শিরোনাম দেখে অনেকে ভ্রূ কুঁচকাতে পারেন। ভাবতে পারেন, এ আবার কেমন আঁতলামি? কিন্তু লেখাটা পড়তে থাকলে খুলতে থাকবে রহস্যের জট, আপনি ডুবে যাবেন রেনেসাঁ আমলের বিখ্যাত ভাস্কর ‘মিকেলাঞ্জেলো’র ভেতর।
সাধারণ জনগণ লিওনার্দো দা ভিঞ্চিকে নিয়ে যতটুকু আপ্লুত হয়, তার অর্ধেকও হয়তো হয় না মিকেলাঞ্জেলোকে নিয়ে। তার উপর ‘দি দা ভিঞ্চি কোড’ উপন্যাস দিয়ে লিওনার্দোর জন্য ড্যান ব্রাউন তৈরি করেছেন বিশাল এক ভক্তকূল। উপন্যাসের নায়ক-নায়িকা রবার্ট ল্যাংডন আর সোফির সাথে লিওনার্দোর বিভিন্ন ছবির মধ্যে লুক্কায়িত মেসেজ উদ্ধার করতে করতে আমরা পা দিয়েছি লিওনার্দোর তৈরি এক রহস্যময় ভুবনে। কিন্তু একই রকম লুক্কায়িত মেসেজ যে মিকেলাঞ্জেলোর অংকিত ফ্রেস্কোর মধ্যেও আছে, সে বিষয়ে আমাদের জানা হয় না। তাহলে চলুন, ঘুরে আসি মিকেলাঞ্জেলোর জগত থেকে।
‘মিকেলাঞ্জেলো দি লোদোভিকো বোনারত্তি সিমোনি‘ হলেন ইতালির তুসকানি অঞ্চলে অবস্থিত কাপ্রেসে গ্রামে জন্ম নেওয়া এক অসামান্য ভাস্কর, চিত্রশিল্পী, স্থপতি, প্রকৌশলী, কবি এবং অঙ্গ ব্যবচ্ছেদকারী। বিশাল নামের শুধু ‘মিকেলাঞ্জেলো’ অংশটিই তার অনন্য নাম, বাকি অংশ পিতার নাম থেকে জুড়ে দেওয়া। ৬ মার্চ, ১৪৭৫ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত এই রেনেসাঁ মানবের জন্ম (মৃত্যুঃ ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দের ১৮ ফেব্রুয়ারি, ৮৮ বছর বয়সে)। তাই লেখাটাকে মিকেলাঞ্জেলোর জন্মদিনে লেখকের বিলম্বিত শুভেচ্ছা হিসেবেও ধরতে পারেন।
মিকেলাঞ্জেলো সবচেয়ে বিখ্যাত তার নির্মিত ভাস্কর্য ‘ডেভিড’-এর জন্য। এরপরই বলা যায় সিস্টিন চ্যাপেলের সিলিংয়ে তার হাতে আঁকা ফ্রেস্কোর কথা। এরপর বলতে পারেন ‘পিয়েতা’ ভাস্কর্যের কথা, যেখানে মা মেরি তার সদ্যমৃত পুত্র যীশুর দেহ কোলে নিয়ে বসে আছেন। সবশেষে আসি এমন একটা স্থাপত্যের কথায়, যেটা সম্পর্কে অনেকে অভিভূত হয়ে আছেন কিন্তু জানেন না যে এর স্থপতি স্বয়ং মিকেলাঞ্জেলো – সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকা!
