(ম্যাগাজিনের সূচি এবং প্রাপ্তিস্থান সংক্রান্ত তথ্য)
বিজ্ঞানযাত্রা ম্যাগাজিনের দ্বিতীয় ভলিউমের সম্পাদকীয়: জাস্ট এ থিওরি!
ভাষা তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়াটা অনেকাংশেই মানুষের ইচ্ছাধীন নয়। এটা বহতা নদীর মতো, তার নিজস্ব একটা মনমর্জি আছে। এ কারণেই অনেক শব্দের ব্যবহার আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না, অথবা ঠিক যেমনটা হওয়া উচিৎ ছিলো, তেমনটা হয়ে ওঠে না। খুব সহজ কিছু উদাহরণ দিচ্ছি। বাংলা বর্ণমালায় ৫০টা বর্ণ আছে, এগুলো দিয়ে যতগুলো শব্দ বানানো সম্ভব, তা চিন্তা করলে হতবিহবল হয়ে যেতে হয়। লম্বা শব্দগুলো বাদই দিলাম, দুটো বর্ণ দিয়েই এমন অনেক শব্দ বানানো সম্ভব, যেগুলো আমরা ব্যবহার করছি না। যেমন, কেকু, কুকা, ককে – এই বর্ণজোড়গুলোর মধ্যেও আমরা কোনো অর্থ আরোপ করে এগুলোকে শব্দে রূপান্তর করিনি। অথচ, একাধিক অর্থ বোঝানোর জন্য একই বানানের শব্দ ব্যবহার করে চলেছি প্রতিদিন। যেমন ধরুন, ‘কর’ শব্দটি। এটার অর্থ রাষ্ট্রকে আয়ের একটা অংশ দেয়াও হয়, হাতও হয়, আবার পরিচিত কাউকে কিছু করতে বলাও হয়। ‘বাড়ি’ শব্দটা দিয়ে বাসাও বোঝায়, আবার কাউকে আঘাত করাও বোঝায়; ‘পড়া’ দিয়ে পাঠ করাও বোঝায়, ভূপাতিত হওয়াও বোঝায়; ‘পরে’ বলতে পরিধান করাও বোঝায়, আবার নিকট কোনো ভবিষ্যতের কথাও বোঝায়। আরো শত শত উদাহরণ আছে, সেদিকে যাচ্ছি না।
ওপরের শব্দগুলো তেমন কোনো বিশাল জটিলতা তৈরি না করলেও বিজ্ঞানের জগতে কিছু কিছু শব্দের সাধারণ ব্যবহার জটিলতা তৈরি করে। আর যে শব্দটার ব্যবহার নিয়ে একটু বেশিই ঝামেলা সৃষ্টি হয়েছে, সেটা হচ্ছে একটা ইংরেজি শব্দ ‘থিওরি’। সাধারণ মানুষেরা এটাকে ব্যবহার করেন আন্দাজ বা অনুমান হিসেবে। আবার বিজ্ঞানীরা এটাকে ব্যবহার করেন কোনো কিছু ব্যাখ্যা করতে পারে এমন তত্ত্ব হিসেবে। বাংলাতে এই সমস্যাটা ছিলো না। আমরা অনুমান আর তত্ত্বের মধ্যে পার্থক্য করতে পারতাম। কিন্তু বিশ্বায়নের এই যুগে এক ভাষা থেকে আরেক ভাষায় শব্দ ঢুকে যেতে সময় লাগে না। তাই, এখন আমরাও থিওরি শব্দটা হরহামেশাই ব্যবহার করছি। এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে, শব্দটার দুটো অর্থের জন্যেই করছি। তাই, ‘Theory’ আর এর আশেপাশের শব্দগুলো নিয়ে একটু সঠিক ধারণা থাকা সবার জন্যেই জরুরি বলে মনে করি। আর এটা বিজ্ঞানের পদ্ধতির সাথে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। আর এজন্যেই এই সম্পাদকীয়র অবতারণা।
ফ্যাক্ট (Fact) – যা ঘটে বা যা যা ঘটে গেছে, সেটাই ঘটনা; আর ইংরেজিতে সেটাই হচ্ছে ফ্যাক্ট।
হাইপোথিসিস (Hypothesis) – সেই ঘটনাগুলো কেন বা কিভাবে ঘটেছে, সেটা ব্যাখ্যা করার জন্য কিছু সম্ভাব্য পদ্ধতি চিন্তা করা হয়, সেগুলো হচ্ছে হাইপোথিসিস বা প্রকল্প। সেই প্রকল্পগুলোকে এরপর কড়াভাবে যাচাই করা হয়। যাচাই পদ্ধতির কয়েকটা হলো,
১) প্রকল্পটা আবিষ্কৃত ফ্যাক্টগুলোর সম্পূর্ণ অংশকে ব্যাখ্যা করতে পারছে কিনা?
২) প্রকল্পটা অন্যান্য আবিষ্কৃত ফ্যাক্টগুলোর সাথে সাংঘর্ষিক কিনা?
