দারুণ খবর! গরম খবর!
জীব বিজ্ঞান ও বিবর্তনের সাম্প্রতিক খবরাখবরে চোখ রাখলে ইতোমধ্যেই আপনি খবর শুনেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার এক গহীন গুহাশ্রেণীর ভেতরে আবিষ্কার হয়েছে মানব গোত্রের এক নতুন প্রজাতি, নাম হোমো নালেদি। জানা গেছে এই প্রজাতিটি হোমোনিডি সাব-ফ্যামিলির হোমিনিন গোষ্ঠীর (tribe) অন্তর্ভুক্ত ছিল।
ঘটনা কী?
কী? বিষয়টা কঠিন লাগছে তো? কঠিনই বটে। সাধারণত আমরা যারা বিবর্তন তত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করি না, কিংবা ভাসাভাসা জ্ঞান আছে, তাদের কাছে এই সূক্ষ্ণ ডিটেইলগুলো কঠিন লাগারই কথা। আমার কাছেও লেগেছে। তবে এই লেখাটি পড়লে আশা করছি বিষয়টা সবার কাছেই পরিষ্কার হয়ে উঠবে। তাহলে চলুন দেখি আমাদের পূর্বপুরুষদের বৈচিত্র্যময় বংশধারা কেমন ছিল। এখানে উল্লেখ্য যে আমি নিজেও বিবর্তন তত্ত্ব নিয়ে উচ্চতর পড়াশোনা করি নি, সুতরাং ভুল-ত্রুটি হলে অবশ্যই সেটি উল্লেখ করবেন। আমিও শুধরে নিবো, অন্যরাও ভুল তথ্য জেনে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না।
প্রথমে চলুন দেখা যাক হোমিনিডি, হোমিনিনি, হোমিনিন –এই বিভ্রান্তিকর নামগুলোর অর্থ কী।
আমাদের পূর্বপুরুষেরা
হোমিনিন (Hominin) নামটি সাম্প্রতিক সময়ে বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। এর কারণ মানুষের পূর্বপুরুষদের শ্রেণীবিভাগে কিছুদিন হলো বেশ কিছু রদবদল হয়েছে। আশির দশক অবধি শ্রেণীবিন্যাসের জনক কার্ল লিনিয়াসের বর্ণিত শ্রেণীবিভাগকেই মোটামুটি ঠিক ধরা হতো। তিনি অন্যান্য জীবজন্তুর পাশাপাশি মানুষের পূর্ব-প্রজাতিগুলোর শ্রেণীকরণও করেছিলেন। তার হিসেব অনুযায়ী, হোমিনয়েড [Hominoids] ফ্যামিলির মধ্যে দুটো উপ-ফ্যামিলি ছিলঃ হোমিনিড [Hominids] আর অ্যান্থ্রোপয়েড [Anthropoids] । আধুনিক মানুষ বা হোমো স্যাপিয়েন্স এবং তাদের সরাসরি পূর্বপ্রজাতিগুলিকে হোমিনিড বলা হতো। আর শিম্পাঞ্জি, গরিলা, ওরাং ওটাং এবং তাদের পূর্বপ্রজাতিগুলোকে ধরা হতো অ্যান্থ্রোপয়েড।
কিন্তু…
সমস্যা হলো কিছুদিন আগে অণুজীববিজ্ঞানীরা যখন আবিষ্কার করলেন যে মানুষ, শিম্পাঞ্জি আর গরিলা প্রজাতি তিনটি আসলে অনেক নিকট-আত্মীয়, আর ওরাং ওটাং এদের সবার একটু দূরসম্পর্কের আত্মীয়। তখন কার্ল লিনিয়াসের শ্রেণীবিভাগটাকে আপডেট করার দরকার পড়লো। হোমিনয়েডকে ভাগ করা হলো নতুন দুটো উপ-ফ্যামিলিতেঃ পনজিনি [ponginae] (ওরাং ওটাং ও তার নিকট-আত্মীয়, পূর্বপুরুষ ইত্যাদি) আর হোমিনিনি [homininae] (মানুষ ও তার পূর্বপুরুষ, গরিলা, শিম্পাঞ্জি ইত্যাদি)।
এই দুটো উপ-ফ্যামিলি থেকে আরেকটু নিচে নামলে দেখা গেল যে হোমিনিনির তিনটা আলাদা ভাগ জরুরি হয়ে পড়ছে। হোমিনিনিতে বৈচিত্র্য বেশি (মানুষ-গরিলা-শিম্পাঞ্জি), তাই এই উপ-ফ্যামিলিটাকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হলোঃ হোমিনিনি [Hominini] (মানুষ ও তার পূর্বপুরুষ), পানিনি [Panini] (শিম্পাঞ্জি ও তার পূর্বপুরুষ, এবং গরিলিনি [Gorilini] (গরিলা ও তার পূর্বপুরুষ)।
