কিছু কিছু মানুষ এবং তার কর্ম দেখে প্রাণে স্পন্দন জাগে, ঘটে স্ফুরণ। ইচ্ছে করে বুকের ভিতর আগলে রাখি চিরকাল, সারাজীবন। চিৎকার করে পৃথিবীকে বলি, হে পৃথিবী তুমি পেয়েছ এক মহাজীবন, আজ তোমার নবজন্ম। ঠিক তেমনি একজন মানুষ হরিপদ কাপালী। বাড়ি ঝিনাইদহ জেলার আসাননগর গ্রামে। জীর্ণ শরীর, শীর্ণ চেহারা। পেশায় কৃষক, কল্যাণী আবিষ্কারকও বটে। শিক্ষা দীক্ষা বলতে কিছু নেই। হরিপদ কাপালী সাদাসিদে গোছের অতি দরিদ্র একজন মানুষ। অতি দরিদ্র, নিরক্ষর গোছের মানুষটিই আবিষ্কার করেছেন বাংলা জনপদের অন্যতম প্রধান খাদ্য ধান-এর একটি উচ্চফলনশীল জাত। হরিপদ কাপালীর নাম অনুসারে এর নাম রাখা হয়েছে “হরি ধান”।
পারিবারিক জীবন
এই পৃথিবীতে অনেক মানুষই আছে যাদের শৈশব, কৈশোর বলতে কিছু থাকে না। থাকে না বাবা, মায়ের আদর-যত্ন এবং ভালোবাস, থাকে শুধু জীবন-সংগ্রাম। হরিপদ কাপালীও সেরকম একজন মানুষ। ১৯২২ সালের ১৭ ই সেপ্টেম্বর ঝিনাইদহ জেলার এনায়েতপুর গ্রামে হরিপদ কাপালীর জন্ম। বাবার নাম কঞ্জু লাল কাপালী এবং মাতার সরোধনী। জন্মের কিছুদিন পরেই দরিদ্র পিতাকে চিরবিদায় জানান হরিপদ কাপালী। পিতার অবর্তমানে কিশোর বয়সেই কাঁধে চাপে সংসারের দায়িত্ব। জীবিকা নির্বাহ করতে কিশোর বয়স থেকেই গ্রামে গ্রামে এর ওর বাড়িতে কাজ করতে হয়েছে হরিপদকে। এমনি করে একদিন কাজের সন্ধানে আসেন ঝিনাইদহের আসাননগর গ্রামে। সেখানে পছন্দ হয় সুনিতী বিশ্বাসকে। বিয়ে করে ফেলেন কিশোর বয়সেই। বিয়ের পর থেকে মৃত্যু অবধি তিনি আসাননগর গ্রামেই বসবাস করেছেন।
শিক্ষাজীবন
কিশোর বয়সেই সংসার যার কাঁধে, এর ওর বাড়িতে ফায়-ফরমাশ খেটে দু’বেলা পেট পুরে যার, তার আবার স্কুল, কলেজ! হয়তো ইচ্ছেও ছিল না, কিংবা থাকলেও পেরে উঠেননি বা দরিদ্রতা পেরে উঠতে দেয়নি। হরিপদ কাপালীর হয়তো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই তবে বর্ণমালাকে ভালোবাসতেন ভীষণ। কাঠ বাঁশের তৈরি চাকচিক্যহীন এক প্রকার ঝুলন্ত বিছানার উপরে একগুচ্ছ ইংরেজী বর্ণমালা তৈরি করে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। জিজ্ঞেস করলে বলতে পারতেন কোনটা কী। বার্ধক্যে এসে কিছুটা ভুলে গেলেও বর্ণমালার প্রতি ভালোবাসা কমেনি একটুও ।
হরিধান আবিষ্কারের গল্প
ঝিনাইদহ জেলা সদর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে আসাননগর গ্রাম। এই গ্রামের বেশিরভাগ মানুষেরই পেশা কৃষি, ধানের চাষাবাদ। হরিপদ এ গ্রামের একজন প্রবীণ অভিজ্ঞ কৃষক। ১৯৯২ সালের কোনো একদিন ধানের যত্ন নিতে জমিতে যান হরিপদ। এমন সময় তার নজরে আসে একটি ভিন্ন জাতের গাছের। এতগুলো জমি, এত জাতের ধানের মধ্যে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গাছটি। হরিপদ আগ্রহ ভরে দেখলেন, বুঝতে চাইলেন ভিন্ন জাতের আগন্তুকটি কে? গাছটিকে তার আগাছা মনে হল না। রেখে দিলেন, যত্ন দিলেন। কিছুদিন পরে দেখা গেল গাছটি আরও বেড়ে উঠেছে এবং মোটা তাজা হয়েছে সেটির বাইল (আঞ্চলিক ভাষায় ধানের গুচ্ছকে বাইল বলা হয়)। কিছুদিন পরে ধান আসে। হরিপদ লক্ষ্য করেন, অন্যজাতের তুলনায় অনেক বেশি ধান হয়েছে নতুন জাতের তিনটি বাইলে। হরিপদ সেগুলো তুলে নিয়ে যান বাড়িতে। বেশ যত্ন করেন। আগন্তুক ধানগুলোকে বীজ হিসেবে তৈরি করেন। পরীক্ষামূলকভাবে আবার সেগুলো তার চাষের জমির এক কোণায় আলাদাভাবে বপন করেন। নির্দিষ্ট সময় পর নতুন জাতের সংসারে ধান আসে প্রচুর। দৈর্ঘ্যে বেশ উঁচু, উৎপাদন বেশি, রোগ-বালাই কম, এমনকি খরচও কম এই ধানে। ব্যাপার দেখে হরিপদ অনেক বেশি পরিমাণে বীজ, চাষাবাদ এবং উৎপাদন করেন নামহীন এই আগন্তুক ধানের।
