“ফ্রিকোয়েন্সি হপিং স্প্রেড স্পেকট্রাম” নামক টেকনিক্যাল টার্ম সম্পর্কে শুনেছেন? বেশিরভাগ পাঠক হয়তো ডানে বামে মাথা দোলাবেন। সমস্যা নেই। এটা তারবিহীন যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রযুক্তিগত ভিত্তি। মোবাইল ফোন, ওয়াই-ফাই, ব্লুটুথ, ফ্যাক্স, ওয়্যারলেস LAN, বারকোড স্ক্যানার, পামটপ কম্পিউটার (ল্যাপটপের পরের ভার্সন আর কি), রেডিও মডেম ডিভাইস, ডিজিটাল ডিস্প্যাচ, কম্পিউটার ডাটা, ইমেইল, মাল্টিমিডিয়া ডাটা ইত্যাদি তারবিহীন প্রযুক্তির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হয়েছিলো ফ্রিকোয়েন্সি-হপিং স্প্রেড-স্পেকট্রাম প্রযুক্তির মাধ্যমে।
এবার বলুন তো, হেডি লামার-এর নাম শুনেছেন? ঐ যে চল্লিশের দশকের জনপ্রিয় হলিউড অভিনেতা। ওহ আচ্ছা, আপনার কাছে আধুনিক যুগের নায়ক নায়িকারই খবর নেই? তাহলে তো চল্লিশের দশক দূর কি বাত! তবে এই মহিলাকে চিনতে পারার আরেকটি কারণ আছে। আর সেই কারণেই এই প্রবন্ধের অবতারণা।
একটু জেনে রাখুন, অস্ট্রিয়ায় জন্মগ্রহণকারী এই মহিলা হলিউডে অভিনয় করতে এসে তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিলেন। অস্ত্র সরবরাহকারী হাজব্যান্ডের কাছ থেকে পালিয়ে আমেরিকায় আসা, কিংবা থিয়েট্রিক্যালি রিলিজড ফিল্মের ইতিহাসে প্রথম নায়িকা হিসেবে অর্গাজমের দৃশ্যে অভিনয় করা মিলিয়ে হেডির জীবন ছিল ঘটনাবহুল। ২০১৫ সালের ৯ নভেম্বর, হেডি লামারের ১০১ তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে গুগল তাকে নিয়ে একটা ডুডল বানায়। কিন্তু কেন? উপরের ঘটনা দুটো তো ডুডল বানানোর লায়েক নয়। তাহলে?
এখানেই আসছে স্প্রেড স্পেকট্রামের সাথে হেডি লামারের যোগসূত্র। তবে এই সূত্রে ঢোকার আগে হেডির জীবনের প্রাথমিক কিছু কাহিনি আমাদের জানা দরকার।
হেডি লামারের সিনেমাটিক জীবন
১৯১৪ সালের ৯ নভেম্বর অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা শহরের এক ইহুদী পরিবারে জন্ম নেয় এক আশ্চর্য কন্যা শিশু, যে তার নানান রূপ দেখিয়ে চমকে দিয়েছিলো বিশ্বকে। শিশুটির নাম রাখা হয় হেডউইগ ইভা মারিয়া কেসলার (Hedwig Eva Maria Kiesler)। বিশ দশকের (১৯২০) শেষের দিকে প্রযোজক ম্যাক্স রেইনহার্ড, ইভা মারিয়ার মধ্যে অভিনেতা হিসেবে অপার সম্ভাবনা দেখতে পান, এবং তাকে বার্লিনে নিয়ে আসেন। সেখানে মঞ্চ অভিনয়ের উপর তালিম নেওয়া শেষে ইভা মারিয়া আবার অস্ট্রিয়ায় ফিরে যান। গিয়ে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে স্ক্রিপ্টগার্ল হিসেবে কাজ শুরু করেন। এরপর অভিনেতা হিসেবে চলচ্চিত্রে কাজ করার সুযোগ পান। প্রথম