হোমিনিনির ভেতর হোমিনিনি, প্যাঁচ লেগে যাচ্ছে তো? এক্ষেত্রে নামের ইংরেজি বানানটা খেয়াল করবেন। উপ-ফ্যামিলির নামের শেষে ae আর তার ভেতরের ছোট গ্রুপের নামের শেষে i – এভাবে মনে রাখতে পারেন। আমাদের বোঝার সুবিধার্থে Hominini-কে আমরা তারকা চিহ্ন (*) দিয়ে চিহ্নিত করবো।
মোদ্দা কথা হলো, আগে যাদেরকে হোমিনিড বলা হতো, তারাই আসলে হোমিনিনির* সদস্য হোমিনিন। আধুনিক মানুষের সরাসরি পূর্বপুরুষ। এদের মধ্যে হোমো genus-এর সবাই আছে (হোমো স্যাপিয়েন্স, হোমো ইরগ্যাস্টার, হোমো রুডলফেন্সিস ইত্যাদি)। আর আছে অস্ট্রালোপিথেসিনরা (অস্ট্রালোপিথেকাস আফ্রিকানাস, অস্ট্রালোপিথেকাস বইসেই ইত্যাদি)। আরও আছে এদের আগের কিছু প্রজাতি যেমন, প্যারান্থ্রোপাস, আর্ডিপিথেকাস ইত্যাদি।
হোমিনিন কারা?
এবারে আসুন আমরা আর সব বাদ দিয়ে হোমিনিনদের নিয়ে একটু জানার চেষ্টা করি। আগেই বলেছি, এরা সকলেই আমাদের সরাসরি পূর্বপুরুষ-প্রজাতি, এই কাণ্ডের একটি ছোট শাখায় হোমো স্যাপিয়েন্সদের অবস্থান। কালের বিবর্তনে এদের অন্য প্রজাতিগুলোর বিবর্তন ও বিলুপ্তি ঘটেছে। ফসিল থেকে বেশ কয়েক ধরনের হোমিনিন প্রজাতির কথা আমরা জানতে পেরেছি। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রজাতির নাম আর স্থায়িত্বকাল নিচে দেয়া হলো। জন গুর্শের আঁকা বিভিন্ন প্রজাতির ছবি দেখতে চাইলে এই লিংকে যেতে পারেন।
১। অস্ট্রালোপিথেকাস (স্থায়িত্বঃ ৪২ লাখ – ১৪ লাখ বছর পূর্বে)
২। হোমো ইরেক্টাস ও হোমো ইরগ্যাস্টার (স্থায়িত্বঃ ১৯ লাখ – ৭০,০০০ বছর পূর্বে)
৩ক। নিয়ানডারথাল (স্থায়িত্বঃ ৪ লাখ – ৩০,০০০ বছর পূর্বে)
৩খ। শারীরি-আধুনিক মানব (স্থায়িত্বঃ ২ লাখ – ১ লাখ বছর পূর্বে)
৩গ। ডেনিসোভান (স্থায়িত্বঃ ৪৮,৬৫০ – ২৯,২০০ বছর পূর্বে)
৩ঘ। ক্রোম্যাগনন বা আদি আধুনিক মানব (স্থায়িত্বঃ ৩৫,০০০ – ১০,০০০ বছর পূর্বে)
৪। আধুনিক মানুষ – হোমো স্যাপিয়েন্স স্যাপিয়েন্স (স্থায়িত্বঃ ৪৫,০০০ বছর – বর্তমান)
এখানে খুব জরুরি একটি বিষয় হলো, ২ নম্বর প্রজাতিগুলো (হোমো ইরেক্টাস ও ইরগ্যাস্টার) থেকে কাছাকাছি ধরনের হোমিনিনরা মাইগ্রেশন শুরু করে। অর্থাৎ বিভিন্ন স্থান থেকে উৎপত্তি লাভ করে পরিবেশ বা খাদ্যের কারণে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলে যেতে থাকে। প্রায় সব প্রজাতিই আফ্রিকায় উৎপন্ন হয়েছে, তারপর এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গিয়েছে। পরিবেশ বদলানোর ফলে সমসাময়িক অনেকগুলো প্রজাতি তৈরি হয়েছে। যারা খুবই কাছাকাছি, কিন্তু শরীরবিদ্যা, হাড়ের গড়ন, অস্ত্রশস্ত্র, সংস্কৃতিতে অনেক আলাদা। একই সময়ে বিভিন্ন প্রজাতিগুলো পাশাপাশি অবস্থান করেছে, মারামারি করেছে এমন নিদর্শনও পাওয়া গেছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এই সময়টা হলো আজ থেকে ৪০,০০০ থেকে ১০,০০০ বছর পূর্বে।
হোমো নালেদি বৃত্তান্ত
