(এই লেখাটার মূল উদ্দেশ্য হল কোনো স্থানের বিকিরিত শক্তির ঘনত্ব যে কেবল মাত্র তাপমাত্রার উপর নির্ভর করে সেটা সহজে বোঝানো, আশেপাশের তাপমাত্রা স্থির থাকলে কোনো বস্তু কোনো নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় প্রতি মুহূর্তে যতটুকু বিকিরণ শোষণ করে ঠিক ততটুকু বিকিরণই ছড়িয়ে দিতে থাকে সেটা সহজে দেখানো, বিকিরণ ক্ষমতা এবং শোষণ ক্ষমতার সংজ্ঞা সম্পর্কে ধারণা দেওয়া এবং তা থেকে কার্শফের বিখ্যাত বিকিরণ সূত্র প্রমাণ করা। সবশেষে কার্শফের বিকিরণ সূত্র কী করে সৌরবর্ণালী ব্যাখ্যার মাধ্যমে আধুনিক জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের মূল দুয়ার খুলে দিল সেটা নিয়ে আলোচনা করা।)
মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে কিছু সহজ বিষয় নিয়ে আগেই ধারণা দিয়ে রাখি। ঐতিহাসিক কিছু ভ্রান্ত ধারণাও এই ফাঁকে বলে ফেলা যাবে। তাপ, তাপমাত্রা আর এর ছড়িয়ে পড়া নিয়ে মানুষের কৌতুহল অনেক প্রাচীন। ১৭৯১ সালের আগে উত্তপ্ত বস্তু থেকে তাপ কিভাবে ছড়ায় এবং শীতল বস্তু থেকেই বা কিভাবে ছড়ায় সেটা নিয়ে মানুষের স্বচ্ছ ধারণা ছিল না। ধারণা করা হত উত্তপ্ত বস্তু থেকে ‘উষ্ণ বিকিরণ’ নির্গত হয়- ফলে তার পাশে গেলে গরম লাগে, ঠাণ্ডা বস্তু থেকে ‘শীতল বিকিরণ’ নির্গত হয়- তাই তার পাশে গেলে ঠাণ্ডা লাগে। এ ব্যাপারে প্রথম সঠিক দিকনির্দেশনা দেন বিজ্ঞানী প্রিভোস্ট (Prevost)। ১৭৯১ সনে তিনি বলেন একটা বস্তু গরম বা ঠাণ্ডা যাই হোক না কেন সেটা তার চারপাশে তাপ বিকিরণ করতে থাকে- সাথে সাথে চারপাশ থেকে আসা বিকিরিত তাপ শোষণও করতে থাকে। যদি বস্তু থেকে যে পরিমাণ তাপ প্রতি মুহূর্তে বের হচ্ছে সেটার পরিমাণ চারপাশ থেকে প্রতি মুহূর্তে যে তাপ সেই বস্তু শোষণ করছে তার চেয়ে বেশি হয় তবে আমরা বুঝি যে বস্তুটি উত্তপ্ত। আর চারপাশ থেকে প্রতি মুহূর্তে শোষণ করা তাপের পরিমাণ যদি বেশি হয় তবে আমরা বুঝি যে বস্তুটি ঠাণ্ডা। বস্তুটির এই যে তাপের আদান-প্রদান তার পুরো ব্যাপারটাই নির্ভর করবে বস্তুটির তাপমাত্রার উপর। বিজ্ঞানী প্রিভোস্ট এও বলেন যে একই তাপমাত্রায় থাকা দুটি বস্তু একে অন্যের সাথে সমান সমান তাপের আদান-প্রদান করবে। তাপমাত্রা একই হলে দুটি বস্তুর মাঝে যে প্রতি মুহূর্তে সমান সমান তাপের আদান-প্রদান হবে সেটা খুব সহজ একটা কাল্পনিক পরীক্ষার মাধ্যমে বুঝে ফেলা যায়। ধরা যাক, দুটি বস্তু A ও B কে আলাদা আলাদা দুটি পাত্রে রাখা হয়েছে। পাত্র সহ বস্তু দুটিকে সমান সমান তাপমাত্রায় রাখার ব্যবস্থা করা হল। বস্তু দুটির মাঝে যেন তাপের আদান-প্রদান হয় সেই ব্যবস্থা রাখতে একটি নলের সাহায্যে পাত্র দুটিকে যুক্ত করা হল। এখন যদি বস্তু দুটি যে পাত্রে রাখা আছে তাদের ভেতর শক্তির ঘনত্ব (একক আয়তনে শক্তির পরিমাণ) ভিন্ন ভিন্ন হয় তাহলেই এক পাত্র থেকে আরেক পাত্রে তাপ প্রবাহিত হতে পারবে। তাই সঠিক বেঠিক না জেনেই আমরা ধরে নিই যে A বস্তুটির পাত্রের ভেতরকার শক্তির ঘনত্ব B এর চেয়ে বেশি। এর ফলে দেখা যাবে A থেকে কিছু পরিমাণ তাপ B তে চলে গিয়েছে তাদের মাঝের শক্তি ঘনত্বকে সমান করার জন্য- এবং দেখা যাবে A কিছুটা ঠাণ্ডা হয়েছে এবং B আগের চেয়ে কিছুটা গরম হয়ে গেছে। এখন যেহেতু দুটি বস্তুর মাঝে তাপমাত্রার পার্থক্য তৈরি হয়েছে তাই এই বস্তু দুটি দিয়ে অনায়াসে একটা তাপ-ইঞ্জিন বানিয়ে ফেলা যাবে। তাপ-ইঞ্জিন হল এমন একটা ব্যবস্থা যেখানে উচ্চ তাপমাত্রার কো্নো বস্তু থেকে কিছু তাপ নিয়ে