চারটি মুভি ইভাকে তেমন নামডাক উপহার দিতে পারেনি। কিন্তু ১৯৩২ সালে ১৮ বছর বয়সে ইভা “এক্সট্যাসি (Extase)” নামক যে চেকোস্লোভাকিয়ান ফিল্মে অভিনয় করেন, তার সুবাদে খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। কারণ এই মুভিতে তিনি মারাত্মক সাহসী দুটো দৃশ্যে অভিনয় করেন। এক, নগ্ন হয়ে সাঁতার কাটা আর দৌড়ানো; দুই, অর্গাজম উপভোগ করা।
পরের বছর, ১৯৩৩ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে ইভা বিয়ে করেন অস্ট্রিয়ার সে সময়কার তৃতীয় ধনী ব্যক্তি ফ্রেডরিখ ম্যান্ডালকে। জাতিতে ফ্রেডরিখ ছিলেন আধা ইহুদী, এবং পেশায় অস্ত্র ব্যবসায়ী। ইহুদী হওয়ার পরও তিনি নাৎসি বাহিনির কাছে অস্ত্র সরবরাহ করতেন। তার আরেক ক্রেতা ছিল মুসোলিনির সৈন্যবাহিনি। নিজের আত্মজীবনীতে ইভা মারিয়া তথা হেডি উল্লেখ করেছেন, ফ্রেডরিখ ছিলেন অত্যন্ত কর্তৃত্বপরায়ণ, হিংসুটে আর ইভা মারিয়ার অভিনয় ক্যারিয়ারের বিরোধী। চলচ্চিত্র বাজার থেকে “এক্সট্যাসি” মুভির অর্গাজম দৃশ্য চিরতরে মুছে ফেলার জন্য ফ্রেডরিখ মুভির সবগুলো প্রিন্ট কেনার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্ত পারেননি।
মূলত ইভা মারিয়া নামক উঠতি নায়িকাকে ফ্রেডরিখ বিয়ে করেছিলেন নিজের ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য। ইভা যেন ছিলেন নিজ গৃহে বন্দী রাজকন্যা। বাড়িতে যখন ব্যবসায়িক কারণে নৈশভোজের আয়োজন করা হতো তখন, কিংবা বিভিন্ন জায়গায় যখন ব্যবসা সংক্রান্ত মিটিংয়ে যেতে হতো, তখন ফ্রেডরিখ সুন্দরী বৌকে সঙ্গে সঙ্গে রাখতেন। এসব মিটিংয়ে উপস্থিত থাকতেন অনেক বিজ্ঞানী এবং অস্ত্র প্রকৌশলী। ইভা মিটিংয়ে গিয়ে অন্যদের সাজপোশাক দেখে সময় নষ্ট করেননি। তিনি বিজ্ঞানী আর প্রকৌশলীদের সাথে ফ্রেডরিখের কথোপকথন মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। সেখান থেকেই অস্ত্রের নকশা আর নিত্যনতুন প্রযুক্তি সম্পর্কে ইভার ধারণা জন্মে। তৈরি হয় প্রায়োগিক বিজ্ঞানের প্রতি ঝোঁক।
একসময় ফ্রেডরিখের সাথে ইভার বৈবাহিক জীবন অসহনীয় হয়ে উঠে। নিজেকে ফ্রেডরিখের কাছ থেকে দূরে সরানোর জন্য ইভা নিজ দেশ অস্ট্রিয়া থেকেই চলে যাবেন বলে ঠিক করেন। তার আত্মজীবনী মারফৎ জানা যায়, কাজের লোকের পোশাক পরে ইভা ছদ্মবেশ ধারণ করেন এবং ফ্রেডরিখের চোখে ধুলো দিয়ে প্যারিসে পালিয়ে যান। কিন্তু গুজব রটেছিল আরেকটা। ইভা নাকি নিজের সব গয়নাগাটি পরে এক ডিনার পার্টিতে আসেন, এবং সেখান থেকে সব গয়নাসহ পালিয়ে যান। তবে পুলিৎজার পুরষ্কার জয়ী লেখক রিচার্ড রোডস তার “Hedy’s Folly” বইয়ে বলেন, ছদ্মবেশের ব্যাপারটা নাকি ইভার গোস্ট রাইটার “লিও গিল্ড” বানিয়ে লিখেছিলেন! এমন কিছু আদৌ ঘটেনি।
