চারপাশে সমাজের অনেক খারাপ খবরের মধ্যে, মানুষের অনেক পাশবিকতার মধ্যে, হঠাৎ হঠাৎ ভালো খবর নিয়ে আসে বিজ্ঞান। ২০১৬ সালের ১২ই এপ্রিল এমনই একটা ভালো খবর পেলাম বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং এর কাছ থেকে। তিনি এবং ইউরি মিলান একটা অভিযান পরিকল্পনা শুরু করেছেন। গন্তব্য – আলফা সেন্টোরি।
আলফা সেন্টোরি
গ্রীক মিথলজিতে অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক ঘোড়ার মত দেখতে প্রাণীটার নাম মনে আছে? হ্যাঁ, সেন্টর! দক্ষিণ গোলার্ধের আকাশের দিকে চোখ মেললে সেন্টোরাস নামে একটা নক্ষত্রপুঞ্জ দেখা যায়। ১৮০০ বছর আগে জ্যোতির্বিদ টলেমি ৪৮টা নক্ষত্রপুঞ্জ তালিকাভুক্ত করেছিলেন, তার মধ্যে এই সেন্টোরাস নক্ষত্রপুঞ্জও ছিলো।
এই নক্ষত্রপুঞ্জে ‘সেন্টরের পা’ – এই নামে তিন নক্ষত্রবিশিষ্ট একটা সৌরজগত আছে। এটাকে আমরা বলি, আলফা সেন্টোরি। এতে অবস্থিত তিনটা নক্ষত্রের নাম বেশ সোজা – আলফা সেন্টোরি এ, আলফা সেন্টোরি বি, আর আলফা সেন্টোরি সি। শেষের নক্ষত্রটাকে আমরা ডাকি প্রক্সিমা সেন্টোরি। Proxima একটা ল্যাটিন শব্দ, যার অর্থ হচ্ছে নিকটতম। অর্থাৎ, সূর্যের পরে এই প্রক্সিমা সেন্টোরিই আমাদের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র। বাকি দুই সঙ্গীর তুলনায় এটা একটু কম উজ্জ্বল। এটাকে বলে রক্তিম বামন নক্ষত্র (Red Dwarf Star); এমন নক্ষত্রের সংখ্যাই কিন্তু মহাবিশ্বে সবচেয়ে বেশি।
বাকি দুটো (আলফা সেন্টোরি এ আর বি) নক্ষত্রকে খালি চোখে আলাদা করে দেখা যায় না। অর্থাৎ, খালি চোখে মনে হয় যে ওখানে নক্ষত্র একটাই। আলফা সেন্টোরি-এ আমাদের সূর্যের তুলনায় দেড়গুণ বেশি উজ্জ্বল। সিরিয়াস আর ক্যানোপাসের পরে আকাশের তৃতীয় উজ্জ্বলতম নক্ষত্র এই আলফা সেন্টোরি।
পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব ৯৩ মিলিয়ন মাইল। সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো এসে পৌঁছুতে ৮ মিনিটের কিছু বেশি সময় লাগে। প্রক্সিমা সেন্টোরি থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে সময় লাগে ৪.২৫ বছর। দূরত্বটা তাই আর মাইলে হিসেব করা হয় না, বলা হয় ৪.২৫ আলোকবর্ষ। বাকি দুটো সামান্য একটু দূরে, পৃথিবী থেকে ৪.৩৭ আলোকবর্ষ। আর এই সোয়া চার আলোকবর্ষ দূরের সৌরজগতেই মহাকাশযান পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে Breakthrough Starshot প্রকল্প।
ব্রেকথ্রু স্টারশট প্রকল্প
