেই একই বক্রতা তৈরি করতো?
আর চাদরের উপরের ছোট বড় বলগুলো দ্বারা ভর অনুযায়ী সৃষ্ট বক্রতার পেছনে যদি চাদরের নিচ থেকে দেওয়া পৃথিবীর টানের হাত থাকে,তাহলে স্থান-কালের চাদরে গ্রহ-নক্ষত্রগুলো দ্বারা সৃষ্ট বাঁকের পেছনে কার হাত আছে?
যার যেমন ভর, সে তেমনই বক্রতা তৈরি করে। এটা অন্য কারো বক্রতার ওপর নির্ভরশীল না। আর চাদরটা ও চতুর্মাত্রিক, চার মাত্রার। তাই, নিচে-ওপরে-বামে-ডানে-সামনে-পিছে সবদিকেই সে কাজ করছে, সবসময় (চতুর্থ মাত্রা)।
চাদরের উদাহরণটা দেয়া হয়েছে জাস্ট বোঝার জন্য। এখানে চাদরটাকে চতুর্মাত্রিক মনে করুন, আর বলগুলোকে গ্রহ-নক্ষত্র মনে করুন। বড় বলটা গ্রহ, ছোটো বলগুলো গ্রহ।
মহাবিশ্ব তো সবসময় সম্প্রসারিত হচ্ছে। কিন্তু একটা প্রশ্ন সম্প্রসারণের এই স্পেস টা আসছে কোথা থেকে বা সৃষ্টি হচ্ছে কেমনে?
স্পেসও তৈরি হচ্ছে, স্পেসের বাইরে স্পেস নাই।