তাকে কাজে পরিণত করা হয় এবং অকেজো অংশটুকু অন্য আরেকটি ঠাণ্ডা বস্তুতে ছেড়ে দেয়া হয়। এবার আসি আসল সমস্যায়। পাত্র সহ দুটি বস্তু একটা নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় রাখা ছিল বলে তাদেরকে সব মিলিয়ে একটামাত্র তাপমাত্রায় থাকা বস্তু চিন্তা করে নিলে কোনো ভুল হবে না। এখন শক্তি ঘনত্বের ভিন্নতা যদি সত্যি হয় তাহলে দেখা যাচ্ছে একই তাপমাত্রায় আছে এমন একটা ব্যবস্হা নিজেই নিজের ভিতর থেকে তাপ-ইঞ্জিনের মূলনীতি কাজে লাগিয়ে তাপকে কাজে পরিণত করে ফেলছে- কিন্তু তাপগতিবিদ্যার প্রথম সূত্র মতে এটা রীতিমত অসম্ভব! কারণ বাইরে থেকে তাপ না দিলে কো্নো তাপ-ইঞ্জিন চলতে পারবে না-অর্থাৎ তার ভেতর থেকে কাজ পাওয়া যাবে না। তাই আমরা যেসব ব্যাপার ধরে এই কাল্পনিক পরীক্ষা করেছি সেগুলো কোনোমতেই ঠিক না। অর্থাৎ A ও B পাত্রের মাঝে থাকা শক্তি ঘনত্বের আসলে কো্নো পার্থক্য নেই- তাদের মান সমান, এবং একই তাপমাত্রায় থাকা অবস্থায় দুটি বস্তুর মাঝে তাপের আদান-প্রদান একমুখী হবে না- বরং দুইদিক থেকেই তাপের সমান সমান আদান প্রদান হবে, তা না হলে তাদের মাঝে তাপমাত্রার পার্থক্য তৈরি হবে যেটা অসম্ভব একটা পরিস্থিতির জন্ম দিবে। (এভাবে একটা ব্যাপারে আগে থেকে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে পরে সেই সিদ্ধান্তকেই ভুল দেখানোর মাধ্যমে একটা সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর এই প্রক্রিয়ার একটা সুন্দর নাম আছে- সেটা হল Proof By Contradiction/ প্রুফ বাই কন্ট্রাডিকশন বা অসঙ্গতির মাধ্যমে প্রমাণ। জ্ঞানের অনেক শাখায় এর প্রয়োগ অনেক কঠিন ব্যাপারেও সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে সাহায্য করে।)
এখন কারো মনে হয়ত প্রশ্ন জাগতে পারে যে তাপের আদান-প্রদান না হলেও তো চলত- হওয়ার দরকার কি? বিকিরণের মূল বৈশিষ্ট্যই হল সেটা সব তাপমাত্রাতে ঘটে চলবে। বস্তুগুলো যখন আলাদাভাবে ছিল তখনও সেগুলো তাপ বিকিরণ করে চলেছিল- তাই একসাথে রাখার পরে যে সেটা বন্ধ হয়ে যাবে তার কোনো কারণ নেই। আর যেহেতু দুটি বস্তুই তাপ বিকিরণ করে চলবে তাই একটা বস্তুর করা বিকিরণ যদি অন্যটা শোষণ না করে তাহলেও কো্নো একটা বস্তু তাপ হারাতে হারাতে তাদের নিজেদের মাঝে তাপমাত্রার পার্থক্য সৃষ্টি করে ফেলবে- আর সেটাও হবে গণ্ডগোলের কারণ। সুতরাং একই তাপমাত্রায় থাকা দুটি বস্তু একে অন্যের সাথে সমান সমান তাপের আদান-প্রদান করবে। এখন আসি আরো একটা বিষয়ে। A ও B বস্তুদুটোর কথা উল্লেখ করার সময় আমরা বস্তুগুলি কেমন সে ব্যাপারে কিছুই বলিনি-অর্থাৎ সেগুলো কী দিয়ে গঠিত, কে ছোট কে বড়, কার রঙ কেমন, বস্তুগুলো চলতে পারে কিনা, কত দূরে আছে ইত্যাদি ইত্যাদি। সুতরাং এখান থেকে এটাই বলা যায় যে বস্তুগুলো যেমনই হোক না কেন যত সময় তাদের তাপমাত্রা সমান থাকবে তত সময় তারা একে অন্যের সাথে সমান সমান তাপ আদান-প্রদান করবে। অন্য ভাবে বললে- একটা বস্তুর তাপমাত্রা যদি তার চারপাশের তাপমাত্রার সমান হয় তবে সেটি প্রতি মুহূর্তে যে পরিমাণ তাপ বিকিরণ করবে, ঠিক সে পরিমাণ তাপ তার চারপাশ থেকে শোষণ করবে। আর এটাই হল বিজ্ঞানী প্রিভোস্টের তাপের আদান-প্রদানের তত্ত্ব (Prevost’s Theory of Heat Exchange) । (চিত্রে ব্যাপারটা দেখানো হল)
