কম্পিউটার বিজ্ঞানের ইতিহাস নিয়ে লেখার জন্য যখন ইন্টারনেটের বিভিন্ন সোর্সে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করি তখন Live Science এ একটা আর্টিকেল দেখতে পাই যা শুরু হয় এমনভাবে –
“The computer was born not for entertainment or email but out of a need to solve a serious number-crunching crisis.”
এ যেন এক বাক্যে কম্পিউটার আবিষ্কারের উদ্দেশ্য ও তার ব্যবহার বলে দেওয়া হল। আসলে কম্পিউটার যে একটি গণনাকারী যন্ত্র এটা আজকাল এর সাধারণ ব্যবহারকারীদের দেখে বোঝা যায় না। আজকাল সবক্ষেত্রেই কম্পিউটারের ব্যবহার দেখতে পাই। এর যাত্রা শুরু হয়েছিল অ্যাবাকাসের মাধ্যমে তবে এটি যে আজকে বিজ্ঞানের একটি শাখায় পরিণত হয়েছে তা সম্ভব হয়েছে বিভিন্ন শতাব্দীর বিভিন্ন মহাজ্ঞানীর গবেষণার মাধ্যমে যা পরিচালিত করেছিল কম্পিউটার সায়েন্স এর দিকে।
যাত্রা শুরু হয়েছিল অ্যাবাকাসের মাধ্যমে, ৩০০ খ্রিষ্ট–পূর্বাব্দে, প্রাচীন ব্যবলীয়নে যা এখন পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে পুরাতন অ্যাবাকাস। সেই সময়কালীন একজন মহান মনীষী ছিলেন যার নাম ইউক্লিড। ইউক্লিড ১৩টি বইয়ের একটি বিখ্যাত সিরিজ লিখেছিলেন ‘এলেমেন্টস‘। এই বই পরবর্তীতে যৌক্তিক বিশ্লেষণের মডেলে পরিণত হয়, যা যুক্তি ও আধুনিক বিজ্ঞানের উন্নয়নে ভূমিকা পালন করে। এটা মনে করা হয় যে Antikythera Mechanism এখন পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে পুরাতন অ্যানালগ কম্পিউটার। ১৯০১ সালে Antikythera দ্বীপে একটি প্রাচীন ধ্বংসপ্রাপ্ত জাহাজ হতে এটি পাওয়া যায়। মনে করা হয় যে, প্রাচীন গ্রিক বিজ্ঞানীরা ২০৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে Astronomical Positions নির্ণয়ের জন্য এটি বানিয়েছিলেন।
আধুনিক অ্যালগরিদমের ভিত্তি গড়ে দেন Al-Khwārizmī (৭৮০–৮৫০)। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি আজকের গণিতের অ্যালগরিদমের ধারণা দেন। আল–খোয়ারিজমিকে কম্পিউটার সায়েন্সের দাদা ধরা হয়।এরপর এই যাত্রায় যোগ দেন স্কটিশ খামখেয়ালী বিজ্ঞানী জন নেপিয়ার, লগারিদমের আবিষ্কারক। তিনি এর বিকল্পও তৈরি করেন যা বর্তমানে Napier’s Bones নামে পরিচিত। নেপিয়ারের আবিষ্কার সরাসরি ‘স্লাইড রুল‘ আবিষ্কারের দিকে ঠেলে দেয়, যা ১৬৩২ সালে ইংল্যান্ডে আবিষ্কৃত হয় এবং এটি ১৯৬০ এর দিকে নাসা ইঞ্জিনিয়ারদের দ্বারা ব্যবহৃত যারা মার্কারী, জেমিনি আর অ্যাপোলো প্রোগ্রামের সাথে যুক্ত ছিলেন।
১ম গিয়ার চালিত ক্যালকুলেটর ডিজাইন করা হয় ১৬২৩ সালে যেটির নাম ছিল Calculating Clock। উইকিপিডিয়া ও এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা মতে, এটির প্রোটোটাইপ বানানোর পরেই আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয়ে যায়। যিনি এটি বানিয়েছিলেন তার নাম Wilhelm Schickard, যাকে বলা হয় Father of Computing age.
