গ্রাভিটি বা মহাকর্ষের সংজ্ঞা আলাদাভাবে দেয়ার তেমন একটা প্রয়োজনীতা দেখছি না। পদার্থবিদ্যায় চারটি মৌলিক বলের মধ্যে মহাকর্ষ সবচেয়ে দুর্বল বল হওয়া সত্ত্বেও এটাই গোটা বিশ্বব্রহ্মান্ডের গঠনশৈলী বা তাদের মধ্যের সম্পর্ক সবচেয়ে সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করে। আমরা নিউটনকে (১৬৪২-১৭২৭) মহাকর্ষের জনক বলি। গ্রাভিটি বা মহাকর্ষ ধারণাটি তারই দেওয়া। কিন্তু তার জন্মের প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে অভিকর্ষ বা সূক্ষ্মভাবে বললে মহাকর্ষ নিয়ে প্রথম পরীক্ষাগুলো (১৬৯০-৯২) করেছিলেন গ্যালিলিও। এই পরীক্ষাগুলোর ফলাফল থেকে তিনি তার বিখ্যাত পড়ন্ত বস্তুর সূত্রগুলো দিয়েছিলেন।
কিন্তু সেই সময় কেন বস্তুগুলো নিচের দিকে পড়ছে সেটা নিয়ে তিনি আর খুব বেশী এগোননি বিভিন্ন কারণে। এছাড়াও সেসময় তিনি তার বিখ্যাত আবিষ্কারগুলোর একটি টেলিস্কোপের দিকেই বেশী মনযোগী ছিলেন। কেপলার দিয়েছিলেন গ্রহসমূহের আবর্তনকাল, কক্ষপথ সংক্রান্ত তিনটি সূত্র (১৬০০)। তিনিও তাদের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে খুব একটা এগোননি। কেপলার মূলত পুরো মহাবিশ্বের জ্যামিতিক গঠন নির্ণয়ের মত অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ ব্যাপার নিয়ে পড়ে থাকতেন, যেটা তাকে খুব বেশী ফলও দেয়নি। কারণ, তার কল্পনার ডিজাইনটার অস্তিত্ব ছিলো শুধু কল্পনাতেই। তারপরেও সেখান থেকে চিন্তা করতে করতে তিনি গ্রহের গতির তিনটি সঠিক সূত্র বের করতে পেরেছিলেন।
গ্যালিলিওর পরীক্ষার প্রায় ৭০ বছর পার হলো। কাহিনী অনুযায়ী ১৬৬৫ সালের কোন এক দিনে যুবক নিউটনের সামনে আপেল পড়ার মত সেই সামান্য ঘটনাটি ঘটলো। সেই সাধারণ ঘটনাটিই ওই অসাধারণ মস্তিষ্কের যুবকের মাথায় নতুন চিন্তার জন্ম দিল। সেই চিন্তার ফলাফল ছিল সূদুরপ্রসারী এবং সেটা আমাদের প্রথমবারের মত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে একটি সুতোয় গাঁথার মত সুযোগ এনে দিলো। নিউটন বললেন এই মহাজগতের সবকিছুই একে অপরকে একটা অদৃশ্য বল দিয়ে নিজের দিকে টানছে। তিনি এই বলের নাম দিলেন মহাকর্ষ। যাই হোক, আসল কাহিনী নাকি এমন- নিউটন চিন্তার মেজাজেই ছিলেন, ভাবছিলেন বস্তুগুলো একে অপরকে আকর্ষণ করে কিনা। তখন আপেলের পতনের ব্যাপারটা তার মাথায় চিন্তাগুলোকে বিন্যস্ত করতে সহযোগিতা করেছিলো।