রাশিয়ান পদার্থবিদ+ব্যবসায়ী ইউরি মিলনার আর জুলিয়া মিলনার মিলে মহাকাশ গবেষণা ব্রেকথ্রু ইনিশিয়েটিভ নামক একটি সংস্থা স্থাপন করেছিলেন ২০১৫ সালে। এই মুহূর্তে তার অধীনে তিনটা প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে – ১) Listen, ২) Message, ৩) Starshot. প্রথম প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ ১০০ মিলিয়ন ডলার, যার কাজ হচ্ছে মহাকাশ থেকে কোনো বার্তা আসছে কিনা তা শোনা। দ্বিতীয় প্রকল্পে ওরা একটা প্রতিযোগিতা করছে, যার পুরষ্কার ১ মিলিয়ন ডলার। জেতার জন্য একটা বার্তা তৈরি করতে হবে যাতে পৃথিবী, এখানকার মানুষ, আর সংস্কৃতি নিয়ে কথা থাকবে; এটা পাঠানো হবে মহাকাশের উদ্দেশ্যে। আর তৃতীয় প্রকল্প কাজ করবে নিকটতম নক্ষত্রে মহাকাশযান পাঠানোর জন্য।
নিউ ইয়র্কের ওয়ান ওয়ার্ল্ড পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে জ্যোতিঃপদার্থবিদ স্টিফেন হকিং আর ইউরি মিলনার ২০১৬ সালের এপ্রিলের ১২ তারিখে ব্রেকথ্রু স্টারশটের ঘোষণা দিয়েছেন। মার্ক জুকারবার্গও তাদের এই প্রচেষ্টার, অর্থাৎ Breakthrough Starshot এর বোর্ডে যুক্ত হয়ে সমর্থন জানিয়েছেন। এই প্রকল্পের অধীনে খুব কম ওজনবিশিষ্ট একটা মহাকাশযান তৈরি করা হবে। এর ওজন হতে পারে এক গ্রাম। আর এটার সাথে লাগানো থাকবে lightsail. Lightsail হচ্ছে এমন একটা পাল যেটা আলোর ধাক্কায় চলে। এটার অসাধারণ ইতিহাস নিয়ে বিস্তারিত লিখেছিলাম যখন প্ল্যানেটারি সোসাইটি মহাকাশে সফলতার সাথে (২০১৫ সালে) তাদের প্রথম লাইটসেইল পাঠিয়েছিলো।
খুব সংক্ষেপে, আলো হচ্ছে শক্তির প্যাকেট দিয়ে তৈরি, যেটাকে বলে ফোটন। ফোটনের কোনো ভর নেই। কিন্তু যখন সেটা প্যাকেটের মধ্যে ভ্রমণ করে, তখন তার এনার্জি বা শক্তি থাকে, আর থাকে মোমেণ্টাম বা ভরবেগ। এই ফোটন যদি কোনো প্রতিফলকের গায়ে এসে পড়ে, তখন এটা সামান্য পরিমাণ ধাক্কা দেয়। ধাক্কাটা খুব সামান্য, কিন্তু একবার ধাক্কা শুরু হলে আর কোনো থামাথামি নাই। এটা ধাক্কা দিতেই থাকে। ব্রেকথ্রু এর ছোট্টো মহাকাশযান বা ন্যানোক্রাফটকে ধাক্কা দেবে পৃথিবীর মাটিতে বসানো একটা আলোকরশ্মির উৎস।
এই ন্যানোক্রাফটের গতি হবে আলোর গতির প্রায় ২০ ভাগের এক ভাগ বা এক-পঞ্চমাংশ। অর্থাৎ, পৃথিবী থেকে আলফা সেন্টোরিতে যেতে আলোর যেহেতু ৪ বছর লাগে, এই ন্যানোক্রাফটের লাগবে ৫ গুণ বেশি সময় – প্রায় ২০ বছর। সফল হলে, উৎক্ষেপণের ২৪ বছর পর আমরা আরেকটা সৌরজগতের চোখ ধাঁধানো ছবি পাবো। ২৪ বছর কেন? এইমাত্র না বললাম, ২০ বছর লাগবে! ঠিক ধরেছেন, ন্যানোক্রাফট ২০ বছরে পৌঁছে যাবে। এরপর আলোর গতিতে ছবিগুলো আমাদের কাছে এসে পৌঁছাতে আরো ৪ বছর লেগে যাবে।
