নিজের চিন্তা করার অধিকারকে সংরক্ষণ কর। কারণ কিছু চিন্তা না করা থেকে ভুলভাবে চিন্তা করাও ভালো । মানুষ একটি সত্যের জন্য যতটা না লড়াই করে তার থেকে বেশি কুসংস্কারের জন্য করে। কারণ কুসংস্কার সবসময়েই অস্পৃশ্য এবং অসার, কিন্তু সত্য হচ্ছে আলাদা, আলাদা দৃষ্টিভঙ্গী । তাই এটি পরিবর্তনশীল। – হাইপেশিয়া
ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করলে আমরা দেখতে পারি, আধুনিক সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত সত্য উন্মোচনের পথকে রুদ্ধ করে রেখেছে ধর্ম। ধর্ম শুধুমাত্র সত্য উন্মোচনের পথে বাঁধাই প্রদান করেনি বরং যারাই সত্যকে উদ্ঘাটন করে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা করেছে, তাদের প্রাণ কেড়ে নেয়া হয়েছে, সহ্য করতে হয়েছে অমানবিক নির্যাতন। নিকোলাস কোপার্নিকাস, জর্দানো ব্রুনো, গ্যালিলিও, সক্রেটিস, আইনস্টাইন, লিসে মাইটনার-সহ আরও অসংখ্য বিজ্ঞানী তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এটি ধর্মের একটি নিকৃষ্ট ইতিহাস। শুধু তাই নয়, সে সময় নারীদেরকে প্রাপ্য মর্যাদা দেয়া তো দূরের কথা, মানুষ বলেই মূল্যায়ন করা হত না। ধর্ম আর পুরুষতান্ত্রিকতার প্রভাব যেন একই সুতোয় গাঁথা। মূদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। নারীদেরকে ভাবা হত নিচু জাতের প্রাণী। আসলে শুধু সে সময় নয়, আধুনিক যুগেও কতজনই বা নারীর অবদানকে স্বীকার করে নেন বা নিয়েছেন? অথচ সভ্যতার শুরু হয়েছিলো নারী পুরুষের যৌথ কাজের সমন্বয়ে। পুরুষের পাশাপাশি নারীও অবদান রেখেছে জ্ঞান, বিজ্ঞান, দর্শন, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান তথা বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায়। কিন্তু পুরুষত্বের বলে নারীদেরকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে চিরকাল। তকমা দেয়া হয়েছে দুর্বল, বুদ্ধিহীন বলে। এখন হয়ত জ্ঞান-বিজ্ঞানে নারীদের পদাচরণা বেশ কম, কিন্তু আপনি কয়েক হাজার বছর অতীতে গিয়ে ঘুরে আসুন। দেখবেন নারীদের অবদান কখনো কখনো পুরুষকেও ছড়িয়ে গিয়েছে। কিন্তু পুরুষ তাদের অবদান স্বীকার করেনি, কোথাও কোথাও তো কৃতিত্ব কেড়েও নিয়েছে শক্তি আর সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেখিয়ে। পুরুষ আর ধর্ম মিলে নারীদেরকে অবমাননা করেছে বারবার। সে কারণেই আমরা দেখতে পাই লিসে মাইটনার, রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন, মাদাম কুড়ি, লরা বেসি, সোফিয়া কোলেভাস্কা, লিস মিন্টার, ক্যারলিন হার্সেল, মেরি অ্যানি ল্যাভয়শিয়ে, লিজা রান্ডল, এরকম অসংখ্য নারী বিজ্ঞানীর অবিস্মরণীয় আবিষ্কার এবং কাজ থাকা স্বত্বেও তাদের অবদানকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে। এমনকি