১৯৩৭ সালে ইভা পালিয়ে প্যারিসে চলে আসেন। সেসময় হলিউডের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান “মেট্রো-গোল্ডউইন-মেয়ার” তথা MGM-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা লুইস বি. মেয়ার প্যারিসে অবস্থান করছিলেন। তিনি সারা ইউরোপ চষে বেড়াচ্ছিলেন ট্যালেন্টের খোঁজে। ইভার সাথে দেখা হওয়ার পর তিনি তার সাথে সাত বছরের চুক্তি করেন। এ চুক্তিতে পারিশ্রমিক হিসেবে ছিল প্রতি সপ্তাহে ৩০০০ ইউএস ডলার! এই মেয়ারই “ইভা মারিয়া” নামটা পরিবর্তন করে “হেডি লামার” রাখেন।
১৯৩৮ সালে আমেরিকায় পৌঁছানোর পর Algiers মুভির মাধ্যমে হেডির হলিউড অভিষেক ঘটে। এরপর খুব দ্রুত তিনি সাফল্য এবং জনপ্রিয়তা ছুঁয়ে ফেলেন। মাত্র ৯ বছরের ভেতর তিনি ১৮টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।
যা হোক, হেডির ফিল্মি ক্যারিয়ার নিয়ে অনেক জ্ঞান ঝাড়লাম। এবার তাকাই তার বৈজ্ঞানিক ক্যারিয়ারের দিকে।
হেডি লামার এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ
১৯৩৯ সালে যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হল, তখন হেডি খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তিনি ছিলেন একজন মানবতাবাদী, যিনি সবসময় চিন্তা করতেন, কীভাবে পৃথিবীকে আরেকটু সমস্যামুক্ত করা যায়। তাই নিয়মিত যুদ্ধের খবর রাখা শুরু করলেন। আগে থেকেই তিনি নাৎসিদের ঘৃণা করতেন। ফলে অক্ষশক্তির (জার্মান, ইতালি, জাপান, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া, এবং বুলগেরিয়া) বিপক্ষে গঠিত মিত্রশক্তিকে (আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়নসহ আরও ১৩টি দেশ) সমর্থন জানালেন। যখন জানতে পারলেন, নাৎসি বাহিনির সাবমেরিনগুলো বিপক্ষ দলের যাত্রীবাহী জাহাজের উপর টর্পেডো (জলের অভ্যন্তরে বিস্ফোরিত হওয়ার ক্ষমতা সম্পন্ন মিসাইল) নিক্ষেপ করতে শুরু করেছে, তখন আঁতকে উঠলেন। ভাবলেন, তাকে এমন কিছু উদ্ভাবন করতে হবে যেটা এই হানাহানি রুখতে সক্ষম হবে।
ভাবতে পারেন, আলটপকা কেন একজন সিনেমার নায়িকা এমন চিন্তা করবে? এখানেই মজা! হেডি শুধুমাত্র একজন চেহারা সর্বস্ব অভিনেতা ছিলেন না। তার মাথায় গিজগিজ করতো নতুন জিনিস উদ্ভাবনের চিন্তা। তার প্রথম দিককার উদ্ভাবনের মধ্যে আছে উন্নতমানের ট্রাফিক স্টপলাইট, এবং কার্বোনেটেড পানীয় তৈরির জন্য পানিতে দ্রবণীয় এক বিশেষ ধরনের ট্যাবলেট। তবে কিনা, পানীয়টি সফলতার মুখ দেখেনি। হেডির মতে, এর স্বাদ ছিল অ্যান্টাসিড Alka-Seltzer-এর মত!