আসলে মিকেলাঞ্জেলো সম্পর্কে বলা শুরু করলে ‘কান টানলে মাথা আসে’র মত একের পর এক কথা বের হতে থাকবে। তার রোমাঞ্চকর জীবনী, কর্মজীবন, চার্চের সাথে তার সম্পর্ক ইত্যাদি নিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা খরচ করা যায়। কিন্তু আজ ঐদিকে যাবো না। আজ বলবো সিস্টিন চ্যাপেলের সিলিংয়ে আঁকা ফ্রেস্কোয় তিনি কী লুকিয়ে গেছেন, সে রহস্য নিয়ে।
মিকেলাঞ্জেলোর যখন আঠারো বছর বয়স, তখন থেকে তিনি শব ব্যবচ্ছেদের মাধ্যমে মানবদেহ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। ঐসময় ইতালিতে মৃতদেহ কাটাছেঁড়া করা ছিল নিষিদ্ধ। কিন্তু মিকেলাঞ্জেলো ঠিকই তার রাস্তা বের করে নিয়েছিলেন। মিকেলাঞ্জেলোর সমসাময়িক লেখক জর্জো ভাসারি তার ‘Lives of the Most Excellent Painters, Sculptors, and Architects‘ বইয়ে লিখেছেন, মিকেলাঞ্জেলো একটা কাঠের ক্রুশ বানিয়ে ইতালির ফ্লোরেন্স শহরের ‘সান্তা মারিয়া দেল সান্তো স্পিরিতো’ আশ্রমের অধ্যক্ষকে উপহার দিয়েছিলেন। তিনি এই কাজটা করেছিলেন অধ্যক্ষকে খুশি করার জন্য। অধ্যক্ষ সত্যিই খুশি হয়েছিলেন এবং মিকেলাঞ্জেলোকে নিজ আশ্রমে একটা কক্ষও বরাদ্দ করে দিয়েছিলেন। এই কক্ষে মরদেহ ব্যবচ্ছেদ করে মানবদেহের অঙ্গসংস্থান জানার জন্য মিকেলাঞ্জেলো পড়াশোনা করতেন। কিন্তু ঠিক কতদিন তিনি শব ব্যবচ্ছেদ চালিয়ে গেছেন, সে বিষয়ে স্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। যেহেতু ১৪৯৩ সালে অধ্যক্ষকে ক্রুশ উপহার দিয়ে কক্ষ বরাদ্দ পেয়েছিলেন মিকেলাঞ্জেলো, তাই ধারণা করা হয় ১৪৯৩ থেকে ১৪৯৪ পর্যন্ত তিনি মরদেহ কাটাছেঁড়া করেছেন। এসব মরদেহ আসতো আশ্রমের নিজস্ব হাসপাতাল ‘সান্তো স্পিরিতো’ থেকে।
অনেকেই অনুমান করেন, পুরুষ আর নারী শরীরের অঙ্গসংস্থান বিদ্যা সম্পর্কে শুধু নয়, রেনেসাঁ মানব জানতেন উভয় শরীরের রোগবিদ্যা (প্যাথলজি) সম্পর্কেও। কিন্তু দুঃখের কথা, তার আঁকা বেশিরভাগ এনাটমিকেল স্কেচ আর নোটই মিকেলাঞ্জেলো ধ্বংস করে ফেলেন। তাই একজন ভাস্কর বা স্থপতি হিসেবে মানুষ তাকে যেভাবে চেনে, সেভাবে তার “অঙ্গ ব্যবচ্ছেদকারী” ভূমিকার কথা জানে না। কিন্তু যুগ যুগ ধরে মানুষ বিস্মিত হয়েছে মিকেলাঞ্জেলোর ভাস্কর্য আর সিস্টিন চ্যাপেলের চিত্রকর্ম দেখে। কীভাবে তিনি পারলেন পাথর কুঁদে মানুষের ‘anatomically নিখুঁত দেহ’ ফুটিয়ে তুলতে (‘ডেভিড’ ভাস্কর্যটি দেখতে পারেন) বা দেওয়ালে তার ছবি আঁকতে? তবে কি তিনি মানুষের অঙ্গসংস্থান সম্পর্কে বিশদভাবে জানতেন? তখনই আসে মিকেলাঞ্জেলোর মানবদেহ নিয়ে পড়াশোনা করার অধ্যায়টা।
