(Book review: “What is life: How chemistry becomes biology” by Addy Pross.)
বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্তর ভিত্তিতে চার্লস রবার্ট ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বের অবস্থান আজ অনড়, দেশ ও সংস্কৃতিভেদে নানারূপে বিবর্তন তত্ত্বের অস্বীকৃতি থাকলেও জীববিজ্ঞানীমহলে বিবর্তনতত্ত্ব এখন সুপ্রতিষ্ঠিত। দেড়শ বছরে আধুনিক জীনবিজ্ঞানের হাত ধরে অনেকটা পথ পেরিয়ে ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব এখন পুরোপুরি ব্যাখ্যা করতে পারে কিভাবে আদি প্রাণ থেকে তার শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে ধীরে ধীরে সৃষ্টি হল প্রাণের অসংখ্য জটিলতর রূপভেদ। তবে একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে মনে খচখচ থেকেই যায়। কেন বা কিভাবে আদি প্রাণের সৃষ্টি হল, সে সম্পর্কে ডারউইন কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি, তার সময়ের জন্যও এই প্রশ্নের উত্তর ছিল আরাধ্যর অতীত। ডারউইনের বিবর্তনতত্ত্ব তাই প্রাণের বিবর্তন নিয়ে আলোচনা করে, প্রাণের সৃষ্টি বা উৎপত্তি নিয়ে নয়।
প্রাণের সৃষ্টির দুটো দিক নিয়ে জীববিজ্ঞানে আলোচনা করা হয়, একটি হল ঐতিহাসিক(historic), আরেকটি হল ইতিহাস নিরপেক্ষ(ahistoric)।
১)ঐতিহাসিক দিকের আলোচনার বিষয়বস্তু হল, প্রাণ কোন সময়ে সৃষ্টি হয়েছিল, আদি প্রাণ সৃষ্টির সময় পৃথিবীর পরিবেশ কেমন ছিল, আদি প্রাণের ঠিক কি কি গাঠনিক উপাদান ছিল। সোজা কথায়,আদি প্রাণের ঠিকুজি নির্ণয়।
এ ব্যাপারে প্রথমবারের মতো বড়সড় অগ্রগতি আসে ১৯৫২ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে করা স্টানলি মিলার এবং হ্যারল্ড উইরির এক্সপেরিমেন্টে। প্রাণ সৃষ্টির সময়কালে আদি পৃথিবীতে যে পরিবেশ ছিল মনে অনুমান করা হয়, মিলার তাদের এক্সপেরিমেন্টে ল্যাবে কৃত্রিমভাবে সেরকম পরিবেশ সৃষ্টি করে বেশ কিছু জৈব যৌগ সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। এর মাঝে ছিল প্রোটিন, যা জীবনের জন্য এক মহার্ঘ বায়োমলিকুল। সে সময়ে বিজ্ঞানীমহলে শোরগোল তুললেও মিলারের পরীক্ষা পরবর্তীতে প্রাণের ঐতিহাসিক কারণ সন্ধানে খুব বেশি সাহায্য করতে পারেনি। আদি পৃথিবীতে পরিবেশ ঠিক কিরকম ছিল, ঠিক কোন পরিবেশে কোথায় প্রাণের সৃষ্টি হয়েছে(সমুদ্রের তলদেশে নাকি শিলা-পলিমাটির আস্তরণের উপর), প্রাণের গাঠনিক উপাদান কি ছিল, এ সম্পর্কে জীববিজ্ঞানীদের মাঝে নানা-মাত্রায় মতভেদ এবং বিভিন্ন প্রস্তাবনা রয়েছে। এই সব প্রস্তাবনার অনেকগুলোই আদি প্রাণ সৃষ্টির সহায়ক হিসেবে বিবেচনার যোগ্য, তাই অন্য সব প্রস্তাবনা বাতিল করে নির্দিষ্ট করে কোন একটা বিশেষ তত্ত্বকে বেছে নেয়া যায়না। সবমিলিয়ে বলা যায়, সময়কাল সম্পর্কে মতৈক্য থাকলেও প্রাণের ঐতিহাসিক কারণের ব্যাপারে এখনও কোন মতৈক্য আসা যায়নি এবং সেটা এখনও যথেষ্ট ধোঁয়াশাময়। যেহেতু আমাদের কাছে সময় পরিভ্রমণের জন্য কোন টাইম মেশিন নেই, সম্ভাবনা আছে যে আমরা কোন নিশ্চিত হতে পারব না আদি প্রাণের ঠিকুজি সম্পর্কে।
