মহাশূন্যে প্রায় ২০ বছরের দীর্ঘ পরিভ্রমণের পর অবসর জীবন হাতছানি দিচ্ছে মহাকাশযান ক্যাসিনিকে। সৌরজগতের দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্রহ শনির প্রেমে উদ্ভ্রান্ত প্রেমিকের মতো ১৩ বছর ছুটে বেড়িয়েছে ক্যাসিনি। পৃথিবী থেকে যাত্রা শুরু করে শনির কাছে পৌঁছাতে সময় লেগেছিলো ৭ বছর। শেষ বারের মতো শনির চাঁদ টাইটানকে খুব কাছ থেকে প্রদক্ষিণ করে ক্যাসিনি অবশেষে ডুব দিবে শনির বরফাবৃত বলয়ের গভীরে। এটাই হতে যাচ্ছে তার শেষ মিশন। প্রেমের চূড়ান্ত পরিণতি।
পৃথিবী বংশোদ্ভূত ক্যাসিনির শনি অভিমুখে পথচলা শুরু হয়েছিলো ১৯৯৭ সালের ১৫ অক্টোবরে। ফ্লোরিডার কেপ ক্যানাভেরাল এয়ার ফোর্স স্টেশন থেকে ক্যাসিনির যাত্রী হিসেবে ছিলো ইএসএ হইগেনস (Huygens), মনুষ্যসৃষ্ট প্রোব যা প্রথম সৌরজগতের অন্য কোথাও অবতরণ করে। মূলত, এই মিশনটি ছিলো নাসা, ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি, এবং ইটালিয়ান স্পেস এজেন্সির একটি যৌথ অপারেশন। ২০০৪ সালে হইগেনস-ক্যাসিনির বিচ্ছেদ ঘটে, হইগেনস ২০০৫ এর দিকে নেমে যায় টাইটানের মাটিতে, তার উপর অর্পিত দায়িত্ব সম্পাদনের কাজে। ক্যাসিনির মূল অভিযানের নির্ধারিত সময়কাল ছিলো ২০০৪ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত। পরে ক্যাসিনি ইকুইনক্স মিশন শিরোনামে একে ২০১০ পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। আর ২০১৭ পর্যন্ত দ্বিতীয় এবং শেষবারের মতো ক্যাসিনি সলস্টিস মিশন হিসেবে বর্ধিত হয়ে এখন ক্যাসিনি তার শেষ অভিযান পরিচালনা করতে যাচ্ছে।
২০০৪ থেকে ২০০৮ সাল অবধি শনির চারপাশে প্রায় ৭৫ বার এবং টাইটানের কক্ষপথে প্রায় চারডজন পাক খেতে খেতে ক্যাসিনি এর প্রাথমিক এবং মূল কম্ম সারা করে। সে সময়ে তার প্রধান উপলক্ষ্য ছিলো শনি এবং তার বাচ্চাকাচ্চারা (উপগ্রহ), এর বলয়ের গঠন, এবং ম্যাগনেটোস্ফিয়ারকে কেন্দ্র করে। ইকুইনক্স মিশন চলাকালীন সময়ে শনির বরফাবৃত গ্রহ এনসেলাডাসে প্রথমবারের মতো সক্রিয় ক্রায়ো-ভলকানিজম পরিলক্ষিত হয়। ক্রায়ো-ভলকানো (Cryo-volcano) হলো বিশেষ ধরনের আগ্নেয়গিরি যা মূলত বরফাবৃত এবং লাভা হিসেবে পানি, তরল অ্যামোনিয়া অথবা মিথেন নির্গত হয়। আগুন ছাড়া ক্যামনে আগ্নেয়গিরি হয় আমি জানি না। সূর্য উত্তর গোলার্ধের একেবারে সর্বোচ্চ বিন্দুতে পৌঁছানো পর্যন্ত ক্যাসিনির বর্তমান মিশন সলিস্টিস চলমান থাকবে। ২০১৭ সালের মে মাসে সূর্য পৌঁছে যাবে সেই বিন্দুতে। সলিস্টিস মিশনে ক্যাসিনি শনির ঋতু পরিবর্তন নিয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে পাঠিয়ে দিবে পৃথিবীর বুকে বসে থাকা মানবজাতির কাছে। সেপ্টেম্বরের দিকে এই মিশনের এবং ক্যাসিনির সম্পূর্ণ জীবনকালের পরিসমাপ্তি ঘটবে, ক্যাসিনি ডুবে যাবে শনির গভীরে।
শেষ অভিযানে ক্যাসিনি এমন কিছু তথ্য সংগ্রহের কাজ চালাবে যা গোটা অভিযানের পূর্ববর্তী সময়ে সম্ভব ছিলো না। এর মধ্যে থাকছে:
- পুরো গ্রহের চৌম্বকক্ষেত্রের এবং অভিকর্ষীয় মানচিত্র তৈরি। অভিকর্ষীয় মানচিত্র গ্রহের বিভিন্ন স্থানে অভিকর্ষের তারতম্য নির্দেশ করে। এটি দ্বারা শনির অাভ্যন্তরীন গঠন এবং বৃহস্পতি সুপ্রসন্ন থাকলে (বোঝো, শনিকেও বৃহস্পতি আর মঙ্গলের দশা দেখে চলতে হয়) শনির তূলনামূলক দ্রুত ঘূর্ণনগতির কারণ সম্পর্কিত ধারণা পাওয়া যাবে।