কখনো কখনো অনেকেরই প্রাপ্য নোবেল পুরষ্কার পর্যন্ত দেয়া হয়নি শুধু নারী হবার কারণে (যদিও পরবর্তী সময়ে নানা আলোচনা, সমালোচনার মুখে মাদাম কুরিকে নোবেল কমিটি নোবেল পুরষ্কার দিতে বাধ্য হয়েছিলো)। অটোম্যান স্ট্যানলি তার “মাদারস এন্ড ডটার অব ইনভেনশন” বইতে নারীর অবদান এবং তাদের প্রতি সমাজের অবহেলাকে তুলে ধরেছেন। দেখিয়েছেন, পুরুষ যাই কিছু করেছে, ইতিহাস তাকে যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ করে রেখেছে। আর নারীদের অবদানকে পাশ কাটিয়ে গেছে। এরকমই একজন অবহেলিত নারী বিজ্ঞানী সম্পর্কে আজ আমরা জানব। তিনি ছিলেন ইতিহাসের প্রথম এবং পূর্ণাঙ্গ নারী গণিতজ্ঞ এবং দার্শনিক। কিন্তু তাকে শিকার হতে হয়েছিল ধর্মীয় আক্রোশের আর পুরুষতান্ত্রিকতার। নাম তার হাইপেশিয়া।
প্রাথমিক পরিচিতি
আনুমানিক ৩৭০ খ্রিস্টাব্দে প্রাচীন মিশরের আলেক্সান্দ্রিয়া শহরে জন্মগ্রহণ করেন হাইপেশিয়া। পিতার নাম থিওন। থিওনও ছিলেন একজন গণিতজ্ঞ। কাজ করতেন আলেক্সান্দ্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক হিসবে। ছিলেন বিখ্যাত আলেক্সান্দ্রিয়া মিউজিয়ামের পরিচালকও। হাইপেশিয়ার মৌলিক শিক্ষা এবং বেড়ে ওঠার পিছনে তার পিতার ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। ধর্মীয় করালগ্রাস, পুরুষতান্ত্রিকতার চরম বর্বর যুগেও তার বাবা চেয়েছিলেন হাইপেশিয়া শুধুমাত্র নারী না হয়ে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হোক। বিজ্ঞানমনস্ক, দর্শন এবং যুক্তিসম্পন্ন একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠুক। অবশ্য তিনি পূর্ণাঙ্গ মানুষ তো হয়েছিলেনই, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন ইতিহাসের একজন বিখ্যাত গণিতজ্ঞ হিসেবেও। তার অসম্ভব মেধা, যুক্তি, বাগ্মীতা, আবিষ্কারের সাথে সৌন্দর্য মিশিয়ে হয়ে উঠেছিলেন ৪০০ সালের একজন শ্রেষ্ঠ নব্য প্লেটোবাদী দার্শনিক।
হাইপেশিয়ার গবেষণাকাল এবং বর্ণাঢ্য জীবনের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা
বাবার পরামর্শে বিভিন্ন বিষয়ে বাস্তব জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে হাইপেশিয়া বেড়িয়ে পড়েন পুরো রোমান সাম্রাজ্য ঘুরতে। রোমান সাম্রাজ্য ঘুরতে ঘুরতে তিনি চলে যান এথেন্সে। সেখানে গিয়ে গ্রিসের একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। এখানে হাইপেশিয়া প্রচুর জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। একসময় তার খ্যাতি গ্রিসকে ছাড়িয়ে আলেক্সান্দ্রিয়ায় পৌঁছায়। তখন তাকে আলেক্সান্দ্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের শিক্ষক হিসেবে অধ্যাপনার প্রস্তাব দেওয়া হয়। তিনি আলেক্সান্দ্রিয়ায় ফিরে আসেন এবং