হাজ্জা (Hadza) হলো সংস্কৃতিগত, ভাষাগত ও বংশগতভাবে ভিন্ন ১০০০-১৫০০ জনের একটি আদিবাসী গোত্র যারা উত্তর তানজানিয়ার ইয়াসি খালের পাশ ঘেঁষে বসবাস করে। সংস্কৃতিগতভাবে ভিন্ন হওয়ার কারণ হলো, পূর্ব আফ্রিকায় তারাই একমাত্র আদিবাসী গোত্র যারা বেঁচে থাকার জন্য সম্পূর্ণরূপে শিকার ও বন্য প্রাণী সংগ্রহের ওপর নির্ভরশীল। ভাষাগতভাবে আলাদা, কারণ এদের ব্যবহৃত ক্লিক ভাষা ”হাজ্জেন” অন্য ক্লিক ভাষা থেকে ভিন্ন। ক্লিক ভাষা বলতে সেই ভাষাগুলোকে বোঝানো হয়, যেগুলোতে শব্দের পাশাপাশি জিহবার অগ্র ও তালু দিয়ে সৃষ্ট ক্লিকিং শব্দগুলোও অর্থ বহন করে।
যাক সে কথা, তারা যে বংশগত ভাবে ভিন্ন তাও উঠে আসে বিভিন্ন গবেষণা থেকে। জিনগত গবেষণা করে দেখা গেছে, এরা কয়েক হাজার বছর আগে থেকে অন্যান্য জনগোষ্ঠী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ভাবে বিবর্তিত হয়েছে। মনে করা হয়, এদের খাদ্যাভ্যাস সকল মানবসভ্যতার মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন। এদের মধ্যে ৩০০ জন এমন লোক আছে যারা শিকার করা প্রাণী, বন্য শাক-সবজি, ও ফলমূল ছাড়া কোনোদিন অন্যকোন খাবার মুখেও দেয়নি। এরা চাষবাষ বা পশুপালনও করে না। এদের মতে, বন্য খাবার সংগ্রহ করে খাওয়ার মধ্যে যতটা প্রশান্তি পাওয়া যায় ও সুস্থ থাকা যায়, তা ফসল ফলিয়ে বা পশুপালন থেকে পাওয়া যায় না।
হাজ্জা’রা মূলত ২০-৪০ জনের একটি করে দল গঠন করে নিজেদের জন্য ক্যাম্প করে, দলের সবাই সাধারণত রক্ত সর্ম্পকীয় হয়। প্রত্যেকদিন ক্যাম্পের সদস্যরা একসাথে বসে ঠিক করে যে তারা সেদিন কোন এলাকায় খাবার সংগ্রহে যাবে। পুরো হাজ্জা এলাকাটি ৫টি ভাগে ভাগ করা হলেও নির্দিষ্ট গোত্রের নামে কোনো নির্দিষ্ট ভূ-খণ্ড নেই। হাজ্জাদের সবচেয়ে পছন্দের খাবারটি হচ্ছে মধু। সে অঞ্চলের হাজার বর্ষজীবি বেওবেব (Baobab) গাছে মৌমাছিদের বানানো বিশাল আকৃতির মধুর চাক তাদের প্রধান আকর্ষণ। কিছু মধুর চাক এমনো আছে যে সেখান থেকে তারা ১০০ বছর যাবত মধু সংগ্রহ করে আসছে। এছাড়া এই বেওবেব গাছের ফলগুলোও খুব পুষ্টিকর। পাতাও কম যায় না। অন্যান্য খাবারে টান পড়লে হাজ্জা’রা এ গাছের পাতা খায়। বেওবেব গাছের ছাল-বাকল তারা বিভিন্ন ঔষধ তৈরিতে ব্যবহার করে। হাজ্জারা এভাবে তাদের আশেপাশের গাছপালা ও পশুপাখির বহুমূখী ব্যবহার জানে। সেই সাথে তারা পবিবেশ বান্ধবভাবে খাবার সংগ্রহে পারদর্শী। তারা এমনভাবে খাবার সংগ্রহ করে যাতে ঐ অঞ্চল বিরান হয়ে না যায়। ফলশ্রুতিতে দেখা যায় তাদের কয়েক প্রজন্ম একই অঞ্চলেই খাবার সংগ্রহ করছে। হাজ্জা’দের অঞ্চলে বছরে দুটো ঋতু — শুষ্ক মৌসুম আর বর্ষা মৌসুম। ঋতুভেদে হাজ্জা’দের খাবারের ধরনটাও পরিবর্তিত হয়ে যায়। শুষ্ক মৌসুমে তারা মূলত মাংস ও শাকসবজি খায় আর বর্ষা মৌসুমে ফলমূল ও শাকসবজি খায়।
