টুথব্রাশ আর টুথপেস্টঃ দাঁত মাজুনির সাজ সরঞ্জাম এলো কীভাবে?

সেদিন দাঁত মাজতে মাজতে হঠাৎ মাথায় প্রশ্ন এলো, কে-কবে-কীভাবে দাঁত মাজার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলো? টুথব্রাশের আইডিয়া কার মাথা থেকে বেরিয়েছিলো? প্রথম টুথপেস্টই বা কী দিয়ে তৈরি হয়েছিলো? আসলে দাঁত মাজার ব্যাপারটা এতটাই অভ্যাসবশত (নাকি অবচেতনভাবে?) করি যে, এই বিষয়ে কোনো কৌতূহল তেমনভাবে জাগেনি। কিন্তু টেলিস্কোপ দিয়ে বৃহস্পতি দেখে ফেললাম, অথচ দাঁত মাজার মতো প্রয়োজনীয় বিষয়ে কিছুই জানি না, তা তো হতে পারে না! দাঁতের যত্ন নেওয়ার অভ্যাসটা কিন্তু আধুনিক মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনতা থেকে আসেনি। প্রাচীন রোমান যুগেও সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোকেরা বিশেষভাবে দক্ষ ভৃত্যদের চাকরি দিতো শুধুমাত্র তাদের দাঁত পরিষ্কার করতে! আর ফরাসি দন্ত চিকিৎসকেরা ১৭০০ বা ১৮০০ শতকের শুরুর দিকে টুথব্রাশ ব্যবহার করার ব্যাপারে গণ সচেতনতা তৈরি করেন।

অনুমান করতে পারেন, কখন থেকে এই দুনিয়ায় টুথব্রাশের প্রচলন ঘটে? পাঁচশো বছর? না। এক হাজার? ন্যাহ। দুই? না রে বাবা! পাক্কা পাঁচ হাজার থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে। কি, হেঁচকি উঠলো নাকি? তাহলে জবান বন্ধ হয়ে যেতে পারে এই শুনে যে, সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে থেকে টুথব্রাশ নামক বস্তুটি মানব সভ্যতায় অন্তর্ভুক্ত হলেও আধুনিক যে টুথব্রাশ আপনি ব্যবহার করেন, সেটা চালু হয়েছে মাত্র ৬৬ বছর আগে!

কারা প্রথম টুথব্রাশ বানিয়েছিলো?

খ্রিস্টের জন্মের ৩৫০০-৩০০০ বছর আগে (এখনকার হিসেবে প্রায় ৫৫০০ বছর) ব্যাবিলন এবং মিশর দেশের মানুষেরা সর্বপ্রথম দাঁত মাজার জিনিসপত্র তৈরি করে। তারা গাছের ছোট ডালকে ঘষে ক্ষয় করার মাধ্যমে তন্তু বের করে দাঁত পরিষ্কার করার এক ধরনের জিনিস বানিয়েছিলো। এটি ঠিক টুথব্রাশ নয়, বরং টুথস্টিক বা মেসওয়াক। যারা ছোটবেলায় শহরের বাইরে থেকেছেন, তারা নিশ্চয় জীবনের কোনো না কোনো সময় গুরুজনদের দেখাদেখি দাঁতন করেছেন? আমিও নিম গাছের ডাল ভেঙে দাঁতন বানিয়ে দাঁত ঘষেছি। কিন্তু জানতাম না, এটার নামই মেসওয়াক! প্রায় ১৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চীন দেশে উদ্ভাবিত হয় “চিবিয়ে ভর্তা করার কাঠি” বা “chewing sticks”। এটি তৈরি করা হতো সুগন্ধিযুক্ত গাছের ডাল দিয়ে। বুঝাই যাচ্ছে এর কাজ ছিলো মুখের ভেতরকার বদ বু দূর করা!

এই চৈনিকদেরই কৃতিত্ব দেওয়া হয় প্রথমবারের মতো প্রাকৃতিক টুথব্রাশ উদ্ভাবন করার। তারা ১৪৯৮ সালে শূকরের ঘাড়ের শক্ত ছোট লোম দিয়ে তৈরি করেছিলো এক ধরনের টুথব্রাশ। এই লোমগুলো জোড়া দেওয়া হয়েছিলো হাড় বা বাঁশের সাথে। ফলে হাড়/বাঁশ কাজ করতো ব্রাশের হাতল হিসেবে। কী বুদ্ধি! যখন এই টুথব্রাশ সুদূর চীন থেকে ঘুরতে ঘুরতে ইউরোপে এলো, গঠনে কিঞ্চিৎ পরিবর্তন দেখা দিলো। ইউরোপিয়ানরা বোধহয় শূকরের শক্ত লোম মুখে ঢুকাতে পছন্দ করছিলো না। তাই তারা ঘোড়ার নরম লোম দিয়ে ব্রাশ বানালো। আর যারা এই পশুর লোমের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলো, তারা ব্রাশ বানানোর জন্য বেছে নিলো পাখির পালক! আহ, যদি একটিবার দাঁত মাজতে পারতুম এটা দিয়ে।Post making

