সমকামিতা কি প্রাকৃতিক? না একধরনের ফ্যাশন? কী বলছে গবেষণা? আজ যৌন বৈচিত্র্যের এই পাঠ নিয়ে জীববিজ্ঞান কী বলছে তাই দেখব।
১) জিনগতঃ সমকামিতার সাথে জিনের সংযোগ আছে, এমন তথ্য পাওয়া গিয়েছে ১৯৯৩ সালের ডিন হ্যামারের করা গবেষণায়। ২০১৪ সালে করা বৃহৎ পরিসরে জমজদের উপর করা আরো একটি গবেষণায় এই ফলাফল প্রায় সম্পুর্ণভাবে নিশ্চিত হয়। তবে এতদিন ধরে সুনির্দিষ্ট কোন জিনের জন্য এমনটা হয়; তা নিশ্চিত ছিল না। কিন্তু ২০১৭ এর ডিসেম্বরে নেচারে প্রকাশিত ফলাফল থেকে বলা যায়, এ মুহুর্তে এটা আমরা জানি, সমকামিতার জন্য কোন জিনদ্বয় দায়ী। তাই সমকামিতা যে জিনগত এটা বলতে সম্ভবত এখন খুব একটা দ্বিধা নেই।
২) মস্তিষ্কগতঃ সমকামিতা যে সহজাত, তা নিয়ে এ প্রসঙ্গে আরো কিছু গবেষণা প্রায়ই আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়। আর তা হলো, সমকামিতা নামক এই যৌন অভিমুখিতার সাথে মস্তিষ্কের সংযোগ। মস্তিষ্কের INAH3 নামক অংশটি পুরুষের ক্ষেত্রে নারীর তুলনায় বড় হয়। কিন্তু সাইমন লিভ্যে নামক একজন স্নায়ুবিজ্ঞানী দেখেছেন সমকামী পুরুষের INAH3 আর বিষমকামী নারীর INAH3 প্রায় সমান। অর্থাৎ সমকামী পুরুষের INAH3 বিষমকামীর পুরুষের চেয়ে আকারে সংকুচিত। তবে এ সংকোচন কতটা? এটা হচ্ছে মহিলাদের INAH3 এর আকারের ন্যায়। এই গবেষণাটি পুনঃপ্রতিলিপিত করা হয়েছে, যা আগের গবেষণাটিকে নিশ্চিত করে। আরো দেখা গিয়েছে বিষমকামীদের সাথে সমকামীদের INAH3 এলাকার প্রস্থচ্ছেদ ও নিউরনের সংখ্যায় কোনো পার্থক্য নেই।
এই জায়গা থেকে অনেকের ধারণা হয়েছিল, সমকামী পুরুষদের হয়তো, বিষমকামী নারীর ন্যায় হাইপোথ্যালামাস থাকে। কিন্তু আরেকটি গবেষণা থেকে দেখা গিয়েছে, পুরুষ সমকামীদের সুপ্রাকায়াজম্যাটিক নিউক্লিয়াস; বিষমকামী পুরুষ ও নারীর তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। গবেষণায় আরো দেখা গিয়েছে পুরুষ ও নারী সমকামীর বাম এমিগডালা বিস্তৃত এবং পক্ষান্তরে নারী পুরুষ বিষমকামীর ডান এমিগডালা বিস্তৃত। দেখা গিয়েছে, দুইটি মস্তিষ্কগোলার্ধকে সংযোগকারী শ্বেত তন্তু সমৃদ্ধ এন্টিরিওর কমিশার, নারী ও পুরুষ সমকামীতে; বিষমকামী পুরুষের তুলনায় বড়।
অনেকে বলতে পারেন, হয়তো জন্মের পরে, সমকামিতার দরুণ মস্তিষ্কের নানা অংশের এই পরিবর্তন ঘটেছে, হয়েছে সংকোচন-প্রসারণ। কিন্তু ২০১০ সালে প্রকাশিত আরেকটি গবেষণা থেকে বলা হচ্ছে, মস্তিষ্কের এই ধরনের বিকাশ মার্তৃগর্ভেই বিকশিত হয়, যা সামাজিক কারণে কোনো ধরনের প্রভাবে প্রভাবিত হয় না।
৩) এপিজেনেটিক সংযোগঃ জীববিজ্ঞানের উদীয়মান এই শাখা থেকে দেখা যায়, সমকামিতার সাথে এপিজেনেটিক সংযোগ আছে।
