যারা শীতপ্রবণ দেশে বসবাস করেন, তাদের জন্য শীতকাল বড়ই কঠিন সময়। কাদা-জল-বৃষ্টির আর্দ্র বাংলাদেশ থেকে এসেই দেখতে হয় রুক্ষ শুষ্ক শীতের শীতল ফণা। এর সাথে যুক্ত হয় তুষারপাত আর পা-ডোবানো বরফ – যা কখনো সাদা পাউডারের মতোন গুঁড়োগুঁড়ো নরম আর কখনো কালো গ্রানাইট পাথরের মতো শক্ত! নরম বরফে তবু হাঁটা-চলা করা যায়, কিন্তু অল্প রোদে সে বরফের উপরটা একটু গলে যখন ঠাণ্ডা বাতাসে আবার জমে যায়, তখন তা হয় ভয়ঙ্কর পিচ্ছিল আর মসৃণ। হাঁটতে গিয়ে আছাড় খেলে হাত-পা ভাঙার সম্ভাবনা থাকে।
এই বরফ যখন গাড়ির কাঁচের ওপরে জমে, তখন তা ওঠানো কী পরিমাণ ঝামেলার কাজ তা সহজেই অনুমেয়। একে তো শক্ত, বাড়ি দিলে কাঁচসহ ভেঙে যেতে পারে। তাও আবার অস্বচ্ছ। তাই বরফশুদ্ধ গাড়ি চালাতেও পারবেন না! অনেকেই একটা মারাত্মক ভুল করেন। গরম পানি ঢেলে এই বরফ গলাতে চেষ্টা করেন। এটা একেবারেই ভুল উপায়। গরম পানির আঁচে বরফ অল্পই গলে, উল্টো ঠাণ্ডা বাতাসে সেই গরম পানিটুকুও জমে বরফ হয়ে যায়। অনেকে হয়তো খেয়াল করেন না যে বাইরের তাপমাত্রা তখনো শূন্যের নিচে। তাই জ্যাকেট গ্লাভস পরে নাক-মুখ ঢেকে একটা প্লাস্টিকের ছোট বেলচা দিয়ে ঘষে ঘষে এই বরফ ‘ভাঙতে’ হয়।
বেশ সময় ও শ্রমসাধ্য কাজ। তবে বিজ্ঞান এত মজার, যে এই কাজটাকেও সহজ করে দিয়েছে। খুব অল্প খরচে আপনি নিজেই একটি দ্রবণ বানিয়ে নিতে পারবেন, যা কাঁচের ওপর ছিটিয়ে দিলে মুহূর্তেই বরফ গলে স্বচ্ছ পানি হয়ে গড়িয়ে পড়বে! সেই দ্রবণ বানানোর উপায় বলছি। আর দ্রবণটি কোন জাদুতে এই শক্ত বরফ গলিয়ে দেয় সেটাও বলছি।
২
এই দ্রবণটির ইংরেজি নাম Rubbing Alcohol। এটি মূলত জীবাণুনাশক হিসেবে ব্যবহার করি আমরা। কোনখানে কেটে বা ছড়ে গেলে অল্প রাবিং এলকোহল পানিতে মিশিয়ে সে স্থানে দিতে হয়। এর রাসায়নিক নাম আইসোপ্রোপাইল এলকোহল বা ২-প্রোপানল। এটা আসলে ইথানলের একটি পরিবর্তিত রূপ। ইথানল বা ইথাইল এলকোহল সম্পর্কে বিজ্ঞান বিভাগের সবাই বেশ পরিচিত। বিজ্ঞানে না পড়লেও ইথানলকে আপনি চিনবেন, মূলত পানীয় মদের সবগুলোই ইথানলের নানান মাত্রার দ্রবণ। এছাড়াও বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় এই এলকোহল প্রচুর পরিমাণে ব্যবহৃত হয়। এর রাসায়নিক সঙ্কেত হলো C2H6O বা C2H5OH বা CH3CH2OH। রাসায়নিক সঙ্কেতে আসলে পদার্থটি কোন কোন মৌলিক পদার্থ দিয়ে তৈরি, সেটার কয়টা পরমাণু আছে ইত্যাদি তথ্য থাকে। যেমন