মুহাম্মদ জহিরুল আলম সিদ্দিকী (শামীম): লজিং মাস্টার থেকে তুখোড় বিজ্ঞানী

s5

অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট  ফর বায়ো ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ন্যানোটেকনোলজির একজন অ্যাসোসিয়েট গ্রুপ লিডার, মুহাম্মদ জহিরুল আলম সিদ্দিকী সম্প্রতি প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার শনাক্তকরণের এক ডিভাইস আবিষ্কার করেছেন। নেচার পাব্লিশিং গ্রুপের সায়েন্টিফিক রিপোর্ট, আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির জার্নালসহ কয়েকটি বিখ্যাত জার্নালে তা প্রকাশিত হয়েছে এবং তিনি ইতোমধ্যে এই গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের প্যাটেন্ট লাভ করেছেন।

ড. সিদ্দিকী মূলত প্রাথমিক অবস্থায় ক্যান্সার শনাক্তকরণের ডিভাইস ডেভেলপমেন্টের উপর কাজ করেন। কিভাবে ক্যান্সারের মতো অতি ব্যয়বহুল রোগের চিকিত্সাকে স্বল্প খরচে করা সম্ভব হয় তার উপরেই এই বিজ্ঞানীর কাজ। তিনি বলছিলেন, ২০১৪ সালে চালানো এক জরিপে দেখা যায়, আমেরিকাতে প্রতি বছর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ মারা যায় ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে। এটি এমন একটি ঘাতক ব্যাধি যেটি অজ্ঞাতসারে শরীরের ভিতর বৃদ্ধি পায় এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ধরা পড়ে শেষ পর্যায়ে, যখন চিকিত্সার মাধ্যমে এটি পুরোপুরি নিরাময় করা প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়। কিন্তু প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত করা সম্ভব হলে শতকরা ৮০ থেকে ৯০ ভাগ ক্যান্সার নিরাময় করা সম্ভব।
.
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মতো নিম্ন আয়ের দেশের মানুষদের কাছে সহজলভ্য হবে এমন একটি যন্ত্রের মাধ্যমে প্রাথমিক অবস্থায় ক্যান্সার শনাক্তকরণের স্বপ্ন নিয়ে আমি ২০১২ সালে অস্ট্রেলিয়ান রিসার্চ কাউন্সিল থেকে ৩ লাখ ৭২ হাজার ডলারের অনুদান পাই। সেই অর্থায়নে আমি এবং আমার গবেষক দল এমন একটি ডিভাইস বানাই, যার মাধ্যমে মানব রক্তের অভ্যন্তরে অবস্থিত অতি বিরল এক ধরনের কোষ (সার্কুলেটিং টিউমার সেল বা সিটিসি) সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করা যায়, যেটি প্রাথমিক পর্যায়ের ক্যান্সারের সুনির্দিষ্ট তথ্য বহন করে। এই ডিভাইসের কার্যকারিতার মূলে আছে ন্যানোশেয়ারিং নামের এক ধরনের পদ্ধতি।’
.
জহিরুল আলম সিদ্দিকী তার উদ্ভাবিত ডিভাইসকে সাধারণ মানুষের ব্যবহার উপযোগী করার প্রয়াস হিসেবে গত ১৭ অক্টোবর অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল হেলথ অ্যান্ড মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল থেকে ৪ লাখ ১১ হাজার ডলার অনুদান পেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি আশা করছি, এই অনুদানের মাধ্যমে আমি স্বল্প মূল্যের একটি যন্ত্র তৈরি করতে পারব, যেটি ক্যান্সার শনাক্তকরণের গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড যন্ত্র হিসেবে পৃথিবীর সর্বত্র ব্যবহার করা সম্ভব হবে। এই যন্ত্রটি যেমন বিভিন্ন পর্যায়ের ক্যান্সার শনাক্তকরণে ব্যবহার করা যাবে, তেমনি এর মাধ্যমে চিকিত্সকরা ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের চিকিত্সার বিভিন্ন পর্যায়ে শরীরে ক্যান্সারের বৃদ্ধি অথবা হ্রাস পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন। যার ফলে রোগীর চিকিত্সা সঠিক পথে এগোচ্ছে কি না সেই ব্যাপারে চিকিত্সকরা সঠিক ধারণা পাবেন।’
 
s3

এখানে উল্লেখ্য, যারা কষ্ট দেখলে কাজ না করে সরে আসতে চান বা অনুকূল পরিবেশ না পেলে কাজ করতে চান না, তাদের জন্য এক অনুপ্রেরণার নাম জহিরুল আলম শামীম। কারণ তাঁর জন্য এই অর্জনের পথটা ছিল দারুণ কঠিন।