এখন আসি একটু ভিন্ন বিষয়ে। আমরা কম বেশি সবাই জানি, কোনো বস্তুর উপর যে কোনো রকম বিকিরণ পড়লে সেটা তিনটি অংশে ভাগ হয়ে যেতে পারে। কিছু বিকিরণ বস্তুটি শোষণ করে ফেলে, কিছুটা নিজের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হতে দেয় এবং বাকি অংশটুকু প্রতিফলিত করে। মোট বিকিরণের কতটুকু অংশ শোষিত বা প্রবাহিত বা প্রতিফলিত হবে সেটা থেকে বস্তুটির বিকিরণ সংক্রান্ত আচরণ আমাদের সামনে ফুটে ওঠে। বিকিরণের এই শোষিত বা প্রবাহিত বা প্রতিফলিত হওয়া যেমন বস্তুটি কী দিয়ে তৈরি তার উপর নির্ভর করে , ঠিক তেমনি নির্ভর করে বস্তুটির উপর কী ধরণের বিকিরণ এসে পড়ছে তার উপরও। ব্যাপারটা একটু সহজ ভাবে উদাহরণ দিয়ে বুঝাই। দৃশ্যমান আলো, তাপ, অতিবেগুণী রশ্মি, এক্সরে, রেডিও তরঙ্গ, গামা রশ্মি, মাইক্রোওয়েভ ইত্যাদি সবগুলোই বিকিরণের মাঝে পড়ে। এদের মাঝে মূল পার্থক্য হল তাদের কম্পাঙ্ক (f) ও তরঙ্গদৈর্ঘ্যে (λ)। যার কম্পাঙ্ক বেশি তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য এমন ভাবে কমে যায় যেন এই দুটি মানের গুণফল শূন্য মাধ্যমের জন্য ধ্রুবক হয়। এই গুণফল হল আসলে শূন্যমাধ্যমে তাদের বেগের মান (c)- যা সবার জন্য একই। এটাই হল ভিন্ন ভিন্ন ধরণের বিকিরণ। এখন কোনো বস্তু তার উপর এসে পড়া বিকিরণের কতটুকু শোষণ করবে কিংবা কতটুকু প্রতিফলিত করবে সেটা বিকিরণ কেমন ধরণের সেটার উপরও নির্ভর করে। কক্ষতাপমাত্রায় খালি চোখে বস্তুটিকে দেখে সেটা বলে দেয়ার কোনো উপায় নেই (একমাত্র ব্যতিক্রম হল ধাতব চকচকে তল)। যেমন সাদা রঙের পেইন্টিং খুব অল্প পরিমাণ দৃশ্যমান আলো শোষণ করে। বেশীরভাগটাই প্রতিফলিত করে। কিন্তু সেটা যদি তাপ বা অবলোহিত রশ্মি হয় তাহলে কিন্তু ব্যাপারটা এমন থাকে না- সাদা রঙের পেইন্টিংও বেশ ভালই বিকিরণ শোষণ করতে শুরু করে। তেমনি আরেকটা উদাহরণ দেয়া যায় পানির ক্ষেত্রেও। পানি দৃশ্যমান আলোকে খুব সহজেই তার মাঝ দিয়ে চলে যেতে দেয়- শোষণ খুব একটা করে না। কিন্তু সেটা যদি তাপ বা অবলোহিত রশ্মি হয় তবে সেই একই পানি অনেক বেশী পরিমাণে বিকিরণ শোষণ করে নেয়। সুতরাং, একটা বস্তু কোনো মুহূর্তে তার উপর এসে পড়া বিকিরণের সাথে কেমন আচরণ করছে সেটা বলার সময় অবশ্যই এটা বলে দিতে হবে যে সেটা কী ধরণের বিকিরণ- অর্থাৎ বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্য (বা কম্পাঙ্ক) কত সেটা বলে দিতে হবে। তাই বিকিরণের শোষিত বা প্রবাহিত বা প্রতিফলিত হওয়ার ব্যাপারগুলো নিয়ে আলোচনার সময়ে তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ব্যাপারটা মাথায় রাখতে হয়।
এই অংশে এসে আমরা বস্তুর উপর এসে পড়া বিকিরণের সাথে সম্পর্কিত দুটি রাশি নিয়ে আলোচনা করব। ১) শোষণ ক্ষমতা (Absorptive power) ও ২) বিকিরণ ক্ষমতা (Emissive power)। এই রাশি দুটির সঠিক সংজ্ঞা থেকেই মূলত কার্শফের বিকিরণ সূত্রের ভিত্তি রচিত হয়। এদের সংজ্ঞা দেয়ার আগে কো্নো বস্তু একটা নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় কোনো নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের কতটুকু বিকিরণ শোষণ করবে বা নির্গত করবে সেটা যেসব বিষয়ের উপর নির্ভর করে তা নিয়ে একটু আলোচনা করি। দুটি বস্তুর মাঝে যেটার উপরিতলের ক্ষেত্রফল বেশি সেটা বেশি পরিমাণ বিকিরণ প্রতি মুহূর্তে তার মাঝে শোষণ করতে পারবে এবং উল্টাভাবে তার থেকে প্রতি মুহূর্তে বেশি পরিমাণ বিকিরণ বেরও হতে পারবে- এর কারণ হল বিকিরণ বস্তুর উপরিতলে শোষিত হয় বা উপরিতল থেকে নির্গত হয়। বস্তু যদি সময় বেশি পায় তবে সে মোট হিসাবে বেশি বিকিরণ শোষণ বা নির্গত করতে পারবে- সময় কম পেলে মোট হিসাবে তা কম