এতক্ষণে তো আমরা বুঝে গেছি যে আমাদের উন্নত জীবনের সংস্পর্শ এরা পায়নি বা চায়নি। এদের শিশুরা সিজার ছাড়া ভূমিষ্ঠ হয়, মায়ের দুধ না পেলেও কোন ফরমুলা খাবার পায় না, এদের কোনো টীকা কর্মসূচি নেই, রোগ সৃষ্টিকারী ব্যকটেরিয়ার হাত থেকে বাঁচার জন্য এ্যান্টিবায়োটিক ড্রাগ নেই। এসব না থেকেও তারা অনেক ভালো আছে তা বলছি না। বরং এদের গড় আয়ু আমাদের থেকে কম। এরা মূলতঃ মারা যায় ব্যকটেরিয়া বা অন্য কোনো অণুজীবঘটিত সংক্রমণ থেকে। এদের শিশুমৃত্যুর হার ২১% অর্থাৎ আমাদের থেকে বেশি। কিন্তু অবাক করা বিষয় হচ্ছে এদের মেটাবলিক ডিজিজ, যেমন ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, হৃদরোগ প্রভৃতি নেই বললেই চলে।
হাজ্জা’রা প্রচুর পরিমাণে আঁশ জাতীয় (fiber) খাবার খায় এবং কমবেশী ৬০০ প্রজাতির বিভিন্ন উদ্ভিদ হতে খাবার সংগ্রহ করে। এরা দৈনিক প্রায় ১০০ গ্রাম আঁশ খায়। এসব আঁশের বেশিরভাগই মানুষের অন্ত্র হজম করতে পারে না বলে এরা সরাসরি অন্ত্রে চলে যায় যা অন্ত্রের অণুজীবের জন্য খুব ভালো খাবার। হাজ্জা’দের অন্ত্রে বৈচিত্র্যময় অণুজীব বাস করতে পারে। আমরা শিল্পোন্নত মানুষেরা মাত্র ১৫ গ্রাম আঁশ খাই, যা থেকে অন্ত্রের অণুজীব যথেষ্ট খাবার সংগ্রহ করতে পারে না।
অতিরিক্তঃ পুরো লেখাটা নৃবিজ্ঞান ঘেঁষা। এটাকে একটু জীববিজ্ঞানের ছোঁয়া লাগানোর জন্য অণুজীব প্রসঙ্গে একটু বিস্তারিত বলি। আমরা যখন খাবার খাই, তখন শুধু নিজেদের জন্য খাই না বরং আমাদের অন্ত্রে বসবাসকারী কোটি কোটি ব্যাকটেরিয়াসহ অন্যান্য অণুজীবও এই খাবারগুলো খায়। অন্ত্রে বসবাসকারী এই আনুবীক্ষণিক জীব গুলো আমাদের বেঁচে থাকার জন্য খুবই অত্যাবশ্যকীয়। অথচ কোন প্রক্রিয়ায় এরা আমাদের উপকারগুলো করে থাকে, তার সামান্যই আমরা জানি। কোন বৈশিষ্ট্যগুলো থাকলে অণুজীবগুলো আমাদের জন্য স্বাস্থ্যকর হয়ে উঠে, তা যখন আমরা সবিস্তারে জানতে পারবো, তখন আমাদের অন্ত্রে আমরা আদর্শ ব্যকটেরিয়ার কলোনী প্রতিস্থাপন ও আবাদ করতে পারব। তবে একটি বিষয়ে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন, তা হচ্ছে অন্ত্রের অণুজীবে যতবেশী বৈচিত্র্য থাকবে, অর্থাৎ যত বেশি ধরনের অণুজীব থাকবে, তত তা মানুষের স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো হবে। আরো জেনেছেন যে, এই আভ্যন্তরীণ জীবগুলোর বৈচিত্র্য খাবারের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়। অর্থাৎ যত বৈচিত্র্যময় খাবার, তত বৈচিত্র্যময় হবে অন্ত্রের অণুজীব। আর যত বৈচিত্র্যময় অণুজীব, তত তা মানুষের পক্ষে স্বাস্থ্যকর। আমাদের অন্ত্রের ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, ও অন্যান্য পরজীবিগুলো আমাদের জন্য অনেক কাজ করে। আমরা হজম করতে পারি না, এমন বেশ কিছু খাদ্য উপাদানকে ভেঙ্গে এমন কিছু পুষ্টি উপাদান তৈরি করে, যা মানুষ অন্য কোনো উপায়ে পেত না। এদের নিয়ে যত গবেষণা হচ্ছে তত এদের উপকারিতা প্রকাশিত হচ্ছে। বেশ কিছু গবেষণা বলছে এরা শুধু আমাদের হজম নয়, বরং সকল অঙ্গের কার্যক্রমের সাথে জড়িত। এরাই আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে বিভিন্ন প্রকার রোগসৃষ্টিকারী অনুজীবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে সক্ষম করে তোলে।
সূত্রঃ https://www.bbc.com/news/magazine-40686373