আজকাল যে আধুনিক নকশার টুথব্রাশ ব্যবহার করা হয়, তার ধারণা এসেছিলো ১৭৮০ সালের দিকে। তখন উইলিয়াম অ্যাডিস (William Addis) নামক একজন ইংরেজ এমন একটা ব্রাশ তৈরি করেন, যেটার হাতলটা বানানো হয়েছিলো বাছুরের হাড় বাঁকিয়ে। অবশ্য তন্তুর অংশটা তিনি শূকরের লোম দিয়েই বানিয়েছিলেন। ১৮৪৪ সালে প্রথমবারের মতো তিন সারি বিশিষ্ট টুথব্রাশের নকশা করা হয়। কিন্তু তখনও পর্যন্ত তন্তুর অংশের জন্য শূকর, ঘোড়ার লোমের উপরেই নির্ভর করতে হচ্ছিলো। কিন্তু জনাব ওয়ালেস ক্যারোদার্স যখন ১৯৩৫ সালে কৃত্রিম তন্তু “নাইলন” উদ্ভাবন করলেন, তখন মানুষ হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। কারণ ১৯৩৮ সাল থেকে পশুর লোমের বদলে নাইলন দিয়েই টুথব্রাশের তন্তুর অংশটা তৈরি হতে লাগলো। ফলে দেখা দিলো ইতিহাসের প্রথম আধুনিক টুথব্রাশ। এর নাম “Doctor West’s Miracle Tuft”। আর আশ্চর্যের উপর আশ্চর্য যে, প্রথম ইলেকট্রিক টুথব্রাশ উদ্ভাবিত হয়েছিলো ১৯৩৯ সালে! অথচ এখনও এটা সহজলভ্য নয়।

"ডাক্তার ওয়েস্টের মিরাকল টাফ্ট" নামক দাঁত মাজুনির বিজ্ঞাপন

“ডাক্তার ওয়েস্টের মিরাকল টাফ্ট” নামক দাঁত মাজুনির বিজ্ঞাপন

১৯৫০ সালের মধ্যে ব্রাশে ব্যবহার করার জন্য নাইলন তন্তুকে আরও নরম করে তৈরি করা হলো। কারণ বাজারে এরকম নরম ব্রাশই খাচ্ছিলো পাবলিকরা। আজকের যুগে ব্যবহৃত টুথব্রাশের চেহারা আর গাঠনিক উপাদান হরেক রকম হয়ে থাকলেও আদি যুগ থেকে এখন পর্যন্ত ব্রাশের মৌলিক গঠনটা রয়েছে অপরিবর্তিত! সেই যে ব্যাবিলনবাসী বা মিশরীয়রা হাতলওয়ালা গাছের ডাল ব্যবহার করতো, যে ডালের আগায় ঘষে ঘষে তন্তুর মতো অংশ বানানো হতো, তার সাথে আজকের ব্রাশের খুব পার্থক্য আছে কি?