পারবে। তাই দেখা যাচ্ছে একই তাপমাত্রায় রাখা দুটি বস্তু একটা নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের মোট কতটুকু বিকিরণ শোষণ বা নির্গত করেছে সেটা থেকে আমরা তাদের মাঝে কে ভালো শোষক বা বিকিরক সেটা নিশ্চিতভাবে বলে দিতে পারছি না। কারণ বস্তু দুটি যদি একই উপাদানে গঠিত হয় তবে যে বস্তুর ক্ষেত্রফল বেশি সেটা একটা নির্দিষ্ট সময়ে বেশি বিকিরণের আদান-প্রদান করতে পারবে- আবার কম ক্ষেত্রফলের বস্তুটিকে বেশি ক্ষেত্রফলের বস্তুর চেয়ে সময় বেশি দিলে কম ক্ষেত্রফলের বস্তুও দীর্ঘ সময়ে মোট হিসাবে বেশি বিকিরণের আদান-প্রদান করতে পারবে। কিন্তু একই উপাদানে তৈরি বস্তু দুটির ব্যাপারে এরকম দুই ধরনের সিদ্ধান্ত কখনোই হতে পারে না। এই সমস্যা দূর করার জন্যই কোনো বস্তুর একক ক্ষেত্রফল থেকে একক সময়ে কতটুকু বিকিরণ শোষিত বা নির্গত হচ্ছে সেটা দিয়ে বস্তটির বিকিরণ ধর্মের ব্যাপারে আমরা সিদ্ধান্ত নিই।
যদি একটি বস্তুর একক ক্ষেত্রফলের উপর একক সময়ে একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় একটি নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিকিরণ শক্তি ΔQ এসে পড়ে এবং সেটার ΔQa পরিমাণ শোষণ হয়(absoption) , ΔQr পরিমাণ প্রতিফলন হয়(reflection) ও ΔQt পরিমাণ বস্তুর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত(transmission) হয় তাহলে
ΔQ= ΔQa + ΔQr + ΔQt
(আমাদের আলোচনার সবখানে আমরা শোষণ বা absoption কে এর প্রথম অক্ষর ‘a’ দিয়ে বোঝাব, প্রতিফলন বা reflection কে এর প্রথম অক্ষর ‘r’ দিয়ে বোঝাব, প্রবাহ বা transmission কে এর প্রথম অক্ষর ‘t’ দিয়ে বোঝাব)
এখন আমরা শোষণ ক্ষমতার (Absorptive power) সংজ্ঞায় যেতে পারি। একটি বস্তুর একক ক্ষেত্রফলের উপর একক সময়ে একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় একটি নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিকিরণ শক্তি এসে পড়লে সেটার কত অংশ শোষিত হয় সেটাই হল শোষণ ক্ষমতা (absorptive power)। অন্যভাবে বললে বস্তুর একক ক্ষেত্রফলের উপর একক সময়ে একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় একটি নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিকিরণ শক্তি যতটুকু শোষিত হয় এবং মোট যতটুকু বিকিরণ শক্তি পড়ে তার অনুপাতই হল সেই নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় সেই নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের জন্য বস্তুটির শোষণ ক্ষমতা।
এখন আমরা বিকিরণ ক্ষমতার (Emissive power) সংজ্ঞায় যেতে পারি। এর সংজ্ঞা কয়েকভাবে দেয়া যায়। (যেভাবেই সংজ্ঞায়িত করা হোকনা কেন সেটা ঘুরেফিরে একই ফলাফল দেয়। তাই চিন্তার কিছু নেই।) সবচেয়ে সহজ ভাবে বললে, কো্নো বস্তুর একক ক্ষেত্রফল থেকে একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় একক সময়ে একটি নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের যতটুকু বিকিরণ শক্তি বের হয়ে আসে তাকে সেই তাপমাত্রায় সেই তরঙ্গদৈর্ঘ্যের জন্য বস্তুটির বিকিরণ ক্ষমতা বলে। একে আমরা ‘e’ বা ‘E’ দিয়ে প্রকাশ করব।
