কৈলাস – ঈশ্বরের বাসস্থান
হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, বওন – চারটা ধর্মের কাছে এই জায়গাটা অত্যন্ত পবিত্র। হিমালয় পর্বতমালার পশ্চিম তিব্বতের অংশে এটা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ৬,৬৭৫ মিটার উচ্চতায়। এই পর্বত থেকেই উৎসারিত হয়েছে এশিয়ার বেশ বড় একটা জনসংখ্যার প্রাণের উৎস। সিন্ধু, শতদ্রু, ব্রহ্মপুত্র, কর্ণালী (গঙ্গার উপনদী) – সব এই পর্বতের আশেপাশে থেকেই সৃষ্টি হয়েছে।
প্রথমদিকের মহাদেশগুলোর সংঘর্ষে তৈরি হয়েছিলো এই পর্বত। একটা আগ্নেয়গিরির সূত্রপাত হয়েছিলো তিব্বতের লাসা খাঁড়িতে ঐ সময়। সমুদ্রের চামড়া ফেটে যাচ্ছিলো ইউরেশিয়ার (Eurasia = ইউরোপ আর এশিয়ার যৌথ ভূমি) সাবডাকশনে। সেগুলোর ক্ষয় হলো, আর বাকি অংশটুকু থেকে সৃষ্টি হলো কৈলাস পর্বত। সাবডাকশন নিয়ে পড়তে চাইলে পড়তে পারেন Earth Story এর লেখার অনুবাদ পড়তে পারেন আমাদের ওয়েবসাইটে – টেকটোনিক প্লেটের জাদুময় গতিপথ।
এখানকার শিলাগুলো শক্ত প্যালিওসীন কংগ্লোমারেট, ওপরে সিলিকার আবরণ, তৈরি হয়েছিলো লাভার দলা থেকে। এদেরকে molasse এর একটা ফর্ম হিসেবে ধরা হয়; এই শিলাগুলো ক্ষয় হয়েছিলো যখন হিমালয় দ্রুতবেগে ওপর দিকে উঠছিলো আর তাই, বৃষ্টিপাতও বেড়ে গিয়েছিলো। উচ্চমুখী পর্বতগুলো আর্দ্র বায়ুকে ওপর দিকে ঠেলে দিচ্ছিলো, আর সেগুলো ওখানে আরো শীতল হয়ে জমে নেমে এসেছিলো বৃষ্টি হয়ে।
কৈলাসের অবস্থান ইয়ার্লাং-সাংপো সন্ধিতে, এখানেই ইওসীন যুগের মহাদেশগুলো মিলিত হয়েছিলো আর আশেপাশের পাললিক শিলার রুপান্তর ঘটিয়েছিলো। এই কংগ্লোমারেটের সাথে শিলার ভার্টিক্যাল জয়েন্ট একত্রিত হয়ে, বরফ আর শিলার গায়ে তৈরি করেছিলো একটা স্বস্তিকা। স্বস্তিকা, যেটা পবিত্রতার চিহ্ন, প্রায় সব কয়টি ধর্মে। স্বস্তিকা, যেটাকে গত শতাব্দীতে নাৎসীরা ব্যবহার করে এই চিহ্নের অপমান করেছিলো।
তিব্বতীয় বৌদ্ধরা এই পর্বতকে ডাকেন কাং-রিনপোচে বা মূল্যবান তুষার নামে, আর জৈনদের কাছে এর নাম অষ্টপদ। তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্ম নিয়ে এসেছিলেন যে পদ্মসম্ভব আর প্রথম জৈন হিসেবে খ্যাত তীর্থংকর, দুজনেই এখানে বোধিপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। হিন্দুরা মনে করে, সকল সৃষ্টির আর ধ্বংসের দেবতা মহাদেব শিব আর তার স্ত্রী পার্বতীর অনন্তকালীন ধ্যান চলছে এই কৈলাস পর্বতে। তাদের ধারণা, এটাই হচ্ছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মেরুদণ্ড “মেরু পর্বতের প্রতিরুপ। আঞ্চলিক তিব্বতীয় বনপো ধর্মের মানুষ এটাকে ডাকে নয়তলা স্বস্তিকা পর্বত। এই সবগুলো ধর্মতেই কৈলাসকে মনে করা হয়, ব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্র হিসেবে।