চাকরিটি নেন। বিখ্যাত গণিতবিদ দায়োফ্যান্তাস রচিত এরিথমেটিকা বইয়ের উপর তিনি ১৩ অধ্যায়ের একটি আলোচনা লিখেন যার কিছু অংশ পরবর্তীতে দায়োফ্যান্তাইন বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এছাড়া তিনি এপোলোনিয়াসের কৌণিক ছেঁদ এবং টলেমির জ্যোর্তিবিদ্যার কাজের উপর বেশ কিছু আলোচনা প্রকাশ করেন। বিখ্যাত স্যুডা বইটিও তার রচনা বলে অনেকর অভিমত আছে। বাবার সুবাদে আলেক্সান্দ্রিয়া মিউজিয়াম এবং লাইব্রেরিতে হাইপেশিয়ার প্রবেশাধিকার ছিল অবাধ। টলেমি, এরিস্টটল, প্লেটোর কাজের উপর তিনি লাইব্রেরির একটি কক্ষে আলোচনা করতেন নিয়মিত। তার আলোচনা শোনার জন্য দূর-দুরান্ত থেকে লোকজন ছুটে আসত। তখনকার সময়ে হাইপেশিয়ার বক্তব্য শুনতে হতো টাকা দিয়ে। তার মেধা যেমন ছিল অসাধারণ, তেমনি যুক্তিও ছিল সুস্পষ্ট। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি আলেক্সান্দ্রিয়ার শ্রেষ্ঠ নব্য প্লেটোবাদী দার্শনিক এবং গণিতজ্ঞ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। অনেকেই তার বক্তব্য শুনে এবং তার প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে একনিষ্ট অনুরাগী হিসেবে থেকেছেন আজীবন।
শিক্ষক হিসেবেও হাইপেশিয়া ছিলেন শ্রেষ্ঠ। সকল শিক্ষার্থীই তাকে ভালোবাসত। তার প্রিয় ছাত্রদের মধ্যে একজন ছিলেন সিরিনের সাইনেসিস। ইনি পরে টলেমাইস নামক অঞ্চলের বিশপ হয়েছিলেন। হাইপেশিয়ার মৃত্যুর পর তার অসংখ্য কর্মের প্রমাণ পাওয়া যায় এই সিরিনের লেখা চিঠিপত্র থেকে। জ্যামিতির কালজয়ী গ্রন্থ “ইউক্লিডস এলিমেন্ট” (Euclidas element)-এর নতুন সংস্করণ তৈরিতেও বাবাকে সহায়তা করেছেন হাইপেশিয়া। এছাড়া বাবার সাথে যৌথভাবে টলেমির “আলমাগসেত” (Almagset) গ্রন্থের উপর কাজ করেছেন। শুধুমাত্র গণিত, দর্শন কিংবা জ্যোর্তিবিদ্যার উপর গবেষণা, কাজ ও আলোচনা ছাড়াও তিনি বিজ্ঞানের অন্যন্য শাখাতেও অবদান রেখেছেন। তিনি একটি অ্যাস্ট্রোল্যাব (যা দিয়ে মহাজাগতিক নানা সমস্যার সমাধান এবং গ্রহ, নক্ষত্রের ঘূর্ণন নির্ণয়ে কাজ করা হত) এবং একটি হাইড্রোস্কোপ (যা দিয়ে তরল পদার্থের আপেক্ষিক গুরুত্ব পরিমাপ করা যেত) আবিষ্কার করেন। হাইপেশিয়ার কর্মে মুগ্ধ হয়ে মার্গারেট এলিক তার “Hypathia’s heritage” গ্রন্থে হাইপেশিয়াকে বর্ণনা করেছেন মাদাম কুরির পূর্ববর্তী সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং শ্রেষ্ঠ নারী বিজ্ঞানী হিসেবে। আবার অন্য একটি প্রবন্ধে (Women and Technology in Ancient Alexandria : Maria and Hypatia) মার্গারেট এলিক বলেছেন,
“Hypatia was a scholarly pagan and a woman, an espouser for Greek scientific rationalism and an influential political figure. This proved to be a dangerous combination.”