একটু লক্ষ্য করলেই আমরা বুঝব যে শোষণ ক্ষমতা হল একটা অনুপাত, যেখানে আমাদের দেয়া সংজ্ঞা অনুযায়ী বিকিরণ ক্ষমতা হল একটা সুনির্দিষ্ট রাশি। আমরা চাইলেই একই রকমভাবে বিকিরণ ক্ষমতার সংজ্ঞা অনুপাত হিসেবে দিতে পারতাম- তখন বলতে হত- কোনো বস্তুর একক ক্ষেত্রফল থেকে একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় একক সময়ে একটি নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের যতটুকু বিকিরণ শক্তি বের হয়ে আসে এবং সর্বোচ্চ যতটুকু বিকিরণ শক্তি বের হতে পারত তাদের অনুপাতকে বিকিরণ ক্ষমতা বলে। কিন্তু এখানে একটা বিষয় আমরা জানি না- সেটা হল সর্বোচ্চ কতটুকু বিকিরণ শক্তি বের হতে পারত তার মান। তাই এমুহূর্তে আমরা এই সংজ্ঞা ব্যবহার করব না।
বিকিরণ ক্ষমতা ও শোষণ ক্ষমতার সংজ্ঞা বুঝে গেলে আমরা খুব সহজেই কার্শফের বিকিরণ সূত্র বুঝে ফেলতে পারি। এই সূত্র মূলত কোনো নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় একটা নির্দিষ্ট তরঙ্গের বিকিরণের জন্য কোনো বস্তুর বিকিরণ ক্ষমতা ও শোষণ ক্ষমতার মধ্যে কী ধরণের সম্পর্ক থাকতে পারে সেটা নির্দেশ করে।
ধরা যাক, A ও B দুটি অস্বচ্ছ সমতল প্লেট যাদের ক্ষেত্রফল এক একক। তাদের একে অন্যের সংস্পর্শ ছাড়াই খুব কাছাকাছি মুখোমুখি রাখা হয়েছে। তাদের তাপমাত্রা যদি সমান হয় তাহলে প্রিভোস্টের তাপের আদান-প্রদানের তত্ত্ব থেকে আমরা বলতে পারি A প্লেটটি B প্লেট থেকে আসা যত পরিমাণ বিকিরণ শোষণ করবে ঠিক সমপরিমাণ বিকিরণ A প্লেটটি ছেড়ে দিবে বা বিকিরিত করবে। একই ভাবে, B প্লেটটি A প্লেট থেকে আসা যত পরিমাণ বিকিরণ শোষণ করবে ঠিক সমপরিমাণ বিকিরণ B প্লেটটি ছেড়ে দিবে বা বিকিরিত করবে।
A প্লেটের বিকিরণ ক্ষমতা, শোষণ ক্ষমতা এবং প্রতিফলন ক্ষমতাকে যথাক্রমে E, A, R দিয়ে দেখাই (বড় হরফ)। B প্লেটের বিকিরণ ক্ষমতা, শোষণ ক্ষমতা এবং প্রতিফলন ক্ষমতাকে যথাক্রমে e, a, r দিয়ে দেখাই (ছোট হরফ)।
(প্লেট দুটি অস্বচ্ছ বলে তাদের প্রত্যেকের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত বিকিরণের পরিমাণ শূন্য ধরা যায়।)
সুতরাং, (2) থেকে, A+R=1 এবং a+r=1
অতএব, R=(1-A) এবং r=(1-a) ———-(3)
এখন প্লেট দুটি খুব কাছাকাছি বলে A প্লেট থেকে প্রতি মুহূর্তে যে পরিমাণ বিকিরণ বের হচ্ছে সেটা পুরোটাই B প্লেটে গিয়ে পড়ছে বলে ধরা যাবে। উল্টাভাবে B প্লেট থেকে বের হওয়া বিকিরণের বেলাতেও ব্যাপারটা সত্যি হবে।
শোষণের বেলায় একটা মজার ব্যাপার ঘটবে। একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ বিকিরণকে চিন্তা করলে কো্নো প্লেটই সেটাকে একবারে শোষণ করবে না। প্রথমে কোনো প্লেটে অন্য প্লেট থেকে যে পরিমাণ বিকিরণ এসে পড়বে তার কিছু অংশ শোষিত হয়ে বাকিটুকু দ্বিতীয়(অন্য) প্লেটের দিকে প্রতিফলিত হবে। দ্বিতীয় প্লেট সেই প্রতিফলিত বিকিরণকে (যেটা কিনা তার নিজেরই ছেড়ে দেয়া বিকিরণ ছিল) নিজের মাঝে কিছুটা শোষণ করে বাকি অংশটুকু আবার প্রথম প্লেটের দিকে প্রতিফলিত করে দিবে। এভাবে পুরো ব্যাপারটা চলতে থাকবে।
সুতরাং, সংজ্ঞা থেকে বলা যায়, A প্লেটের উপর B প্লেট থেকে প্রতি মুহূর্তে e পরিমাণ বিকিরণ এসে পড়ছে এবং তার মাঝে কিছু অংশ প্রতিফলিত হয়ে যাচ্ছে। প্রতিফলনের পরিমাণ হল eR (R হল A প্লেটের প্রতিফলন ক্ষমতা)। আবার A প্লেটটি নিজেও প্রতি মুহূর্তে নিজের ভেতর থেকে E পরিমাণে বিকিরণ শক্তি ছেড়ে দিচ্ছে। তাই কেউ বাইরে থেকে দেখলে দেখবে যে প্রতিফলন ও বিকিরণ মিলিয়ে A প্লেটটি থেকে প্রতি মুহূর্তে (eR + E) পরিমাণ শক্তি বের হচ্ছে।
একইভাবে, B প্লেটের জন্য বললে বলতে হবে, B প্লেটের উপর A প্লেট থেকে প্রতি মুহূর্তে E পরিমাণ বিকিরণ এসে পড়ছে এবং তার মাঝে কিছু অংশ প্রতিফলিত হয়ে যাচ্ছে। প্রতিফলনের পরিমাণ হল Er (r হল B প্লেটের প্রতিফলন ক্ষমতা)। আবার B প্লেটটি নিজেও প্রতি মুহূর্তে নিজের ভেতর থেকে e পরিমাণে বিকিরণ শক্তি ছেড়ে দিচ্ছে। তাই কেউ বাইরে থেকে দেখলে দেখবে যে প্রতিফলন ও বিকিরণ মিলিয়ে B প্লেটটি থেকে প্রতি মুহূর্তে (Er + e) পরিমাণ শক্তি বের হচ্ছে।