১৪৯৪ সাল থেকে মিকেলাঞ্জেলো ভাস্কর্য গড়ার প্রতি সময় দিতে শুরু করেন। মানবদেহ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা থেকে তার আগ্রহ চলে আসে ভাস্কর্যের দিকে। হয়তো তিনি ভেবেছিলেন, যথেষ্ট জ্ঞান হয়েছে মানবদেহ সম্পর্কে। এখন সময় সেই জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে ছোটবেলার আগ্রহ পূরণ করার! কারণ ছোটবেলা থেকেই মার্বেল পাথর কুঁদে ভাস্কর্য বানানো আর চিত্রাংকনের প্রতি মিকেলাঞ্জেলোর আকর্ষণ তৈরি হয়। সে সূত্র ধরে ১৪৯৬ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি মার্বেল পাথর কেটে রোমান দেবতা বাক্কাসের মূর্তি বানান। আবার ১৪৯৮ সালে কুঁদা শুরু করে ১৪৯৯ সালে শেষ করেন তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি “পিয়েতা“। ১৫০৪ সালে ডেলিভারি দেন অসম্ভব বিখ্যাত “ডেভিড” ভাস্কর্যটিকে। এটি বানাতে তার সময় লেগেছিলো ১৫০১ থেকে ১৫০৪ সাল পর্যন্ত মোট চার বছর।
১৫০৮ সালে এসে মিকেলাঞ্জেলো দায়িত্ব পান রোমের ভ্যাটিকান সিটিতে অবস্থিত সিস্টিন চ্যাপেলের সিলিংয়ে ফ্রেস্কো আঁকার। তৎকালীন পোপ ‘দ্বিতীয় জুলিয়াস’ তাকে এই দায়িত্ব দেন। সিস্টিন চ্যাপেল হলো পোপের বাসস্থান হিসেবে পরিচিত ‘অ্যাপোস্টোলিক প্রাসাদে’ অবস্থিত একটি চ্যাপেল। তাই এখানকার দেওয়ালে আঁকা হবে বাইবেলে বর্ণিত ঘটনাবলী, এটাই স্বাভাবিক। আর এর জন্য ধার্মিক মিকেলাঞ্জেলো ছাড়া কে হতে পারে প্রথম পছন্দ? মজার ব্যাপার হলো, এই চ্যাপেলের দেওয়ালে ফ্রেস্কো এঁকে গেছেন আরেক রেনেসাঁ মানব সান্দ্রো বত্তিচেল্লি। ১৪৮১ সালে পোপ ‘চতুর্থ সিক্সতুস’ বত্তিচেল্লিকে নিয়োগ দেন চ্যাপেলের দেওয়ালে বাইবেলের বিভিন্ন ঘটনার ছবি আঁকতে। বত্তিচেল্লি ১৪৮২ সালের মধ্যে এঁকে শেষ করেন ‘Temptations of Christ, Punishment of the Rebels এবং Trial of Moses‘।
যা হোক, ১৫০৮ সালে শুরু করে ১৫১২ সালে মিকেলাঞ্জেলো শেষ করেন ফ্রেস্কো আঁকার কাজ। এই কাজে তিনি কোনো সাহায্যকারী নেননি, পুরো আঁকাআঁকিই করেছেন নিজের হাতে। পূর্বদিক থেকে কাজ শুরু করে ক্রমে পশ্চিমে অগ্রসর হয়েছেন, চ্যাপেলের প্রবেশপথ থেকে আঁকতে আঁকতে পেইন্টিং শেষ করেছেন উপাসনা বেদীর উপরে গিয়ে। যে নয়টা দৃশ্য দিয়ে চ্যাপেলের সিলিং সাজানো হয়েছে, সেগুলো নেওয়া হয়েছে বাইবেলের Genesis বা ‘সৃষ্টিতত্ত্ব’ অধ্যায় থেকে।
প্রথমে নাকি চিত্রশিল্পীকে বলা হয়েছিলো যীশুর বারোজন শিষ্যকে আঁকতে। কিন্তু খ্যাপাটে শিল্পী তার কাজের ব্যাপারে আরও বেশি স্বাধীনতা দাবী করেন এবং বাইবেলের বিভিন্ন ঘটনা আঁকার ব্যাপারে মনঃস্থির করেন। এই স্বাধীনতা তিনি কতদূর পর্যন্ত ব্যবহার করেছিলেন সেটা স্পষ্ট নয়। তবে তার আঁকা দৃশ্যগুলোর ভেতর নানান সময়ে মেডিক্যালের লোকজনেরা মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গের প্রতিমূর্তি দেখতে পেয়েছেন। তারা ধারণা করছেন, নিজের স্বাধীনতা ব্যবহার করে আর এনাটমি সম্পর্কে অর্জিত জ্ঞান কাজে লাগিয়ে মিকেলাঞ্জেলো বাইবেলের দৃশ্যের ভেতর রূপকার্থে মানবদেহের অঙ্গ ফুটিয়ে তুলেছেন।