১৯৩৯ সালে বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন এক ডিনার পার্টিতে হেডির সাথে পরিচয় হয় তার প্রতিবেশী, আমেরিকান সঙ্গীত রচয়িতা জর্জ অ্যান্থেইল-এর। তিনি ছিলেন একজন নিরীক্ষামূলক কম্পোজার, বাজাতেন “প্লেয়ার পিয়ানো” [সাধারণ পিয়ানো থেকে এর যন্ত্রকৌশল আলাদা]। তবে হেডির সাথে জর্জের পরিচয়ের কারণটা সাংস্কৃতিক নয়, চিকিৎসা সংক্রান্ত! হেডি সেসময় চলচ্চিত্রের খাতিরে তার স্তন বড় করার পরিকল্পনা করছিলেন। আর জর্জ ছিলেন শৌখিন এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট (হরমোন বিশেষজ্ঞ)। দুজনে মিলে হরমোন আর অপারেশন সম্পর্কে অনেক শলা পরামর্শ করেও মন মতো সিদ্ধান্তে আসতে পারছিলেন না। আর সেটাই হল মানবজাতির জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। কারণ এরপর তারা আড্ডা বাদ দিয়ে প্লেয়ার পিয়ানো বাজাতে শুরু করলেন।
পিয়ানো আবিষ্কারের পর তো কম মানুষ বাজান নাই! তাহলে কী এমন ডুয়েট তারা বাজালেন যে, আমরা একেবারে কেতার্থ হয়ে গেলুম? এই বিষয়টা বুঝতে হলে প্লেয়ার পিয়ানোর যন্ত্র কৌশল সম্পর্কে দুটো লাইন জানতে হবে। এই বাদ্যযন্ত্রটি নিজে নিজে বাজতে থাকে (না না, ভূতের কারবার নহে)। পিয়ানো যেন নিজে নিজে বাজতে পারে, এজন্য বাদককে আগে থেকেই একটা সুর প্রোগ্রাম করে রাখতে হয়। ছিদ্রযুক্ত একটি বিশেষ কাগজে এই সুর প্রি-প্রোগ্রাম করা হয়। এই কাগজ থেকে সুর তৈরি করতে আবার ব্যবহৃত হয় বায়ুচালিত কৌশল, বা ইলেক্ট্রো-মেকানিক্যাল কৌশল। বর্তমানে অবশ্য ছিদ্রযুক্ত কাগজের বদলে ফ্লপি ডিস্ক বা সিডি এসেছে।
হেডির জানা ছিল যে, সমুদ্রপথে যুদ্ধের জন্য মিত্রশক্তি আর অক্ষশক্তি উভয়পক্ষই বেতার তরঙ্গ পরিচালিত টর্পেডো ব্যবহার করে বিপক্ষের উপর হামলা করছে। কিন্তু জার্মানির নাৎসি বাহিনি ছিল এক কাঠি এগিয়ে। তারা প্রতিপক্ষের ছোঁড়া টর্পেডোর রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি (বেতার কম্পাংক) শনাক্ত করে সেটার গতিপথ পাল্টে দিতো। ফলে মিসাইলটা সঠিক নিশানাকে আঘাত না করে অন্য দিকে ঘুরে যেত। হেডি চিন্তা করছিলেন মিত্রশক্তির জন্য এমন একটা বেতার তরঙ্গ তৈরি করার কথা, যা এক কম্পাঙ্ক থেকে অন্য কম্পাঙ্কে বিচ্ছিন্নভাবে পরিবর্তিত হবে। ফলে সঠিক কম্পাংক শনাক্ত করতে শত্রুর লাল সুতো বেরিয়ে যাবে। ফলে টর্পেডোগুলোর রেডিও ফ্রিকোয়েন্সিকে নাৎসি বাহিনি আর জ্যাম করতে পারবে না। কিন্তু তিনি উপায়টা খুঁজে পাচ্ছিলেন না।
সে রাতে জর্জের সাথে পিয়ানো বাজাতে বাজাতে হেডির মাথায় চিন্তা এলো প্লেয়ার পিয়ানোর কলাকৌশল নিয়ে। বাজানো শেষ হলে জর্জকে তিনি নিজের চিন্তা ভাবনা সম্পর্কে জানালেন। বললেন, প্লেয়ার পিয়ানো যেভাবে প্রি-প্রোগ্রামড কৌশলে চলে, বেতার তরঙ্গেও সেই কৌশল ব্যবহার করে টর্পেডো চালানোর কৌশলকে উন্নত করা যায় কিনা। এরপর দুজনে মিলে অনেকদিন ব্যয় করে নানা আঁকিবুঁকির পর একটা নকশা দাঁড় করালেন। এটিই ছিল ফ্রিকোয়েন্সি হপিং স্প্রেড স্পেকট্রাম প্রযুক্তির সর্বপ্রথম ডিজাইন।