৪) বড় ভাইয়ের সাথে সংযোগঃ সমকামিতার সাথে বড় ভাইয়ের একটা গভীর সংযোগ নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ আলোচনা ও রিসার্চ হয়েছে। এই বিষয়টি নিয়ে অজস্র গবেষণা হলেও ২০১৭ এর ডিসেম্বরে প্রকাশিত একটি গবেষণা উল্লেখযোগ্য। এখান থেকেই সুনির্দিষ্টভাবে দেখা গিয়েছে, কেন অধিক বড় ভাই থাকলে ছোট ভাইয়ের সমকামী হবার সম্ভাবনা বাড়তেই থাকে। (এই বিষয়ে বিস্তারিত বিজ্ঞান যাত্রা থেকেও দেখতে পারেন, সহায়ক তথ্যঃ ক)
৫) নারীর উর্বরতাঃ গবেষণা থেকে দেখা গিয়েছে সমকামী পুরুষদের নারী আত্মীয়রা অধিক সন্তান জন্ম দেয়। অর্থাৎ সমকামীতার সাথে নারীর উর্বরতার একটা ইতিবাচক সংযোগ আছে। তাহলে কী এই কারণে সমকামিতার মত অনুপযোগী একটা বিষয় বিবর্তনীয় ছাঁকনিতে এভাবে টিকে গেলো?- এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় কি?। [জীববিজ্ঞানের অন্যান্য প্রাণিতে উর্বরতার সাথে সমকামিতার এই সংযোগ নিয়ে পড়তে পারেন, ইস্টিশনে খ) ]
৬) হ্যান্ডেডনেস বা কে কোন হাত ব্যবহার করবে: অসংখ্য গবেষণা থেকে দেখা গিয়েছে, যারা বাহাতি এবং ডান হাত ব্যবহার করেন না; তাদের মধ্যে সমকামিতা অধিক হারে দেখা যায় (অনেকগুলো রিসার্চ একসাথে দেখে নিন, এখান থেকে)।
৭) প্রযুক্তিগতঃ অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি সমকামিতার সাথে প্রযুক্তির একটা গভীর সংযোগ সামনে চলে এসেছে। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা তৈরী করেছেন, যে বুদ্ধিমত্তা একজন মানুষের চেহারা দেখেই সে সমকামী না বিষমকামী তা নির্ধারণ করে ফেলতে পারবে। গবেষকরা এটা বলছেন, এই বিষয়টা সমকামিতা যে জন্মের আগে থেকেই নির্ধারিত; এই তথ্যটিকে নিশ্চিত করে। কারণ হলো; একজন মানুষের চেহারা কেমন হবে, তা তার জিন, তার জন্মপূর্ব হরমোনগুলোই নির্ধারণ করে, তাই প্রযুক্তি যেহেতু মানুষের চেহারা দেখেই ধরতে পারছে, সে সমকামি না বিষমকামী; অতএব, এই কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, যৌন অভিমুখিতা নির্ধারণে প্রকৃতিই ভুমিকা রাখে।
৮) পার্থক্য: সমকামী ও বিষমকামী মানুষদের মধ্যে আরো অনেক পার্থক্য দেখা গিয়েছে। এরকম কিছু পার্থক্য গুলো তুলে ধরি
A) গবেষণায় দেখা গিয়েছে, সমকামী পুরুষদের শিশ্ন, বিষমকামীদের তুলনায় দীর্ঘ ও মোটা হয়।
B) সমকামী পুরুষদের বাম হাতের বুড়ো আঙুল এবং কড়ে আঙুলের ছাপ ঘনতর হয়।
C) শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে করা গবেষণায় দেখা গিয়েছে সমকামী পুরুষদের বাহু এবং হাতের দৈর্ঘ্য সাধারণ জনসংখ্যার তুলনায় ছোট হয়।
D) সমকামী নারী এবং উভকামী নারীতে চকিত প্রতিক্রিয়া পুরুষের মতো হয়ে থাকে। (চকিত প্রতিক্রিয়া বলতে এখানে বুঝানো হয়েছে, উচ্চ আওয়াজ শুনলে আমরা চোখের পাতা যেভাবে নাড়াই বা হঠাৎ আমরা যে প্রতিক্রিয়া দেই সেসব)
উপসংহার