ইথানলের সঙ্কেত দেখে আমরা জানতে পারি যে এতে দুইটি কার্বন, ছয়টি হাইড্রোজেন ও একটি অক্সিজেন পরমাণু আছে। পরমাণুগুলোর বিন্যাস সহজে বোঝার জন্য একই সঙ্কেতকে বিভিন্নভাবে লেখা যায়। নিচের ছবিতে বামের অণুটি দেখুন, ইথানলের পরমাণুগুলো কীভাবে যুক্ত থাকে সেটা দেখানো হয়েছে (ছবি ৩)। ছবিতে একটি হাইড্রোজেন পরমাণুকে লাল বৃত্ত দিয়ে দেখিয়েছি। রাবিং এলকোহলে এই হাইড্রোজেনের জায়গায় একটা ‘এলকাইল’ (CH3) যুক্ত হয়। অর্থাৎ রাবিং এলকোহলের সঙ্কেত হলো C3H8O বা C3H7OH। নিচের ছবির বাম দিকের অণুটা রাবিং এলকোহল। উপরে যে ছবিটি দেয়া হয়েছে (ছবি ২), সেটা এই অণুরই ত্রিমাত্রিক চেহারা। কালোটুকু কার্বন, সাদা পরমাণুগুলো হাইড্রোজেন, আর লাল পরমাণুটি অক্সিজেন। সুন্দর না?
৩
গঠন-টঠন না হয় বুঝলাম। কিন্তু এটা বরফ কীভাবে গলায়? এটা আসলে গলনাঙ্কের সাথে সম্পর্কিত। বিশুদ্ধ রাবিং এলকোহলের গলনাঙ্ক হলো -৮৯°সেলসিয়াস। পানি জমে বরফ হয় ০°সেলসিয়াসে। আমরা যে তাপমাত্রার কথা বলছি, তা হয় শূন্যের কয়েক ডিগ্রি নিচের তাপমাত্রা, যেমন -১০°সে. থেকে -৫০°সে.। খেয়াল করুন, এই তাপমাত্রায় পানি কঠিন পদার্থ (বরফ), কিন্তু রাবিং এলকোহল তরল অবস্থায় থাকে। ম্যাজিকটা ঘটে, যখন আপনি রাবিং এলকোহলের সাথে পানি মিশিয়ে এর লঘু দ্রবণ তৈরি করবেন। সাধারণত দুই-তৃতীয়াংশ বা তিন-চতুর্থাংশ রাবিং এলকোহলের মধ্যে বাকি অংশটুকু পানি দিয়ে দ্রবণটি তৈরি করা হয়। রাবিং এলকোহলের অণুগুলো দ্রবণে পানির অণুর সাথে মিশে এর গলনাঙ্ককে মূলত নামিয়ে নিয়ে আসে। ইংরেজিতে এই ‘ম্যাজিক’-এর নাম melting-point depression। রাবিং এলকোহলের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে গলনাঙ্ক -১০°সে. থেকে -৫০°সে.-এর ভেতরের কোনো মান হয়ে থাকে।
এই দ্রবণটাকে বরফের ওপর ছিটানো হলে বরফের অণুগুলোকেও সেটা সাথে নিয়ে নেয়। সাথে সাথে ‘বরফ’ অংশের গলনাঙ্ক শূন্য থেকে নেমে আসে, আর গলনাঙ্ক কমা মানেই পদার্থ কঠিন থেকে তরলে পরিণত হওয়া। তারপর ন্যাকড়া দিয়েই মুছুন, আর ওয়াইপার চালিয়েই মুছুন, কাঁচ একেবারে বরফমুক্ত!
[বিভিন্ন দোকানে প্রস্তুতকৃত বরফ গলানোর দ্রবণ পাওয়া যায়, একে বলে ‘de-icer’। কিন্তু সেগুলোর চেয়ে রাবিং এলকোহলের দাম খুবই কম। খামোখা টাকাগুলো অমন ‘কমার্শিয়াল’ রাসায়নিকে খরচ না করে নিজেই ‘বরফ-হন্তা’ বানিয়ে নিতে পারেন কম খরচে। বিজ্ঞানের মজাটা সাথে বোনাস!]