টুথপেস্টের গল্প

টুথব্রাশ নিয়ে বিশাল রচনা লিখে টুথপেস্টকে ভুলে যাবো, তা ঠিক নয়। দুজনে মিলেই তো হলুদ দাঁতকে করে সাদা, মাড়িকে করে শক্ত। তাই এখন হবে টুথপেস্টকে নিয়ে কচকচানি। যারা ভাবছেন, টুথপেস্ট এসেছে টুথব্রাশের সাহায্যকারী হিসেবে, তারা এইবেলা নড়েচড়ে বসুন। কারণ টুথপেস্ট উদ্ভাবিত হয়েছিলো টুথব্রাশেরও আগে! আর সেই আগে মানে কত আগে, সেটা শুনে দিব্যি ভিরমি খাওয়া যায়। অনুমান করা হয়, আজ থেকে প্রায় ৭১০০ বছর আগে টুথপেস্টের প্রথম ব্যবহার শুরু হয়। এই ব্যবহারও মিশরীয়রাই শুরু করেছিলো। জাতিটা একটা ইয়ে বটে! টুথপেস্ট, টুথব্রাশ সবকিছুর উদ্ভাবক হিসেবে ইতিহাসে নাম লিখিয়ে রেখেছে। প্রাচীন গ্রিস এবং রোমের বাসিন্দারাও টুথপেস্ট ব্যবহার করতো বলে জানা যায়। তবে সেটা কতো সালের ঘটনা, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় না। ভারতীয় উপমহাদেশ এবং চীনে টুথপেস্টের ব্যবহার চালু হয় খ্রিস্টের জন্মের প্রায় ৫০০ বছর আগে থেকে। আদ্যিকালের টুথপেস্টের কাজ কী আধুনিক টুথপেস্টের মতই ছিলো? নাকি ওগুলো ব্যবহার করা হতো অন্য কোনো উদ্দেশ্যে? চলুন দেখি ইতিহাস কী বলেঃ দাঁত এবং মাড়ি পরিষ্কার রাখা, দাঁতকে সাদা করা, নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের খুশবু বজায় রাখা। হুম, কাজ এখনকার টুথপেস্টের মতই। পার্থক্য একটাই। তখন টুথপেস্টের ব্যবসা ধরে রাখার জন্য এত বিজ্ঞাপন ছিলো না, মডেলরাও সহ-মডেলের গায়ের উপর পড়ে, হাঁ করে নিজের মুখের গন্ধ শোঁকাতো না।2

প্রাচীন টুথপেস্ট

টুথপেস্টের উদ্দেশ্য ডাইনোসরের আমল থেকে আজ পর্যন্ত মোটামুটি একরকম থাকলেও এটা তৈরির উপাদানগুলোতে এসেছে আজব কিসিমের পরিবর্তন। প্রথম দিকে টুথপেস্ট তৈরির জন্য ব্যবহার করা হতো ষাঁড়ের খুরের ছাইয়ের গুঁড়ো এবং ডিমের পোড়া খোসা। এ দুটো জিনিস আবার মেশানো হতো ঝামা পাথরের গুঁড়োর সাথে। কিন্তু দুনিয়ায় এতকিছু থাকতে কেন ষাঁড়ের খুর নিয়ে আমাদের পূর্বপুরুষরা টানাটানি করেছিলেন, জানতে পারিনি। অবশ্য রোমান আর গ্রিকরা ছিলো আরও এক ডিগ্রি সরেস। পেস্ট তৈরিতে তারা আরও বেশি রুক্ষ উপাদান ব্যবহার করতো। হয়ত তাদের ধারণা ছিলো, পেস্ট যত রুক্ষ হবে, দাঁত তত পরিষ্কার হবে, হাসিটা তত সুন্দর দেখাবে। এজন্য তারা হাড় গুঁড়ো করে তার সাথে ঝিনুকের খোলসের গুঁড়ো মিশিয়ে পেস্ট বানাতো। তার উপর প্রশ্বাসের গন্ধ দূর করার জন্য রোমানরা আরেকটু চালাকি করে পেস্টের সাথে সুগন্ধি উপাদান যোগ করতো। অবশ্য পেস্টের সাথে কয়লার গুঁড়া আর গাছের ছাল যোগ করারও নজির আছে। চৈনিকরা অনেক ধরনের উপাদান মিশিয়ে পেস্ট বানানোর কৌশল শিখেছিলো। কিন্তু তাদের কি আর ভেষজ উপাদান ছাড়া চলে? তাই সময়ের সাথে সাথে তারা গাছ-লতা-পাতা দিয়ে পেস্ট বানানোর পদ্ধতি খুঁজে বের করেছিলো। তাদের পেস্টে উপস্থিত থাকতো জিনসেং, পুদিনা, আর লবণ।