১৬৪২ সালে এই যাত্রায় যোগ দেন বিজ্ঞানী ব্লেইজ প্যাসকেল তাঁর উদ্ভাবিত গিয়ার-চালিত adding machine নিয়ে, যেটির অপর নাম Pascaline। এটি তার বাবার কাজে ব্যবহৃত হত যিনি ছিলেন একজন কর সংগ্রহকারী। তবে এটি তেমন আশানুরূপ বিক্রি হয়নি কারণ এটির দাম ছিল অত্যধিক বেশি আর হিসাবেও নিখুঁত ছিল না (তখনকার দিনে সঠিক মাপে গিয়ার বানানো সম্ভব ছিল না)।
এর কিছুকাল পরেই এই যাত্রায় আলাদা মাত্রা আনেন জার্মান বিজ্ঞানী Gottfried Wilhelm Leibniz। তিনি এমন এক ক্যালকুলেটর তৈরি করেন যেটিতে কোনো গিয়ার ছিল না। এটি ছিল প্রথম ক্যালকুলেটর যেটি ৪টি arithmetic operations এ কাজ করতে পারত। তিনি এর নামকরণ করেন Stepped Reckoner। আমরা বর্তমানে যে বাইনারি সিস্টেম ব্যবহার করি সেটি প্রথম আবিষ্কার করেন লিবনিজ যা আধুনিক কম্পিউটারের মৌলিক ভিত্তি।
১৮০১ সালে Joseph Marie Jacquard নামক এক ব্যক্তি এমন এক তাঁতকল তৈরি করেন যেটি punched card সিস্টেমে কাজে লাগানো হতো। প্রথম দিককার কম্পিউটারে এই পাঞ্চড কার্ড সিস্টেম ব্যবহার করা হত। যদিও এই প্রযুক্তি অনেক শ্রমিককে কাজ হারাতে বাধ্য করে, তবে ইতিহাস বলে যে প্রযুক্তি কাজের সংখ্যা বৃদ্ধি করে, কমায় না।
১৮২২ সালের দিকে ইংরেজ গণিতবিদ চার্লস ব্যাবেজ Difference Engine এর ধারণা নিয়ে আসেন যেটি ছিল বায়ুচালিত আর আয়তনের একটি রুমের সমান। তিনি ব্রিটিশ সরকার থেকে অনুদান পান যেহেতু সমুদ্রে ন্যাভিগেশনে এই যন্ত্র গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করত। তবে এই প্রোজেক্ট শুরু হওয়ার পর দেখা যায় এই যন্ত্র অত্যধিক জটিল আর কিছুদিনের মধ্যেই এটি ব্রিটিশ সরকারের অনুদানের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রোজেক্টে পরিণত হয়। ১০ বছর পরেও এই যন্ত্র সম্পূর্ণ হয়নি তাই ব্রিটিশ সরকার এই প্রোজেক্ট বন্ধ করে দেয়। এই যন্ত্র কখনো সম্পূর্ণ তৈরি হয়নি। এই যন্ত্রটি বর্তমানে লন্ডনের সায়েন্স মিউজিয়ামে প্রদর্শনীর জন্য উন্মুক্ত করে রাখা হয়েছে।
কিন্তু চার্লস দমে যাননি। এরপর তিনি নিয়ে আসেন Analytical Engine এর ধারণা। এটিকে আধুনিক কম্পিউটারের প্রথম ডিজাইন হিসেবে গণ্য করা হয়। এটি আয়তনে ছিল একটি বাড়ির মত আর ৬টি স্টিম ইঞ্জিন দ্বারা পরিচালিত। এটি ছিল প্রথম মেকানিক্যাল কম্পিউটার। এটির আর্কিটেকচার আজকের আধুনিক কম্পিউটারের আর্কিটেকচারের মত ছিল। আমরা বর্তমানে যেটিকে Turing Complete বলি, এটি ছিল তার প্রথম ডিজাইন। এই যন্ত্র ছিল programmable, যার ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল Jacquard এর পাঞ্চড কার্ড প্রযুক্তি। ব্যাবেজ বুঝতে পেরেছিলেন যে পাঞ্চড কার্ড প্রযুক্তি তথ্য সংরক্ষণের জন্য ব্যবহার করা সম্ভব। যেহেতু Jacquard এর তাঁতকলের প্রযুক্তির সাথে এর সম্পর্ক ছিল তাই ব্যাবেজ তার Analytical Engine এর প্রধান দুটি অংশের নাম দিয়েছিলেন Store এবং Mill। স্টোর হল যেখানে নাম্বার গুলো থাকতো আর মিল হলো যেখানে তাঁত বুনা হতো। আজকের দিনে আমরা এই স্টোরকে বলি ‘মেমরি ইউনিট’ আর মিলকে বলে ‘সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিট’।

Trial model of a part of the Analytical Engine, built by Babbage, as displayed at the Science Museum (London)
তথ্যসূত্রঃ
- http://www.computersciencelab.com/ComputerHistory/History.htm
- https://cs.uwaterloo.ca/~shallit/Courses/134/history.html
- https://medium.com/history-of-computer-science/brief-history-of-the-computer-science-a13c6fbe5873#.7fzr00xp2
- http://www.livescience.com/20718-computer-history.html
- https://global.britannica.com/technology/Calculating-Clock
- https://en.wikipedia.org/wiki/Turing_completeness
- https://en.wikipedia.org/wiki/Stepped_reckoner
- https://en.wikipedia.org/wiki/History_of_computer_science
- https://en.wikipedia.org/wiki/Analytical_Engine
- https://en.wikipedia.org/wiki/Suanpan
- https://en.wikipedia.org/wiki/Antikythera_mechanism