২০১৫ সালে ছয়জন ইতালিয়ান চিকিৎসক মানুষকে ভাবিয়ে তুললেন Creation of Adam–এর পেছনে নতুন ধারণা প্রকাশ করে। তারা বললেন, মিকেলাঞ্জেলোর মত একজন বিখ্যাত আঁকিয়ে তার পেইন্টিংয়ে নিশ্চয় খেয়াল খুশিমত ফিগার বসিয়ে দেবেন না! তিনি যা আঁকবেন, নিশ্চয় তার পেছনে কারণ থাকবে। তার আঁকা প্রতিটা উপাদান অবশ্যই নির্দিষ্ট জায়গায়, নির্দিষ্ট কারণে আঁকা আছে। এরপর ছবিটির বিভিন্ন অংশ নিয়ে তারা মতামত ব্যক্ত করলেন। তাদের মতে, নিচের চিত্রে গাঢ় লাল রঙের তীর দিয়ে যে অংশটা দেখানো হচ্ছে, সেটা ফ্যালোপিয়ান টিউব। বাদামী তীর দিয়ে দেখানো বিশাল লাল রঙের ডিম্বাকৃতি অংশটা হচ্ছে প্রসব পরবর্তী জরায়ু। হলুদ তীর দিয়ে যেসব কোঁচকানো অংশ দেখানো হচ্ছে, সেগুলো হলো প্রসব পরবর্তী সময়ে জরায়ুর ভেতর বিদ্যমান মিউকোসা। এদেরকে স্বাভাবিক জরায়ুতে পাবেন না। এদের পাওয়া যায় সন্তান জন্মদানের পর জরায়ুর পেশী যখন গুটাতে শুরু করে, তখন। নীল তীর দিয়ে যে ভেতরে ঢুকে যাওয়া অংশ দেখানো হচ্ছে, সেটা জরায়ুমুখ।
এবার আসুন আদমের ছবির দিকে। দেখে মনে হচ্ছে, আদম একটা পাথরের উপর শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। কিন্তু কেন এখানে পাথর আসলো? একটা ব্যাখ্যা হতে পারে এমন যে, প্রাচীনকালে পাথরকেও মায়ের মত ‘জন্মদাত্রী’ হিসেবে গণ্য করার রেওয়াজ ছিলো। অনেক পৌরাণিক চরিত্রই পাথর থেকে জন্ম নিয়েছে। আর খেয়াল করে দেখলে বুঝা যায়, পাত্থরের পেছনে নীল রঙের একটা পটভূমি আছে, যদিও সেটাকে পাথরের সাথে সম্পর্কিত মনে হচ্ছে না। আরও মনোযোগ দিন, দেখবেন নীল রঙের পটভূমিকে একটা নারীদেহের মত লাগছে আর তাতে স্তনের বোঁটাও আছে। একে কমলা তীর দিয়ে নির্দেশ করা হলো। এবার আসুন চূড়ান্ত পয়েন্টে। নারীদেহের সাথে যদি জরায়ুর অবস্থানের তুলনা করেন তাহলে দেখবেন যে, জরায়ুটি অবস্থিত আছে নারীদেহের তলপেটের ঠিক উপরে, অর্থাৎ দেহের যেখানে জরায়ুর থাকার কথা, ঠিক সেখানেই।
চিত্রের সাহায্যে আরেকটু স্পষ্টভাবে দেখানো যায় ব্যাপারটা। প্রথমে নারীদেহ আর জরায়ুর খসড়া ছবি। এরপরের ছবিতে নারীদেহের উপর ফ্রেস্কোকে রেখে দেখানো হলো আদমের মাথার উপর স্তনের বোঁটার অবস্থান। তৃতীয় ছবির বামে দেখুন জরায়ুর ছবি আর ডানে দেখুন ঈশ্বরের অবয়ব কীভাবে সেই জরায়ুর ভেতর খাপে খাপে মিলে গেছে, সেটা।
প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, ২০০৪ সালে এনরিকো ব্রুস্কিনি তার ‘Masterpieces of the Vatican’ বইয়ের ১১২ নাম্বার পৃষ্ঠায় বেশ কৌতূহলোদ্দীপক কথাবার্তা বলেছেন। তার কথার মুলসুর হলো, Creation অর্থ সৃষ্টি করা। কিন্তু Creation of Adam ছবি দেখে মনে হচ্ছে না, ঈশ্বর আদমকে সৃষ্টি করছেন; বরং ছবিটা যেন মানুষের শারীরিকভাবে জন্মগ্রহণ করার প্রক্রিয়াকেই নির্দেশ করছে। কারণ আদমের পেটে নাভি দেখা যাচ্ছে। আর নাভির সাথে যুক্ত নাড়ী দিয়ে যে বাচ্চা মায়ের গর্ভে থাকাকালে পুষ্টি সংগ্রহ করে, সেটাও আমরা জানি। তাই আদমকে যদি সৃষ্টিই করা হতো, তাহলে তার এই নাভির কী দরকার ছিলো? সুতরাং তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে বলা যায় না, বলা দরকার সে জন্মগ্রহণ করেছে। সে সূত্র ধরেই ব্রুস্কিনি ধারণা করছেন, ঈশ্বরের দেহের পাশ দিয়ে যে সবুজাভ রঙের স্কার্ফ ঝুলতে দেখা যাচ্ছে, সেটা হয়তো সদ্য কাটা নাড়ীর ছবি!