সবই তো বুঝলাম, কিন্তু এই সবের সাথে গরম আবিষ্কারের খবরটার কী সম্পর্ক? এরকম কঙ্কাল তো কিছুদিন পরপরই পাওয়া যাচ্ছে, তাই না? হ্যাঁ এটা ঠিক যে গবেষকরা প্রতিনিয়তই নিত্যনতুন ফসিল খুঁজে পাচ্ছেন। তবে এই নতুন আবিষ্কারের গুরুত্ব সেসব ফসিল থেকে একটু আলাদা। দক্ষিণ আফ্রিকার রাইজিং স্টার গুহা শ্রেণীতে প্রায় অক্ষত অবস্থায় একটি সম্পূর্ণ নতুন প্রজাতি পাওয়া গেছে। নতুন প্রজাতির আবিষ্কার সবসময়ই দারুণ ইন্টারেস্টিং ঘটনা। কারণ এই প্রজাতি আমাদের মানব বিবর্তনের লম্বা জটিল টাইমলাইনটাকে সমৃদ্ধ করে তুললো। কিছু ফাঁকা জায়গা ভরাট হলো। সংক্ষেপে বলার পরেও এতোক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন এতকিছু এক দিনে জানা যায় নি। এর সাথে জড়িয়ে আছে দীর্ঘ দশক দশকের গবেষণা। সবই আসলে আমাদের পূর্বসূরীদের জানার আগ্রহের প্রেরণায় চলছে।
হোমো নালেদিদের বেশ কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা গেছে। এ বিষয়ে প্রকাশিত দু’টি গবেষণাপত্র (১ এবং ২) থেকে নিচের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো পাওয়া গেছে।
প্রথমত খুবই দুর্গম এই গুহাশ্রেণীর ভেতরে একইসাথে প্রায় দেড় হাজার দেহের কঙ্কাল এক জায়গায় পাওয়া গেছে। গুহায় ঢোকার একটাই মুখ, সে মুখটাও মাত্র ১২ মিটার চওড়া। ভেতরে এতগুলো কঙ্কাল তাহলে গেল কীভাবে? বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন এই গুহাটি সম্ভবত নালেদিদের কবরস্থান বা সৎকারের জায়গা। গোত্রের সদস্যরা মারা গেলে তাদেরকে এখানে কবর দেয়া হতো।
দ্বিতীয়ত, এদের হাত ও পায়ের গড়নের সাথে আধুনিক মানুষ বা আদি-আধুনিক মানুষের হাত ও পায়ের গড়নের অনেক মিল পাওয়া গেছে। এদের উচ্চতাও প্রায় পাঁচ ফিট, যা আমাদের গড় উচ্চতার কাছাকাছি। ধারণা করা হচ্ছে এরা প্রজাতি হিসেবে আমাদের কাছাকাছি ছিল। অথচ আশ্চর্যের বিষয় হলো তাদের ধড় ও কাঁধের গড়ন, যা পুরনো প্রজাতিগুলোর সাথে বেশি মিলে যায়। এমন ছোট কাঁধ নির্দেশ করে যে তারা উঁচু স্থান বইতে পারদর্শী ছিল, কিন্তু সেটা কি কোন গাছ নাকি অন্য কিছু তা এখনও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
তৃতীয়ত, এদের মস্তিষ্কের আকার ছিল অনেক ছোট, মাত্র ২৭ থেকে ৩৪ ঘন ইঞ্চি। এটাও হোমিনিন যেমন অস্ট্রালোপিথেকাসদের সাথে বেশি মিলে যাচ্ছে। মূলত মগজের এমন ছোট আকার দেখেই মোটামুটি নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে যে হোমো নালেদি বেশ পুরনো প্রজাতি, আজ থেকে প্রায় ২৮ লাখ বা ২৫ লাখ বছর পূর্বে তাদের বিচরণ ছিল। এত পুরনো প্রজাতি অথচ হাত-পায়ের গড়ন আমাদের কাছাকাছি, এমনকি তাদের নিজস্ব সৎকার প্রথাও ছিল – এই বিষয়টাই বিজ্ঞানীদেরকে অবাক করে দিয়েছে। হোমো নালেদিরা এমন অন্ধকার ও দুর্গম গুহায় নিশ্চয়ই আলো নিয়ে ঢুকেছিল, সে সময়ে আগুনের নিয়ন্ত্রণ এসেছিল তাহলে? এটাও এক নতুন আবিষ্কার বটে!
সব মিলিয়ে নতুন এই আবিষ্কার আর ফসিল বিবর্তনের টাইমলাইনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হয়ে থাকবে। এই আবিষ্কারে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আমাদের মানব প্রজাতির ইতিহাসও আরেকটু সমৃদ্ধ হলো।