৪০০ সালে হাইপেশিয়াই প্রথম সকল প্রকার ধর্মীয় কুসংস্কার এবং কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বিজ্ঞানকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। বিজ্ঞানকে আলাদা করেছিলেন ধর্ম থেকে, প্রতিকায়িত করেছিলেন নতুন এক সংজ্ঞায়। একারণে লেখক জন উইলিয়াম ড্র্যাপার বলেছিলেন,
“হাইপেশিয়া ছিলেন ধর্মের বিপরীতে বিজ্ঞানের নিবিড় সমর্থক।”
হাইপেশিয়া মনে করতেন, ধর্ম সেটাই যা সত্যকে আবিষ্কার করে; যা মানুষকে সত্যিকারের বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিনির্ভর করে তোলে এবং বিজ্ঞানকে প্রতিষ্ঠিত করে। হাইপেশিয়া তার এক শিষ্যকে বাইবেল সম্পর্ক বলেছেন,
“আমি খ্রিস্টান নই, কিন্তু বাইবেলের প্রাচীন এবং দুটো খণ্ডই আমি পড়েছি। আব্রাহাম ইয়াকুব ইউসুফ ধর্মই বল আর, যীশু খ্রিস্টের ধর্মই বল অহংকার না করেও আমি বলতে পারি ও দুটির মর্মই আমি উপলব্ধি করেছি । বিশ্বাসের কথা, ইশ্বরের প্রেমের বাণী ও দুটিতে আছে ঢের কিন্তু দার্শনিকের দৃষ্টিতে ওসব বাকসুলভ উচ্ছ্বাস ছাড়া আর কিছুই নয়। পরিণত বুদ্ধির জাতির জন্য থাকা উচিত যুক্তিনির্ভর জ্ঞানভিত্তিক ধর্ম একটা, যা ছিল গ্রিকদের। যার পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংকল্প নিয়ে আমি যথাসাধ্য কাজ করে যাচ্ছি আলেক্সান্দ্রিয়ায় বসে”
একই কথা অন্যরকমভাবে বলেছেন আরেকটি জায়গায়,
“রূপকথাকে রূপকথা হিসেবে, পুরাণকে পুরাণ হিসেবে এবং অলৌকিকতাকে অলৌকিকতা হিসেবেই শেখানো উচিত। কারণ শিশুর মন সেগুলো বিশ্বাস করে নেয় এবং পরবর্তীতে কোন বড় আঘাত বা দূর্ঘটনাই সেগুলো মন থেকে মুছতে পারে ”
হাইপেশিয়া তার শিক্ষার্থীদেরকে দায়োফ্যান্তাস, এরিথমেটিকা শেখাতেন। টলেমি, প্লেটোর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাদের সাথে আলোচনা করতেন। হাইপেশিয়া মূলত শিক্ষার্থীদের মাঝে বাস্তব শিক্ষার বুনিয়াদ গঠনের উপর বেশি করে গুরুত্বারোপ করেছিলেন। বিদূষী এই নারী শুধু গুণেই নয় রূপেও ছিলেন অসম্ভব সুন্দরী। তার রূপে, গুণে, কাজে মুগ্ধ হয়ে অনেকেই চেয়েছেন হাইপেশিয়াকে জীবনসঙ্গী করতে। কিন্তু এ যে আফ্রোদিতির দেহে প্লেটোর আত্মা, জুনোর মত জ্ঞানময়ী, মিনার্ভার মত মর্যাদাময়ী। তার দরকার জ্ঞান সাধনা, সত্যকে অনুসন্ধান, আহরণ এবং পরিশেষে তা সকলের মাঝে বিলিয়ে দেয়া। তার যেন ব্যাঘাত না ঘটে কিছুতেই। আর সে কারণে তিনি সকল প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন বিবাহ নামক জঞ্জাল থেকে।
ধর্মীয় করালগ্রাস, নিকৃষ্ট রাজনীতি এবং হাইপেশিয়ার মৃত্যু
হাইপেশিয়ার মৃত্যু ছিল নিকৃষ্ট ধর্মীয় রাজনীতির ফল। এটি ইতিহাসের নিকৃষ্ট হত্যাকাণ্ডগুলোর মধ্যে একটি, যে হত্যাকাণ্ডের লোমহর্ষক বর্ণনা শুনলে শরীরের স্নায়ুতন্ত্র অবশ হয়ে যায়।