এ তো গেলো Creation of Adam নিয়ে কাহিনী। এবার চলুন মিকেলাঞ্জেলোর অন্য একটি ছবি “Separation of Light from Darkness” দেখি।
এখানে দেখা যাচ্ছে, ঈশ্বর অন্ধকার থেকে আলোকে আলাদা করছেন। ২০০৩ সালের ডিসেম্বর মাসে এই ছবি ব্যবচ্ছেদ করে সুইডেনের মালমো ইউনিভার্সিটি হসপিটালের দুজন ডাক্তার (লেনার্ট বন্ডেসন এবং অ্যানি-গ্রেথ বন্ডেসন) একটি বোমা ফাটালেন। তারা Journal of the Royal Society of Medicine-এ প্রকাশিত প্রবন্ধে বললেন, ছবিতে ঈশ্বরের দৃশ্যমান গলার পুরোটা এত বিস্তারিতভাবে আঁকা হয়েছে যে, গলায় উপস্থিত গলগণ্ডের মত আকৃতিটি স্রেফ কাকতাল বা দুর্ঘটনা হতে পারে না। এটা অবশ্যই ঈশ্বরের গলায় গলগণ্ডের উপস্থিতি নিশ্চিত করে। নিজেদের মতামত দৃঢ় করতে তারা একটা ঘটনার কথাও উল্লেখ করেন। ১৫০৯ সালে বন্ধু জোভান্নি দা পিস্তোইয়াকে একটা ব্যাঙ্গাত্মক সনেট লিখে পাঠিয়েছিলেন মিকেলাঞ্জেলো। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, তার গলগণ্ড হয়েছে। কবিতার পাশে নিজের একটি ব্যাঙ্গাত্মক স্কেচও এঁকেছিলেন তিনি, যেখানে তার গলায় গলগণ্ডের মত একটা উঁচু অংশ দেখা যাচ্ছে।
কিন্তু মিকেলাঞ্জেলোর গলগণ্ড থাকলে যে ঈশ্বরকেও গলগণ্ড রোগী বানাতে হবে, এমন চিন্তা কেন আসলো? এখানেই আসল প্যাঁচ! বন্ডেসনদের মতে, মিকেলাঞ্জেলো আসলে নিজের আদলে ঈশ্বরকে এঁকেছিলেন। কিন্তু কেন তিনি এমনটা করতে যাবেন? এ প্রশ্নেরও উত্তর দিয়েছেন গবেষকদ্বয়। প্রায় ছয় হাজার ফুট জায়গা জুড়ে মিকেলাঞ্জেলো যে ফ্রেস্কো আঁকলেন, সেটার প্রধান সৃষ্টিকর্তা হিসেবে নিজের স্বাক্ষর তিনি দিলেন এই কাজ করার মাধ্যমে। যেহেতু খ্রিস্টান ধর্মমতে ঈশ্বর সমস্ত দুনিয়ার সৃষ্টিকর্তা, তেমনি মিকেলাঞ্জেলোও এই ফ্রেস্কোর সৃষ্টিকর্তা। এক্ষেত্রে ঈশ্বর এবং মিকেলাঞ্জেলো একই পদে আসীন। তাই ঈশ্বরের মাধ্যমে নিজের প্রতিমূর্তি উপস্থাপন করে মিকেলাঞ্জেলো নিজেকে সৃষ্টিকর্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন।
আবার ২০১৬ সালে Rambam Maimonides Medical Journal-এ প্রকাশিত প্রবন্ধে ইতালি এবং অস্ট্রেলিয়ার চার গবেষক মিকেলাঞ্জেলোর গলগণ্ডে আক্রান্ত হওয়া নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। তারা বলেন, “সিলিংয়ে ছবি আঁকার সময় মিকেলাঞ্জেলো নিজের একটি স্কেচ এঁকেছিলেন, যেখানে তার গলায় একটা উঁচু অংশ দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি কিছু গবেষক উঁচু অংশটিকে ‘গলগণ্ড’ হিসেবে শনাক্ত করেছেন। কিন্তু কথা হচ্ছে, মিকেলাঞ্জেলোর জীবনী লেখকেরা (জর্জো ভাসারি, আস্কানিও কন্দিভি) গলগণ্ডের