- ক্যাসিনি শনির বলয়ের মধ্যে যে সাঁতার দিতে যাচ্ছে তার মাধ্যমে বলয়ে মোট উপাদানের পরিমাণ এবং তাদের মূল উৎপত্তিস্থল সম্পর্কে তথ্য অর্জিত হবে।
- শনির বলয় মূলত অগনিত ছোট ছোট বরফখন্ডের সমুদ্র। এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বরফখন্ড গুলোকে শনির অভিকর্ষ বল মাঝে মাঝে বায়ুমন্ডলে টেনে নিয়ে যায়। ক্যাসিনির সংগৃহীত তথ্য এই পুরো ব্যাপারটার একটা স্পষ্ট ধারণা দেবার চেষ্টা করবে।
- আর থাকবে শনি, এর বলয়, আর গ্যাসীয় মেঘের একেবারে কাছ থেকে তোলা বেশ কিছু ছবি।
১৩ বছরের এই অভিযাত্রায় ক্যাসিনি আমাদের বহু মূল্যবান তথ্য-উপাত্ত দিয়ে গেছে শনি আর তার পরিবার সম্পর্কে। ধীরে ধীরে ফুরিয়ে গেছে এর জ্বালানী। নাসার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ক্যাসিনির মিশন শেষে একে শনির বায়ুমন্ডলে নিয়ে ধ্বংস করে ফেলা হবে। এই করুণ পরিণতির বিকল্প হিসেবে ভাবা হয়েছিলো টাইটানের কক্ষপথে ফ্লাই-বাই করিয়ে ক্যাসিনিকে দূরের কুইপার বেল্টে পাঠিয়ে দেয়া। কিন্তু জ্বালানী ফুরিয়ে আসা, যৌবনের শেষ প্রান্তে থাকা মহাকাশযানের জন্যে এটা একটু বেশিই হয়ে যায়। এমনটাও ভাবা হয়েছিলো কোনোভাবে একে বৃহস্পতির কক্ষপথে ঢুকিয়ে দেয়া যায় কিনা। তবে তাতে আখেরে কোনো লাভ হয়তো হতো না। কারণ, বৃহস্পতির কক্ষপথে পৌঁছুতে পৌঁছুতে তার কার্যকারীতা কতটুক অবশিষ্ট থাকে তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তাই অন্য কোনো গ্রহাণু, কিংবা শনির চাঁদের সাথে সংঘর্ষ ঘটানোর চেয়ে শনিতেই তার মিশে যাওয়া ভালো মনে করেছেন নাসার বিজ্ঞানীরা। তাতে ভবিষ্যৎ কোনো মিশনে ক্যাসিনির ধ্বংসাবশেষ অনাকাঙ্খিত সমস্যার সৃষ্টি করতে পারবে না। এপ্রিলের ২২ তারিখ ক্যাসিনি টাইটানকে শেষ বারের মতো ফ্লাইবাই করবে। টাইটানের অভিকর্ষ বল কাজে লাগিয়ে সে পৌঁছে যাবে শনির বলয়ের একেবারে ভেতরকার দিকে। এখন পর্যন্ত ক্যাসিনি শুধু বলয়ের বাইরের দিকে থেকেই শনিকে প্রদক্ষিণ করে গেছে। শেষ কটা দিনে তার সৌভাগ্য (নাকি দুর্ভাগ্য!) হবে শনির খুব কাছাকাছি যাবার। এ যেনো শেকসপিয়ারের কোনো ট্র্যাজেডি! সৌরজগতের সবচেয়ে রূপসী গ্রহ, শনির অত্যুজ্জল বুকের গভীরে চিরনিদ্রায় শায়িত হয়ে যাবে পৃথিবীর সন্তান, অজানা অন্ধকার মহাশূণ্যের প্রতি ছোট্ট এক গ্রহের তুচ্ছাতিতুচ্ছ এক প্রজাতির অপরিসীম ভালোবাসার নিদর্শন, ক্যাসিনি।
এক নজরে ক্যাসিনির সম্পূর্ণ জীবনকাল দেখতে চাইলে ঘুরে আসতে পারেন নাসার এই টাইমলাইন থেকে: https://saturn.jpl.nasa.gov/the-journey/timeline/
দেখুন ক্যাসিনির শেষ অভিযাত্রা নিয়ে নাসার জেট প্রপালশান ল্যাবের বানানো ভিডিও।
তথ্যসূত্র:
- https://saturn.jpl.nasa.gov/mission/grand-finale/overview/
- http://sci.esa.int/cassini-huygens/33415-summary/‘
- https://en.wikipedia.org/wiki/Timeline_of_Cassini%E2%80%93Huygens
- https://www.quora.com/Why-is-the-Cassini-mission-ending-in-2017
- https://www.nasa.gov/mission_pages/grail/multimedia/zuber4.html
- https://en.wikipedia.org/wiki/Cryovolcano