২) প্রাণ সৃষ্টির ইতিহাস নিরপেক্ষ কারণের আলোচ্য বিষয় হল, ঠিক কেন এবং কি কারণে প্রাণের সৃষ্টি হল। একটা বলকে ছেড়ে দিলে যেমন সেটা অভিকর্ষের নিয়ম মেনে নিচের দিকে পড়ে, প্রাণ সৃষ্টির বেলায় তেমনভাবে জৈব রসায়নের কোন বিশেষ নিয়ম কাজ করছে কি না। এ নিয়েও বিজ্ঞানীমহলে মতভেদ রয়েছে। নোবেলবিজয়ী ফ্রেঞ্চ জীববিজ্ঞানী Jacques Monod তার সত্তুরের দশকে প্রকাশিত ‘Chance and necessity’ বইতে বলার চেষ্টা করেছিলেন , প্রাণের উৎপত্তির পেছনে পদার্থবিজ্ঞান বা রসায়নের কোন নিয়ম কাজ করছে না, মহাবিশ্ব তার গর্ভে ‘প্রাণ নিয়ে গর্ভবতী’ ছিল না। কসমসে প্রাণের আবির্ভাব কেবলই ‘কাকতালীয়’একটা ঘটনা। এরকম ঘটনা আরেকবার ঘটার সম্ভাবনা খুবই কম। আরেক নোবেল বিজয়ী প্রাণরয়ায়নবিদ Christian de Duve অবশ্য তার সাথে দ্বিমত পোষণ করে বলেছেন, পদার্থবিজ্ঞান এবং রয়ায়নের নিয়ম অনুসারেই প্রাণের উৎপত্তি অবশ্যভাম্বী ছিল। মহাবিশ্ব অবশ্যই তার গর্ভে প্রাণ নিয়ে গর্ভবতী ছিল, নাহলে আমরা এখানে থাকতাম না।
এই বইয়ে অবশ্য দ্বিতীয় মতবাদকেই সমর্থন করা হয়েছে। ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বে নিষ্প্রাণ যৌগ থেকে আদি প্রাণের সৃষ্টি এবং তারপর প্রাণের বিবর্তনকে দুটো আলাদা প্রক্রিয়া হিসেবে সাধারণত চিন্তা করা হয়। লেখক এই বইয়ে বলার চেষ্টা করেছেন, আদতে এই দুটো কোন আলাদা প্রক্রিয়া নয়, একটি নিরবছিন্ন প্রক্রিয়ার অংশ। প্রাণের সৃষ্টির পেছনে একটি ইতিহাস নিরপেক্ষ কারণ রয়েছে, যেমন ইতিহাসের সব সময়েই আপেল নিচে পড়ার কারণ ছিল অভিকর্ষ। রয়ায়নের নিয়মে উপযুক্ত পরিবেশে অবধারিতভাবেই প্রাণের সৃষ্টি অনিবার্য। লেখক দেখানোর চেষ্টা করেছেন, ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বকে আরও সাধারণভাবে ‘Chemical theory of matter’ এর ভেতরে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। আমরা যা যা দেখে ‘প্রাণ’ বলি, সেই প্রাণের সরলতম বৈশিষ্ট্যগুলো(রেপ্লিকেশন, মিউটেশন, কমপ্লেক্সিফিকেশন, সিলেকশন, ইভোলিউশন) কিছু প্রাণহীন অজৈব যৌগের মধ্যেও দেখা যায়। এই যৌগগুলো রয়ায়নের সাধারণ নিয়মের বাইরেও কিছু স্বতন্ত্র নিয়ম অনুসরণ করে, নিষ্প্রাণ হলেও এরা প্রাণকে অনেকটা ‘মিমিক’ করে। এই বিশেষ যৌগগুলো নিয়ে গবেষণার জন্য ‘সিস্টেম কেমিস্ট্রি’ রয়ায়নের একটি অপেক্ষাকৃত নবীন শাখা গড়ে উঠেছে। লেখক বলার চেষ্টা করেছেন, জীববিজ্ঞানকে আরও বড় পরিসরে সিস্টেম কেমিস্ট্রির অংশ হিসেবে চিন্তা করা যেতে পারে। এককথায়, লেখক জীববিজ্ঞান এবং রয়ায়নের মধ্যবর্তী দূরত্বকে মিলিয়ে দিতে চেয়েছেন।
আমরা প্রাণকে এখন পর্যন্ত কতটুকু বুঝি, আদতে আমাদের কৃত্রিম প্রাণ সৃষ্টির সম্ভাবনা এবং প্রতিকূলতা, এই বিষয়গুলো নিয়েও কিছুমাত্রায় আলোচনা করা হয়েছে।( ২০১০ সালের ক্রেইগ ভেন্টরের উদ্ভাবনকে আসলে টেকনিকালি ‘কৃত্রিম জীবন’ বলা ভুল হবে, ভেন্টর শুধুমাত্র জিনোম সিন্থেসিস করেছিলেন, পুরো কোষ নয়।) যারা প্রাণ সম্পর্কে জীববিজ্ঞানের সর্বাধুনিক ধারণাগুলো জানতে আগ্রহী, বইটা তাদের অনেক নতুন খোরাক দেবে।