আমরা বর্তমানে যে যুগে বাস করছি তার মাঝে থেকে আমরা আসলে নিউটনের মহাকর্ষ আবিষ্কারকে সেভাবে অনুভব করতে পারবো না, কারণ এখন আমাদের হাতে বেশ কিছু অত্যাধুনিক টেলিস্কোপ আছে যা দিয়ে আমাদের দৃষ্টিসীমানা এতদূরে চলে গেছে যেটা নিউটনের আমলে কেউ স্বপ্নেও হয়ত ভাবেনি। কিন্তু পৃথিবীতে বসে নিজের সামান্য প্রতিফলক টেলিস্কোপ আর গণিত দিয়ে পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে তিনি যেভাবে মহাকর্ষের একটা অদৃশ্য সুতোয় বেধেঁ দিয়েছিলেন(ইউনিফিকেশন) সেটা অসাধারণ একটা ব্যাপার ছিলো। তার মহাকর্ষ সূত্র দিয়ে আমরা মুক্তিবেগ, অভিকর্ষজ ত্বরণ ও গ্রহান্তরে এর তারতম্য, ওজন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি বের করতে পেরেছি। যেহেতু তার সূত্রে দূরত্ব বাড়লে বল বর্গের ব্যাস্তানুপাতে হ্রাস পায়, তার এই সূত্র এটাও ব্যাখ্যা করতে পেরেছে কেন গ্রহগুলোর কক্ষপথগুলো উপবৃত্তাকার আর কেনই বা অধিকাংশ গ্রহ নক্ষত্র গোলাকার।
কিন্তু নিউটন মহাকর্ষ বলের কেবলমাত্র নামকরণই করতে পেরেছিলেন, কিন্তু এটা ব্যাখ্যা করতে পারেননি মহাকর্ষ আসলে কিভাবে কাজ করে? অতঃপর, তিনি এটাতে একটা ঐশ্বরিক যোগসূত্র সামনে এনেছিলেন। তিনি বলতেন…
“This most beautiful system of the sun, planets, and comets, could only proceed from the counsel and dominion of an intelligent Being. … This Being governs all things, not as the soul of the world, but as Lord over all; and on account of his dominion he is wont to be called ‘Lord God’ [pantokrator], or ‘Universal Ruler’. … The Supreme God is a Being eternal, infinite, absolutely perfect.”
নিউটনের অপূর্ণ সেই গবেষণা আবার জেগে উঠে বিংশ শতকের শুরুতে আরেক মহান বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের হাত ধরে (অবশ্য কিভাবে স্পর্শ না করেও মহাকর্ষ কাজ করে – মাইকেল ফ্যারাডে সেই ব্যাখ্যা দিয়ে ফেলেছিলেন)। আইনস্টাইন পেটেন্ট অফিসের কর্মচারী হিসেবে কাজ করার সময় এটা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে আলোই এই মহাজগতে সবচেয়ে দ্রততম। মাত্র ২৬ বছর বয়সে ১৯০৫ সালে তিনি তিনি প্রকাশ করেন তার বিখ্যাত তত্ত্বগুলোর একটি। যার নাম বিশেষ আপেক্ষিকতা বা স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটি। নিউটন ভাবতেন স্থান বা স্পেস আপেক্ষিক কিন্তু সময় ধ্রুব বা কন্সট্যান্ট। যা তিনি দেখিয়েছেন তার গতির সূত্রগুলিতে আইনস্টাইন বললেন এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আসলে ধ্রুব বলে কোনো কিছু নেই; স্থান-কাল উভয়েই আপেক্ষিক বা রিলেটিভ; শুধুমাত্র আলোর গতিই ধ্রুব। কেউ আলোর গতিকে অতিক্রম করতে পারবে না। অর্থাৎ আইন্সটাইন আসলে আলোর গতিকে একটা মহাজাগতিক মানদণ্ড বা কসমিক স্পিড লিমিট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। কিন্তু তার এই ধারণা কিন্তু নিউটনের মহাকর্ষের ধারণার সাথে পুরোপুরিই সাংঘর্ষিক।
