আলফ্রেড নোবেল প্রায় নিশ্চিত ছিলেন যে তার সবচাইতে চমকপ্রদ আবিষ্কার, ডাইনামাইট, সকল যুদ্ধ বিগ্রহ থামিয়ে মানবজাতির কল্যাণে আসবে। তিনি ভেবেছিলেন যে ডাইনামাইট থাকলে যুদ্ধের সব পক্ষই সম-শক্তিমান থাকবে যা বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধানের যুদ্ধংদেহী মনোভাব কমাবে। বলাই বাহুল্য যে আসলে যুদ্ধ থামাতে ডায়নামাইট কোনো ভূমিকাই রাখেনি। কিন্তু তার আরেকটি জিনিস যেটা মানবজাতিকে উন্নত করতে ভূমিকা রেখেছে তা হলো আলফ্রেড নোবেলেরই নাম বহন করা নোবেল প্রাইজ এবং প্রাইজ মানি। ১৯০১ সাল হতে চলে আসা নোবেল পুরষ্কার সৃষ্টিলগ্ন হতেই পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা সম্মানিত পুরষ্কার যা মানব মেধা মননের চূড়ান্ত প্রয়োগকারীদের দেওয়া হয়ে আসছে।
৩৫৫টি প্যাটেন্টের আবিষ্কারক ও স্বত্বাধিকারী, চিরকুমার আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যুর পর তাঁর এক্সিকিউটর আবিষ্কার করে যে তিনি গোপনে পাচঁটি শাখায় – রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান, সাহিত্য, চিকিৎসাশাস্ত্র, এবং শান্তিতে – “মানবজাতির জন্য সর্বোচ্চ অবদান” এর জন্য বাৎসরিক পুরষ্কার দেবার জন্য তাঁর উইলে নির্দেশ দিয়ে যান। পুরষ্কারের অর্থের জন্য তিনি প্রাথমিকভাবে তৎকালীন ৩৫ মিলিওন সুইডিশ ক্রোনোর (বর্তমানের ২২৫ মিলিওন ডলার) অনুদান দেন যার বাৎসরিক সুদ থেকে নোবেল পুরষ্কারের অর্থ দেওয়া হয়। প্রতিটি পুরষ্কারই আলাদা আলাদা ইন্সটিটিউট এবং ইন্সটিটিউটের সদস্যগণের মাধ্যমে নির্ধারিত করা হয়। যার মধ্যে চিকিৎশাসাস্ত্রের জন্য নোবেল ইন্সটিটিউটের সদস্যদের মধ্যে যারা সক্রিয়ভাবে এই কর্মক্ষেত্রে যুক্ত, তাদেরকে থাকতে হবে। শান্তি পুরষ্কার নির্ধারিত হয় পাঁচজন নরওয়ে পার্লামেন্টের সদস্যদের বিচারে। মরণোত্তর নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হয় না।
নোবেল পুরষ্কারকে আমরা মানবজাতির হিসাবে সবচাইতে সম্মানিত পুরষ্কার ধরে নিয়ে নোবেল বিজয়ীদের চূড়ান্ত সম্মান দিয়ে থাকি। অবশ্যই এই পুরষ্কার প্রদান আর সকল মানব কর্মকাণ্ডের মতই কিছুটা হলেও ত্রুটিযুক্ত। বিজ্ঞানের শাখাগুলোতে না হলেও সাহিত্য, শান্তি, এবং তুলনামূলক নতুন শাখা অর্থনীতিতে অনেক ক্ষেত্রে একপাক্ষিকতার বা রাজনৈতিক প্রভাবের অভিযোগ আছে।
সবচাইতে বেশী বিতর্কিত হয় সাহিত্য এবং শান্তি পুরষ্কারের বিজয়ীদের নিয়ে। কারণ, সাহিত্য আর শান্তি ২টাই আসলে একেকজন একেকভাবে বিচার করে। তাই অনেক ক্ষেত্রে শান্তি এবং সাহিত্যে নোবেল সবার মনঃপূত হয় না। আবার কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় যে নোবেল বিজেতা নিজেই নোবেল পুরষ্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন যেমনটি প্রথমবারের মত করেছিলেন জ্যাঁ-পল সার্ত্রে। ১৯৬৯ সালে জ্যাঁ-পল সার্ত্রেকে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী ঘোষণা করা হলেও উনি পুরষ্কার গ্রহণ করতে প্রত্যাখ্যান করেন এই বলে যে সাহিত্য হলো মনের চাহিদা যা প্রত্যকের জন্যেই ভিন্ন এবং কোনো ইন্সটিটিউট বা কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠী একে সংজ্ঞায়িত বা বিচার করতে পারে না। পরে যদিও উনি মারা যাবার পর তাঁর পরিবার নোবেল পুরষ্কারের অর্থ গ্রহণের দাবি করে। আবার পাবলো নারুদো নোবেল এত বেশী করে চেয়েছেন যে উনি সরাসরি প্রকাশ্যে সুইডিশ সাহিত্যিকদের তোষামোদ করতেন। শেষ পর্যন্ত উনি ১৯৭১ সালে সাহিত্যে নোবেল বিজয় করেন। ওদিকে ২০০৪ সালে অস্ট্রিয়ান নারীবাদী এবং লেখিকা এলফ্রিড জেলনেক (Elfriede Jelinek) কে সাহিত্যে নোবেল দেওয়া এতই বিতর্কিত ছিলো যে নোবেল কমিটির একজন সভাসদ তো পদত্যাগই করে বসেন। এমনকি এই গুজবও আছে যে সুইডিশরা রাশানদের ইতিহাসগতভাবে দেখতে পারে না বলে লিও টলস্টয়কে নোবেলের জন্য মনোনীতও করা হয়নি। ওদিকে শান্তিতে নোবেল নিয়ে কথা বলতে গেলে শেষ হবে না। কারণ, এটা নোবেলের সবচাইতে বিতর্কিত শাখা যেখানে দেখা যায় যে বেশীরভাগ নোবেলই বিশ্ব রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে দেওয়া হয়।