কী অসাধারণ উত্তেজনার ব্যাপার! প্রথম উড়োজাহাজ তৈরির পর ১০০ বছরের কিছু বেশি সময় পেরিয়েছে। আর এর মধ্যেই আমরা স্বপ্ন দেখছি অন্য নক্ষত্রে যাওয়ার। এর আগে পাইওনিয়ার, ভয়েজার, এবং নিউ হরাইজনস মহাকাশযানগুলো আমাদের সৌরজগতের গ্রহগুলোর কক্ষপথের বাইরে চলে গেছে। কিন্তু ওরা নিকটতম নক্ষত্রের দিকে যাচ্ছে না, ব্রেকথ্রু এর গন্তব্য আবার সেদিকেই। স্টিফেন হকিং তার ফেসবুক পেইজে লিখেছেন –
এলবার্ট আইনস্টাইন আলোকরশ্মিতে চড়ে ভ্রমণ করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। আর সেই ভাব-গবেষণার ফলাফলই তাকে বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের সন্ধান দিয়েছিলো। মাত্র এক শতাব্দীর একটু বেশি পেরিয়েছে, আর এর মধ্যেই আমরা সেই গতির চমৎকার একটা ভগ্নাংশ (ঘণ্টায় ১০ কোটি মাইল) অর্জন করে ফেলার সম্ভাবনা দেখছি। এরকম গতিতে যেতে পারলে মানুষের এক জীবনের মধ্যেই আমরা অন্য নক্ষত্রে পৌঁছুতে পারবো। উদ্ভাবন আর প্রকৌশলী দক্ষতা – দুটোরই সীমানা বাড়িয়ে দেয়, এমন উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনাতে যুক্ত হতে পারাটা বেশ উত্তেজনার ব্যাপার।
মানবজাতির ওপর থেকে এখনো ভরসা যে উঠে যায়নি, তার প্রধান কারণ হচ্ছে – বিজ্ঞান। ভয়েজার এবং পাইওনিয়ার মিশনে মানবজাতির তরফ থেকে কোন বার্তা যাবে, তা নির্ধারণ করেছিলেন আমার আদর্শ এবং প্রিয় জ্যোতির্বিদ কার্ল সেগান। বেঁচে থাকলে এবারও হয়তো উনিই ব্রেকথ্রু প্রজেক্টের জন্য এই কাজটা করতেন। দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত কোন বার্তাটা যায়। বিজ্ঞানের জগতে সবাইকে স্বাগতম!
আপনার লেখা প্রায় সময়ই সুস্বাদু, এটাও। ধন্যবাদ ব্যাপারটা নিয়ে লেখার জন্য।
“ধাক্কাটা খুব সামান্য, কিন্তু একবার ধাক্কা শুরু হলে আর কোনো থামাথামি নাই। এটা ধাক্কা দিতেই থাকে।” – ধাক্কাধাক্কির এই প্রক্রিয়াটা বুঝিনি। একটু ব্যাখ্যা করবেন লেখক সাহেব?
ঐ লাইনটার ঠিক আগের অনুচ্ছেদেই “অসাধারণ ইতিহাস নিয়ে বিস্তারিত” লেখাটাতে ক্লিক করে দেখুন। প্রক্রিয়াটাও দেখানো হয়েছে ওখানে (ছবিসহ)।
খুব চমৎকার একটা ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে।
আচ্ছা,ন্যানোক্রাফটের গতি কি আলোর গতির ১/৫ হবে,না ১/২০ হবে?
ন্যানোক্রাফ্টের গতি মনে হয় আলোর বেগের ২০% , c এর এক পঞ্চমাংশ। কিন্তু আলোর গতিতে চলার পর প্রক্সিমা সেন্টারাইতে পৌছাতে ক্রাফ্টের ২০ বছর লাগলে , আমাদের কাছে ২০ বছরের আরো একটু বেশী মনে হবে না ? আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব … … …
আমাদের কাছে ২০ বছর মনে হবে, কিন্তু ক্রাফটের কাছে ২০ বছরের চেয়ে কিছুটা কম মনে হতে পারে।
সীমাহীন ধৈর্য আর অক্লান্ত পরিশ্রম করে বিষয়গুলো লেখার জন্য ধন্যবাদ। সমাজ ও জাতী কৃতজ্ঞ থাকবে।