হেডি আর জর্জের পরিকল্পনা মতে, টর্পেডো চালিত হবে ফ্রিকোয়েন্সি হপিং স্প্রেড স্পেকট্রামের (FHSS) মাধ্যমে। এই বিন্যাসে আগে থেকেই প্রোগ্রাম করা থাকবে এমন একটা ন্যারোব্যান্ড ক্যারিয়ার, যার ফ্রিকোয়েন্সি একটি নির্দিষ্ট প্যাটার্ন অনুযায়ী পরিবর্তিত হতে থাকবে। রি-প্রোগ্রামের জন্য ব্যবহৃত হবে “প্লেয়ার পিয়ানো শিট” (যে ছিদ্রযুক্ত কাগজের কথা আগে বলেছি)। গ্রাহক এবং প্রেরক উভয়েই সেই নির্দিষ্ট প্যাটার্ন সম্পর্কে ওয়াকিফহাল থাকবেন। ফলে তারা ডাটা ডিকোড করতে পারবেন। কিন্তু তৃতীয় পক্ষের হাতে পড়লে FHSS-কে মনে হবে স্বল্পস্থায়ী ইম্পালস নয়েজ।
সহজ ভাষায় বললে, FHSS-এর মাধ্যমে পাঠানো তথ্যগুলো ভেঙে ছোট ছোট প্যাকেটে পরিণত হয়, আর ছদ্মবেশী প্যাটার্নের মাধ্যমে অনেকগুলো “hop frequency” দ্বারা বাহিত হয়ে অন্য যন্ত্রের গ্রাহকের নিকট যায়। শুধুমাত্র ঐ hop frequency-তে সিনক্রোনাইজ করা গ্রাহক আর প্রেরক উক্ত তথ্যের মর্মোদ্ধার করতে পারবেন। এই পদ্ধতির মাধ্যমে প্রতি সেকেন্ডে ১৬০০ বার hop frequency পরিবর্তিত হয়। ফলে এর মাধ্যমে উচ্চমাত্রার নিরাপত্তা বজায় রাখা সম্ভব। তার মানে সঠিক ফ্রিকোয়েন্সি জানা না থাকলে শত্রুপক্ষ সিগন্যালটির মর্মোদ্ধার করতে পারবে না।
১৯৪২ সালে হেডি যখন ২৬ বছরের টগবগে অভিনেতা, রূপালি পর্দার সেক্স সিম্বল, কিংবা অভিনয় ক্যারিয়ারের চরম শিখরে আরোহণ করছেন, তখন ঘটলো এক অভূতপূর্ব ঘটনা। বিনোদন জগত থেকে সম্পূর্ণ আলাদা একটা ক্ষেত্রে তিনি সাফল্য অর্জন করলেন। আগস্ট মাসের ১১ তারিখে হেডি এবং জর্জকে “গোপন যোগাযোগ ব্যবস্থা (Secret Communications System)” তথা ফ্রিকোয়েন্সি হপিং স্প্রেড স্পেকট্রাম উদ্ভাবনের জন্য ইউএস প্যাটেন্ট দেওয়া হল। প্যাটেন্ট নাম্বার 2,292,387 । যদিও তাদের এই প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়েছিলো নাৎসি বাহিনির কাজকর্মে বাধা দেওয়ার জন্য, এটি আরেক দিক দিয়েও তার মহিমা বিকশিত করেছিলো। সেটা হল – আধুনিক তারহীন যোগাযোগ ব্যবস্থার ভিত্তি হিসেবে কাজ করা। এখন তো অতি ক্ষুদ্র সার্কিট কিংবা মাইক্রোচিপের যুগে FHSS প্রযুক্তি উন্নতির চরম শিখরে অবস্থান করছে!
হেডি তাদের প্যাটেন্টটি আমেরিকার সরকারকে বিনামূল্যে দিয়ে দিয়েছিলেন। এজন্য হেডি বা জর্জ কেউই প্যাটেন্ট থেকে কোনোরূপ অর্থ উপার্জন করতে পারেননি। কিন্তু ইউএস নেভি তাদের এই ত্যাগকে উপযুক্ত সম্মান দেখাতে পারেনি। তারা ঐ নকশাকে “ব্যবহার অনুপযোগী” বলে বাতিল করে দিয়েছিলো। বলেছিল, আমরা তো আর আস্ত একটা “প্লেয়ার পিয়ানো”কে টর্পেডোর ভিতরে বসাতে পারি না! অ্যান্থেইল ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, নকশাটিতে “প্লেয়ার পিয়ানো”কে ব্যবহার করা হয়েছে একটা উদাহরণ হিসেবে। নকশার বিভিন্ন অংশ আরও ছোট করে টর্পেডোর উপযোগী করে তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু ইউএস নেভি তাদের পাত্তা দেয়নি। উল্টে হেডিকে বলেছিলো, এইদিকে মাথা না ঘামিয়ে তিনি যেন আর সব তারকা যেভাবে যুদ্ধে সাহায্য করছেন (ওয়ার বন্ড বিক্রি করে), সেভাবে সাহায্য করেন। হেডি করেছিলেনও তাই। মাত্র এক বিকেলের মধ্যেই তিনি সাত মিলিয়ন ডলারের ওয়ার বন্ড বিক্রি করে ফেলেছিলেন।