এখন যেহেতু প্লেট দুটি একই তাপমাত্রায় রাখা তাই প্রিভোস্টের তাপের আদান-প্রদানের তত্ত্ব থেকে সহজেই বলতে পারি যে দুটি প্লেটের জন্য এই মান দুটি একই হবে অর্থাৎ বিকিরণের আদান-প্রদানের মান সমান হবে।
সুতরাং, eR + E = Er + e ————-(4)
(3) থেকে R ও r এর মান (4) এ বসালে
e(1-A) + E = E(1-a) + e
বা, e-eA+E = E-Ea+e
বা, Ea=eA
সুতরাং, দেখা যাচ্ছে প্লেট দুটির বিকিরণ ক্ষমতা এবং শোষণ ক্ষমতার অনুপাত সমান। লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে যে প্লেট দুটি কেমন বা তারা কো্নো উপাদান দিয়ে গঠিত এসব ব্যাপারে আমরা কিছু না বলেই আমাদের হিসাব শুরু করেছিলাম। এখান থেকেই বলতে পারি, যেকোনো বস্তুর ক্ষেত্রে বিকিরণ ক্ষমতা এবং শোষণ ক্ষমতার অনুপাতের মান নির্দিষ্ট এবং সব বস্তুর ক্ষেত্রেই এই অনুপাতের মান সমান।
এখান থেকে দেখা যাচ্ছে, যে জিনিসের বিকিরণ ক্ষমতা বেশি তার শোষণ ক্ষমতাও বেশি হবে- কেননা তাদের অনুপাতের মান সব সময় একটা ধ্রুব সংখ্যা হতে হবে। তাই বলা হয় একটি ভাল বিকিরক অবশ্যই একটি ভালো বিকিরণ-শোষক (A good emitter is also a good absorber)।
কার্শফের সূত্রের এই ধ্রুবকের মান কত সেটা বের করতে গিয়ে বিজ্ঞানী কার্শফ কয়েকটি জিনিসের সংজ্ঞা স্থির করেন। কো্নো বস্তুর বেলায়- a+r+t=1
যদি কোনো বস্তু তার উপর এসে পড়া সবটুকু বিকিরণ শোষণ করে ফেলে, একটুও প্রতিফলন বা প্রবাহ হতে না দেয় তবে r=0, t=0 । সেক্ষেত্রে, a=1 ।
এ রকম বস্তুকেই কৃষ্ণবস্তু বা Black Body বলে। কৃষ্ণবস্তুর শোষণ ক্ষমতার মান 1 । কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ ক্ষমতাকে Eb দিয়ে প্রকাশ করলে এবং তার উপর কার্শফের বিকিরণ সূত্র প্রয়োগ করলে আমরা পাব-
সুতরাং, দেখা যাচ্ছে কার্শফের সূত্রের ধ্রুবকটির মান আর কিছু নয়- সেটা হল কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ ক্ষমতা। সুতরাং কার্শফের সূত্রের মূল কথাটা এভাবে বলা হয়-
‘একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় একটি নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিকিরণের জন্য যেকো্নো বস্তুর বিকিরণ ক্ষমতা ও শোষণ ক্ষমতার অনুপাত একটা ধ্রুবক এবং সেই ধ্রুবকের মান সেই তাপমাত্রায় সেই তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিকিরণের জন্য একটি কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ ক্ষমতার সমান’
তখন শোষণ ক্ষমতাকে শোষণ-গুণাংক (Absorptivity) নামেও ডাকা হয়। এখান থেকে বলা যায় যেকোনো বস্তুর ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিকিরণের জন্য তার বিকিরণ-গুণাংক ও শোষণ-গুণাংকের মান সমান। এই ব্যাপারটার গুরুত্ব সর্বপ্রথম বিজ্ঞানী কার্শফ অনুধাবন করেন এবং এটাকে কাজে লাগিয়ে তিনি সূর্যের বর্ণালীর সঠিক ব্যাখ্যা দেন যা পরবর্তীতে আধুনিক জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞান (Astrophysics) ও বর্ণালীমিতির (Spectroscopy) সূচনা ঘটায়।
তার আগে আমরা কিছু ইতিহাস জেনে নিই। ফলে এটার গুরুত্ব সহজেই বোঝা যাবে —
