ইমিউন সিস্টেমঃ একটি পারিবারিক চলচ্চিত্র

মানুষের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার কাজ করার কৌশল বেশ চটকদার। আমাদের দেহের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য হলো, দেহ নিজের বিপদ আঁচ করতে পারে। চোখের ঠিক সামনে কেউ তুড়ি বাজালে নিজ থেকেই চোখের পলক পড়বে বা চোখ বন্ধ হবে। কেন এমনটা হয়? কারণ, চোখ নিজের বিপদ আঁচ করতে পারে। ঠিক তেমনি দেহও নিজের বিপদ আঁচ করতে পারে এবং নিজের সুরক্ষার জন্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে। তাহলে, এই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ব্যাপারটি আসলে কীভাবে ঘটে? কীভাবে আমাদের দেহ কোনো ভাইরাস থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলে? ইমিউন সিস্টেম নিয়ে পড়তে গিয়ে নিজে নিজে একটি পারিবারিক সিনেমা বানিয়ে ফেলেছি। শুধু তাই না, এখনো ফ্যাগোসাইট উচ্চারণ করলে চোখের সামনে নায়ক জসিমের ছবি ভাসছে। যাই হোক, সিনেমার একটি দৃশ্য ফেবুতে পোস্ট দেয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না।
body defense

body defense

প্রথমত, আমাদের জানা উচিৎ – প্যাথোজেন কী?
উত্তরঃ বিভিন্ন মাইক্রোব, যেমন – ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া, ইউক্যারিয়োটিক প্যারাসাইট, এমনকি ছত্রাক। এসব যদি আমাদের দেহে প্রবেশ করে, তাহলে আমাদের অসুস্থ করতে পারে।
এখান জেনে রাখা দরকার, আমাদের দেহে মূলতঃ দুটো দেয়াল রয়েছে এইসব প্যাথোজেন থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য। অর্থাৎ প্যাথোজেন হচ্ছে আমাদের আসন্ন পারিবারিক চলচ্চিত্রের ভিলেন।
প্রথম দেয়ালের কাজ হলো, এসব প্যাথোজেনকে দূরে রাখা। আমাদের ত্বক এবং মিউকাস মেমব্রেন এমনকি পাকস্থলীর এসিডও এই প্রথম দেয়ালের তালিকায় পড়ে। হয়তো বলবেন, পাকস্থলী শরীরের ভেতরে থেকে কীভাবে বাইরের দেয়াল গড়ে? আসলে আমাদের মেরুদণ্ডী প্রাণীর ক্ষেত্রে পাকস্থলী, বিশেষ করে আমাদের ডাইজেস্টিভ সিস্টেম (পাচন তন্ত্র) আমাদের দেহের বাইরের অংশ (এই ব্যাপারে অন্য সময় আলোচনা করবো)। এখন কথা হচ্ছে, এইসব বাইরের দেয়াল টপকে মাঝে মাঝেই আমাদের দেহের ভিতরে প্যাথোজেন ঢুকে পড়ে। তাই নিরাপত্তার প্রথম দেয়ালের ভিতরে রয়েছে আরেকটি দেয়াল।
আমাদের কোথাও কেটে গেলে বা ব্যথা পেলে জায়গাটা ফুলে যায়, কিংবা গরম হয়, বা ব্যথা হয়। এ ঘটনাটা ঘটে Inflammatory Response-এর কারণে। আমরা ব্যথা পেলে বলি না যে, “খুব জ্বলছে”? খেয়াল করুন, ইন-ফ্লেম-(in flame)-এটরি-রেস্পন্স।
যখন আমাদের দেহের কোনো কোষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়, তা থেকে কিছু রাসায়নিক পদার্থের নিঃসরণ ঘটে। এই রাসায়নিক পদার্থ শুধুমাত্র নিঃসৃত হয়েই শেষ হয় না, রক্তপ্রবাহে গিয়ে মারদাঙ্গা বড় ভাইকে ডেকে আনে (এই প্রক্রিয়াটার বর্ণনায় আপাতত গেলাম না)। এই মারদাঙ্গা বড় ভাই হলো – ফ্যাগোসাইট। ফ্যাগোসাইট যখন দেখে, প্যাথোজেন দেহের বাইরে থেকে এসে ছোট বোনকে উৎপাত করছে, তখন দ্বিতীয় কোনো চিন্তা না করে তারা প্যাথোজেনকে গিলে ফেলে। কথাটি কিন্তু রূপক অর্থে না, সত্যি সত্যিই কিছু ফ্যাগোসাইট প্যাথোজেনদের গিলে ফেলে।
ফ্যাগোসাইট কোনো প্যাথোজেনকে গিলে ফেলার আগে কখনো তার পরিচয় জানতে চায় না। আসলে প্যাথোজেন কি ভাইরাস, নাকি প্রোটিন, নাকি অন্য কিছু, সে ব্যাপারে ফ্যাগোসাইটের মোটেও যায় আসে না। এখন, বড় ভাই তো রাগের মাথায় বখাটে প্যাথোজেনকে গিলে ফেললো। আবার যদি ওসব বখাটে আসে, কীভাবে বোঝা যাবে যে ওরা বখাটে? পরিচয়-ঠিকানা তো কিছুই নাই!
বড় ভাইয়ের মাথা একটু ঠাণ্ডা হলে সে এই ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করলো। ততক্ষণে কিন্তু প্যাথোজেন পুরোপুরি ভেঙ্গে টুকরা টুকরা হয়ে গেছে। এই টুকরোগুলো প্রোটিনের টুকরো – পেপটাইড। আমরা যখন প্রোটিন বলি, তখন আসলে বিশাল এমিনো এসিডের চেইনকে বোঝাই। পেপটাইড হলো এমিনো এসিডের ছোট চেইন।
শাস্তি পেয়ে পেপটাইডগুলোর ভেতরে কয়েকজনের টনক নড়লো। তারা বললো, তারা ভালো হয়ে যাবে। ফ্যাগোসাইটও ভাবলো, এদেরকে কাজে লাগানো যেতে পারে। তাই সে পেপটাইড টুকরোদেরকে নিয়ে জোড়া লাগালো এক ধরনের প্রোটিনের সাথে। বেশ গালভরা নাম আছে এই প্রোটিনটির – মেজর হিস্টোকমপ্যাটাবিলিটি কমপ্লেক্স টাইপ-২ (major histocompatibility complex বা সংক্ষেপে MHC)। তো, আমাদের বড় ভাই ফ্যাগোসাইট এরপর এই পেপটাইড দলকে এন্টিজেন (Antigen) নাম দিয়ে নিজের দলে রাখলো।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এতক্ষণ বড় ভাই মারলো যে প্যাথোজেনকে; সেটা এখন এন্টিজেন হল কীভাবে? আসলে এদেরকে আপাতত এন্টিজেন না বলে প্রোটিনের অংশ, বা পেপটাইড হিসেবে পরিচয় দেয়া যায়। এরা পরবর্তীতে রোগ প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে; যেটা ভেবেই আমাদের বড় ভাই এদেরকে নিজ দলে রেখেছে।

Comments

আপনার আরো পছন্দ হতে পারে...

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
জানান আমাকে যখন আসবে -
guest
2 Comments
সবচেয়ে পুরাতন
সবচেয়ে নতুন সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত
Inline Feedbacks
View all comments
সুজন
সুজন
8 বছর পূর্বে

এই লেখটির কি সামনে আরো কোন পর্ব আসবে?

2
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x