তখন সবেমাত্র খ্রিস্টানরা আলেক্সান্দ্রিয়ায় আধিপত্য বিস্তার শুরু করেছে। তারা নানাভাবে প্যাগান, ইহুদিদের উপর নির্যাতন এবং জুলুম করছে। হাইপেশিয়াও ছিলেন একজন প্যাগান। ঘটনার শুরু হয়েছিলো ৩৮০ সালের শুরু দিকে। সম্রাট থিওডোসিয়াস তখন প্যাগানবাদ এবং অরিয়ানবাদের বিরুদ্ধে অসহিষ্ণু নীতি চালু করেছেন। রীতিমত যুদ্ধ ঘোষণা করার মত। তিনি ৩৮৯ সাল থেকে ৩৯২ সাল পর্যন্ত পূর্ব রোমান অঞ্চল এবং পরবর্তীতে ৩৯৫ সাল পর্যন্ত পূর্ব এবং পশ্চিম উভয় অঞ্চল শাসন করেন। ৩৯১ সালে তিনি আলেক্সান্দ্রিয়ার বিশপ থিওফিলাসের এক চিঠির জবাবে মিশরের সমস্ত ধর্মীয় স্থান ধ্বংস করে দেয়ার আদেশ জারি করেন। উন্মাদ খ্রিস্টানের দল এক এক করে ধ্বংস করতে শুরু করে সব। পরবর্তীতে ৩৯৩ সালে আইনসভায় এক আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এই ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধ করলে বেশ কিছুদিন শান্তিতে বসবাস করে মিশরের জনগণ। ৪১২ সালে আবার আলেক্সান্দ্রিয়ার নতুন বিশপ বা পেট্রিয়ার্ক হিসেবে আসেন সিরিল। সিরিল আসার পর আবার নতুন করে শুরু হয় ধ্বংসযজ্ঞ। সিরিলের ধ্বংসযজ্ঞ যেন আরও ভয়ংকর, আরও কঠিন। সিরিল হাইপেশিয়াকে পছন্দ করতেন না কখনোই। মূলত হাইপেশিয়ার দর্শন, বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তি এবং বক্তৃতাকে তিনি সবসময় ভয় পেতেন। তিনি ভাবতেন, সামান্য এক মহিলা একাই পুরো আলেক্সান্দ্রিয়ায় খ্রিস্টধর্মের ভীত কাঁপিয়ে দিচ্ছেন।
সিরিলের অনুসারীদেরকেও হাইপেশিয়া আকৃষ্ট করতেন তার যুক্তিবোধ দিয়ে। সিরিল ভাবলেন, এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে তার খ্রিস্টধর্ম প্রচারে ব্যাঘাত ঘটবে। ধর্ম পরাজিত হবে এই নারী এবং বিজ্ঞানের কাছে। চার্লস কিংসলের উপন্যাস (Hypatia and or the new foes with an old face (1853)) থেকে জানা যায়, বিশপ সিরিল খ্রিস্টান ধর্মানুরাগী তরুণদের হাইপেশিয়ার বক্তব্য শুনতে যেতে নিষেধ করতেন। তার ভয় হত, হাইপেশিয়ার প্রবল ব্যক্তিত্ব আর তীক্ষ্ম যুক্তির কাছে খ্রিস্টধর্মের দার্শনিক ভিত্তির দূর্বলতা প্রকাশিত হয়ে যাবে। কিংসলে তার উপন্যাসে এরকম একজন তরুণের উদাহরণও দিয়েছেন। তরুণের নাম ফিলামন। একজন খ্রিস্টান সন্ন্যাসী। কোনো একদিন তিনি হাইপেশিয়ার বক্তৃতা শুনতে যাবার ইচ্ছে দেখালে সিরিল তাকে নিষেধ করেন। বলেন, “হাইপেশিয়া সাপের থেকেও ধূর্ত এবং সব ধরনের চালাকিতে পটু এক মহিলা। তুমি যদি ওখানে যাও তবে নিজেকে ঠাট্টার পাত্র মনে হবে আর লজ্জায় পালিয়ে আসবে।” অবশ্য সিরিলের নিষেধকে উপেক্ষা করে ফিলামন গিয়েছিলেন হাইপেশিয়ার সভায়। বক্তৃতা শুনতে নয়, বরং ধর্ম দিয়ে হাইপেশিয়াকে বধ করতে। অবশেষে নিজেই বধ হয়েছিলেন হাইপেশিয়ার যুক্তি, জ্ঞান, দর্শন আর বিজ্ঞানের কাছে। শেষ পর্যন্ত হাইপেশিয়ার একজন অনুরাগী হয়ে ছিলেন হাইপেশিয়ার মৃত্যু পর্যন্ত। হাইপেশিয়ার এই জনপ্রিয়তা কোনভাবেই মেনে নিতে পারেননি বিশপ সিরিল। এছাড়া আলেক্সান্দ্রিয়ার নগর পিতা অরিস্টিসের সাথে হাইপেশিয়ার ছিল গভীর বন্ধুত্ব। হাইপেশিয়ার বুদ্ধিমত্ত্বায় এতই আপ্লুত ছিলেন অরিস্টিস যে, কোনো সিদ্ধান্ত তিনি একা নিতেন না। কোনো কাজ হাইপেশিয়াকে না জানিয়ে করতেনও না।