সাদা আলো যে সাতটি বর্ণ দিয়ে তৈরি এ ব্যাপারে সঠিক পথটি বিজ্ঞানী নিউটন আমাদের অনেক আগেই দেখিয়ে গেছেন (১৬৬৬ সালে)। তিনি কাঁচের তৈরি প্রিজমের ভেতর দিয়ে সাদা আলোকে ফেলে সেটাকে সাতটি পাশাপাশি রঙে ভাগ করে দেখান। এভাবে কো্নো রংয়ের আলোকে প্রিজমের ভেতর দিয়ে নিয়ে তাকে তার গঠনকারী রঙে ভাগ করে দেখালে সেই রংগুলির যে সুন্দর সজ্জা তৈরি হয় তাকে মূল রংটির বর্ণালী (Spectrum) বলে। যদি সাতটি রংয়ের বর্ণালী হয় এবং তাদের মাঝে কোনো ফাঁকা না থাকে তবে তাকে নিরবচ্ছিন্ন বর্ণালী (Continuous Spectrum/Continuum Spectrum ) বলে।
নিউটনের আমল থেকে মানুষ জানত যে সূর্যের বর্ণালী হল নিরবচ্ছিন্ন বর্ণালী। ঠিক তেমনি অনেক উচ্চতাপমাত্রার বস্তু থেকেও নিরবচ্ছিন্ন বর্ণালী পাওয়া যায়। কিন্তু এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা বড় একটা ধাক্কা খায় ১৮০২ সালে এসে। উইলিয়াম হাইড ওলাস্টন নামের একজন ইংরেজ রসায়নবিদ সূর্যের বর্ণালী আরো ভাল ভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখতে পান যে সেটা পুরোপুরি নিরবচ্ছিন্ন না- বরং তার মাঝে বেশকিছু কালো দাগ/রেখা দেখা যায়। ১৮১৪ সালে বিজ্ঞানী ফ্রাউনহফার (লেন্স প্রস্তুত করা ছিল তাঁর পেশা) পুনরায় সূর্যের বর্ণালীর এই কালো রেখাগুলো স্বতন্ত্রভাবে আবিষ্কার করেন এবং সঠিক পদ্ধতিতে সেই বর্ণালীর বিভিন্ন অংশের তরঙ্গদৈর্ঘ্য মাপতে শুরু করেন। এজন্যই এই রেখাগুলো ফ্রাউনহফারের রেখা (Fraunhofer lines) নামে পরিচিতি পায়।
তিনি সব মিলিয়ে ৫৭৪ টার মত এ ধরনের রেখা খুঁজে বের করেন (আধুনিক পর্যবেক্ষণে এই সংখ্যা বেশ কয়েক হাজার)। প্রধান রেখাগুলোকে তিনি A, B, C, D করে K পর্যন্ত নাম দেন। কিন্তু এর ব্যাখ্যা তখনো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এর প্রায় ৪৫ বছর পর এ ব্যাপারে সঠিক ব্যাখ্যা দেন বিজ্ঞানী কার্শফ। ১৮৫১ সালে বিজ্ঞানী কার্শফ ও বিজ্ঞানী বুনসেন (যিনি বুনসেন-বার্নার তৈরির জন্য বিখ্যাত) একসাথে কাজ শুরু করেন। তাঁদের কাজের বিষয় ছিল বিভিন্ন পদার্থকে বুনসেন-বার্নারে গরম করে যে বিভিন্ন রকম/রঙের শিখা তৈরি হয় তা প্রিজমের ভেতর দিয়ে নিয়ে গিয়ে বর্ণালী তৈরি করে সেগুলো পর্যবেক্ষণ করা। এই কাজ করতে গিয়ে কার্শফ লক্ষ্য করেন যে কিছু কিছু পদার্থ থেকে তৈরি হওয়া বর্ণালীর উজ্জ্বল দাগ/রঙ ঠিক সেসব জায়গায় দেখা যায় ঠিক যেসব জায়গায় সূর্যের বর্ণালীর কালো রেখাগুলো আছে। দেখে মনে হয় একটার বর্ণালী অন্যটার পরিপূরক। তিনি বিভিন্ন বস্তুকে বুনসেন-বার্নারে গরম করে যে আলো পাচ্ছিলেন তার সাথে সূর্যের আলোকে একত্র করে বর্ণালী তৈরি করে দেখতে পান যে এই যৌথ বর্ণালী সত্যিকারের নিরবচ্ছিন্ন বর্ণালী তৈরি করছে। এখান থেকে তিনি একটা সিদ্ধান্তেই পৌঁছান আর সেটা হল সূর্যের মত নক্ষত্রগুলো আসলে আমাদের পরিচিত বিভিন্ন পদার্থ দিয়েই গঠিত। এর ব্যাখ্যা তিনি দেন তাঁর বিকিরণ সূত্রের সাহায্যে। বিকিরণ সূত্র থেকে দেখা যায় যে কো্নো নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় কোনো নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিকিরণের জন্য পদার্থের বিকিরণ-গুণাংক ও শোষণ-গুণাংকের মান সমান (Єλ = aλ)। তাই উত্তপ্ত বস্তু যে পরিমাণ নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিকিরণ প্রতি একক ক্ষেত্রফলে প্রতি মুহূর্তে ছড়ায়, ঠাণ্ডা অবস্থায় সে একই পরিমাণ নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিকিরণ প্রতি একক ক্ষেত্রফলে প্রতি মুহূর্তে শোষণ করে। এটাই ছিল সূর্যের বর্ণালীর জন্য কার্শফের যুগান্তকারী ব্যাখ্যার মূল অংশ।