বিষয়ে কিছুই লেখেননি। উপরন্তু মিকেলাঞ্জেলোর সেলফ পোর্টরেট, অন্য চিত্রশিল্পীদের আঁকা মিকেলাঞ্জেলোর পোর্টরেট, তার দীর্ঘায়ু – সব মিলিয়ে আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, মিকেলাঞ্জেলোর গলগণ্ড ছিলো না। হয়তো সনেটের সাথে নিজের যে স্কেচ তিনি এঁকেছিলেন, তাতে স্বরযন্ত্রকে ইচ্ছাকৃতভাবে বড় আকারের এঁকেছিলেন।”
প্রিয় পাঠক, আপনি কি ভাবছেন গবেষকরা এই ছবিতে গলগণ্ড আছে কি নেই, তা নিয়েই শুধু হল্লা করছেন? না। আরেক দল চিকিৎসক বলছেন, ঈশ্বরের গলায় যে উঁচু অংশটি দেখা যাচ্ছে, সেটা গলগণ্ড বা ঘ্যাগ নয়, সেটা হলো ‘ব্রেইন স্টেম’! ২০১০ সালের মে মাসে জন্স হপকিন্স ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ মেডিসিনের নিউরোসার্জারি বিভাগের দুজন অধ্যাপক রাফায়েল তামার্গো এবং ইয়ান সুক এই মতামত দেন। Concealed Neuroanatomy in Michelangelo’s Separation of Light From Darkness in the Sistine Chapel শিরোনামে তাদের প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে নিউরোসার্জারি জার্নালে।
তামার্গো এবং সুকের মতে, গলার এই অস্বাভাবিক আকৃতিটার সাথে মিল আছে ব্রেইন স্টেমের (মস্তিষ্কের একদম নিচের দিকে যে অংশটা থাকে, তাকে ব্রেইন স্টেম বলে। স্পাইনাল কর্ড এবং বাকি শরীরের সাথে মস্তিষ্কের যোগাযোগ রক্ষা করে এটি)। কিন্তু কেউ যদি নিউরোএনাটমি সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান না রাখেন, তাহলে ব্যাপারটা ধরতে পারবেন না। আবার ঈশ্বরের গায়ে যে লাল পোশাক জড়ানো আছে, সেটার বুকের মধ্যে টিউবের মত একটা অংশ দেখা যাচ্ছে। এর অবস্থান-আকার এবং আকৃতি বলে দিচ্ছে, এটা স্পাইনাল কর্ড না হয়ে যায়ই না। আবার কোমরের নিচে এসে পোশাকটি এমনভাবে ভাঁজ খেয়েছে যে, সেগুলোকে অপটিক নার্ভ বলে মনে হচ্ছে।
আচ্ছা, এবার যাই ফ্রেস্কোর আরেকটা দৃশ্য “Separation of the Earth from the Waters“-এর দিকে।
২০০০ সালের মার্চ মাসে টেক্সাসের বেইলর কলেজ অফ মেডিসিনের নেফ্রোলজি বিভাগের চিকিৎসক গ্যারাবেড একনোইয়ান বললেন, ছবিটিতে ঈশ্বরের পেছনে যে লাল পর্দা বা চাদর দেখা যাচ্ছে, সেটা মানুষের দ্বিখণ্ডিত ডান কিডনি। মিকেলাঞ্জেলো নিজে কিডনির পাথরে ভুগেছেন বলে কিডনির প্রতি হয়তো তার আলাদা আকর্ষণ ছিলো! আর সেখান থেকেই হয়তো ঈশ্বরের ছবিতে কিডনি চিত্রায়নের একটা সম্ভাবনা থেকে যায়।
পাঠকদের সুবিধার জন্য একনোইয়ানের প্রবন্ধ থেকে নিচে একটা ছবি দেওয়া হল। এখানে দেখানো হয়েছে, কেন একনোইয়ান পর্দাটাকে কিডনি মনে করছেন। তা, ছবিটা দেখে আপনিও কি দোলাচালে পড়ে গেলেন?