FHSS প্রযুক্তির ব্যবহার বুঝতেই ইউএস নেভির লেগেছিলো বিশটা বছর। ১৯৬২ সালে “কিউবান মিসাইল ক্রাইসিস” যুদ্ধে এটি প্রথমবারের মত ব্যবহৃত হয়।
হেডি লামারের শেষ দিনগুলো…
এইরকম বিখ্যাত একটা উদ্ভাবনের পরও উদ্ভাবক হিসেবে হেডি লামার খুব একটা পরিচিতি পাননি। নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর কোনোরকম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যতীত নতুন প্রযুক্তির আবিষ্কার অহরহ ঘটে না। তাই হেডি লামারের উদ্ভাবনকে বলা যায় অনন্য সাধারণ। কিন্তু সমাজ সবসময়ই নারী বিজ্ঞানীদের প্রতি বিরূপ মনোভাব দেখিয়েছে। তাই আরও অনেকের মত হেডিও তার উদ্ভাবনের বিপরীতে যথাযথ মর্যাদা পাননি। তবে আরেকটা কারণ হল, এই প্রযুক্তিটা অনেক বছর ধরে “মিলিটারি সিক্রেট” হিসেবে ছিল। ফলে জনসাধারণের হাতে ছাড়া হয়নি, কেউ জানতও না।
মাত্র ১৯৯৭ সালে এসে হেডি আর জর্জকে তাদের উদ্ভাবনের জন্য Electronic Frontier Foundation (EFF) Pioneer Award-এ ভূষিত করা হয়। ১৯৯৭ সালেরই ৩১ আগস্টে হেডিকে BULBIEª Gnass Spirit of Achievement Bronze Award প্রদান করা হয়। এটি “উদ্ভাবন জগতের অস্কার” হিসেবে পরিচিত। অতি সম্প্রতি, ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় আবিষ্কারক পরিষদের আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয় হেডিকে। কিন্তু এই সম্মান তিনি দেখে যেতে পারেননি। কারণ গুণী এই অভিনেত্রী এবং বিজ্ঞানী ২০০০ সালের ১৯ জানুয়ারি ৮৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে সমাধিস্থ করা হয়েছে ভিয়েনায়।
বিবাহিত জীবনে হেডি সুখী হতে পারেননি। ছয়টি বিয়ে করলেও কোনোটিই টেকেনি। দু’বার দোকান থেকে জিনিস চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েন। তৃতীয় হাজব্যান্ডের ঘরে তার নিজের দুটো সন্তান হয়েছিল – ডেনিস এবং অ্যান্থনি। অ্যান্থনি মারফৎ জানা যায়, মধ্যবয়সে এসে হেডি অনেকগুলো প্লাস্টিক সার্জারি করিয়েছিলেন। নিজের সৌন্দর্য এবং চলচ্চিত্র ক্যারিয়ার যেন বয়সের কারণে নষ্ট না হয়ে যায়, সেজন্য তিনি স্তন এবং ঠোঁটের আকৃতি বড় করেছিলেন, গাল উঁচু করেছিলেন। কিন্তু এর ফলাফল ছিল ভয়াবহ। সৌন্দর্য ধরে রাখার বদলে হেডি তার সহজাত সৌন্দর্যের পুরোটুকুই নষ্ট করে ফেলেছিলেন।
মেরি কুরির জীবনী নিয়ে যে পোস্ট লিখেছিলাম, সেখানে কয়েকজন পাঠক আক্ষেপ করে বলছিলেন, কেন এখনও মেরির জীবনী নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হচ্ছে না? হলে অবশ্যই ঝোলায় অস্কার পুরতে পারতো। একই আক্ষেপ আমার হয়েছে হেডি লামারের জীবনী পড়তে গিয়ে। মাশালা মুভি, বা সায়েন্স মুভি – যেকোনোটাই নির্মাণ করার মত পর্যাপ্ত রসদ আছে হেডির জীবনে। এখন কেবল ভালো চিত্রনাট্যকার আর পরিচালকের হাতে পড়ার অপেক্ষা।
এই বছর হেডির ১০১ তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে গুগলের কর্মী জেনিফার হম নির্মিত ডুডলটা দেখে নিতে পারেন নিচের ভিডিও থেকে।
…
তথ্য সূত্রঃ
অস্ট্রেলিয়ান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন (এবিসি),