আরো বিস্তৃতভাবে তিনি বলেন যে সূর্যের কেন্দ্রের তাপমাত্রা অনেক বেশি- এই উচ্চ তাপমাত্রার কেন্দ্র থেকে যে বিকিরণ বের হয় সেটা নিরবচ্ছিন্ন বিকিরণ(যার মাঝে সব তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিকিরণ আছে)। এই কেন্দ্রের ঠিক উপরের অংশে আছে অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা একটা গ্যাসের আবরণ (এই অংশটিও গরম- তবে কেন্দ্রের চেয়ে কম)। কেন্দ্র থেকে বের হয়ে আসা নিরবচ্ছিন্ন বিকিরণ যখন তার উপরের গ্যাসের এই অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা অংশের ভেতর দিয়ে বাইরে বের হয়ে আসে তখন তার কিছু কিছু নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিকিরণ গ্যাসের মাঝে শোষিত হয়ে যায়। ঠিক কোন্ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিকিরণ গ্যাসের মাঝে শোষিত হবে সেটা নির্ভর করে গ্যাসের এই আবরণ কী কী পদার্থের সমন্বয়ে তৈরি তার উপর। গ্যাসের একেক উপাদান নিরবচ্ছিন্ন বিকিরণের একেক অংশকে শোষণ করে। কার্শফ ও বুনসেন তাদের শিখা-পরীক্ষায় বিভিন্ন পদার্থের জন্য যে বর্ণালী পান সেগুলোর সাথে সূর্যের বর্ণালীকে মিলিয়ে সূর্য কী কী পদার্থ দিয়ে তৈরি তা বলতে সক্ষম হন। তাঁরা সূর্যের মাঝে থাকা ১৬টির মত পদার্থকে সনাক্ত করতে সক্ষম হন যেগুলোর মাঝে উল্লেখ্যযোগ্য হল হাইড্রোজেন ও সোডিয়াম। আরো ভালো ভাবে বুঝতে চিত্রগুলো লক্ষ্য করি-
দেখা যাচ্ছে উত্তপ্ত বস্তু উত্তপ্ত অবস্থায় যেসব তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বর্ণালী উৎপন্ন করে (Emission Spectrum) শীতল অবস্থায় তারা অন্য কো্নো গরম বস্তু থেকে আসা বিকিরণের ভেতর থেকে ঠিক সেসব তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিকিরণ শোষণ করে ফেলে (Absorption Spectrum)- আর এর মূল ব্যাখ্যাটা কার্শফের বিকিরণ সূত্র দিয়ে সহজেই বোঝা যায়।
তাই মহাকাশের যেকোনো নক্ষত্র থেকে আসা আলো দিয়ে বর্ণালী তৈরি করে সেটার সাথে আমাদের পরিচিত পদার্থগুলোর বর্ণালী মিলালে আমরা পৃথিবীতে বসেই বলে দিতে পারি যে সেই নক্ষত্র কী কী উপাদানে তৈরি। এভাবে করেই কার্শফের সূত্র আধুনিক জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞানের দুয়ার খুলে দেয়। শুধু তাই নয়- বর্ণালী পর্যবেক্ষণ করে আমরা কোনো পদার্থ একেবারেই নতুন কিনা সেটাও যাচাই করতে পারি। প্রতিটি পদার্থের বর্ণালীই স্বতন্ত্র, অর্থাৎ কারো সাথে কারো মিলে না। তাই কোনো পদার্থের বর্ণালী যদি একেবারে আনকোরা নতুন হয় তাহলে বলা হয় একটা নতুন পদার্থ খুঁজে পাওয়া গেছে। এভাবে প্রায় ৪০টির মত নতুন মৌল খুঁজে পাওয়া গেছে এবং পর্যায়-সারণিতে স্থান দেয়া হয়েছে!
——————————————————————————————————————
– দীপায়ন তূর্য
(আরো সহজে বর্ণনা করার কোনো উপায় জানা থাকলে নিঃসঙ্কোচে জানানোর অনুরোধ রইলো।)
পরিশিষ্টঃ
এ বিষয়ে আরো কিছু পড়তে চাইলে-
১) www.applet-magic.com/kirchhofflaw.htm
২) https://en.wikipedia.org/wiki/Kirchhoff%27s_law_of_thermal_radiation
৩) https://www.aip.org/history/exhibits/cosmology/tools/tools-spectroscopy.htm
৪) http://www.rsc.org/chemistryworld/2013/09/kirchhoff-spectroscopy-fraunhofer-lines-solar-spectrum
৫) https://en.wikipedia.org/w/index.php?title=Astrophysics&oldid=726536276
৬) https://en.wikipedia.org/wiki/Fraunhofer_lines
৭) https://en.wikipedia.org/wiki/Emissivity