এটা বোঝার জন্য আমরা একটা ব্যাপার চিন্তা করতে পারি। ধরুন কোনো নোটিশ ছাড়াই সূর্য হঠাৎ ধ্বংস হয়ে গেলো বা গায়েব হয়ে গেলো। তো এক্ষেত্রে নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র বলে, যে মূহুর্তে সূর্য ধ্বংস হয়ে গেলো, ঠিক সেই মূহুর্তেই পুরো সৌরজগতে ওলট পালট ঘটে যাবে, পৃথিবী তার কক্ষপথ থেকে ছিটকে যাবে। অর্থাৎ তাৎক্ষণিকভাবেই মহাকর্ষ বলের পরিবর্তন হয়ে যাবে, অন্যভাবে বলা যায় মহাকর্ষ পরিবর্তিত হতে কোনো সময়ই লাগবে না। অর্থাৎ সূর্য ধ্বংসের সাথে সাথেই আমরা মহাকর্ষের পরিবর্তনের ফলটা বুঝতে পারবো।
কিন্তু আইনস্টাইন জানতেন আলো সূর্য থেকে ৯৩ মিলিয়ন মাইল দূরে পৃথিবী পর্যন্ত পৌঁছাতেই সময় নেয় সোয়া আট মিনিট। তিনি ভাবলেন যেখানে আমরা সূর্যের আলো নিভে যাওয়ার খবর পাবো সোয়া আট মিনিট বাদে, সেখানে আমরা তার আগেই মহাকর্ষের পরিবর্তনের প্রভাব কিভাবে পাওয়া সম্ভব? তাই তিনি বললেন, মহাকর্ষ আলোর বেগের চেয়ে বেশি বেগে চলাটা অসম্ভব, এবং সম্ভবত মহাকর্ষের যে ধারণা প্রচলিত তার কিছুটা পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা আছে।
মহাকর্ষকে তিনি নতুনভাবে চেনালেন তার আপেক্ষিকতার আরেকটি তত্ত্বে, যার নাম সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব বা জেনারেল থিওরি অফ রিলেটিভিটি। এই তত্ত্বে তিনি একটি চতুর্মাত্রিক কাঠামোকে দাঁড় করালেন যার নাম স্থান-কাল বা স্পেস টাইম। ত্রিমাত্রিক স্থানের সাথে আরো এক মাত্রা সময় – এই দুইয়ে মিলে স্থান-কাল। তিনি বললেন যে, এই স্থান-কাল অনেকটা জালের মত, যেসব বস্তুর ভর বেশি তারা স্থান-কালের এই জালকে তত বেশি বাঁকাতে পারবে; এমনকি ভরের কারণে স্থান-কালের পরিবর্তনে আলোও বেঁকে যেতে পারে।
একদম সহজ ভাষায় আসি – ধরে নিন, স্থান-কাল হলো একটি চাদর। এই চাদরের উপরই তাই সব কিছুর অবস্থান। এবার চাদরটি চার কোণায় শক্ত করে বাঁধুন যেন টানটান হয়ে থাকে। এরপর একটি ভারী গোলাকার পাথর চাদরের উপর রাখলে পাথরটি চাদরের মাঝখানে গিয়ে স্থির হয়ে থাকবে। পাথরের ভরের কারণে চাদরটি কুঁচকে যাবে এবং চাদরের মাঝখানের অঞ্চলটা নিচের দিকে ঝুলে পড়বে। এবার অপেক্ষাকৃত কম ভরের আরেকটি পাথর চাদরের উপর রাখলে কী হবে? নিঃসন্দেহে যেখানেই রাখি না কেন, সেটির মাঝে বেশি ভরের পাথরটির কাছাকাছি চলে আসার প্রবণতা সৃষ্টি হবে। কারণ, বড় পাথর চাদরে যে বক্রতার সৃষ্টি করেছিলো, তার কারণে মাঝের অঞ্চলটা ঢালু হয়ে গেছে। এই যে কম ভরের পাথরটা বড় ভরের পাথরের দিকে আসতে চাইছে, এই প্রবণতার নামই মহাকর্ষ। স্থান-কালের বক্রতা নামক অদ্ভুত সুন্দর এই তত্ত্বের মাধ্যমে মহাকর্ষ বলকে সংজ্ঞায়িত করলেন আইনস্টাইন।