অনেকে হয়ত ভাবছেন, এ কেমন অদ্ভুত ব্যাপার? কোথা থেকে আসলো এই ধান গাছ? কিভাবে আসলো? বলা বাহুল্য, এটি অলৌকিকভাবে আসেনি। এটি এসেছে প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। প্রাকৃতিক নির্বাচনের আরেকটি সাক্ষ্য আমাদের সামনে তুলে ধরলেন হরিপদ। প্রকৃতিতে এমনি এমনি কিছু আসে না বা ঘটে না, তবে রূপান্তরিত হয়। বিবর্তিত হয় এক জাত থেকে আর এক জাতে। আপনারা যারা চার্লস ডারউইনের ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিবর্তন’ তত্ত্ব বা Darwin’s Theory of Evolution by Natural Selection সম্পর্কে পড়েছেন, তাদের কাছে বিষয়টি সাধারণ মনে হবে না। হয়তো হরিপদ তার অজ্ঞতার কারণে নতুন জাতের কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেননি কিন্তু আমরা আজ জানি কীভাবে এটি এসেছিল। আরও মজার ব্যাপার হল, হরিপদ যখন এই ধানের বীজ তৈরি করে পুনরায় বপন করেন, তখন নিজের অজান্তেই তিনি ডারউইনের ‘কৃত্রিম নির্বাচন’ বা “Selective breeding/artificial selection” পদ্ধতিটি প্রয়োগ করেছিলেন। এই পদ্ধতির মাধ্যমেই পরবর্তীতে নতুন জাতটি ছড়িয়ে পড়তে সক্ষম হয়।
১৯৯৪ সালে আসাননগর গ্রাম ছাড়িয়ে আরও কিছু গ্রামে বিস্তার লাভ করে এই ধান। যেহেতু হরিপদ কাপালী এর আবিষ্কারক, তাই গ্রামবাসী এর নাম দিল হরিধান। ১৯৯৫ সালে যশোর থেকে প্রকাশিত দৈনিক লোকসমাজ পত্রিকায় কাজল নামক একজন স্থানীয় সাংবাদিক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করলে এটি স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের নজরে আসে। অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা হরিপদের কাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা করার জন্য গাজীপুর ব্রি (BRRI) এবং চুয়াডাঙ্গা বীজ গবেষণা কেন্দ্রে প্রেরণ করেন। কিছু প্রদর্শনীতে চাষাবাদও শুরু করেন। একইসাথে চুয়াডাঙ্গা গবেষণা কেন্দ্রের নিজস্ব জমিতে চাষাবাদ শুরু হয় এই ধানের। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে কৃষি গবেষণা কেন্দ্র এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, হরিধান একটি উচ্চফলনশীল (যা কিনা অধিক প্রচলিত বিআর-১১ এবং স্বর্ণা ধানের থেকেও বিঘা প্রতি প্রায় ৫ মণ বেশি উৎপাদিত হয়), কম খরচের, এবং রোগ-বালাইবিহীন ধান। একে পরবর্তীতে হরিধান নামেই ছাড়পত্র প্রদান করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ।
পুরষ্কার
হরিপদ কাপালী তার আবিষ্কারের কৃতিত্ব স্বরূপ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, স্থানীয় জেলা প্রশাসন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র, রোটারিক্লাব সহ প্রায় ১৬ টি জাতীয় পুরষ্কারে ভূষিত হন। অবশেষে ২০১৭ সালের ৬ ই জুলাই আমাদের ছেড়ে চলে যান হরিপদ কাপালী, হরিধানকে রেখে যান আমাদের অন্নের অন্যতম যোগান হিসেবে।
উৎসঃ
১। হরিধান
২। হরিপদ কাপালী