ফেসবুক এখন একটি অত্যন্ত বলিষ্ঠ এবং জনপ্রিয় সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট। সেখানে ততোধিক জনপ্রিয় একটি পোষ্টঃ “টুথপেস্ট এর বিজ্ঞাপনে ডেন্টিস্ট এর গলায় স্টেথোস্কোপ কেন ঝোলে?” এই আপাত নিরীহ মজার পেছনে লুকিয়ে আছে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক অবদান যা চিকিৎসা বিজ্ঞানে ডাক্তারদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয় হাতিয়ার – স্টেথোস্কোপ। হৃদয়ের লাব-ডুব ধ্বনি রবারের নলের মধ্য দিয়ে গিয়ে কানে প্রবেশ করা বোধহয় মনুষ্যসৃষ্ট পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত প্রথম কোনো তরঙ্গবাহক এর রূপ যেখানে শব্দশক্তি তরঙ্গের আকারে প্রতিফলন ধর্মকে অনুসরণ করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পৌঁছে যায়। মনুষ্যসৃষ্ট এরকম আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তরঙ্গবাহক আমরা প্রতিনিয়তই ব্যবহার করে চলেছি। যেমন –
- দীর্ঘ দূরত্বে আলোক ও সংকেত প্রেরণের জন্য উচ্চ সংকেত হার বিশিষ্ট আলোকীয় তন্তুর ব্যবহার।
- মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গ গঠনকারী ‘ম্যাগনেট্রন’ থেকে একটি তরঙ্গবাহক মাইক্রোওয়েভ ওভেনের রান্নার জায়গায় তরঙ্গকে স্থানান্তরিত করে।
- কোনো বস্তুর আলোকীয়, শাব্দিক, স্থিতিস্থাপক বৈশিষ্ট্য পরিমাপকারী বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতিতে তরঙ্গবাহক ব্যবহার করা হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানে ultrasonography-তে, তরঙ্গবাহককে নমুনার সংস্পর্শে রাখা যেতে পারে যাতে পরীক্ষাধীন বস্তুর তরঙ্গের ক্ষমতা সংরক্ষিত হয়। অথবা পরীক্ষাধীন নমুনা যদি ছোট হয় তবে তাকে তরঙ্গবাহকের ভিতরে রেখে দেওয়া যেতে পারে যাতে পরিমাপে সঠিকতা ভালো পাওয়া যায়।
অর্থাৎ, তরঙ্গবাহক বলতে ভাবা যেতে পারে যে, এটি এমন একটি গঠন/কাঠামো যার মধ্য দিয়ে স্থিতিস্থাপক বা তড়িৎচুম্বকীয় উভয়প্রকার তরঙ্গই একস্থান থেকে অন্যস্থানে সঞ্চালিত হতে পারে।
প্রশ্ন হলো – মনুষ্যসৃষ্ট তরঙ্গবাহক ছাড়া কি কোনো তরঙ্গবাহক নেই যার মাধ্যমে মনুষ্য বা মনুষ্যেতর প্রাণীরা সংকেত আদান প্রদানে সক্ষম? এরকমই দুটি প্রাকৃতিক তরঙ্গবাহকের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে – একটি পৃথিবীপৃষ্ঠের ওপরে এবং অপরটি সমুদ্রের তলদেশে। পৃথিবীপৃষ্ঠের ওপরেটি হল Earth-ionosphere waveguide আর সমুদ্রের তলদেশেরটি হল SOFAR (SOund Fixing And Ranging) Channel।
পৃথিবী-আয়নমণ্ডল তরঙ্গবাহক (Earth-ionosphere waveguide)