এখন কথা হলো, সিস্টিন চ্যাপেলের সিলিংয়ে অংকিত ফ্রেস্কো থেকে গবেষকরা যে এত লুকানো রহস্য খুঁজে পাচ্ছেন, সেটা কি শুধুই তাদের অতি কল্পনা? নাকি সত্যিই মিকেলাঞ্জেলো ছিলেন একজন ব্যাডঅ্যাস? চিন্তা করে দেখুন, মস্তিষ্কের চিকিৎসক পর্দার মধ্যে খুঁজে পাচ্ছেন মস্তিষ্ককে, নেফ্রোলজির চিকিৎসক দেখতে পাচ্ছেন কিডনিকে। তাহলে কি মানুষ যা দেখতে চাচ্ছে, সেটাই দেখছে?
উত্তর খোঁজার ভার ছেড়ে দিলাম পাঠকের উপর। কিন্তু যাবার আগে একটা প্রশ্নও রেখে যেতে চাই। প্রথম পর্বে Creation of Adam ছবি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত তুলে ধরেছিলাম। কিন্তু মস্তিষ্কের ভেতর ঈশ্বরের চেহারা আঁকার পেছনে আর কোনো থাকতে পারে কি? মিকেলাঞ্জেলো কি এমন কোনো ইঙ্গিত দিতে চেয়েছিলেন যে, ঈশ্বর মানুষের মস্তিষ্ক প্রসূত একটি ধারণা বা বিশ্বাস? তাই রূপকার্থে মানব মস্তিষ্কের ভেতরেই ঈশ্বরকে বসিয়ে দিয়েছেন তিনি?
আরও পড়ার জন্য ঢুঁ মারতে পারেন নিচের লিংকগুলোয়ঃ
Michelangelo’s Secret Message in the Sistine Chapel
[…] (পরবর্তী এবং শেষ পর্ব এখানে পড়তে পারেন) […]
পুরো ২ খণ্ড পড়ে শেষ করার পরে একটাই মন্তব্য, “পবিত্র গাভী”!!
৩-৪ বছর আগে মিকেলাঞ্জেলোর শুধুমাত্র ‘ক্রিয়েশন অব অ্যাডাম’-এর বিশ্লেষণ সম্পর্কিত লেখা পড়েছিলাম ইংরেজি ব্লগে। বাংলায় পরে এই ধরণের লেখা খুঁজেছিলাম, পাইনি তেমন একটা। আপনার অতি তথ্যবহুল এবং ঝরঝরে ভাষায় লেখাটা নিঃসন্দেহে বাংলায় এই ধরণের বিষয়বস্তু নিয়ে লেখালেখিতে ভবিষ্যতে রেফারেন্স হিসেবে কাজে দিবে। চালিয়ে যান প্লিজ!
ধাক্কাধাক্কি অমর হউক…। চাঁদে পৌঁছাতে হবে 😀
দুই পর্বের লেখাটি এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম। কয়েক বছর আগে The Da Vinci Code পড়ে ভিঞ্চির ক্যারিশমার কথা জেনেছিলাম। এবার মিকেলাঞ্জেলোর সাথেও প্ররিচয় হয়ে গেলো।