এটা আমি বা প্রখ্যাত বিজ্ঞানীদের কেওই বলছে না, সমকামিতা সম্পূর্ণভাবে এই সব কারণের জন্যই হয়, সমকামিতার সাথে আরো অনেক বিষয় জড়িত থাকতে পারে। কেউ যদি ইচ্ছা করে সমকামিতাকে ফ্যাশন হিসাবে ন্যায়, সেটা তার দায়ভার। কিন্তু এইসব গবেষণার ফলাফল থেকে যে বিষয়টা শতভাগ নিশ্চিত হয়ে বলা যায়; তা হলো সমকামিতা প্রাকৃতিক হবার চান্স অনেক বেশি উচ্চতর। সমকামিতার সাথে মনস্তাত্বিক সমস্যা, রাজনৈতিক বিষয়গুলো, মানবাধিকার, ধর্মীয় নানা কারণ, যৌন রোগ সহ নানা বিষয় জড়িয়ে আছে, যদি কখনো পারি, তবে তা নিয়ে লিখব, আপাতত জীববিজ্ঞানের অংশটাই থাকুক।
২৬ তারিখ সন্ধ্যায় প্রয়াত হয়েছিলেন অভিজিৎ রায়। অভিজিৎ রায় এমন একজন ব্যক্তি যিনি আমার মনন মগজ জুড়ে রয়েছেন। ঠিক যেসব বিষয়ে বাংলা ভাষায় জনসাধারণ সঠিক তথ্য জানায় না, জানে না। কিন্তু যে সব বিষয় ধ্রুব সত্য; আবার যেসব বিষয় নিয়ে ভুল ধারণা ছড়ানো হয় মাত্রাতিরিক্ত; ঠিক সেসব বিষয় নিয়ে অভিজিৎ রায় লিখতেন। বিবর্তন নিয়ে, পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে, যুক্তি নিয়ে, সমকামিতা নিয়ে লিখার পাশাপাশি অভিজিৎ রায়ের লেখা বিস্তৃত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত। বিবর্তন নিয়ে এখন অনেকেই লিখছেন, পদার্থবিজ্ঞান নিয়েও আসছে অসাধারণ বইগুলো, যুক্তিবাদ নিয়েও অনেকেই লিখবে, লিখছে, আর রবি ঠাকুর তো থাকবেনই অনেকের লেখার উপজীব্য হয়ে; কিন্তু বাংলা ভাষায় যে বিষয় অভিজিৎ রায় ব্যতীত অবহেলিত; তার নাম সম্ভবত সমকামিতা নিয়ে বিজ্ঞানের নিরীখে লেখাগুলো। তাই তাঁর স্মরণে, তাঁকে উৎসর্গ করে আমার মত ক্ষুদ্র ব্যক্তি এই দ্বিতীয় স্তরের লেখাটি লিখলো।
যারা তথ্যসূত্র আলাদা করে দেখতে চান —
1) http://science.sciencemag.org/content/261/5119/321.long
2) https://www.newscientist.com/article/dn26572-largest-study-of-gay-brothers-homes-in-on-gay-genes/
3) https://www.nature.com/articles/s41598-017-15736-4
4) http://science.sciencemag.org/content/253/5023/1034
5) https://linkinghub.elsevier.com/retrieve/pii/S0018506X01916800
6) https://www.sciencedirect.com/science/article/pii/000689939090350K?via%3Dihub
7) https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/18559854
8) https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/7571001
9) https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/19955753
10) https://link.springer.com/article/10.1007%2Fs00439-005-0119-4
11) http://www.pnas.org/content/115/2/302
12) https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/15539346
13) https://bn.m.wikipedia.org/wiki/Handedness_and_sexual_orientation
14) https://osf.io/zn79k/
15) https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/10410197
16) http://nymag.com/news/features/33520/
17) https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/14570558
সহায়ক তথ্যঃ ক) https://bigganjatra.org/fraternal-birth-order-effect/
খ) https://www.istishon.com/?q=node/26150