পৃথিবী-আয়নমণ্ডল তরঙ্গবাহক এমন একটি প্রাকৃতিক কাঠামো যার মধ্য দিয়ে নির্দিষ্ট বেতার তরঙ্গ বিস্তার করতে পারে, যেখানে স্থলভূমি এবং আয়নোস্ফিয়ার দুই প্রান্তের সীমানা ঠিক করে। যেহেতু আয়নোস্ফিয়ার-এ আধানযুক্ত কণা রয়েছে, তাই এটি একটি পরিবাহী হিসেবে আচরণ করে। আর পৃথিবী একটি পরিবাহী সমতল হিসাবে কাজ করে। তার ফলে পৃথিবী-আয়নোস্ফিয়ার গহ্বর একটি বৃহৎ তরঙ্গবাহক হিসাবে আচরণ করে। অত্যন্ত কম কম্পাঙ্ক (Extremely Low Frequency: ELF) (<3 kHz) এবং খুব কম কম্পাঙ্ক (Very Low Frequency: VLF) (3-30 kHz) সংকেত এই তরঙ্গবাহক-এর ভিতর দিয়ে দক্ষতার সাথে বিস্তার লাভ করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, বজ্রঝড় পৃথিবী ও আয়নোস্ফিয়ার-এর মধ্যে atmospherics নামক একটি সংকেত উত্পাদন করে যা সীমাবদ্ধ তরঙ্গবাহকের মধ্য দিয়ে হাজার হাজার মাইল পরিভ্রমণ করতে পারে। অন্যদিকে, তরঙ্গবাহকের প্রকৃতি round-the-world হওয়ায়, একটি গহ্বর-এর মত অনুনাদ (resonance) উৎপন্ন হয়। এই অনুনাদ-এর অনেকগুলো কম্পাঙ্কের সেটের মধ্যে সবচেয়ে কম কম্পাঙ্ক হলো ~ 7 Hz। এদের চুম্যান অনুনাদ বলে।
পৃথিবী-আয়নোস্ফিয়ার তরঙ্গবাহকের মধ্যে বেতার তরঙ্গ প্রসারণ কয়েকটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করেঃ
- তরঙ্গের কম্পাঙ্ক
- আপতন কোণ
- দিনের বিভিন্ন সময়
- ঋতু
- পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র এবং
- সৌর কার্যকলাপ।
উল্লম্ব আপতন-এর ক্ষেত্রে, আয়নোস্ফিয়ার-এর এফ-স্তরের সর্বোচ্চ ইলেকট্রন প্লাজমা কম্পাঙ্কের [Fe=9(Ne)1/2 kHz, Ne হল cm-3 এককে ইলেক্ট্রন ঘনত্ব] চেয়ে বড় কম্পাঙ্কের তরঙ্গ প্রায় নির্বিঘ্নে আয়নোস্ফিয়ারের মাধ্যমে বিস্তার লাভ করতে পারে। Fe-এর চেয়ে ছোট ফ্রিকোয়েন্সি বিশিষ্ট তরঙ্গ আয়নোস্ফিয়ারের ডি, ই, ও এফ-স্তর থেকে প্রতিফলিত হয়। দিনের বেলায় Fe সাধারণত 8-15 MHz হয়। কিন্তু আনত আপতন-এর ক্ষেত্রে, এই সঙ্কট কম্পাঙ্কের মান বড় হয়। VLF এবং ELF আয়নোস্ফিয়ারের ডি- ও নিম্ন ই-স্তর থেকে যথাক্রমে প্রতিফলিত হয়। আয়নোস্ফিয়ারের ডি-স্তর এর উচ্চতা দিনের বেলায় প্রায় 70 km এবং রাত্রিতে 90 km। অর্থাৎ VLF তরঙ্গ যার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের মান 10-100 km আয়নোস্ফিয়ারের ডি-স্তরের উচ্চতার সঙ্গে তুলনীয়। দেখা যায় যে, আয়নোস্ফিয়ারের মোড তত্ত্ব বৃহত্তর দূরত্বের জন্য এবং তরঙ্গ তত্ত্ব, স্বল্প দূরত্বে সংকেত সম্প্রচারের জন্য ব্যবহার করা আবশ্যক।