নিচে একটা ছবি দিচ্ছি চ্যাপেলের পুরো সিলিংয়ের। প্রতিটা দৃশ্যের পরিচিতি দেওয়া আছে ছবিতে।
সিলিংয়ের কেন্দ্রের কাছাকাছি আঁকা আছে Creation of Adam, যেটা কিনা চিত্রকলার জগতে অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি আর সবচেয়ে বেশিবার আঁকা একটা চিত্রকর্ম। এই চিত্রে বাইবেলের জেনেসিস বা সৃষ্টিতত্ত্বের ঘটনা অনুসারে পৃথিবীর প্রথম পুরুষ আদম এবং ঈশ্বরকে দেখা যাচ্ছে। তারা মুখোমুখি হয়ে আছে, দুইজনের হাত পরস্পরের প্রতি আগানো, এবং তর্জনী প্রায় ছুঁই ছুঁই করছে। ঈশ্বরের চারপাশে স্বর্গদূতেরা ভিড় করে আছে আর স্বর্গদূতসহ ঈশ্বরের অবয়বের পেছনে দেখা যাচ্ছে লাল রঙের একটি চাদর বা পর্দা। শত শত বছর ধরে মানুষ ভেবে এসেছে, এই ছবিতে ঈশ্বর আদমকে জীবনীশক্তি দিতে যাচ্ছেন বা দিচ্ছেন। এ ভাবনাই বলে দেয়, কেন এই ছবিকে সিলিংয়ের কেন্দ্রের কাছে রাখা হয়েছে। কারণ এই ছবিতে চিত্রিত হয়েছে মানবজাতি সৃষ্টির মুহূর্ত। কিন্তু… কিন্তু শতবর্ষ পর এই ধারণাকে দুমড়ে মুচড়ে দিলেন এক চিকিৎসক।
১৯৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যের সেন্ট জন’স মেডিক্যাল সেন্টারের গাইনেকোলজিস্ট কাম শল্য চিকিৎসক ‘ফ্র্যাংক লিন মেশবার্গার’ মিকেলাঞ্জেলোর ‘Creation of Adam’ ফ্রেস্কো সম্পর্কে তার মতামত প্রকাশ করেন। মেশবার্গার বললেন, এই লাল রঙের বস্তুটি আসলে পর্দা বা চাদর নয়, এটি মানুষের মস্তিষ্ক! কিন্তু মিকেলাঞ্জেলো কেন মস্তিষ্ককে এমনভাবে আঁকবেন, যেন সেটা মানুষের চোখে মস্তিষ্ক হিসেবে নয়, বরং পর্দা হিসেবেই আবির্ভূত হয়? একটা মতবাদ হলো, ধর্মীয় চিত্রের মধ্যে হুট করে খুলি ছাড়া মস্তিষ্ক ঢুকিয়ে দিলে সেটা কোনো অর্থ প্রকাশ করে না, বরং চিত্রে বিদ্যমান ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য নষ্ট হওয়ার জন্য ধর্মগুরুদের নাখোশ হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। তাই তৎকালীন পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াস এবং ধর্মনেতাদের চোখ এড়ানোর জন্য মিকেলাঞ্জেলো চতুরতার সাথে মস্তিষ্ককে এভাবে উপস্থাপন করেন। কিন্তু ধর্ম প্রচারকদের পাশাপাশি গত পাঁচশো বছর ধরে এই ব্যাপারটা শত শত শিল্পপ্রেমী, আঁকিয়ে, ইতিহাসবিদের চোখের আড়ালেও রয়ে গিয়েছিলো। লাখ টাকার প্রশ্ন হচ্ছে, কেন শিল্পীকে এই চিত্রের মধ্যে মস্তিষ্ক নিয়ে আসতে হলো?
