আপনি যদি কোনো পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে থাকেন, তাহলে নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন সেখানে ওপরের দিকে সমতলের তুলনায় ঠাণ্ডা। আবার যদি প্লেনে চড়ে থাকেন, দেখবেন যে ওরাএরকম কিছু বলছে, “আমরা এখন ৪০ হাজার ফুট উচ্চতায় এবং বাইরের তাপমাত্রা মাইনাস ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস”। বড় বড় পর্বতের ছবিতে তো চূড়ায় সাদা বরফই দেখি। এর মানে হলো উচ্চতার সাথে সাথে বাতাসের তাপমাত্রা কমে। কিন্তু কেন? প্লেনের ব্যাপারটা ধরুন – আমরা না তখন ভূপৃষ্ঠের চেয়ে ৪০ হাজার ফুট সূর্যের কাছাকাছি আছি? পৃথিবী পৃষ্ঠের গরম বাতাস না ওপরে ওঠে? তারপরেও উচ্চতার সাথে সাথে তাপমাত্রা কমে কেন?
আচ্ছা, এই বিষয়টার ব্যাখ্যার আগে প্রতিদিনকার একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমরা এরোসল ক্যান (ডিওড্রেন্ট বা পারফিউম) থেকে যখন স্প্রে করি, খেয়াল করেছেন যে স্প্রে-টা ঠাণ্ডা লাগে?
ক্যান এর মধ্যে বাতাস ঠাণ্ডা, তা কিন্তু নয়। ক্যান যেহেতু রুমের তাপমাত্রায় আছে, এর মধ্যের বাতাসের তাপমাত্রাও রুমের তাপমাত্রাতেই থাকে। স্প্রে ঠাণ্ডা লাগে কারণ ক্যান এর মধ্যে বেশি চাপে থাকা গ্যাস বাইরের তুলনামূলক কম চাপের পরিবেশে আসে। এর মানে গ্যাস সম্প্রসারিত হয়। ফলে গ্যাসের যে তাপ শক্তি ছিলো, তা অপেক্ষাকৃত বড় জায়গায় ছড়িয়ে যায়। এটাকে জুল-থমসন প্রভাব বলে, যা জেমস জুল আর উইলিয়াম থমসন প্রথমবার ব্যাখ্যা করেছিলেন। আর তাপগতিবিদ্যার গ্যাসের সূত্র (যা বলে যে কম চাপে নির্দিষ্ট পরিমাণের গ্যাস আয়তনে বাড়ে এবং এতে ঐ গ্যাসের তাপমাত্রা কমে – সেই সূত্রটাকে) ঠিক রাখতে গ্যাসের একটাই উপায় থাকে, তাপমাত্রা কমে যাওয়া। এক্ষেত্রে ক্যান এর বাতাস বাইরে আসে, কিন্তু বাইরে থেকে কোনো তাপ দেয়া হয় না বা নেয়াও হয় না। তাপের এই আদান-প্রদান বিহীন প্রক্রিয়ার একটা বৈজ্ঞানিক গালভরা নাম আছে, সেটা হলো ‘Adiabatic Process’।
এবার আমরা বায়ুমণ্ডলে ফিরে আসি। ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি বাতাসের চাপ বেশি থাকে। কারণ, এখানে চাপ প্রয়োগকারী বায়ুমন্ডলের স্তর বেশি। যত উচ্চতায় উঠবো, সেখান থেকে ওপরের বায়ুর স্তর কমতে থাকবে, তাই চাপও কমে যাবে। সহজ ভাষায় – উচ্চতার সাথে সাথে বায়ুমণ্ডলের চাপ কমে যায়।