৩) প্রকল্পটা ফ্যাক্টগুলোর সাথে অন্যান্য প্রকল্পের চেয়ে বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা?
৪) প্রকল্পটা পরবর্তীতে আরো ফ্যাক্ট আবিষ্কারের ভবিষ্যদ্বাণী করতে সক্ষম কিনা?
থিওরি (Theory) – যদি ওপরের চারটারই উত্তর ‘হ্যাঁ’ হয়, তাহলে সেই ব্যাখ্যাটি তত্ত্ব বা থিওরি আকারে প্রতিষ্ঠিত হয়। এবং এই পর্যায় পর্যন্ত আসতে হলে সেই ব্যাখ্যাটিকে নিশ্ছিদ্র হতে হয়। যাচাইয়ের কোনো এক পর্যায়ে কোনো খুঁত ধরা পড়লেই বিজ্ঞানীরা সেটাকে ছুঁড়ে ফেলে দেন। তাই, থিওরি হচ্ছে বিজ্ঞানের জগতে সবচেয়ে সম্মানের বিষয়। আর নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন- সাধারণ মানুষ যেভাবে থিওরি শব্দটা ব্যবহার করে, বিজ্ঞানীরা সেভাবে করে না। দুটো অর্থের জন্য দুটো আলাদা শব্দ থাকলে সবচেয়ে ভালো হতো; কিন্তু ঐ যে, ভাষা তৈরি হওয়ার পদ্ধতিটা অনেকাংশেই আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই!
ল’ (Law) – ল’ বা সূত্র জিনিসটা আসলে প্রকৃতির গাণিতিক রুপ ছাড়া আর কিছু না। থিওরি যেমন ‘কেন/কীভাবে’ এর ব্যাখ্যা দেয়, সূত্র সেসবের ধার ধারে না। প্রকৃতিতে কিছু একটা ঘটছে, সেটা কোন নিয়ম মেনে চলছে, সেটা সূত্রের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়।
এবার আসুন, সবগুলোর উদাহরণ দেখি। প্রকৃতিতে জীবাশ্ম পাওয়া গেছে, এটা একটা ফ্যাক্ট। প্রকৃতিতে জীববৈচিত্র্য দেখতে পাচ্ছেন, ফ্যাক্ট। আমাদের মাথার খুলির আকৃতি, ফ্যাক্ট। একটা ফুল আছে যার পরাগরেণু পাঁপড়ির অনেক গভীরে, ফ্যাক্ট। শিম্পাঞ্জি এবং মানুষের মধ্যেকার ডিএনএ বলতে গেলে প্রায় একই রকম, ফ্যাক্ট। লাফ দিয়ে মুক্তি বেগ অর্জন করতে না পারলে আবার ঠিকই মাটিতে পড়ে যেতে হয়, ফ্যাক্ট। লবণ পানির মধ্যে দ্রবীভূত হয়, ফ্যাক্ট।
প্রত্যেকটা ফ্যাক্টকে ব্যাখ্যা করার জন্য প্রকল্প দাঁড় করাতে হবে। প্রকৃতির এই জীববৈচিত্র্য কিভাবে এলো, সেটা নিয়ে দু রকমের হাইপোথিসিস থাকতে পারে। প্রথমটা হলো, সবকিছু দুম করে একসাথে আবির্ভূত হয়েছে। দ্বিতীয়টা হলো, আস্তে আস্তে একটা থেকে আরেকটাতে (একাধিকে) বিবর্তিত হয়েছে। প্রথমটা আমাদের জানা অন্যান্য ফ্যাক্টের সাথে সাংঘর্ষিক; আমরা দুম করে কোনো প্রাণীর দল আবির্ভূত হতে দেখি না। দ্বিতীয় প্রকল্পটি আমাদের জানা অন্যান্য তত্ত্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যেমন, আমাদের পূর্বপুরুষদের (ভিন্ন প্রজাতিদের) জীবাশ্ম আছে প্রকৃতিতে। প্রকল্পটা ভবিষ্যদ্বাণীও করতে পারে অত্যন্ত সফলভাবে। যেমন, যদি আপনি এমন কোনো ফুল দেখেন যার পরাগরেণু পাঁপড়ির অনেক গভীরে, তাহলে সেই ফুলগাছটা টিকে থাকার জন্য নিশ্চয়ই এমন কোনো পোকা বা পাখিরও বিবর্তন হয়েছে যার শুঁড় অথবা ঠোঁট সেই গভীরতায় পৌঁছাতে সক্ষম। সকল যাচাই বাছাইয়ের পরীক্ষা পেরিয়ে সেই প্রকল্পটি তত্ত্বে পরিণত হয়েছে, এর নাম বিবর্তন তত্ত্ব। বিবর্তন তত্ত্ব ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলো যে, মধ্যবর্তী প্রজাতির জীবাশ্ম পাওয়া যাবে, এবং সেটা পাওয়া গেছে। অর্থাৎ, বিবর্তন একটা ফ্যাক্ট তো অবশ্যই, এটা একটা থিওরিও বটে। বিবর্তন আসলেই ঘটেছে, এটা হচ্ছে ফ্যাক্ট। আর এটা কিভাবে ঘটেছে, সেই ব্যাখ্যাটা হচ্ছে বিবর্তন তত্ত্ব।