পৃথিবী-আয়নোস্ফিয়ার তরঙ্গবাহকের মধ্যবর্তী মাধ্যমের উপাদানগুলির বৈশিষ্ট্য যে অনেক গুলি বিষয়ের উপর নির্ভর করে, তা আগেই বলা হয়েছে। ফলে মাধ্যমটি কখনই সমদৈশিক প্রকৃতির হয় না। এই অসমদৈশিকতা উল্লম্ব ও অনুভূমিক দিকে সঞ্চালিত তরঙ্গের ক্ষেত্রেও প্রকট। আবার, পৃথিবীপৃষ্ঠের বক্রতার জন্য তরঙ্গের ক্ষেত্রপ্রাবল্যের মান পৃথক হতে দেখা যায় বিভিন্ন স্থানে। ভূচৌম্বকীয় ক্ষেত্রের মানের তারতম্যের জন্যও মাধ্যমের বৈশিষ্ট্য নানান দিকে, নানান জায়গায়, নানান রকমের হয়। ফলে, উল্লম্বদিকে সমবর্তিত কোন তরঙ্গ ডি-স্তরে প্রতিফলিত হয়ে যখন ফিরে আসে তখন তা আর শুধু উল্লম্বদিকে সমবর্তিত থাকে না, অনুভূমিক দিকেও একটি সমবর্তিত উপাংশ তৈরি করে। অর্থাৎ, VLF তরঙ্গের অনোন্যকতা পরিবর্তিত হয়। আবার দেখা গেছে, পূর্ব দিক থেকে পশ্চিম দিকে যে তরঙ্গ সঞ্চালিত হয় তা বিপরীতমুখী তরঙ্গের তুলনায় বেশী ক্ষয়িত হয়। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময়, কখনও সখনও 360° পর্যন্ত দশা বৃদ্ধি বা হ্রাসও পরিলক্ষিত হয়। এছাড়া, পৃথিবী-আয়নোস্ফিয়ার তরঙ্গবাহকের বিচ্ছুরণ বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনা করে এবং সন্নিহিত sferics সংকেতের শ্রেনি সময় বিলম্বের পার্থক্য পরিমাপের দ্বারা 10000 km দূরত্ব পর্যন্ত বজ্রঝড় অঞ্চলের অবস্থান নিরূপণ করা যেতে পারে।
সোফার চ্যানেল (SOFAR Channel)
সমুদ্রের নিচে এমন একটি গভীরতায় দুটি জলের অনুভূমিক স্তর বিশিষ্ট একটি শব্দ তরঙ্গবাহক যেখানে শব্দের গতিবেগ হল সর্বনিম্ন, তাকে SOFAR (Sound fixing and ranging) Channel বলে। এর আর একটি নাম রয়েছে – DSC (deep sound channel)। ১৯৪০ সালে Dr. Maurice Ewing এবং Leonid Brekhovskikh পৃথকভাবে এই চ্যানেলকে চিহ্নিত করেন এবং বর্ণনা করেন। শব্দের প্রাবল্য শ্রুতিগোচর সীমার নূন্যতম মানে পৌঁছানোর আগে বা শব্দশক্তি নিঃশেষিত হওয়ার আগে, এই চ্যানেলের মধ্যে দিয়ে কম কম্পাঙ্ক বিশিষ্ট শব্দ হাজার হাজার মাইল সঞ্চালিত হতে পারে। রণক্ষেত্রে ডুবোজাহাজের সাহায্যে সংকেত প্রেরণ কালে এই চ্যানেলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
এখন সমুদ্রের নিচে কোন গভীরতায় SOFAR Channel তৈরি হবে তা মূলত এই বিষয়ের ক্রমযৌগিক প্রভাবের উপর নির্ভর করেঃ
- সমুদ্রজলের তাপমাত্রা
- সমুদ্রজলের চাপ
- সমুদ্রজলের লবণাক্ততা।
সমুদ্রের জলের চাপ গভীরতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সরলরৈখিক ভাবে বাড়তে থাকে, কিন্তু তাপমাত্রা এত সহজ সম্পর্ক ধরে পরিবর্তিত হয় না। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় 1000 m গভীরতা পর্যন্ত তাপমাত্রা খুব দ্রুত কমতে থাকে, এবং তারপর সমুদ্রের তলদেশের মাটি পর্যন্ত এই তাপমাত্রা আর পরিবর্তিত হয় না বললেই চলে। সমুদ্রপৃষ্ঠের কাছাকাছি অঞ্চলে, তাপমাত্রা দ্রুত হ্রাসের জন্য শব্দগতির ঋণাত্মক নতিমাত্রা সৃষ্টি হয়; ফলে শব্দের গতিবেগ কমতে দেখা যায়। আবার গভীরতা বৃদ্ধির সঙ্গে যেহেতু জলের চাপ বাড়তে থাকে, তাই শব্দগতির ধণাত্মক নতিমাত্রা তৈরি হয়। এই দুই বিপরীতমুখী প্রক্রিয়ায় একটি নির্দিষ্ট গভীরতা পাওয়া যায় যেখানে শব্দের গতি একটি সর্বনিম্ন মান পেয়ে থাকে। এই গভীরতাকে চ্যানেল অক্ষ বলা হয়।
বারমুডা অঞ্চলের কাছাকাছি, চ্যানেল অক্ষের গভীরতা মোটামুটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে 1000 m নীচে দেখা যায়। আর প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তরের হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ অঞ্চলে, এই গভীরতা মোটামুটি 750 m। নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে, এই অক্ষ অগভীর। উচ্চ অক্ষাংশে (>60° N বা <60° S) এটি প্রায় সমুদ্রপৃষ্ঠ সংলগ্ন।
আলোকীয় তন্তুর মধ্য দিয়ে, আলো যেমন অভ্যন্তরীণ পূর্ণ প্রতিফলন ঘটনার নিয়ম মেনে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যায়, SOFAR Channel-এর মধ্য দিয়ে শব্দ সঞ্চালনকে এই ঘটনার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। অনুভূমিক চ্যানেলের মধ্য দিয়ে শব্দতরঙ্গ যখন সঞ্চালিত হয় তখন চ্যানেল অক্ষ থেকে দূরবর্তী অঞ্চলে শব্দতরঙ্গের বেগ বেশি হয় এবং অক্ষের নিকটবর্তী অঞ্চলে হয় কম। ফলে তরঙ্গ চ্যানেল অক্ষের দিকে বেঁকে ফিরে আসে এবং এইভাবে চ্যানেলের বিপরীত স্তর থেকে প্রতিফলিত হয়ে একই পদ্ধতির পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে শব্দতরঙ্গ সঞ্চালিত হয়।
এই প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট SOFAR Channel কে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখার জন্য ব্যবহার করে। যেমন, হাম্পব্যাক তিমি সুরেলা গানের সাহায্যে নিজেদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে হাজার মাইল দূর থেকেও। আর নীল তিমির আওয়াজ একটা জেট ইঞ্জিনের চেয়েও জোরালো শোনায়।
প্রাকৃতিক তরঙ্গবাহকের অস্তিত্ব যে শুধু মনুষ্যেতর প্রাণীদের সংকেত আদান প্রদানের কাজেই ব্যবহৃত হয় তা নয়, আমরাও এগুলিকে তরঙ্গ সঞ্চালনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে থাকি। একটা সময় তো বেতার তরঙ্গ প্রেরণ ও গ্রহণ পৃথিবী-আয়নোস্ফিয়ার তরঙ্গবাহকের সাহায্য ছাড়া কল্পনাই করা যেত না। এখন অবশ্য, কৃত্রিম উপগ্রহ বিরাট ভূমিকা নিয়েছে। পরিশেষে, আমাদের করণীয় হলো, যাতে এই নৈসর্গিক আশীর্বাদ থেকে আমরা বঞ্চিত না হই, পরিবেশের প্রতি আমরা যথাযথ খেয়াল রাখি।
Very interesting but Lucid.