রবার্ট ফ্রস্টের নোবেল অধরা থাকার ব্যথা আজো কাব্যপ্রেমীদের দুঃখ দেয়। ভারজিনিয়া উলফ, টমাস হার্ডি, জেমস জয়েসের নোবেল অপ্রাপ্তিকে ইউরোপকেন্দ্রিক নোবেল কমিটির স্বেচ্ছাচারিতা বলেই মনে করে অনেকে। লিও টলস্টয়, সর্বকালের সেরাদের একজন, সম্ভবত শেক্সপিয়ার পরবর্তী সেরা সাহিত্যিকের নোবেল প্রদান না করা সাহিত্যে নোবেলের সবচাইতে বড় কলঙ্ক। অবশ্য বিজ্ঞানের শাখায় নোবেল প্রাইজগুলো তুলনামূলকভাবে অনেক স্বচ্ছতার সাথে বিজয়ী নির্বাচন করে থাকে। কিন্তু কয়েকটা ক্ষেত্রে এমনও হয়েছে যে, যে আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হয়েছে, তা পরবর্তীতে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। সেই কয়েকটা উদাহরণ ছাড়া বিজ্ঞানে নোবেলকে আমরা বলতে পারি মানবজাতির মানদণ্ডে চূড়ান্ত সম্মানের পুরষ্কার। কিন্তু তারপরও বিজ্ঞানে নোবেল নিয়ে কিছু ভুলত্রুটি এবং চাওয়া-না-পাওয়ার গল্প বলাই যায়।
১৯২৬ সালে জোহানেস ফিবিজারকে “ক্যানসারের হবার জন্য রাউন্ড ওয়ার্ম (গোল কেঁচো জাতীয় পোকা) দায়ী” তত্ত্ব দেবার জন্য চিকিৎসাশাস্ত্রে নোবেল দেওয়া হয়, কিন্তু তা পরবর্তীতে চরম ভুল প্রমাণিত হয়। নোবেল বিজয়ীদের কেউ কেউ মানুষের সিলেক্টিভ ব্রীডিং বা নিজ পরিবারের মধ্যেই বিয়ে দেবার পক্ষে কথা বলে বিতর্কিত হয়েছে, কেউ আবার নির্বোধের মত পাবলিক স্কুলের বিরোধিতা করে সমালোচিত হয়েছে, নোবেল পাবার পর অনেকে নাৎসি পার্টিতে যোগ দিয়েছে আর কেউ তো 9/11 এর ঘটনাকে ইনসাইড জব বা আমেরিকার নিজের কাজ বলে আলোচিত-সমালিচত হয়েছে। কিন্তু এসকল বিচ্ছিন্ন ঘটনা বাদ দিলে বেশীরভাগ নোবেল বিজয়ীই মানবজাতিকে একের পর অসাধারণ অবদান দিয়ে ঋণী করে রেখেছে। নোবেল বিজয়ীদের মধ্যে কেউ আবিষ্কার করেছে এক্স-রে, কেউ কোয়ান্টাম ফিজিক্স, কেউ পেনিসিলিন, ইত্যাদি। নোবেল বিজয়ী হয়েছে নেলসন ম্যান্ডেলা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মার্টিন লুথার কিং এর মত কালজয়ী ব্যক্তিরা।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, নোবেল দেবার সুযোগ থাকে অনেক কম। কোনো শাখায় এক বছরে নির্দিষ্ট সংখ্যক নোবেল দেয়া হয়, যে কারণে যুগে যুগে অনেক মহান ব্যক্তিত্ব, অনেক মহান বিজ্ঞানী, অনেক মহান সাহিত্যিক নোবেল পাননি; যেমন – মহাত্মা গান্ধী, এলেনর রুজভেল্ট, স্যার ফজলে হাসান আবেদ (জ্বি, উনি একজন বাংলাদেশি, একটু সার্চ করে দেখবেন), ইরেনা সেন্ডল্যে, কোরাজন আকুইনো, পোপ জন পলের মত অনেক ব্যাক্তিত্ব যাদের বিপ্লবী ভূমিকায় পৃথিবীর চেহারাই আজ অন্যরকম। নোবেল পাননি স্টিফেন হকিং (ব্লাক হোল ডেথ থিওরী সহ আরো অনেক সায়েন্টিফিক বিপ্লবের নায়ক), পর্যায় সারণির আবিষ্কারক দিমিত্রি মেন্দেলিভ, ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের আবিষ্কারক টিম বারনার্স লি, কোয়ার্কের আবিষ্কারক মুড়ে জেলম্যান এর মত জাঁদরেল বিজ্ঞানীরা। এনাদের সোনালি স্পর্শের অভাবে নোবেল সবসময়ই অপূর্ণ থাকবে।
নোবেল পুরষ্কার যারা অর্জন করে, তাদের প্রতি বিশ্ববাসীর সম্মান ও শ্রদ্ধা হয়তো বৃদ্ধি পায়। কিন্তু তার চাইতে বহুগুণ সম্মান বৃদ্ধি পায় নোবেল পুরষ্কারের। নোবেলের মর্যাদা প্রতি বছর চক্রবৃদ্ধি হারে বৃদ্ধি পায়, নোবেলের কলংকমুক্তি ঘটে এসব মহান ব্যক্তিদের কাছে নিজেকে বিলিয়ে দিতে পেরে।
বেশ তথ্যপূর্ণ ভাল লেখা