আবার, কেন আমরা লাফ দিলে মাটিতে ফিরে আসি, এটার জন্যেও বিভিন্ন প্রকল্প দাঁড় করানো যায়। শেষ পর্যন্ত যে প্রকল্পটা তত্ত্বে পরিণত হয়েছে, সেটা হচ্ছে মহাকর্ষ তত্ত্ব। এটা শুধু আমরা লাফ দিলে কেন মাটিতে ফিরে আসি সেটা ব্যাখ্যা করে ক্ষান্ত হয় না, কেন পৃথিবী এবং অন্যান্য গ্রহ সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরে সেটাও ব্যাখ্যা করে। এই তত্ত্ব ভবিষ্যদ্বাণীও করতে পারে যে, মহাকর্ষীয় তরঙ্গ একদিন আবিষ্কৃত হবে। এবং অনেক বছর পরে হলেও, শেষ পর্যন্ত সেটা হয়েছে। এবার আসি মহাকর্ষের সূত্রে। মহাকর্ষের সূত্র বা law of gravity হচ্ছে দুটি বস্তুর মধ্যে কতটুকু মহাকর্ষ কাজ করছে, সেটার গাণিতিক রুপ। মহাকর্ষ এই গাণিতিক সূত্র মেনে চলে বলে এটা law; বিবর্তন এমন কোনো গাণিতিক সূত্র মেনে হয়নি বা হবে না, এটার মূল কথাই হচ্ছে এলোমেলো প্রাকৃতিক নির্বাচন।
এখন কেউ যদি মহাকর্ষ বা বিবর্তন তত্ত্বকে ভুল প্রমাণিত করতে চায়, তাহলে তাকে প্রকল্প যাচাই করার পদ্ধতিতে ফিরে যেতে হবে, এবং ওই প্রশ্নগুলোর জন্য নেতিবাচক উত্তর হাজির করতে হবে। “শুধুই থিওরি” বলে এগুলোকে ভুল প্রমাণ করার চেষ্টা নিতান্তই হাস্যকর। শব্দের একাধিক অর্থ থাকতেই পারে, এটা আমরা আগেই দেখেছি। তাই, একটা শব্দের বিশেষ একটা অর্থকে কেন্দ্র করে কষ্টার্জিত গোটা একটা তত্ত্বকে কলংকিত করার চেষ্টা মোটেও বিজ্ঞানভিত্তিক নয়, বরং অজ্ঞতারই বহিঃপ্রকাশ।
বিজ্ঞানযাত্রার প্রথম ভলিউমেই আমরা বিজ্ঞানের স্বরূপ স্পষ্ট করে দিতে চেয়েছিলাম; জানাতে চেয়েছিলাম যে, বিজ্ঞান হচ্ছে সত্য অন্বেষণের একটা প্রক্রিয়া। কোনো ব্যাখ্যাকে প্রকল্প থেকে তত্ত্বে রুপান্তরিত করার সময় বিজ্ঞান এই নিরপেক্ষ প্রক্রিয়াটি অনুসরণ করে। আপনি যদি বিজ্ঞানের পথযাত্রী হতে চান, আপনাকে এই শব্দগুলোর বিজ্ঞানভিত্তিক অর্থ জানতে হবে, পক্ষপাতদুষ্ট না হয়ে সেই শব্দগুলোর প্রয়োগ করতে হবে। এভাবেই আমরা ধীরে ধীরে বিজ্ঞানের নির্যাস অনুভব করতে পারবো।
বোনাসঃ দ্বিতীয় ভলিউমের মুখবন্ধ
প্রথম ভলিউমের লেখাগুলো পাঠকদের কাছে অত্যন্ত প্রশংসিত হয়েছিলো। সেটার সফলতার পরেও দ্বিতীয় ভলিউম বের করতে অনেক দেরি হয়ে গেলো বলে দুঃখিত। আশা করছি, আপনারা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন, এবং প্রথম ভলিউমের মত এটাকেও সাদরে গ্রহণ করে নেবেন। তবে সাদরে গ্রহণ করে নেয়ার মানে এই নয় যে এখানে কিছু ভুল লেখা থাকলে সেটাকেও মেনে নিতে হবে। বিজ্ঞানের পদ্ধতির মূলেই আছে সমালোচনা এবং সেটাকে আমরা উদারচিত্তে গ্রহণ করবো। একে অপরকে শুধরে দেয়ার মাধ্যমেই আস্তে আস্তে আমরা আগের চেয়ে সঠিক প্রজন্মে পরিণত হতে পারবো। যে কোনো ধরনের তথ্যগত ভুল অথবা অন্যান্য পরামর্শগুলো আমাদেরকে জানাতে পারেন bigganjatra@gmail.com ঠিকানায়।
সবাইকে ধন্যবাদ। বিজ্ঞানযাত্রা চলবে।
Very important information.