খুব সহজে বোঝার জন্য বায়ুমণ্ডলের বাকি সব জটিল প্রক্রিয়া বাদ দিয়ে দেই। এখন ধরে নিন, একটা কাল্পনিক বাতাসের পার্সেল(বাতাসের কাল্পনিক বেলুনের মত) ভূপৃষ্ঠ থেকে উপরে উঠছে। তখন ওই নির্দিষ্ট পার্সেলটি বায়ুমণ্ডলের চাপ কমে যাবার জন্য সম্প্রসারিত হবে বা ছড়িয়ে যাবে। আর ওই এরোসল স্প্রে-এর কায়দায় এর তাপমাত্রা কমে যাবে। পার্সেলটি যত উপরে উঠবে তাপমাত্রা তত কমতে থাকবে। তাপগতিবিদ্যার ব্যাখ্যায় বলতে গেলে, পার্সেল যত সম্প্রসারিত হচ্ছে, এটা চারিদিকের বাতাসকে ঠেলছে, তারমানে তাপগতিবিদ্যার কাজ(work) করছে। লক্ষ্য করুন – এখানে কিন্তু বাইরে থেকে কোনো তাপ দেয়া হচ্ছে না। তাই, যেহেতু পার্সেল কাজ করছে, কিন্তু কোনো তাপ পাচ্ছে না , এটা আভ্যন্তরীণ শক্তি (internal energy) হারাচ্ছে। ফলে তাপমাত্রা কমে যাচ্ছে। সোজা ভাষায়, পার্সেল এর তাপমাত্রা কমছে শুধু চাপ কমার ফলে আয়তন বাড়ার জন্য। আবার মনে করিয়ে দিচ্ছি, উচ্চতা বাড়ছে, বায়ুমণ্ডলের চাপ কমছে, তাই আয়তন বাড়ছে; আর ফলশ্রুতিতে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা কমছে। আর তাপ আদান-প্রদান বিহীন এই তাপমাত্রা কমাটা হচ্ছে সম্পূর্ণ ভাবে ‘Adiabatic Process’-এ। তাপমাত্রা কমার এই হারকে বলে ‘Adiabatic Lapse Rate’.
ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি হতে শুরু করে বায়ুমণ্ডলের একদম ওপরের স্তর পর্যন্ত তাপমাত্রা কমার হা্র কিন্তু এক নয়। নিচের গ্রাফে উচ্চতার সাথে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রার আচরণ দেখানো হয়েছে।
গ্রাফটাতে লক্ষ্য করে দেখুন – ভূপৃষ্ঠ থেকে মোটামুটি ৬০০ মিটার পর্যন্ত তাপমাত্রা একটু দ্রুত হারে কমেছে। এই হার মোটামুটি ৯.৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস/কিলোমিটার। এই পর্যন্ত বাতাস শুকনো থাকে। আর তাই, এই তাপমাত্রা কমার হারকে বলে “Dry Adiabatic Lapse Rate”. আবহাওয়া বিজ্ঞানীদের ভাষায় এটা হলো বাতাস শিশির বিন্দু (dew point) তে পৌঁছানোর আগের তাপমাত্রা কমার হার।
কিন্তু দেখুন, ৬০০০ মিটার থেকে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার শুরু হবার আগ পর্যন্ত গ্রাফটা বেশ খাড়াভাবে উঠছে। মানে, তাপমাত্রা কমার হার ধীর হয়ে গেছে। এর মান মোটামুটিভাবে ৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস/কিলোমিটার।এটা ইঙ্গিত দেয় যে কোনোভাবে তাপের সাপ্লাই হচ্ছে এই অংশটুকুতে। কিন্ত কথা হচ্ছে – কোথা থেকে আসছে এই তাপ?