ফ্র্যাংক লিন মেশবার্গারের আগে কেউই এভাবে ভেবে দেখেননি বা চিহ্নিত করতে পারেননি মিকেলাঞ্জেলোর লুক্কায়িত মেসেজ। ১৯৯০ সালের ১০ অক্টোবর ‘দা জার্নাল অফ দা আমেরিকান মেডিক্যাল এসোসিয়েশন’-এ ‘An Interpretation of Michelangelo’s Creation of Adam Based on Neuroanatomy‘ শিরোনামে মেশবার্গারের প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এখানে বলা হয়, ঈশ্বর যে আদমকে বুদ্ধিমত্তা দিচ্ছেন, সে ঘটনাই ছবিটিতে রূপকের সাহায্যে তুলে ধরা হয়েছে। মেশবার্গারের মতে, “মিকেলাঞ্জেলো বুঝতে পেরেছিলেন ভাস্কর্য গড়া আর আঁকাআঁকিতে তার এই দক্ষতা আসলে হাতের কারণে নয়, মস্তিষ্কের কারণে এসেছে। তিনি বিশ্বাস করতেন, ঈশ্বরের কাছ থেকে আমরা যে ‘স্বর্গীয় অংশ’ গ্রহণ করে থাকি, সেটা অন্যকিছু নয় বরং ‘বুদ্ধিমত্তা’।” তাই নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নিজের মতামত সম্পর্কে মেশবার্গার বলেন, “মানুষের ধারণা এই ছবিতে ঈশ্বর আদমকে জীবন দান করছেন। কিন্তু আপনি দেখুন, ছবিতে আদম কিন্তু ইতোমধ্যেই জীবিত! তাই আমার ধারণা, ঈশ্বর আদমকে জীবন নয়, বুদ্ধিমত্তা দিচ্ছেন।” মেশবার্গার ঈশ্বরের চারপাশে মস্তিষ্কের উপস্থিতির যে ধারণা দিয়েছেন, তাকে ‘Brain-God’ নামে ডাকা হয়। কি, এবার বুঝা যাচ্ছে কেন শিল্পী এই ছবিতে মস্তিষ্ক আমদানি করেছিলেন? তিনি হয়তো মেশবার্গারের ধারণা অনুযায়ীই চলেছিলেন!
নিচে মেশবার্গার তার প্রবন্ধে যেসব ছবি যোগ করেছিলেন, সেগুলোর মধ্য থেকে তিনটি ছবি দেওয়া হলো। পাঠকই মিলিয়ে নিন, লাল পর্দাটা আদৌ মস্তিষ্কের মত লাগছে কিনা!
তবে যেকোনো বক্তব্যের বিপরীতেই এমন কাউকে পাওয়া যায়, যিনি ধুমসে প্রথমজনের বক্তব্যকে খারিজ করে দেন। মেশবার্গারও এ প্রক্রিয়ার হাত থেকে রেহাই পাননি। কয়েকজন চিকিৎসক মেশবার্গারের আবিষ্কারকে সমর্থন না দিয়ে বলেছেন, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে, ঐ আমলে মিকেলাঞ্জেলো ছবির মধ্যে এনাটমি সংক্রান্ত গোপন প্রতীক এঁকে গেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও অঙ্গরাজ্যে কর্মরত চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডাঃ ‘জেমস জি র্যাভিন’ বলেন, “যদি কোনো ছবির দিকে আপনি একনাগাড়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকেন, তবে অনেক ধরনের জিনিসই আপনি ঐ ছবির মধ্যে দেখতে পাবেন। এটা বেশ স্বাভাবিক একটা ঘটনা।” [প্রিয় পাঠক, মানব মস্তিষ্কের খুবই স্বাভাবিক একটা প্রবণতা হলো – মিল নাই, চেনাজানা নাই এমন সব তথ্য-উপাত্ত বা জিনিসের মধ্য থেকে নির্দিষ্ট প্যাটার্ন বা মিল বা যোগসূত্র বের করা। আমাদের মস্তিষ্ক যখন এলোমেলো প্যাটার্ন থেকে পরিচিত আকার আকৃতি খুঁজে নেয়, তখন সেই অবস্থার গালভরা সাইকোলজিক্যাল টার্ম হল Pareidolia]।