 আধুনিক টুথপেস্ট

আঠারো’শো শতাব্দীতে আধুনিক টুথপেস্ট তৈরি শুরু হয়। তখন এতে উপাদান হিসেবে থাকতো সাবান। ঐ একই সময়ে ইংল্যান্ডে যে পেস্ট তৈরি হতো, তাতে ব্যবহার করা হতো সুপারি। ১৮৫০ সালের দিকে গিয়ে সাবানের সাথে যোগ হলো চক। অবশ্য ১৮৫০ সালের আগে যে টুথপেস্ট তৈরি হতো, সেগুলোকে পেস্ট বলা আদৌ ঠিক হচ্ছে না। কারণ সেগুলো ছিলো পাউডার! কিন্তু ১৮৫০-এর দশকে সাবানের বদলে সোডিয়াম লরেল সালফেট (sodium lauryl sulphate) বা এর মতো অন্যান্য উপাদান ব্যবহৃত হতে শুরু করলো। ফলে পাউডারের বদলে উৎপন্ন হলো মসৃণ পেস্ট, অথবা ক্রিমওয়ালা তৈলাক্ত পদার্থ। এভাবে নতুন ধরনের যে টুথক্রিম তৈরি হলো, সেটাকে বয়ামের ভিতরে রাখা হলো। নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক কোম্পানি “কোলগেট” ১৮৭৩ সালে বয়ামের ভিতর সুগন্ধি টুথক্রিম ভরে সেটা বাজারজাত করতে শুরু করলো। আমেরিকান দন্ত চিকিৎসক ওয়াশিংটন শেফিল্ড (Washington Sheffield) এই ক্রিমের মধ্যে পুদিনা পাতার নির্যাস মিশিয়ে তার রোগীদের উপর প্রয়োগ করতে শুরু করলেন। এই নির্যাসের ফলে যে সুখকর অনুভূতি রোগীরা পেতো, তার জন্য তারা ডাক্তারের কাছে পেস্টের জন্য বায়না ধরতে আরম্ভ করলো। ফাঁক বুঝে ডাক্তারও ব্যবসায় নেমে পড়লেন। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি কলাপ্সিবল টিউবের ভিতরে করে টুথপেস্ট উৎপাদন করেন। এই পেস্টের গালভরা নামটা ছিলো, “Dr. Sheffield’s Creme Dentifrice“।1

টিউবের ভিতরে ভরে পেস্ট উৎপাদনের বুদ্ধিটা ডাক্তার সায়েব পেয়েছিলেন তার পুত্রের কাছ থেকে। পুত্র যখন প্যারিস ভ্রমণে গিয়েছিলো, তখন টিউব থেকে রঙ বের করে চিত্রশিল্পীদের আঁকাআঁকি করতে দেখেছিলো। ফলে টিউবের ভিতরে রঙের বদলে জায়গা হলো পেস্টের। আজ পর্যন্ত টুথপেস্টের বাহন হিসেবে টিউবের চেয়ে ভালো কোনো আইডিয়া কেউ নিয়ে আসতে পারেনি। টুথপেস্টের প্রথম টিউবগুলো তৈরি হয়েছিলো সীসা দিয়ে। ১৮৯৬ সালে “কোলগেট” কোম্পানি ডাঃ শেফিল্ডের নকশা করা টুথপেস্টের টিউব নকল করে নিজেরা টিউবের ভিতরে টুথ ক্রিম ভরে বিক্রি করা শুরু করলো। বিংশ শতাব্দীর অর্ধভাগে এসে টুথপেস্ট মোটামুটি আজকের আকার ধারণ করলো। এখন আমরা শুধু ঝা চকচকে দাঁতের জন্যেই পেস্ট ব্যবহার করি না, বরং এখনকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণ হলো, দাঁতের ক্ষয় রোধ করা। এর জন্য আমরা যে ফ্লুওরাইড টুথপেস্ট ব্যবহার করি, সেটা তৈরি হয়েছিলো ১৮৯০-এর দশকে। আধুনিক পেস্টে রুক্ষ উপাদানের পরিমাণও বহুলাংশে কমিয়ে আনা হয়েছে। কারণ এটা দাঁতের জন্য ক্ষতিকর।

সাম্প্রতিক সময়ে যে পেস্ট তৈরি হচ্ছে, সেগুলোতে থাকে ফ্লুওরাইড, রঙ, ফ্লেভার, sweetener, এবং পেস্টকে মসৃণ করার জন্য যা দরকার, সেই উপাদান। সাথে থাকে ফেনা হওয়ার, আর্দ্র থাকার, দাঁত সাদা করার, দাঁতের ক্ষয় রোধ করার, মাড়িকে সুস্থ রাখার, এবং নিঃশ্বাসের সজীবতা ধরে রাখার উপাদান।

11

প্রথমবারের মতন টুথপেস্ট ব্যবহারকারীরা সাবধান!

তথ্য সূত্রঃ

১) কোলগেট

২) সায়েন্স ইলাস্ট্রেটেড

৩) উইকিপিডিয়া

Comments

আপনার আরো পছন্দ হতে পারে...

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
জানান আমাকে যখন আসবে -
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x