অন্যদিকে অরিস্টিসের সাথে সিরিলের ছিল শত্রুতার সম্পর্ক। অনেকেই হাইপেশিয়ার সাথে অরিস্টিসের এই সম্পর্ককে বিশপের আক্রোশের আরেকটি কারণ বলে মনে করেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে হাইপেশিয়ার বীর বেশে প্রবেশ এবং অবস্থান, প্রকাশ্যে নব্য প্লেটনিজম প্রচার, খ্রিস্টধর্মের অসারতা নিয়ে আলোচনা, প্রত্যেক মানুষকে যুক্তিনির্ভর এবং স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে আগ্রহ প্রদান – এসবই কাল হয়ে দাঁড়াল মহামতী এই নারীর। অবশেষে উন্মত্ত বিশপ হাইপেশিয়াকে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় দেবার পরিকল্পনা করেন। যদিও তিনি সরাসরি হত্যা করেননি, বরং তার অনুসারীদের দিয়ে করিয়েছেন বলে প্রচলিত আছে। সক্রেটিসের স্কলাসটিকা থেকে হাইপেশিয়ার মৃত্যুর এরকম একটি বর্ণণা পাওয়া যায়,
“পিটার নামে এক আক্রোশী ব্যাক্তি অনেক দিন ধরেই তক্কে, তক্কে ছিলো, অবশেষে সে হাইপেশিয়াকে কোন এক জায়গা থেকে ফিরবার পথে কব্জা করে ফেলে । সে তার দলবল নিয়ে হাইপেশিয়াকে তার ঘোরার গাড়ী থেকে টেনে হিচড়ে, কেসারিয়াম নামের একটি চার্চে নিয়ে যান। সেখানে তারা হাইপেশিয়ার কাপড়-চোপড় খুলে একেবারে নগ্ন করে ফেলে। তারপর ধারালো অস্ত্রের সাহায্যে তার চামড়া চেছে ফেলে, তার শরীরের মাংস চিড়ে ফেলে, আর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগ পর্যন্ত হাইপেশিয়ার উপড় তাদের অকথ্য অত্যাচার চলতে থাকে। এখানেই শেষ নয়, মরে যাবার পর হাইপেশিয়ার মৃতদেহ টুকরো, টুকরো করে সিনারন নামের একটি জায়গায় জড় করা হয়, আর তারপর তা পুড়িয়ে ছাই করে দেয়া হয়।”
সারাহ জেইলিন্সকি নামক একজন লেখক লিখেছেন,
“৪১৫, কিংবা ৪১৬ সালের একদিন মিশরের আলেক্সান্দ্রিয়া শহরের রাস্তায় পিটার দ্যা লেকটরের নেতৃত্বে খ্রিস্টান চরমপন্থীদের একটি দল একজন নারীকে বহনকারী একটি ঘোরার গাড়ি ঘিরে ফেলে । এবং তাকে টেনে হিঁচড়ে বের করে একটি গির্জায় নিয়ে তোলে। সেখানে তারা তাকে উলঙ্গ করে মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তার দিকে ছাদের টালি নিক্ষেপ করে।”
কি বীভৎস সে মৃত্যু! কি ভয়ানক সে পুরুষতান্ত্রিকতার অহংকার! এ যেন শুধু একটি মৃত্যু নয়, একটি যুগের অবসান। বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত থেকে জানা যায়, হাইপেশিয়ার মৃত্যুর পর পুরো ইউরোপ থমকে দাঁড়ায়। নিভে যায় বিজ্ঞান আর দর্শনের আলো। কম করে হলেও পরবর্তী ১০০০ বছর বিজ্ঞানের কোন অগ্রগ্রতি হয়নি। ধর্মীয় কূপমণ্ডূকতা আর কুসংস্কারের অবাধ চর্চা হয়েছে এসময়। ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিল আলেক্সান্দ্রিয়ার জ্ঞানচর্চার পবিত্র স্থান – আলেক্সান্দ্রিয়ার লাইব্রেরি আর জাদুঘর। পুড়িয়ে ফেলা হয় সমস্ত বই, তথ্য এবং উপাত্ত। অবশ্য থিওনের কিছু বই উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিলো। তারপর বহু বছর পেরিয়ে গেছে। হাইপেশিয়াকে ভুলে গেছে সকলেই, ভুলে গেছে তার অবদান। এমন এক সংকটকালে, ১৭২০ সালের কোনো এক দিনে আগন্তুকের মত এসে পড়েন জন টোনাল্ড নামক একজন লেখক। তিনি “Hypatia or the History of a most beautiful, most virtuous, most learned and in every way accomplished lady; who was torn to pieces by the clergy of Alexandria to gratify the pride, emulation and cruelty of the archbishop commonly but undeservedly titled St Cyril” নামক একটি শিরোনামে হাইপেশিয়াকে তুলে নিয়ে আসেন ডুবে যাওয়া সেই অন্ধকার সাগরের অতল গহ্বর থেকে।
টোনাল্ড বলেন, সেইন্ট বা সন্ত নামধারী পুরুষতন্ত্রে দীক্ষিত এক বিশপ ছিলেন এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা, আর শিষ্যরা ছিলেন তাদের গুরুর জিঘাংসা চরিতার্থ করার নিয়ামক। ভলতেয়ার তার “Examen Important De Milord Bolingbroke Ou Le Tombeau Du Fanatisme (১৭৩৬)” বইয়ে লিখেছেন এই পাশবিক হত্যাকাণ্ড পরিচালিত হয় সিরিলের মাথা মুড়ানো ভিক্ষু হিসেবে খ্যাত কতগুলোর ডালকুত্তার সাহচর্যে, আর উগ্র গোড়া ধর্মবাদীদের আস্ফালনে। পরবর্তীতে অবশ্য হাইপেশিয়ার যথাযথ মর্যাদা, তার কাজের গুরুত্ব এবং ইতিহাসে তার প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরে লেখালেখি হয়েছে বিস্তর। যদিও বা বাংলাতে তার তেমন কিছুই হয়নি। বার্ট্রান্ড রাসেল (হিস্ট্রি অব ওয়েস্টার্ন ফিলোসফি), এন্তারের এডওয়ার্ড গিবন (দ্যা ডিক্লায়েশন এন্ড ফল অব রোমান এম্পায়ার), দামাস্কিউয়াস (সুদা), হেনরি ফিল্ডিং (আ জার্নি ফ্রম দিস ওয়ার্ল্ড, টু দ্যা নেক্সট), চার্লস লিকন্ড দ্যা লিসল (Hypatie: Hypatie et Cyrille) লিখেছেন নাটক, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস। তার স্মরণে এখনো দুটি বিখ্যাত গবেষণা সাময়িকী প্রকাশিত হয়। একটি “হাইপেশিয়াঃ ফেমিনিস স্টাডিস”, অপরটি “এ জার্নাল অব ফেমিনিস্ট ফিলোসফি”। ২০০৯ সালে হাইপেশিয়ার জীবন ও কাজ নিয়ে এগোরা নামক একটি স্প্যানিশ চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিলো যা কিনা ১৩ টি গয়া পুরষ্কারের জন্য মনোনীত হয়ে ৭ টি জিতে নিয়েছিল।
একজন মানুষ কিংবা নির্দিষ্ট আদর্শের অনুসারী কাউকে হত্যা করা যায় হয়তো, কিন্তু আদর্শ আর চেতনা? তাকে কখনো হত্যা করা যায় কি? হত্যা করা গেছে কখনো? ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন হাইপেশিয়া সহ সকল অবহেলিত এবং নির্যাতিত বিজ্ঞানী। আবার নতুন করে, নতুন বিশ্বে লেখায় লেখায় উঠে আসবে অমলিন সে নারী বিজ্ঞানীদের কথা।
তথ্যসূত্রঃ
১। হাইপেশিয়া,
২। আলেকজান্দ্রিয়ার হাইপেশিয়া ।
৩ । হাইপেশিয়া মানব মুক্তির দিশারী ।
৪। হাইপেশিয়া: এক বিস্মৃতপ্রায় গনিতজ্ঞ ।
৫। আলেকজান্দ্রিয়ার মহান নারী দার্শনিক।