সহজভাবে বলি। Dry Adiabatic Lapse Rate এ বাতাসের তাপমাত্রা কমতে কমতে এমন একটা অবস্থায় পৌঁছাবে (dew point) যখন এর আপেক্ষিক আর্দ্রতা ১০০% হবে। এখানেই বাতাসে জলবিন্দু তৈরি বা ঘনীভবন (condensation) শুরু হবে। অর্থাৎ, এখানে এসে মেঘ তৈরি শুরু হবে। যে তাপটা নিয়ে পানি বাষ্প হয়েছিলো (latent heat), সেটা বের করে দিয়ে বাষ্প পানির কণায় ঘনীভূত হতে শুরু করবে। আর এই বাড়তি তাপটা (latent heat) বাতাসের তাপমাত্রা কমার হারকে( ৯.৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস/কিলোমিটার) কমিয়ে দিবে। মানে, আগের চেয়ে কম হারে তাপমাত্রা কমবে। এই তাপমাত্রা কমার হারকেই বলে ‘Moist Adiabatic Lapse Rate’.
তো এতক্ষণে বুঝলাম ‘Adiabetic Lapse Rate’ দুই কিসিমের – ‘Dry Adaiabatic Lapse Rate’ এবং ‘Moist Adiabetic Lapse Rate। প্রথমটা হলো মেঘ তৈরি হবার আগের তাপমাত্রা কমার হার আর দ্বিতীয়টা হলো মেঘের মধ্যে তাপমাত্রা কমার হার। গ্রাফে স্ট্রাটোস্ফিয়ারে ওযোন(Ozone)-এর উপস্থিতির জন্য ওই অংশে বায়ুমণ্ডল উষ্ণ হওয়া দেখাচ্ছে।
এখন কথা হলো – এই Lapse Rate এর বাস্তব ব্যবহারটা কী?
প্রথম প্রয়োগটা হলো বায়ুমণ্ডলের কোনো স্তরের Lapse Rate জানা থাকলে ওই স্তরের যে কোনো উচ্চতার তাপমাত্রা সহজেই গাণিতিকভাবে হিসেব করে বের করা যায়। একইভাবে, তাপমাত্রা জানা থাকলে উচ্চতা নির্ণয় করা যায়।
অন্য আরেকটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োগ হলো বায়ুমণ্ডলের স্থিতিশীলতা নির্ণয় করা। শুধু এটুকু জেনে রাখি, বায়ুমণ্ডল স্থিতিশীল মানে ভাল আবহাওয়া। আর অস্থিতিশীল মানে বৃষ্টি বাদল, খারাপ আবহাওয়া।
Lapse Rate দিয়ে কোনো উচ্চতার তাপমাত্রা তো মাপলাম। ধরন, একটি পাহাড়ের চূড়ায় তাপমাত্রা পেলাম ১০ ডিগ্রী সেলসিয়াস। এখন একটা গরম বাতাসের পার্সেল ভূপৃষ্ঠে ৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় আছে। এটা চারপাশের তাপমাত্রা থেকে গরম বলে উপরে উঠতে থাকবে। আর ওঠার সাথে সাথে Lapse Rate অনুযায়ী ঠাণ্ডা হতে থাকবে। এখন যদি পার্সেলটি ওই পাহাড় চূড়ায় উঠতে উঠতে ১৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় আসে, তাহলে সেটা কিন্তু এখনো পারিপার্শ্বিক তাপমাত্রা (১০ ডিগ্রী সে.) এর তুলনায় গরম থাকবে; তাই পার্সেলটি আরো উচ্চতায় উঠতে থাকবে। এরকম অবস্থায় বাতাসকে বলা হবে অস্থিতিশীল। আর যদি কোনো উচ্চতায় পার্সেলটির তাপমাত্রা পারিপার্শ্বিক তাপমাত্রার তুলনায় কম হয়, তবে বাতাসকে বলা হবে স্থিতিশীল।
এই লেখাটা পড়ে আবার সবাই ভাববেন না যে বায়ুমণ্ডলের প্রক্রিয়াগুলো এত সহজ সরল। ওখানে জটিল এবং কুটিল সব কারবার চলছে। আমাদের বোঝার সুবিধার জন্য এখানে সরলীকরণ করা হলো।
বেশ সুন্দরভাবে বোঝানো হয়েছে ৷