এইবার মহাবিশ্বের জটিল চাদরে মাঝখানের বড় পাথরটিকে যদি সূর্য ধরেন, তাহলে ছোট পাথরটিকে বলা যায় পৃথিবী। স্থান-কালের চাদরের বক্রতা থেকে সৃষ্ট মহাকর্ষের মাধ্যমেই সূর্য বেঁধে রাখছে সৌর জগতের সবকিছুকে। এ থেকেই বলা হলো, বিশাল ভরের যে কোনো বস্তু স্থান-কালকে বাঁকিয়ে দিতে পারে। ভর যত বেশি হবে সে বাঁকাতেও পারবে তত বেশি। চাদরের উদাহরণটি প্রকৃত অর্থেই স্থূল। তাই এটি বুঝতে একটু কল্পনা শক্তিকে কাজে লাগিয়ে পুরো বিষয়টিকে ত্রিমাতৃকক্ষেত্র রূপে ভেবে নিতে হবে। আর এই বক্রতার কারণেই গ্রহগুলো যেভাবে ঘুরছে তার প্রকৃতিটা উপবৃত্তাকার।
এবার যদি সূর্যের হঠাৎ ধ্বংস হবার বিষয়টা চিন্তা করেন তাহলে দেখবেন, যখনই সূর্য চলে যাবে তখন স্থান-কালে বক্রতা আর থাকবে না, সমান হয়ে যাবে , কিন্তু সূর্যের ধ্বংসের ব্যাপারটা আমরা তাৎক্ষণিকভাবে টের পাবো না। অনেকটা শাপলা ভর্তি পুকুরে ঢিল ছুঁড়লে যে ঢেউ হবে তার মত। অর্থাৎ ঢেউ শাপলাকে আঘাত করবে ঠিকই কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে না, ঠিক তেমনি সূর্য ধ্বংস হলে স্থান-কালের বাঁকানো অংশ বা বক্রতা হঠাৎ পরিবর্তনে সোজা হওয়ার চেষ্টা করবে এবং এর ফলে স্থান-কালের চাদরে ঢেউয়ের মত পরিবর্তন ঘটবে এবং চারপাশে এর ফলাফলটাকে ছড়িয়ে দেবে। কিন্তু অবশ্যই এটা আলোর গতিকে অতিক্রম করবে না। আসলে লিখে ভালোভাবে বোঝানো বা কল্পনার মানসপটে এটার চিত্র আঁকা বেশ কষ্টসাধ্য একটা ব্যাপার।
এই অসাধারণ তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে আইনস্টাইনকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। দুইবারের চেষ্টায় তিনি দেখিয়েছিলেন সূর্যগ্রহণের সময় সূর্যের সৃষ্ট স্থান-কাল-বক্রতার দরুণ আলো দূরবর্তী অন্য নক্ষত্র থেকে আসার সময় বেঁকে যায়। এই তত্ত্ব আইনস্টাইনকে বিজ্ঞানমহলে রীতিমতো সুপারস্টার করে তোলে। প্রতিষ্ঠা লাভের পর থেকে আজ পর্যন্ত এটা সবচেয়ে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত তত্ত্বগুলোর মধ্যে একটি। এই তত্ত্বের কারণে কৃষ্ণগহ্বর (Black hole), কীট-গহ্বর (Worm hole), সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্ব, গ্রাভিটেশনাল লেন্সিংয়ের মত ধারণাগুলো জন্মলাভ করেছে। মহাবিশ্বের সম্প্রসারণশীলতা প্রমাণিত হয়েছে বেশ আগেই লালমুখিতার (রেড শিফট এর) মাধ্যমে। গ্রাভিটেশনাল লেন্সিং মাত্র কদিন আগেই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। আইনস্টাইন আমাদের এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে নিয়ে নতুনভাবে ভাবতে শিখিয়েছেন। কে জানে? তার এই তত্ত্বই হয়তো আমাদের এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আরো চমকপ্রদ কোনো কিছুর সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে।
Big bang theory samparke , ki6u post korun plz
সময় যদি একটা মাত্রা হয় তাহলে ৫ম মাত্রাতে থাকলে কি আমরা সময়কে ধরতে পারব?