একদম চূড়াতে কোনো বরফ জমে না, কারণ এটার শরীর এতোটাই খাড়া। বরফ নিচে পড়ে যায়, গলে যায়, আর উৎপত্তি হয় পবিত্র সেই নদীগুলোর। এই মরুভূমির মত এলাকাতে এটাই শ্বেতশুভ্র পর্বত হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে, হিমালয়ের প্রথম ও প্রধান রেঞ্জ হিসেবে।
কেউ এখন পর্যন্ত এটার চূড়ায় ওঠেনি, যদিও লক্ষ লক্ষ তীর্থযাত্রী হাজার হাজার বছর ধরে এটাকে চক্কর মেরেছে, জ্ঞান আর পুনর্জন্মে সুখী হবার আশায়। অনেকেই বারবার অবনত হয়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করেছে এর চারপাশে যে ৫০ কিলোমিটার ট্র্যাক আছে, সেই পথে হাঁটতে হাঁটতে। পর্বত আরোহণ জগতের বিখ্যাত নক্ষত্র রেইনহোল্ড মাইসনার এর চূড়াতে আরোহণ করার জন্য চায়না সরকারের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন।
কৈলাস – যেখানে ভূ-তত্ত্ব আর অতীন্দ্রিয়বাদ এসে মিশে যায়; আর যাকে শ্রদ্ধা করা হয় সেই ভুলে যাওয়া সুপ্রাচীন অতীত থেকে। একটা মহাসাগরের মৃত্যু আর পর্বতমালার শিলার জন্মের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই কৈলাস পর্বত। এটার ভূ-তাত্ত্বিক গুরুত্ব কোনো অংশেই এটার আধ্যাত্মিক গুরুত্বের চেয়ে কম নয়।
রাক্ষসতাল / রাক্ষস হ্রদ
রাক্ষসতালের অবস্থান তিব্বতে। এই হ্রদ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে আঞ্চলিক বৌদ্ধ ও হিন্দু পুরাণের সাথে। দুই ধর্মের জন্যই এটা একটা তীর্থস্থান। আর “ঈশ্বরদের বাসস্থান” হিসেবে খ্যাত আরেক তীর্থস্থান কৈলাস পর্বতে যাওয়ার মূল পথেও এটা পড়ে।
তিব্বতীয় উপত্যকার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া তুমুল উত্তুরে হাওয়া আঘাত হানে, সমুদ্রপৃষ্ঠের ৫০০০ মিটার ওপরে অবস্থিত এই হ্রদের ওপর দিয়ে। মজার ব্যাপার, এটার পানি লবণাক্ত, কারণ বৃষ্টি আর তুষারের গলনে আশেপাশের পর্বতগুলো থেকে অনেক লবণ আপতিত হয় এখানে।
হিন্দু শাস্ত্রমতে, শিবের বাস এখান থেকে বেশ কাছে, কৈলাস পর্বতে। তাই, এই হ্রদের কাছে এসেই শিবের তপস্যা আরম্ভ করেছিলো রাবণ (রামায়ণের ভিলেন, লংকার রাজা)…… সে একটা করে নিজের মাথা কেটে ফেলতো শিবকে তুষ্ট করার জন্য। সাথে সাথে আরেকটা নতুন মাথা গজিয়ে উঠতো, যাতে সে তার তপস্যা চালিয়ে যেতে পারে। আরেক মতবাদ অনুসারে, তার দশটা মাথা থেকে প্রতিদিন একটা করে মাথা কেটে ফেলতো রাবণ। আর দশমদিনে শিব তুষ্ট হয়ে তাকে বর প্রদান করেন।
এই জায়গা থেকেই উৎপত্তি হয়েছিলো পাঞ্জাবের পাঁচটা পবিত্র নদীর একটি (পাঞ্জ-আব হচ্ছে পঞ্চ/পাঁচ-পানি, ফার্সি ভাষা অনুসারে)
***** References:
Image credit: Sunciti Sundaram, Sapna Tharani
Travel China Guide, Sacred Sites, River Expedition, Geological Map.
রাবণের তো ভগবান হেব্বি পাওয়ার দিছিলো! ??