হাওড় অঞ্চলের ছোট্ট এক গ্রামে দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম শামীমের। থাকা-খাওয়ার পর পড়ালেখাটা তখন বিলাসিতা। কিন্তু শামীম নাছোড়বান্দা। প্রাথমিক তো শেষ করলেনই, লজিং থেকে পড়ালেখা চালালেন মাধ্যমিকেও। এরপর লজিং থেকে থেকে সিলেট শহরতলির মোগলা বাজারের রেবতি রমন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। ১৯৯৫ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ভর্তি হন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে।  তারপর দক্ষিণ কোরিয়ার পুসান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাড়ি জমান পিএইচডি করার জন্য বিশ্লেষণী রসায়নে। তার পিএইচডি গবেষণাপত্র পৃথিবীর নামকরা সব জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ ইউনিভার্সিটিতেও বেশ কিছুকাল গবেষণা করেন তিনি।

ড. সিদ্দিকী গবেষক হিসেবে বড় স্বীকৃতি পান ২০০৬ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার পুসান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ব্রেইন কোরিয়া ২১’ নামের শ্রেষ্ঠ গবেষণা পদকটি পাওয়ার মাধ্যমে। সে বছর কোরিয়ার বিভিন্ন বিজ্ঞান সাময়িকীতে ড. সিদ্দিকীর যেসব গবেষণা নিবন্ধ ছাপা হয়, তার ওপর ভিত্তি করেই দেওয়া হয় ওই পদক। ২০০৭-এ পিএইচডিতে অসামান্য কৃতিত্বের জন্য হন পুসান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্র। গবেষণায় নিবেদিত থাকার স্বীকৃতি স্বরূপ ২০১১ ও ২০১২ পর পর দুইবার অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অস্ট্রেলিয়ার সংসদ ভবনে নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানান অনুদানপ্রাপ্ত কৃতী বিজ্ঞানীদের, সেখানে তিনিও ছিলেন।

দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উঠে এসে জহিরুল আলম সিদ্দিকী এখন কাজ করছেন বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ে। অস্ট্রেলিয়ায় স্ত্রী সিরাত সিদ্দিকী, ছেলে ইওয়ান ও মেয়ে রিদাকে নিয়ে ড. সিদ্দিকীর সুখের সংসার। সদিচ্ছা থাকলে আর তার সাথে পরিশ্রম যোগ হলে সব সম্ভব বলে তিনি বিশ্বাস করেন। বাংলাদেশের তিন জন আবু সিনা শুভ, শুভাশীষ টিটু, মোস্তাক আহমেদসহ ভারতীয়, চায়নীজ, সিঙ্গাপুরিয়ান এবং অস্ট্রেলিয়ান ৮ জন ছাত্র  পিএইচডি করছেন তার তত্ত্বাবধানে। বাংলাদেশকে নিয়ে তিনি অনেক স্বপ্ন দেখেন। মন থেকে অনুভব করেন কিছু করার তাগিদ। সুযোগ পেলে বাংলাদেশে গড়তে চান একটা স্বপ্নের ল্যাব, যেখানে শুধু বাংলাদেশি নিবেদিতপ্রাণ গবেষকেরা কাজ করবেন। অবদান রাখবেন বিজ্ঞানের মৌলিক ও প্রায়োগিক শাখায়। এই ল্যাব একদিন হবেই—এই বিশ্বাস তার আছে। আমরাও আশা করি ড. সিদ্দিকীর সাফল্য একদিন বাংলাদেশের সম্মানকে নিয়ে যাবে এক নতুন উচ্চতায়।

মূল লেখাঃ ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত

লেখকঃ নাজমুল ইসলাম শিপলু, পিএইচডি গবেষক, কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটি

Comments

আপনার আরো পছন্দ হতে পারে...

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
জানান আমাকে যখন আসবে -
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x