র্যাভিন বিস্তর গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন শিল্পীদের উপর রোগের প্রভাব নিয়ে। তিনি বলেন, “কিছুদিন আগে আমি চীনে গিয়েছিলাম। সেখানে লোকজন আমাকে পাহাড়ের স্তরবিন্যাসের কাছে নিয়ে সেগুলোর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের মাথা আকৃতির অবয়ব দেখাচ্ছিলো। সেগুলো দেখে আপনি ভাবতে পারেন, আরে খোদা! ওটা তো একটা পুরুষের মাথা আর ওটাকে লাগছে একটা মহিলার মত। তারা তো দেখি চুমুও খাচ্ছে। কিন্তু পুরো ব্যাপারটিই আসলে ঐ পাহাড়ের অবয়ব নিয়ে আপনার মস্তিষ্কে চলা অতিরিক্ত চিন্তা-ভাবনার ফসল।”
নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের অধ্যাপক ডাঃ ক্যাথলিন ওয়েল-গ্যারিস ব্র্যান্ড (যিনি আবার রেনেসাঁ আমলের একজন বিশেষজ্ঞ) বলেন, “পর্দার আদলে মস্তিষ্ক উপস্থাপন করার ব্যাপারটা রেনেসাঁ আমলের সংস্কৃতির সাথে খাপ খায় না। এই চিত্রে আঁকা সবগুলো উপাদানই ঐ আমলের ঐতিহ্যের সাথে সম্পর্কিত। তাই মেশবার্গার তার আধুনিক জ্ঞানের সাথে রেনেসাঁর সংস্কৃতিকে মিলিয়ে একটা জগা খিচুড়ি পাকিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে।” অবশ্য অনেক চিকিৎসক আর শিল্পবোদ্ধা এভাবে এক ফুঁয়ে মেশবার্গারের মতামত উড়িয়ে দেননি! তারা বলেছেন, মেশবার্গারের উত্থাপিত মস্তিষ্কের ব্যাপারটা খুবই কৌতূহলোদ্দীপক। কিন্তু তারপরও কিছুটা সন্দেহ থেকে যায় এর সত্যতা নিয়ে। তবে ইউনিভার্সিটি অফ মিশিগান, অ্যান আর্বরের শিল্প বিশেষজ্ঞ ডাঃ গ্রাহাম স্মিথ বলেছেন, “রেনেসাঁ আমলে লিওনার্দো দা ভিঞ্চির আঁকা মস্তিষ্কের অনেক ছবি আছে। এগুলো দেখে মনে হয়, সে সময় বিজ্ঞানীরা বুদ্ধিমত্তার সাথে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের যোগসূত্র খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। তাই ঈশ্বরকে মানুষের মনের সমতুল্য ভেবে মেশবার্গার যে ধারণার জন্ম দিয়েছেন, সেটা আসলে উড়িয়ে দেওয়ার মত নয়।”
কিন্তু আবার টুইস্ট!
বছর দুই আগে, ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে মেশবার্গারের ধারণাকে বাতিল করে একদল চিকিৎসক Creation of Adam নিয়ে প্রসব করেছেন নতুন ধারণার। Mayo Clinic Proceedings জার্নালে প্রকাশিত The “Delivery” of Adam শিরোনামের প্রবন্ধে ছয়জন চিকিৎসক বলেছেন, তারা মেশবার্গারের ধারণাকে খুব একটা সমর্থন দিতে পারছেন না, কারণ ছবির টাইটেলের সাথে মেশবার্গারের ধারণার কোনো মিল নেই। তাদের মতে, ছবিতে দেখা যাচ্ছে প্রসব পরবর্তী একটা জরায়ু এবং এর আশেপাশের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গকে। অর্থাৎ মিকেলাঞ্জেলো এমন কিছু একটা এঁকেছেন, যেটা Creation of Adam শিরোনামের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ… তিনি আসলে এঁকেছেন মানবজাতির জন্মকে।
(পরবর্তী এবং শেষ পর্ব এখানে পড়তে পারেন)
অধীর আগ্রহে রইলাম পরবর্তী পর্বের জন্যে।
[…] প্রথম পর্ব পাবেন এখানে। […]